নেপালে বঙ্গনারী/নেপালের প্রাকৃতিক বিবরণ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় পর্য্যায়

নেপালের প্রাকৃতিক বিবরণ।

 নেপাল হিমাচলের ক্রোড়স্থ পার্ব্বত্য রাজ্য—ইহা হিমাচলের মধ্যভাগে অবস্থিত। নেপাল রাজ্য দৈর্ঘ্যে ৫০০ মাইল প্রস্থে কোন স্থানেই ১৪০ মাইলের অধিক নয়,—গড়ে ১০০ মাইল মাত্র।

 সীমা।—ইহার উত্তরে তিব্বত, দক্ষিণে হিন্দুস্থান, পূর্ব্বে সিকিম, পশ্চিমে কুমায়ুন ও রোহিলা প্রদেশ। পূর্ব্বে নেপাল রাজ্য পশ্চিম সীমায় শতদ্রু নদী পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কিন্তু ১৮১৬ খৃষ্টাব্দ হইতে ইংরাজদিগের সহিত যুদ্ধের পর সিগাউলির সন্ধি দ্বারা সার ডেভিড্ অক্টারলনি কুমায়ুন রোহিলাখণ্ড প্রভৃতি প্রদেশ অধিকার করিয়া ইংরাজ রাজ্যভুক্ত করিয়া লইয়াছেন। তখন হইতে সিমলা, নৈনিতাল, মসুরি প্রভৃতি নেপালরাজ্যের অঙ্গচ্যুত হইয়াছে। এক্ষণে নেপালরাজ্য আয়তনে পঞ্জাবের ন্যায়, এবং জন সংখ্যা ৪৭,০০০০০ লক্ষ হইবে। এক কাটমণ্ডুর উপত্যকায় ২৫০০০০ লোকের বাস। নেপালের উত্তরে চিরতুষারাবৃত পর্ব্বতমালা অবিচ্ছেদে বিস্তৃত। এই সকল পর্ব্বতমালা ১৬,০০০ ফিট হইতে ২৮,০০০ ফিট পর্য্যন্ত উচ্চ হইবে। পৃথিবীর মধ্যে চারিটী অত্যুচ্চ শিখরই এই নেপাল প্রদেশে অবস্থিত। যথা,—নন্দদেবী, ধবলগিরি, গোঁসাইথান, এভারেষ্ট বা গৌরীশঙ্কর। পশ্চিমে নন্দদেবী কুমায়ুনের শিরোভূষণ রূপে অবস্থিত। নন্দদেবীর ২০০ মাইল পূর্ব্বে ধবলগিরি, ধবলগিরির ১৮০ মাইল পূর্ব্বে গোঁসাইস্থান। গোঁসাইস্থানের ১৩০ মাইল পূর্ব্বে এভারেষ্ট বা গৌরীশঙ্কর। নেপালরাজ্য, হিন্দুস্থানের অনেকগুলি প্রসিদ্ধ নদীর জন্মস্থান। উপরিলিখিত চারিটী অত্যুচ্চ পর্ব্বতশিখর এবং তন্নিসৃত নদী, সকল নেপাল রাজ্যকে চারিটী বিভিন্ন প্রাকৃতিক অংশে বিভক্ত করিয়াছে, আমরা যথাক্রমে নেপালের নদীগুলির নাম উল্লেখ করিতেছি। ১ম পশ্চিমে কালী বা সরযু নদী নন্দদেবী হইতে নিঃসৃত হইয়া পার্ব্বত্য প্রদেশ হইয়া, ক্রমে অযোধ্যা প্রদেশ দিয়া প্রবাহিত হইয়া ঘর্ঘরা (বা কর্ণালি) নদীতে আত্মসমর্পণ করিয়াছে।

 ২। ঘর্ঘরা (বা কর্ণালি)-হিমাচলের ক্রোড়ে ঘর্ঘরার অপর নাম কর্ণালি—হিন্দুস্থানে ইহা ঘর্ঘরা নামেই প্রসিদ্ধ। মানস সরোবরের নিকট জন্মগ্রহণ করিয়া টিকলাখড় পাশ দিয়া নেপালরাজ্যে প্রবেশ করিয়াছে। নেপালের অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পার্ব্বত্য নদী ইহাকে পরিপুষ্ট করিয়াছে। ঘর্ঘরা নদী—হিন্দুস্থানে অবোধ্যা প্রদেশের পূর্ব্বপ্রান্ত দিয়া প্রবাহিত হইয়া সরয়ু এবং কুশীর সহিত মিলিত হইয়া দানাপুরের একটু উপরে গঙ্গায় আসিয়া পতিত হইয়াছে।

 ৩। রাপ্তিনদী—ধবলগিরিতে রাপ্তির জন্ম—অযোধ্যার উত্তর পূর্ব্বাংশ দিয়া গোরক্ষপুরের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইয়া রাপ্তিনদী অবশেষে ঘর্ঘরার সহিত মিলিত হইয়াছে।—গোরক্ষপুর ইহার দক্ষিণতীরে অবস্থিত।

