নেপালে বঙ্গনারী/নেপালের বর্ত্তমান গুর্খা রাজগণ
নেপালের বর্ত্তমান গুর্খা রাজগণ।
নেপালের গুর্খা রাজা ও রাজমন্ত্রী গণের তালিকা।
১। পৃথ্বীনারায়ণ।
২। সিংহ প্রতাপ।
৩। রণ বাহাদুর সাহ।
৪। গৃবাণ যুদ্ধ বিক্রম।
৫। রাজেন্দ্র বিক্রম সাহ।
৬। সুরেন্দ্র বিক্রম সাহ।
৭। পৃথ্বিবীর বিক্রম সাহ।
৮। ত্রিভুবন বিক্রম সাহ।
রাজমন্ত্রী গণ।
১। বাহাদুর শাহ রণবাহাদুর সাহের পিতৃব্য এবং মন্ত্রী।
২। দামোদর পাঁড়ে—রণ বাহাদুরের মন্ত্রী।
৩। ভীম সাহ চৌতুরিয়া—রণ বাহাদুরের মন্ত্রী।
৪। ভীমসেন থাপা।
৫। রণ জং পড়ে।
৬। রঘুনাথ পণ্ডিত।
৭। কতে জং চৌতুরিয়া।
৮। মাতব্বর থাপা।
৯। গগন সিং।
১০। জঙ্গ বাহাদুর।
১১। রণদীপ সিং।
১২। বীর শামসের।
১৩। দেব শামসের।
১৪। চন্দ্র শামসের।
১। পৃথ্বী নারায়ণ—নেপাল জয় করিয়া গুর্খা এবং নেপাল রাজ্য মিলিত করিয়া সমুদায় প্রদেশ নেপাল রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করেন। পরে কিরাটী এবং লিম্বুদিগকে পরাজিত করিয়া পূর্ব্বে মিচি নদী পর্য্যন্ত নেপালরাজ্যের সীমা বিস্তার করেন। ক্ষুদ্র নেপাল রাজ্য এই প্রকারে বর্ত্তমান আকার ধারণ করিল। পৃথ্বীনারায়ণ নবজীতরাজ্যে অধিক দিন রাজত্ব করিতে পারেন নাই। ১৭৭১ খৃষ্টাব্দে তাঁহার মৃত্যু হয়।
২। সিংহ প্রতাপ—পৃথ্বীনারায়ণের মৃত্যুর পর তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র সিংহ প্রতাপ পৈতৃক সিংহাসনে আরোহণ করেন। সিংহ প্রতাপ দক্ষিণে পৈতৃক রাজ্য কিঞ্চিৎ বৃদ্ধি করেন। ১৭৭৫ খৃষ্টাব্দে তিনি রণ বাহাদুর সাহ নামে শিশুপুত্র রাখিয়া পরলোক গমন করেন।
৩। রণবাহাদুর সাহ—সিংহ প্রতাপের পত্নী রাণী রাজেন্দ্রলক্ষী পুত্রের অপ্রাপ্ত বয়সকালে অতিশয় যোগ্যতার সহিত রাজ্য শাসন করেন। এবং তাঁহার শাসন কালে রাজ্যের পরিসরও বৃদ্ধি পায়। রণ বাহাদুর বয়ঃপ্রাপ্ত হইবার পূর্ব্বেই রাণী রাজেন্দ্রলক্ষ্মী পরলোক গমন করেন। তখন রণবাহাদুরের পিতৃব্য বাহাদুর সাহ বালক রাজার অভিভাবকরূপে রাজ্যশাসন করিতে থাকেন। কিন্তু রণবাহাদুর বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া পিতৃব্য বাহাদুর সাহকে কারারুদ্ধ করিয়া হত্যা করেন। রণবাহাদুর অতি অযোগ্য নিষ্ঠুর এবং রূঢ় প্রকৃতির নৃপতি ছিলেন। এই সময় হইতেই নেপালের সিংহাসনে ক্রমাগত শিশু রাজা উপবেশন করিয়া আসিতেছেন। অদ্যাবধি এ নিয়মের অন্যথা হয় নাই। রণবাহাদুরের অনেক কুকীর্ত্তি আছে। তাঁহার দুইটী পুত্র ছিল, একটী পরিণীতা রাণীর গর্ভজাত, অপরটি ব্রাহ্মণীর গর্ভজাত জারজ পুত্র।
প্রথমোক্তের নাম রণোদ্যতসাহ, দ্বিতীয়ের নাম গৃবান যুদ্ধ বিক্রম। এই ব্রাহ্মণী রাজ্ঞী বসন্ত রোগে লুপ্তশ্রী হইয়া আত্মহত্যা করেন। ব্রাহ্মণীর মৃত্যুতে রাজা শোকে ক্ষিপ্ত প্রায় হইয়া অনেক অদ্ভুত কর্ম্ম করেন, তন্মধ্যে দেবী মন্দিরের লাঞ্ছনা প্রধান কার্য্য। তিনি সমুদায় শীতলার মন্দির অপবিত্র করিয়া, তথায় পূজা রহিত করিয়া দিয়াছিলেন, এবং ব্রাহ্মণদিগের উপরও বিবিধ অত্যাচার করেন। রণবাহাদুর প্রজাদিগের উপর বিবিধ অমানুষিক অত্যাচার করিতেন। ক্রমে তাঁহার মস্তিষ্ক একান্ত বিকৃত হইয়া পড়িল; তখন রাজমন্ত্রী দামোদর পাঁড়ে তাঁহাকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া কাশী প্রেরণ করেন। রণবাহাদুর ইতিপূর্ব্বে তাঁহার পুত্র রণোদ্যত সাহকে অতিক্রম করিয়া ব্রাহ্মণীর গর্ভজাত পুত্র গৃবাণ যুদ্ধ বিক্রমকে আপনার উত্তরাধিকারী মনোনীত করিয়াছিলেন। রণবাহাদুর কাশী গমন করিলে মন্ত্রিগণ পঞ্চমবর্ষীয় বালক (৪) গৃবাণ যুদ্ধ বিক্রমকে রাজপদে অভিষিক্ত করেন। এবং রণোদ্যতের জননীকে এই শিশু রাজার অভিভাবক মনোনীত করেন। জ্যেষ্ঠা রাজমহিষী ত্রিপুরাসুন্দরী রণবাহাদুরের সঙ্গে কাশী গমন করিয়াছিলেন। গৃবাণ যুদ্ধ বিক্রম রাজা হইলে ছয় বৎসর বয়স্ক বালক রণোদ্যত শাহ তাহার চৌতুরিয়া অর্থাৎ প্রধান মন্ত্রীর পদে অভিষিক্ত হন। রণোদ্যতের জননী এই উভয় বালকের অভিভাবক ছিলেন। কাশীতে রণবাহাদুর জ্যেষ্ঠা রাজমহিষী ত্রিপুরাসুন্দরীর উপর অশেষ অত্যাচার করিতেন। অবশেষে ত্রিপুরাসুন্দরী কাশি ত্যাগ করিয়া নেপালে আসিতে মনস্থ করিলেন। ১৮০২ সালে তিনি নেপালের সীমায় পদার্পণ করিলে কনিষ্ঠা মহারাণী একদল সৈন্য তাহার গতিরোধ করিবার জন্য প্রেরণ করেন। তাহারা মহিষীর অনুচরবর্গকে বন্দী করিল। রাণী অগত্যা ফিরিয়া গেলেন। পর বৎসর আবার তিনি নেপালের পথে যাত্রা করিলেন। এবারেও তাহার বিরূদ্ধে সৈন্য সামন্ত প্রেরিত হইয়াছিল কিন্তু সৈন্যগণ অন্তরে ত্রিপুরাসুন্দরীর প্রতি অনুরক্ত ছিল। তাঁহার বিরুদ্ধাচরণ করা দূরে থাকুক, তাঁহাকে লইয়া সসৈন্যে তাহারা সহরে প্রবেশ করিল। কনিষ্টা রাজ্ঞী ভীত হইয়া শিশু রাজাকে লইয়া পশুপতিনাথের মন্দিরে আশ্রয় লইলেন। ত্রিপুরাসুন্দরী বালক রাজাকে আনিয়া সিংহাসনে বসাইয়া আপনাকে অভিভাবক বলিয়া ঘোষণা করিলেন। কনিষ্ঠা মহিষীও প্রকাশ্যভাবে সমুদায় ক্ষমতা জ্যেষ্ঠার হস্তে সমর্পণ করিয়া তাঁহার বশ্যতা স্বীকার করিলেন। ঠিক এই সময়েই কাপটেন নস্ক (Captain Knox) ইংরাজ গবর্ণমেণ্ট কর্ত্তৃক নেপালের রেসিডেণ্ট রূপে প্রেরিত হইয়াছিলেন। তিনি নেপাল রাজের সহিত “বাণিজ্য এবং মৈত্রীর” একটী তর্কের মীমাংসার জন্য অনেক চেষ্টা করেন। নেপাল দরবার মুখে তাহার প্রতি যথেষ্ট সৌজন্য এবং ভদ্রতা প্রকাশ করিতেন বটে, কিন্তু লেখাপড়ার ব্যাপারে বড় অগ্রসর হইতেন না। ক্রমে Captain Knoxএর ধৈর্য্যচ্যুতি হইতে লাগিল। এই সময়ে জ্যেষ্ঠা মহারাণী ত্রিপুরাসুন্দরী নেপালে প্রবেশ করিয়াছেন এই সংবাদ শুনিবামাত্র কনিষ্ঠা মহারাণী কাপটেন নক্সের (Captain Knox) সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করিলেন। কিন্তু ত্রিপুরাসুন্দরী অন্তরে ইংরাজদিগকে অতিশয় সন্দেহের চক্ষে দর্শন করিতেন। ইংরাজের সহিত সংশ্রবে আসিতে প্রস্তুত ছিলেন না। কাপটেন নস্ক শীঘ্রই নেপাল দরবারের এই প্রকার বৈরীভাব বুঝিতে পারিলেন। তিনি সভা ভঙ্গ করিয়া চলিয়া আসিলেন এবং ইংরাজ গবর্ণমেট কাশিতে মহারাজ রণবাহাদুরকে নেপালে আসিবার অনুমতি দিলেন। এত দিন ইংরাজ গবর্ণমেণ্ট এক প্রকার জোর করিয়া রণবাহাদুরকে কাশীতে রাখিয়াছিলেন। রণবাহাদুর অচিরে নেপালে উপস্থিত হইলেন। তখনও দামােদর পাঁড়ে মন্ত্রীর পদে অভিষিক্ত ছিলেন। তিনি একদিন সৈন্য লইয়া রাজার সম্মুখীন হইলেন। দামােদর অন্তরে রণবাহাদুরের একান্ত বিরােধী ছিলেন। রণবাহাদুরের সহিত ভীমসেন থাপা নামে এক যুবক ছিলেন। রাজার উপর এ বক্তির অপ্রতিহত ক্ষমতা ছিল। মহারাজ সৈন্যগণের সম্মুখীন হইলে তিনি তাঁহাকে বলিলেন “মহারাজ! এমন সুযােগ ছাড়িবেন না, আপনি এই সৈন্যগণকে আপনার বশ্যতা স্বীকার করাইতে পারিলে চিরদিনের মত দামােদর পাঁড়ের ক্ষমতা চূর্ণ হইবে।” রণবাহাদুর ভীমসেনের প্ররােচনায় উত্তেজিত হইয়া নিজে সৈন্যদিগের সম্মুখীন হইয়া স্বীয় উষ্ণীষ উর্দ্ধে উত্তোলন করিয়া বলিলেন “আমার বিশ্বাসী গুর্খা সৈন্যগণ! তােমরা তােমাদের মহারাজকে চাও, না দামােদর পাঁড়ের অধিনায়কত্ব স্বীকার করিতে চাও, তােমাদের রাজা কে?” অমনি সৈন্যদল “জয় মহারাজাধিরাজ রণবাহাদুরের জয়” বলিয়া ঘাের জয়নাদে প্রাঙ্গন কম্পিত করিল। পতিপ্রাণা মহিষী ত্রিপুরাসুন্দরী মহারাজকে পরম আদরে গ্রহণ করিলেন। রণবাহাদুর আবার নেপালে তাঁহার সিংহাসনে আরােহণ করিলেন এবং অত্যাচার নিষ্ঠুরতায় আবার নেপালবাসীকে অস্থির করিয়া তুলিলেন। রণবাহাদুর রাজ্যে প্রবেশ করিয়াই দামােদর পাঁড়ে ও তাঁহার পুত্রকে কারারুদ্ধ করিলেন এবং শীঘ্রই ভীমসেন থাপার প্ররােচনায় দামােদর ও তাঁহার পুত্র এবং আরও অনেক পাঁড়েকে হত্যা করিলেন। রণবাহাদুরভীমসেন থাপাকে প্রধান মন্ত্রীর পদে অভিষিক্ত করিলেন। একটী বড় আশ্চর্য্য কথা যে, গৃবান যুদ্ধ বিক্রমকে রাজা বলিয়া অস্বীকার করিতে প্রজাগণ কেহই প্রস্তুত হইল না। তখন অগত্যা রণবাহাদুর স্বীয় পুত্রের অভিভাবক হইয়া রাজ্যশাসন করিতে লাগিলেন।
অল্পদিনের মধ্যেই রণবাহাদুরের অত্যাচার অসহনীয় হইয়া উঠিল। তখন রাজ্যের কতিপয় প্রধান পুরুষ রণবাহাদুরের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা শের বাহাদুরের সহিত মিলিত হইয়া মহারাজের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পাইবার জন্য এক চক্রান্তে লিপ্ত হইল। রণবাহাদুর এ চক্রান্তের বিষয় অবগত হইয়া ভীমসেন থাপার পরামর্শে তৎক্ষণাৎ শের বাহাদুরকে ডাকিয়া পাঠাইলেন এবং নেপালের পশ্চিমাংশে যে সৈন্যদল প্রেরিত হইয়াছিল তাহাদের সহিত মিলিত হইতে আদেশ করিলেন। শের বাহাদুর অতি অবজ্ঞাসূচক ভাষায় এই আদেশ প্রত্যাখ্যান করিলে রণবাহাদুর অমনি তাঁহার মস্তকচ্ছেদনের আজ্ঞা দিলেন। এই কথা শুনিয়া শের বাহাদুর হস্তস্থিত তরবারির দ্বারা রণবাহাদুরকে আক্রমণ করিলেন। এ দিকে বালনুর সিংহ কনওয়ার নামে এক প্রধান থাপা তাঁহাকে হত্যা করিয়া ফেলিল। এক মুহূর্ত্তের মধ্যেই দুই ভ্রাতাই নিধনপ্রাপ্ত হইলেন। এই বালনুর সিংহ কনওয়ারই সুপ্রসিদ্ধ জঙ্গ বাহাদুরের পিতা। বালনুর সিংহের এই কার্য্যের জন্য তাঁহাকে পুরুষানুক্রমে বিশেষ সম্মানিত করা হয়। রণবাহাদুরের মৃত্যুতে ভীমসেন থাপার ক্ষমতা অপ্রতিহত হইল। প্রধান মন্ত্রী রূপে তিনি এবং মহারাণী ত্রিপুরাসুন্দরী অতি যোগ্যতার সহিত রাজ্যশাসন করিতে থাকেন। রণবাহাদুরের মৃত্যুর সময় গৃবাণ যুদ্ধ বিক্রম দশ বৎসরের বালক মাত্র ছিলেন। রণবাহাদুরের সহিত কনিষ্ঠ মহারাণী সহমৃতা হইয়াছিলেন। ভীমসেনের বিশেষ ইচ্ছায় এইরূপ হইয়াছিল। রণবাহাদুরের মৃত্যুর পরও শের সাহের চক্রান্তে লিপ্ত এই অনুযোগ দিয়া ভীমসেন স্বীয় বিরোধীদিগকে হত্যা করেন। ইতিপূর্ব্বে পাঁড়েগণকেও হত্যা করা হইয়াছিল। এই রূপে প্রধান রাজ পুরুষদিগের দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইল।