 ৪। গণ্ডকী নদী নেপালের মধ্য প্রদেশ দিয়া প্রবাহিত হইয়া গঙ্গায় আসিয়া পড়িয়াছে—

 ৫। পূর্ব্বে কুশী নদী—নেপাল রাজ্য এই তিনটী প্রাকৃতিক অংশে বিভক্ত। পশ্চিমে ঘটরা প্রদেশ—মধ্যে গণ্ডকী প্রদেশ—পূর্ব্বে কুশী প্রদেশ।—এই তিনটী প্রদেশ ছাড়া কাটমণ্ডু উপত্যকা নেপালের একটী বিশেষ অংশ, ইহার পশ্চিমে গণ্ডকী প্রদেশ, পূর্ব্বে কুশী প্রদেশ। কাটমণ্ডুর উপত্যকায় বাঘমতী নদীর জন্ম হইয়াছে। বাঘমতী নদী ক্রমে দক্ষিণাভিমুখিনী হইয়া মুঙ্গেরের সন্নিকটে গঙ্গায় গিয়া পতিত হইয়াছে।

 পূর্ব্ব সীমায় ক্ষুদ্র মিচী নদী নেপাল রাজ্যের পূর্ব্বতম সীমা। এই নদী নেপাল ও সিকিমের মধ্যে ব্যবধান স্বরূপ হইয়াছে।

 নেপাল হইতে তিব্বতে যাইবার কতকগুলি সঙ্কীর্ণ গিরিপথ হিমালয়ের মধ্য দিয়া আছে। আমরা পশ্চিম হইতে যথাক্রমে এই গিরিপথ গুলির উল্লেখ করিব।

 ১। টিক্‌লাখর পাশ (Tiklakhar or Yaripass) নন্দদেবী এবং ধবলগিরির মধ্যে ইহা অবস্থিত। হিমালয়ের উত্তরে মানস সরােবরের নিকট ঘর্ঘরা নদী জন্মগ্রহণ করিয়া এই পথ দিয়া নেপালে আসিয়া পতিত হইয়াছে।

 ২। মৎস্য পাশ— ধবলগিরির ৪০ মাইল পূর্ব্বে এই পথটী অবস্থিত।

 ৩। কিরাং পাশ—

 ৪। কুটী পাশ—এই দুইটী পথ যথাক্রমে গোঁসাইস্থানের পশ্চিমে এবং পূর্ব্বে অবস্থিত। এই দুইটী পথ দিয়াই তীব্বত হইতে অধিকতর যাত্রী নেপালে যাতায়াত করিয়া থাকে। লাশা হইতে কাটমণ্ডু আসিতে হইলে কুটী এবং কিরাং পাশই সর্ব্বাপেক্ষা প্রশস্ত পথ। কুটী পাশ দিয়া ৪৫ দিনের মধ্যে পদব্রজে লাশা যাওয়া যায়। এ পথে, অশ্বারােহণে যাওয়া সম্ভব নয়। কুটী পাশ কাটুমণ্ডু হইতে ৯০ মাইল এবং কিরাং পাশ ১০০ মাইল হইবে। কিরাং পাশ দিয়া অশ্ব সকল অনায়াসে গমনাগমন করে, এই কারণে কিরাং পাশই বাণিজ্যোদ্দেশে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। কিরাং পাশ দিয়া লাশা যাইতে ৭।৮ দিন লাগিয়া থাকে। একবার হিমাচল পার হইলে তীব্বতের পথ অতি সুগম হইয়া পড়ে, তখন আর যাত্রীগণের কোন কষ্টই হয় না।

 ৫। হাতীয়া পাশ।—কুটী পাশের ৪০/৫০ মাইল পূর্ব্বে হাতীয়া পাশ। হাতীয়া পাশ দিয়া কুশীর একটী শাখা নেপালে আসিয়া পতিত হইয়াছে।

 ৬। ওয়ানাং পাশ নেপালের পূর্ব্বতম গিরিপথ। কাঞ্চনজঙ্ঘার পশ্চিমে ইহা অবস্থিত।

 এই সকল গিরিপথ কেবল তীব্বতের লােকদিগের দ্বারা ব্যবহৃত হয়। কাঠমণ্ডু উপত্যকায় শীতকালে দলে দলে তীব্বতীয়গণ বাণিজ্য দ্রব্য লইয়া আগমন করে। নানাবিধ কম্বল, পার্ব্বত্য অশ্ব, কুকুর, মেষ, ছাগল, নানাবিধ প্রস্তর, চামরীর পুচ্ছ, স্বর্ণ, রৌপ্য, মৃগনাভি, লবণ, প্রভৃতি তীব্বতীয়গণ নেপালে লইয়া আসে। নেপাল হইতে অনেক লােক এবং কাশ্মিরীগণ কিরাং ও কুটী পাশ দিয়া লাশায় গিয়া থাকে।