মহারাণী ত্রিপুরাসুন্দরী ইংরাজদিগের বন্ধু ছিলেন না। ইংরাজদিগের সহিত, নেপালরাজ কোন সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ ছিলেন না; অধিকন্তু গুর্খাগণ সর্ব্বদাই ইংরাজরাজ্যে অল্পাধিক অত্যাচার করিত। পিণ্ডারী দস্যুদলকে দমন করিবার জন্য ইংরাজ গবর্ণমেণ্ট বারম্বার নেপালরাজকে অনুরোধ করিয়াও কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই। দুর্ভেদ্য নেপাল রাজ্যে অনেক দস্যু আশ্রয়লাভ করিয়াছিল। এই সকল নানা কারণে ১৮১৪ খৃষ্টাব্দে নেপালের সহিত ইংরাজরাজ রণঘোষণা করিলেন। রণবাহাদুরের মৃত্যুর পর অমর সিং থাপা কুমায়ুন গাড়ওয়াল প্রভৃতি অধিকার করিয়া শতদ্রু পর্য্যন্ত নেপালরাজ্যের সীমা বৃদ্ধি করেন। এই যুদ্ধের পর নেপালরাজ ইংরাজদিগের সহিত সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হইতে বাধ্য হন। ১৮১৪ খৃষ্টাব্দে সিগাউলির সন্ধিতে নেপালের পশ্চিমাংশ ইংরাজের হস্তগত হইল। ১৮১৬ খৃষ্টাব্দে অনারেবল ই, গার্ডিনার (H. E. Gardiner) নেপালের রেসিডেণ্ট হইয়া আসিলেন। ইনিই প্রথম নেপালের রেসিডেণ্ট্। গার্ডিনার সাহেব আসিবার দুই মাস পরেই মহারাজ গৃবাণ যুদ্ধ বিক্রম সাহ ২১ বৎসর বয়সে বসন্তরোগে গতাসু হন। ১৮১৬ খৃষ্টাব্দে তাঁহার দুই বৎসর বয়স্ক পুত্র (৫) রাজেন্দ্রবিক্রম সাহ নেপালের সিংহাসনে আরোহণ করেন। পূর্ব্বের মহারাজদ্বয়ও শৈশবেই সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন।
এই শিশুকে পাইয়া ভীমসেন থাপার শক্তি অপ্রতিহত হইল। এই ভীমসেন থাপা রাজ্যশাসনবিষয়ে অতি যোগ্যপুরুষ ছিলেন। ইনি যদিও অন্তরে ইংরাজদিগের বন্ধু ছিলেন না, কিন্তু ইংরাজের সহিত বিবাদে যে নেপালের স্বাধীনতা লুপ্ত হইবে তাহা বিলক্ষণ বুঝিতেন। এই হেতু কোন প্রকার অশান্তির কারণ উপস্থিত হইতে দিতেন না। ইংরাজের সহিত সদ্ভাব এবং শান্তি, নেপালের স্বাধীনতা রক্ষার এক মাত্র উপায় বলিয়া জানিয়াছিলেন। ইংরাজের সহিত ঘনিষ্টভাবে আসিতে কিছুতেই সম্মত ছিলেন না; এবং যাহাতে ইংরাজ প্রত্যক্ষ কিম্বা পরোক্ষ ভাবে কোন প্রকারে নেপালের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতে না পারেন, সে বিষয়ে দূরদর্শিতার সহিত ইংরাজের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। কি জঙ্গ বাহাদুর কি বর্ত্তমান মন্ত্রিগণ এ পর্য্যন্ত সকলেই ভীমসেন থাপার প্রদর্শিত পন্থা অনুসরণ করিয়া আসিতেছেন। নেপালের রাজমন্ত্রীদিগের বিষয় আর একটী বিশেষ কথা বলিতেছি;—ইংরাজগণ প্রথম হইতেই নানা উপায়ে রাজমন্ত্রীদিগকে হস্তগত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন; কিন্তু তাঁহারা যতই ক্ষমতাপ্রিয়, স্বার্থপর হউন না কেন, জাতীয় স্বাধীনতা বিসর্জ্জন করিতে কিছুতেই প্রস্তুত হন নাই। পরস্পরের শত্রুতা বিস্তর করিয়াছেন, স্বজনের রক্তে নেপাল বারম্বার কলুষিত হইয়াছে, কিন্তু দেশের বৈরিতা কেহই করেন নাই।
ভীমসেন থাপার সময়ে নেপালের অনেক আভ্যন্তরীণ উন্নতি সাধিত হইয়াছিল। ১৮১৬ সালের সন্ধির পর যদিও নেপালরাজ্যের একতৃতীয়াংশ ইংরাজের হস্তগত হইয়াছিল, তথাপি ভীমসেনের সুযোগ্য শাসনে এবং চেষ্টায় নেপালের বিবিধ উন্নতি সাধিত হয়। (১) সৈন্যসংখ্যাবৃদ্ধি, (২) ধনবৃদ্ধি। ইতিপূর্ব্বে ব্রাহ্মণদিগের বিস্তর ব্রহ্মোত্তর জমি ছিল এবং অসংখ্য দেবমন্দিরের বিস্তর ভূসম্পত্তিও ছিল। ১৮১৪ সালের যুদ্ধের পূর্ব্বে তিনি সমুদায় পণ্ডিত ব্রাহ্মণদিগকে সমবেত কবিয়া দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ভূমি দান করিতে অনুরোধ করেন। অনেকে স্বেচ্ছায় স্বীয় সম্পত্তি দান করেন। কিন্তু ভীমসেন অধিকাংশ ব্যক্তিকে স্বীয় স্বীয় অংশ দিতে বাধ্য করেন। দেবমনিরের ভূসম্পত্তিও সৈন্যরক্ষার জন্য গ্রহণ করা হইল। এই প্রকারে রাজকোষে বিস্তর অর্থাগম হইল। এবং রাজ্যে শান্তি থাকাতে ব্যবসার উন্নতির জন্য ধনাগম হইতে লাগিল। ভীমসেন থাপার হস্তে নেপালের সৈনিকবল এবং অর্থবল বিলক্ষণ বৃদ্ধি পাইয়াছিল। তিনি সৈন্যগণকে সর্ব্বদাই কৃত্রিম যুদ্ধ এবং গোলা বারুদ বন্দুক প্রভৃতির নির্ম্মাণে নিযুক্ত রাখিতেন। সৈন্যগণের হৃদয়ে ভীমসেনের অপ্রতিহত প্রভাব ছিল। মহারাণী ত্রিপুরাসুন্দরী যতদিন বাঁচিয়াছিলেন ভীমসেন থাপার প্রতাপ ততদিন অপ্রতিহত ছিল। ১৮৩২ খৃষ্টাব্দে তাঁহার মৃত্যুর পর ভীমসেনের ভাগ্যাকাশ অন্ধকারময় হইয়া আসিল। মহারাণী ত্রিপুরাসুন্দরী অতি যোগ্যতার সহিত নেপালের রাজকার্য্য নির্ব্বাহ করিতেন। ভীমসেনের ভ্রাতা রণবীর সিংহ থাপা ভীমসেনের প্রতি অন্তরে ঈর্ষা পোষণ করিতেন। তিনি সেই সময় প্রধান সেনাপতি ছিলেন। বালক রাজা রাজেন্দ্র বিক্রমের উপর রণবীর সিংহের প্রভাব দিন দিন অধিক হইতেছিল। তিনি মহারাজকে সর্ব্বদাই ভীমসিংহের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিতে চেষ্টা করিতেন। এই সময়ে মাতব্বর সিংহ নামে ভীমসেন থাপার এক ভ্রাতুষ্পুত্র দিন দিন শক্তিশালী হইয়া উঠিতেছিলেন। রণবীর সিংহ, ভীমসেন থাপা ও মাতব্বর সিংহের ঘাের বিদ্বেষী ছিলেন; কিন্তু স্বহস্তে কিছু করিতে পারেন নাই। যাহা হউক রণবীর সিংহ প্রমুখ দল দিন দিন শক্তিশালী হইয়া উঠিতে লাগিলেন। ১৮৩৭ খৃষ্টাব্দে মহারাজ রাজেন্দ্র বিক্রম সাহ ভীমসেনের দলের অনেক ব্যক্তিকে কর্ম্মচ্যুত করেন। এবং দামােদর পাঁড়ের পুত্রকে উচ্চ রাজকার্য্যে নিয়ােগ করিয়া তাঁহাদের সমুদায় ভূসম্পত্তি পুনঃপ্রদান করেন। এই সময় হঠাৎ মহারাজ রাজেন্দ্র বিক্রমের সর্ব্বকনিষ্ঠ একবৎসরবয়স্ক পুত্রটি মৃত্যুমুখে পতিত হয়। অমনি মহারাজ বলিলেন যে, বালকটীর ভীমসেন থাপা কর্ত্তৃক প্রদত্ত বিষভক্ষণে মৃত্যু হইয়াছে। কিন্তু এরূপ কথিত আছে মহারাজ স্বয়ং সেই পুত্রকে হত্যা করিয়া ভীমসেনকে দণ্ড দিবেন এই হেতু এরূপ কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়াছিলেন।
ভীমসেন থাপার নামে এই অভিযােগ উপস্থিত করিয়া সমুদায় থাপা পরিবার, রণবীরসিংহ, মাতব্বর সিংহ, রাজবৈদ্য এবং আরও অনেক ব্যক্তির প্রতি অমানুষিক অত্যাচার সংঘটিত হয়। রাজবৈদ্য ব্রাহ্মণ বলিয়া তাহাকে হত্যা না করিয়া তাহার ললাট এরূপ দগ্ধ করা হয় যে মস্তকের ঘৃত বাহির হইয়া পড়ে। এই সমুদায় ব্যক্তিকে জাতিচ্যুত করিয়া সর্ব্বস্বান্ত করা হইল। একটি নেপালী বৈদ্যের শরীরের চর্ম্ম উন্মোচন করিয়া জীবিতাবস্থায় তাহার হৃদ্ যন্ত্র বাহির করিয়া ফেলা হইল কিন্তু এত অত্যাচারেও কেহ ভীমসেন থাপার বিরুদ্ধে এক অক্ষরও উচ্চারণ করিল না।
রাজা স্বচক্ষে এই সকল অমানুষিক অত্যাচার দর্শন করিতেন। মহারাজ রাজেন্দ্র বিক্রম সাহের দুইটী মহিষী ছিল। জ্যেষ্ঠার— গর্ভে তিন পুত্র, তন্মধ্যে কনিষ্টটির হত্যা হওয়াতে এই সকল পৈশাচিক কাণ্ডের অভিনয় হয়। কনিষ্টা মহিষীর দূইটী পুত্র ছিল। জ্যেষ্ঠা মহারাণী পাঁড়েদিগের পক্ষপাতিনী, কনিষ্ঠা থাপাদিগের। ভীমসেনের প্রতি এই সকল অত্যাচার লইয়া কনিষ্ঠা মহারাণী মহারাজকে অনেক অনুযোগ করিয়াছিলেন এবং তাহার চেষ্টায় কিছুদিনের জন্য ভীমসেন থাপাকে অব্যাহতি দেওয়া হইল। দুই বৎসর পরে ১৮৩৯ খৃষ্টাব্দে দামোদর পাঁড়ের পুত্র রণজিৎ পাঁড়ে তদানীন্তন রাজমন্ত্রী হইয়া ভীমসেনের প্রতি এই হত্যার অভিযোগ আনয়ন করেন। পুনরায় অনেক প্রকার অত্যাচারের সূত্রপাত হইল। যন্ত্রণা সহ্য করিতে অপারক হইয়া ভীমসেন আত্মহত্যা করিতে প্রয়াস পান এবং স্বীয় খুকরির আঘাতে প্রাণত্যাগ করেন। যে ভীমসেন থাপা নেপালরাজ্যের অশেষ প্রকার কল্যাণসাধন করিয়াছিলেন, যিনি এক সময়ে নেপালের দোর্দ্দণ্ড ও প্রতাপান্বিত রাজমন্ত্রী ছিলেন, তাঁহার মৃতদেহের অবমাননা করিতে শত্রুগণ কুণ্ঠিত হইল না। ভীমসেনের মৃতদেহ রাজপথে নিক্ষিপ্ত হইয়া শৃগাল কুকুরের ভক্ষ্য হইল। জ্যেষ্ঠা মহারাণী এবং রণজিৎ পাঁড়ে অতিশয় নিষ্ঠুর এবং ন্যায়বিরুদ্ধ আচরণ সকল করিয়া প্রজাদিগকে রাজাধিরাজের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিতে চেষ্টা করিলেন। সৈন্যদিগের ভাতা কমাইয়া দিয়া বিদ্রোহের সূচনা করেন। রামনগর বলপূর্ব্বক দখল করাতে ইংরাজের সহিত যুদ্ধের সূচনা হওয়াতে অগত্যা রামনগর ছাড়িয়া দিতে নেপালরাজ বাধ্য হন। সেই সময়ে ইংরাজদিগের সহিত যে সন্ধি হয় তদ্দারা পাঁড়েদিগকে মন্ত্রিপদ হইতে অপসারিত করিতে মহারাজ বাধ্য হন। তখন রঘুনাথ পণ্ডিত এবং তাঁহার ভ্রাতা রাজভক্ত কৃষ্ণরাম, ফতেজং চৌতুরিয়া তাঁহার ভ্রাতা গুরুপ্রসাদ, দলভঞ্জন পাঁড়ে এবং অভিরাম রাণাকে লইয়া এক মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। এই সময় রাজ্যে অত্যন্ত বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইল। রাজেন্দ্র বিক্রমের জ্যেষ্ঠা মহিষী পাঁড়েদিগের সহিত গোপনে সর্ব্বদাই চক্রান্ত করিতেন। রাজাধিরাজ সকল কার্য্যের অযোগ্য হইয়াও প্রত্যেক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতেন। রাজকুমার তখন দ্বাদশবর্ষীয় বালকমাত্র; কিন্তু তাঁহার নিষ্ঠুর এবং দুর্দ্দমনীয় প্রকৃতিবশতঃ নিয়ত সকলের উপর অমানুষিক অত্যাচার করিয়া স্বীয় পৈশাচিক প্রকৃতি চরিতার্থ করিত।
ইতি মধ্যে ১৮৪০ সালে জ্যেষ্ঠা মহারাণীর মৃত্যু হইল। দেশের আপামর সাধারণ লোক এই শাসনবিপর্য্যয়ে অস্থির হইয়া কনিষ্ঠা মহারাণীকে রিজেণ্ট করিয়া রাজকুমারকে সিংহাসনে বসাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল; কিন্তু চৌতুরিয়াগণ এ প্রস্তাবের বিরোধী ছিলেন। যাহা হউক সর্ব্বসম্মতিক্রমে প্রকাশ্য দরবারে রাজা রাজেন্দ্র বিক্রম তাঁহার কনিষ্ঠা মহিষী মহারাণী লক্ষ্মী দেবীকে রাজরক্ষয়িত্রী করিয়া সুরেন্দ্র বিক্রমকে রাজাধিরাজ করেন; কিন্তু নিজেও রাজপদে অভিষিক্ত থাকেন। অল্প সময়ের মধ্যেই লক্ষ্মী দেবী সকল ক্ষমতা আয়ত্তাধীন করিয়া স্বীয় জ্যেষ্ঠ পুত্রকে রাজাধিরাজ করিতে সচেষ্ট হন; কিন্তু চৌতুরিয়া এবং পাঁড়েগণ ইহার বিরোধী ছিলেন। লক্ষ্মী দেবী থাপাদিগের পক্ষপাতিনী ছিলেন। থাপাদিগের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা ক্ষমতাবান্ পুরুষ মাতব্বর থাপা তখন বিদেশে ছিলেন। মহারাণী তাঁহাকে প্রধান মন্ত্রীর পদে অভিষিক্ত করিবার প্রলোভন দেখাইয়া নেপালে আনয়ন করেন। এই সময় তাঁহার ভ্রাতষ্পুত্র কাজি জঙ্গবাহাদুরও নেপালে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। জঙ্গ বাহাদুর পরে নেপালের ভাগ্যচক্র কিরূপ আত্মবশ করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন, তাহা সকলেই জানেন। মাতব্বর খাপা দেশে প্রত্যাবৃত্ত হইয়াই স্বীয় পিতৃব্য ভীমসেন খাপার হত্যাকারীদের উপর বৈরনির্য্যাতন করিতে আরম্ভ করেন। করবার পাঁড়ে, কুলরাজ পাঁড়ে, ইন্দ্রবীর থাপা, কনক সিংহ প্রভৃতিকে হত্যা করা হয়, এবং সমুদায় পাঁড়ে নেপাল হইতে বিতাড়িত হন। মাথব্বর থাপা প্রধান মন্ত্রীর পদে অভিষিক্ত হইয়া রাজা রাজেন্দ্র বিক্রম, রাজকুমার সুরেন্দ্র বিক্রম এবং মহারাণী লক্ষ্মী দেবী এই তিন ব্যক্তির তিনটী দোষ দেখেন। রাজা অতি অযোগ্য, অপদার্থ; কিন্তু চক্রান্তকারী অবিশ্বাসী, রাজকুমার প্রচণ্ড ক্রোধনস্বভাব,ও অমানুষিক নিষ্ঠুর। মহারাণী ক্রূরচক্রী এবং স্বীয় পুত্রকে রাজপদে অভিষিক্ত করিবার জন্য নিয়ত সচেষ্ট মাতব্বর প্রথমে মহারাণীকে রিজেণ্ট করিয়া রাজকুমারকে রাজাধিরাজ পদে অভিষিক্ত করিবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু মহারাণীর অভিপ্রায় অন্যরূপ জানিয়া রাজকুমারের পক্ষ অবলম্বন করেন। মহারাণী মাতব্বর থাপাকে স্বীয় কার্য্যসিদ্ধির অন্তরায় দেখিয়া তাঁহার উচ্ছেদসাধনে তৎপর হন। রাজকুমারের পক্ষাবলম্বী ছিলেন বলিয়া মহারাজাধিরাজ রাজেন্দ্র বিক্রম তাঁহার প্রতি বিমুখ হন। অবশেষে মহারাজ ও মহারাণী চক্রান্ত করিয়া একদিন রাত্রে হঠাৎ মাতব্বরকে ডাকিয়া আনিয়া নিজেদের সমক্ষেই তাঁহাকে হত্যা করিলেন। কথিত আছে রাজাজ্ঞায়, জঙ্গ বাহাদুরই তাঁহাকে হত্যা করিয়াছিলেন। এইরূপে মাতব্বর থাপাকে অল্পদিনের জন্য ডাকিয়া আনিয়া হত্যা করা হইল। মাতব্বর থাপার মৃত্যুর পর গগন সিংহকে প্রধান মন্ত্রী করিয়া আবার এক মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। (জঙ্গ বাহাদুর, অভিরাম রাণা, দলভঞ্জণ পাঁড়ে প্রভৃতিকে লইয়া) গগন সিংহ হীন কুলোদ্ভব হইয়াও মহারাণীর প্রসাদে এই উচ্চপদ লাভ করিল। স্বয়ং মহারাজই, মহারাণীর সহিত গগনসিংহের এই প্রকার ঘনিষ্ঠতায় অতিশয় বিরক্ত হইতেন এবং তাঁহারই প্ররোচনায়, গোপনে গগন সিংহকেও হত্যা করা হইল। গগন সিংহ স্বীয় গৃহে পূজায় প্রবৃত্ত ছিলেন, এমন সময়ে নিকটবর্ত্তী স্থান হইতে কে তাঁহাকে গুলি করিয়া হত্যা করিল। হত্যাকারীকে কেহই ধরিতে সমর্থ হয় নাই। মহারাণী লক্ষ্মী দেবী গগন সিংহের হত্যার সংবাদ শুনিবামাত্র সেই রাত্রেই পদব্রজে ‘কোট’ নামক দরবারগৃহে উপনীত হইলেন এবং রাজসভার সমুদায় পদস্থ ব্যক্তিকে আহ্বান করিয়া পাঠাইলেন; সকলে ত্বরায় উপস্থিত হইলেন। মহারাণীর আজ্ঞায় জঙ্গ বাহাদুরের সহায়তায় সে দিন ভীষণ হত্যাকাণ্ডের অনুষ্ঠান হইল (১৯এ সেপ্টেম্বর, ১৮৪৬)। ফতে জঙ্গ, দলভঞ্জণ পাঁড়ে, অভিরাম রাণা, কনক বিক্রম শাহ প্রভৃতি ৩১ জন প্রধান ব্যক্তিকে হত্যা করা হইল। জঙ্গ বাহাদুর এবং তাঁহার ভ্রাতৃগণ এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান অভিনেতা ছিলেন। মহারাণী স্বয়ং উপস্থিত থাকিয়া এই হত্যাকাণ্ডে তাঁহাদিগকে উৎসাহিত করিয়াছিলেন।
এই হত্যাকাণ্ডের পর জঙ্গ বাহাদুর মহারাণী কর্ত্তৃক প্রধান মন্ত্রীর পদে অভিষিক্ত হইলেন। মাতব্বর থাপার ন্যায় জঙ্গ বাহাদুরও মহারাণীর অভিসন্ধির সহিত যোগ দিতে পারিলেন না। মহারাণী লক্ষ্মী দেবী জঙ্গ বাহাদুরের দ্বারায় সুরেন্দ্র বিক্রমকে হত্যা করিয়া স্বীয় পুত্রকে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য অনেক চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু অকৃতকার্য্য হইয়া জঙ্গ বাহাদুরকে হত্যা করিবার জন্য শেষবারে চক্রান্ত করিলেন। চক্রান্তটী এইরূপ ছিল;—বীর ধৌজ বুসনিয়াত এই চক্রান্তের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। স্থির হইয়াছিল যে, জঙ্গ বাহাদুর এবং তাঁহার ভ্রাতৃগণকে কোট নামক গৃহে ডাকাইয়া আনিয়া হত্যা করা হইবে। বিজয় রাজ পণ্ডিত নামে এক ব্রাহ্মণ এই চক্রান্তের বিষয় অবগত হইয়া জঙ্গ বাহাদুরকে বলিয়া দেন। জঙ্গ বাহাদুর অগ্রে জানিতে পারিয়া সাবধান হইলেন। বীর ধৌজ ও ১৪।১৫ জন তাঁহার দলস্থ ব্যক্তিকে হত্যা করা হইল। জঙ্গ বাহাদুর এবং তাঁহার বংশধরগণ “রাণাজু” এই উপাধিতে ভূষিত হইলেন। এই চক্রান্তের পর লক্ষ্মী দেবী তাঁহার পুত্রদ্বয় সমভিব্যাহারে কাশীতে চিরনির্ব্বাসিত হইলেন। মহারাণীর প্ররোচনায় মহারাজাধিরাজও তাঁহার সঙ্গী হইলেন। এবং কিছুকাল কাশীধামে বাস করিয়া অনেক চক্রান্ত করিলেন। অবশেষে একদল বিদ্রোহীদলের সহিত যোগ দিয়া নেপালে প্রবেশ করিলেন। কিন্তু অচিরে পরাস্থ এবং বন্দী হইয়া কাটমণ্ডুতে নীত হন। তাঁহার অনুপস্থিতে সুরেন্দ্র বিক্রম সাহ সর্ব্বসম্মতিক্রমে নেপালের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। রাজেন্দ্র বিক্রম সাহ এক প্রকার বন্দী অবস্থায় জীবনের অবশিষ্ট দিন ভাটগাঁওএর রাজপ্রাসাদে যাপন করিয়াছিলেন। জঙ্গ বাহাদুরের সহায়তায় সুরেন্দ্র বিক্রম সাহ সিংহাসনারোহণ করিলেন এবং জঙ্গ বাহাদুর দ্বারাই নেপালের রাজবংশের ক্ষমতা চিরদিনের মত খর্ব্বীকৃত হইল। তখন হইতে রাজার ক্ষমতা লোপ পাইয়া মন্ত্রীর প্রাধান্য প্রবর্ত্তিত হইল। সেই সময় হইতেই নেপালের রাজমন্ত্রীই নেপালরাজ্যের একমাত্র হর্ত্তা কর্ত্তা বিধাতা হইলেন।
রাজাধিরাজ সুরেন্দ্র বিক্রম সাহ এই প্রকার ভাবে রাজত্ব করিতে ইচ্ছুক ছিলেন না এবং একবার সিংহাসন ত্যাগ করিবার ইচ্ছাও করিয়াছিলেন। ১৮৪৭ খৃঃ সুরেন্দ্র বিক্রমের জ্যেষ্ঠপুত্র জন্মগ্রহন করেন। ১৮৫১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মহারাজাধিরাজের আর একটী পুত্র জন্মগ্রহণ করিল। ১৮৪৮ খৃঃ ইংরাজগণ দ্বিতীয় শিখ যুদ্ধে লিপ্ত হইলেন। তখন জঙ্গ বাহাদুর একদল গোর্খা সৈন্য লইয়া ইংরাজদিগের সহায়তা করিবার জন্য গবর্ণর জেনারেলকে প্রস্তাব করিয়া পত্র লিখিয়াছিলেন, কিন্তু ইংরাজগণ জঙ্গ বাহাদুরের সৈন্যদলের সহায়তা গ্রহণ করেন নাই। ১৮৪৯ খৃষ্টাব্দে শিখ্দিগের মহারাণী চান্দা কঁয়াড় চুণার দুর্গ হইতে পলায়ন করিয়া নেপালে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। নেপাল সরকার তাঁহাকে আশ্রয় দান করিয়াছিলেন এবং মাসে ৮০০ টাকা ব্যয় নির্ব্বাহের জন্য দিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহাকে নেপালে এক প্রকার বন্দীর ন্যায় রাখা হইয়াছিল। ১৮৫০ খৃষ্টাব্দে জঙ্গ বাহাদুর তাঁহার ভ্রাতৃদ্বয় সমভিব্যাহারে ইংলণ্ড যাত্রা করিলেন। তাঁহার অসুপস্থিতে তাঁহার দ্বিতীয় ভ্রাতা বনবাহাদুর প্রধান মন্ত্রীর কার্য্য করিয়াছিলেন। জঙ্গ বাহাদুর ইংলণ্ড হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিলে, তিনি জাতিচ্যুত হইয়াছেন এই বলিয়া তাঁহাকে হত্যা করিবার জন্য এক চক্রান্ত হয়, তাঁহাকে জঙ্গ বাহাদুরের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বদ্রিনুর সিং, তাঁহার পিতৃব্যপুত্র জয় বাহাদুর, রাজাধিরাজের কনিষ্ঠ ভ্রাতা উপেন্দ্র বিক্রম সাহ যোগ দিয়াছিলেন। কাজি করবার ক্ষত্রি জঙ্গ বাহাদুরের সঙ্গে ইংলণ্ড গিয়াছিলেন, তিনি জঙ্গ বাহাদুরের জাতিচ্যুত হইবার কথা উত্থাপন করিয়াছিলেন। বনবাহাদুর এ চক্রান্তের বিষয় অবগত হইয়া জঙ্গ বাহাদুরকে অশ্রুপূর্ণলোচনে এসকল জ্ঞাত করেন। প্রথমে চক্রান্তকারীদিগকে হত্যা করিবার কথা হয়। পরে তাহাদের চক্ষু নষ্ট করিবার প্রস্তাব হয়। শেষে জঙ্গবাহাদুরের অনুরোধে ব্রিটীশ্ গবর্ণমেণ্ট তাঁহাদিগকে এলাহাবাদে বন্দী স্বরূপ রাখিয়াছিলেন।
জঙ্গ বাহাদুর। জঙ্গ বাহাদুর ইংলণ্ড হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া অশেষ প্রকারে নেপালের উন্নতি সাধনে মনোযোগী হইলেন। তিনি শাসন বিভাগে অনেক প্রকার সংস্কার আনয়ন করেন। পূর্ব্বে চৌর্য্যঅপরাধে অপরাধী ব্যক্তিকে নানা প্রকার নিষ্ঠুর উপায়ে অপরাধ স্বীকার করান হইত। হস্ত পদ নাসা প্রভৃতি কর্ত্তন করিয়া অপরাধী ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া হইত। জঙ্গবাহাদুর এ সকল শাস্তির ব্যবস্থা সম্পূর্ণ রহিত করিয়া দেন। নেপালে সহমরণ প্রথাও এই সময় নিষিদ্ধ হয়। সুরেন্দ্র বিক্রমের পুত্র শাহাজাদা ত্রৈলোক্য বিক্রমের সহিত আপনার তিনটি কন্যার বিবাহ দেন। পৃথ্বীবীর বিক্রমশাহ তাঁহার মধ্যমা কন্যার গর্ভজাত ছিলেন। সুরেন্দ্র বিক্রমের জীবদ্দশায়ই ত্রৈলোক্য বিক্রম পরলোকগমন করেন। জঙ্গবাহাদুর চিরদিনই ভারতের ব্রিটীশ গবর্ণমেণ্টের সহিত বন্ধুতা রক্ষা করিয়া আসিতেছিলেন। ইংলণ্ড গমনের পর ব্রিটীশ রাজ্যের সহিত তাঁহার হৃদ্যতা আরও ঘণীভূত হয়। কাটমণ্ডুর ব্রিটীশ রেসিডেণ্টের সহিত তিনি সর্ব্বদাই সদ্ভাবে যাপন করিয়াছেন। বাস্তবিক জঙ্গবাহাদুর একজন অসাধারণ পুরুষ ছিলেন। তাঁহার ন্যায় সাহসী উদ্যোগী পরিশ্রমী পুরুষ বর্ত্তমান সময়ে দুর্লভ! এরূপ শ্রুত হওয়া যায় যে কেহ তাঁহার চক্ষে কখন জল দেখে নাই। তাঁহার আজ্ঞা তিলমাত্র অবহেলা করে এমন সাহস কাহারও ছিল না। অসমসাহসিক যে কোন কার্য্যে তাঁহার অত্যন্ত উৎসাহ ছিল। বনের বাঘ, দুরন্ত বন্যহস্তী বশীভূত করা তাঁহার নিকট অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার ছিল। কতদিন আমোদচ্ছলে ব্যাঘ্রের সহিত যুদ্ধ করিয়াছেন। কাটমণ্ডুর ইংরাজ চিকিৎসকদিগের পুস্তকে পাঠ করিয়াছি তিনি কঠিন অস্ত্রচিকিৎসা দেখিতে অত্যন্ত উৎসুক হইতেন। ইংরাজ জাতি সাহসী বীরকে অত্যন্ত ভালবাসে, সেইজন্য জঙ্গবাহাদুরকে ইংরাজেরা অত্যন্ত সম্মান করিতেন। শিথিলভাবে কোন কার্য্য সম্পন্ন করা জঙ্গবাহাদুরের প্রকৃতি ছিল না। তাঁহার প্রত্যেক কার্য্যে ভিতর তাঁহার ব্যক্তিত্ব উজ্জ্বল ভাবে ফুটিয়া উঠিত। নেপালের ইতিহাসে জঙ্গবাহাদুরের নাম চিরদিন উজ্জ্বল অক্ষরে মুদ্রিত থাকিবে সংশয় নাই। একবার একজন ইংরাজ রেসিডেণ্ট নেপালে ভাল পথ নির্ম্মান করাইবার জন্য জঙ্গবাহাদুরকে অনুরোধ করেন, তাহার উত্তরে তিনি যে বাক্য উচ্চারণ করিয়াছিলেন তাহা নেপালীদিগের নিকট চিরস্মরণীয় হইয়া আছে, বলিয়াছিলেন “সাধে কি আমরা ভাল পথ করি না,— আমাদের রাজ্যের দুর্গমতাই আমাদের আত্মরক্ষার প্রধান উপায়। প্রবল প্রতাপান্বিত ব্রিটিশ রাজ্যের তুলনায় আমরা সিংহের সম্মুখীন বিড়াল। সিংহ আক্রমণ করিলে বিড়ালের আর কি সাধ্য আছে? তবে আত্মরক্ষার জন্য তাহার চক্ষু উপড়াইতে পারে।”
রাজকুমারী
ও
রাজমাতা শ্রীপাঁচ মহারাণী
রণদীপ সিংহ
ও
তাঁহার পত্নী
১৯০১ খৃষ্টাব্দে বীরশামসেরের মৃত্যু হয়; তাঁহার মৃত্যুর পর যথা নিয়মে দেবশামসের রাজমন্ত্রী হইলেন। কিন্তু দুই মাস মাত্র তিনি উক্তপদ অলঙ্কৃত করিয়াছিলেন। দুই মাসের মধ্যেই মহারাজ চন্দ্রশামসের প্রমুখ দল তাঁহাকে নানাবিধ চক্রান্ত দ্বারা পদচ্যুত করিয়া একেবারে নেপালরাজ্য ত্যাগ করিতে বাধ্য করেন। এখন তিনি ভারতবর্ষেই আছেন, তাঁহার নিজের ধনসম্পত্তি অধিকাংশই তিনি উপভোগ করিতেছেন। দেবশামসের পদচ্যুত হইয়াছেন বটে কিন্তু অন্য কোন প্রকারে তাঁহাকে ক্লেশ দেওয়া হয় নাই। নেপালের ইতিহাসে এই একমাত্র রক্তপাতশূন্য বিপ্লবের কথা শুনিতে পাওয়া যায়। এই ঘটনায় মহারাজ চন্দ্রশামসেরের বুদ্ধি এবং বিবেচনার যথেষ্ঠ পরিচয় পাওয়া যায়। নেপালের রাজমন্ত্রীর পদ লইয়া যুদ্ধবিগ্রহ রক্তপাত প্রভৃতি চিরন্তন রীতি হইয়া দাঁড়াইয়াছে। মহারাজ দেবশামসেরকে পদচ্যুত করিয়া ১৯০২ খৃষ্টাব্দে মহারাজ
বীরসামসের জঙ্গ রাণা বাহাদুর। চন্দ্রশামসের রাজমন্ত্রী হইয়াছেন। বর্ত্তমান সময়ে নেপালরাজ্যে ইনিও যে সর্ব্ব বিষয়ে সর্ব্বতােভাবে যােগ্যতম পুরুষ, তাহাতে আর সংশয় নাই। এই একটি মাত্র ব্যক্তির উপর নেপালের আপামর সাধারণ লােকের সুখ দুঃখ নির্ভর করে; এই একটি মাত্র ব্যক্তির দ্বারা নেপালরাজ্যের সর্ব্ববিধ কল্যান সাধিত হইতে পারে;—এই একটী মাত্র ব্যক্তি ১০ বৎসরে নেপালের যেরূপ শ্রীবৃদ্ধি সাধন করিতে পারেন তাহা ভারতে কুত্রাপি আর সম্ভব নয় —নেপাল স্বাধীন রাজ্য! আশার চিত্র যাহা তাহা আজও দৃশ্যতঃ এবং কার্যতঃ সুব্যক্ত হয় নাই। নেপাল এতাবৎকাল কেবল ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থাভিসন্ধিতে নানা বিদ্রোহের লীলাভূমি হইয়াছে; যাহা হইতে পারে তাহা হয় নাই। মহারাজ চন্দ্রশামসের কাষ্ঠমণ্ডুর শ্রীবৃদ্ধি সাধনে তৎপর আছেন এখন কাটমণ্ডু সহর বৈদ্যুতিক আলােকে উজ্জ্বলতা প্রাপ্ত হইয়াছে।
এইরূপে অল্পাধিক পরিমাণে নেপালের সর্ব্বত্রই বাহ্যিক শ্রীবৃদ্ধি কিছু কিছু সাধিত হইতেছে, কিন্তু ভারতবর্যের প্রজাগণ ইংরাজরাজ্যে যে সকল সুখ সুবিধায় বাস করিতেছে নেপালে তাহার কিছুই নাই। ভারতের সনাতন অবস্থা কিরূপ ছিল, তাহা যদি কাহার দেখিবার সাধ থাকে ত নেপালরাজ্যে গমন করিলে হয়। গাড়ী নাই (নেপাল উপত্যকায় রাজপরিবারের আছে) রেল নাই—ত্বরিত ডাক নাই—টেলিগ্রাম নাই—ভাল স্কুল নাই—কলেজ নাই—বালিকাবিদ্যালয় নাই—রীতিমত আদালত নাই। আছে শ্রমজীবী কৃষক, আছে ভারবাহী মনুষ্য এবং পশু, আছে সুলভ যোদ্ধা এবং সৈনিক, আছে উচ্চ রাজকর্ম্মচারী রাণাপরিবার। যে জঙ্গবাহাদুর নেপালের অশেষবিধ কল্যাণ সাধন করিয়া গিয়াছেন, তাঁহার পুত্র পৌত্রগণ, হত এবং নেপাল হইতে তাড়িত হইলেও তাঁহার ভ্রাতুস্পুত্রগণ বর্ত্তমান সময়ে নেপালের সমুদয় উচ্চতম পদে অধিষ্ঠিত আছেন। বর্ত্তমান রাজমন্ত্রী জঙ্গবাহাদুরেরই ভ্রাতুস্পুত্র; নেপালেএই রাণাপরিবারের দোর্দ্দণ্ড প্রতাপ। নেপালরাজ পৃথ্বীবীর বিক্রম বিগত ডিসেম্বর মাসে (যখন পঞ্চমজর্জ্জ ভারতে শুভাগমন করেন) পরলোক গমন করিয়াছেন। এক্ষণে নেপালের সিংহাসনে পৃথ্বীবীর বিক্রমের পঞ্চবর্ষীয় শিশুপুত্র ত্রিভুবন বিক্রমশাহ প্রতিষ্ঠিত আছেন। নেপালের ভাগ্যে আবহমান কাল এইরূপ হইয়া আসিতেছে। পৃথ্বীনারায়ণের সময় হইতে (একজন ভিন্ন) শিশু নৃপতি দ্বারা রাজপদ শোভিত হইয়া আসিতেছে। নেপালে রাজার কোন কর্ত্তৃত্ত্বই নাই;—সুতরাং সেখানে শিশুনৃপতিদ্বারা কোনরূপ ক্ষতি বৃদ্ধি হইবার সম্ভাবনা নাই।
বৎসরাধিক কাল হইল মহারাজ চন্দ্রশামসের ইংলণ্ড ভ্রমণ করিতে গিয়াছিলেন। জঙ্গবাহাদুরের ইংলণ্ডে ভ্রমণ নেপালের ইতিহাসে অনেক শুভপরিবর্ত্তন আনয়ন করিয়াছিল। বর্ত্তমান রাজমন্ত্রীর বিলাত ভ্রমণের ফল এত অল্পকালের মধ্যে আমরা সমুদায় নির্ণয় করিতে পারি না। সম্ভবতঃ ইহার সুফলও নেপালের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হইবে। নেপালের ভবিষ্যৎ ইতিহাসে কি আছে জানি না; সেই বিচিত্র কর্ম্মা পুরুষের অপূর্ব্ব লীলা নির্ণয় করে সাধ্য কার? বােধিসত্ত্বের এক তরবারির আঘাতে নাগবাস হ্রদ আজ রমণীয় উপত্যকায় পরিণত হইয়াছে; না জানি আবার কোন মহাত্মার তরবারির আঘাতে নেপালের সমুদায় কুরীতি পাপরাশি ধৌত হইয়া নেপাল ভূপৃষ্ঠে স্বর্গধাম বলিয়া কীর্ত্তিত হইবে। নেপালের আভ্যন্তরীণ আর কোন কুরীতির কথাই উল্লেখ করিতে চাই না—কেবল দাসত্ব প্রথা আর বহু পত্নীগ্রহণের রীতি, আমার নিকট জাতীয় অবনতির মূল কারণ বলিয়া বােধ হইয়াছে। শুনিতেছি বর্ত্তমান রাজমন্ত্রী অল্পে অল্পে এই উভয় প্রকার কুরীতি বর্জ্জন করিতে চেষ্টা করিতেছেন। নেপালের জনসাধারণের ভিতর শিক্ষার আলােক তেমন ভাবে বিস্তৃত হয় নাই। উচ্চপরিবারের রমণীগণ নিরক্ষর নহেন— তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ সংস্কৃত শিক্ষা করেন। পুরুষগণ সামান্য ইংরাজি শিক্ষা করেন। কয়েকজন নেপালী যুবককে রাজমন্ত্রী শিক্ষার জন্য জাপানে প্রেরণ করিয়াছিলেন। আমাদের যেমন জীবিকার জন্য বিদ্যাশিক্ষা করিতে হয় নেপালে তাহা নয়, সুতরাং সেখানে শিক্ষার অবস্থাও তদ্রূপ। নেপালে কর্ম্মচ্ছলে অনেক বাঙ্গালী আছেন। তাঁহাদের মধ্যে কেহ বা ডাক্তার কেহ বা শিক্ষক। শ্রীযুক্ত রাজকৃষ্ণ কর্ম্মকার নামে একব্যক্তি বহুকাল হইতে নেপাল রাজসরকারে বন্দুক কামান প্রভৃতি নির্ম্মাণ করিয়া আসিতেছেন। বুদ্ধিজীবী বাঙ্গালির অপ্রতিহত গতি সর্ব্বত্র!
নেপাল রাজ্যে পদার্পন করিয়া, একদিন এই বলিয়া আনন্দ করিয়াছিলাম, যে আজ স্বাধীন দেশের স্বাধীন বায়ু আসিয়া আমার দেহকে আলিঙ্গন করিল। এমন দিন আমার জীবনে আসিবে ভাবি নাই ত? দুই বৎসর নেপালে বাস করিয়া, দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বলিতে হইল, এযে আমার স্বাধীন রাজ্যের স্বপ্ন। স্বাধীনতায় এ জাতি কি লাভ করিয়াছে হায়! আমি তাহা দেখিতে পাইলাম না!
নেপালের ব্রিটীশ প্রেসিডেণ্ট।
নেপালের বর্ত্তমান ইতিহাসের কথা বলিতে গিয়া কাটমণ্ডুর ব্রিটীশ রেসিডেণ্টের কথা উল্লেখ না করিলে কাহিণী অসম্পূর্ণ থাকে। পূর্ব্বেই উল্লেখ করিয়াছি পৃথ্বীনারায়ণের নেপাল জয়ের পূর্ব্ব হইতে কাটমণ্ডুর মল্লরাজার সহিত ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা বাণিজ্যজাত সম্বন্ধ ছিল। সেই সূত্রে পৃথ্বীনারায়ণ নেপাল আক্রমণ করিলে তাঁহারা ইংরাজের সহায়তা ভিক্ষা করিয়াছিলেন। পলাশীর যুদ্ধ এবং গুর্খা কর্ত্তৃক নেপাল জয় প্রায় সমসাময়িক ঘটনা। ক্যাপটেন নক্স কাটমণ্ডুতে গিয়া নেপালরাজের সহিত বন্ধুতা সূত্রে আবদ্ধ হইতে চেষ্টা করিয়া বিফল মনােরথ হইয়া প্রত্যাবর্ত্তন করেন। প্রথমে নেপালীরা ব্রিটীশ গবর্ণমেণ্টকে অবজ্ঞার চক্ষে দর্শন করিত। শিখদিগের সহিত যুদ্ধের সময়, আফগানিস্থানের দুর্ঘটনায় তাহারা অত্যন্ত উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়াছিল। ১৮১৬ খ্রীষ্টাব্দের যুদ্ধের পর নেপালীদিগের চৈতন্যের উদয় হয়। ভীমসেন থাপাই একথা স্পষ্টাক্ষরে স্বজাতিকে বুঝাইয়া বলেন, যে স্বাধীনতা রক্ষার একমাত্র উপায় ইংরাজের সহিত কোন প্রকার সংঘর্ষণ উপস্থিত না করা। কাটমণ্ডুতে যে ইংরাজ রেসিডেণ্ট বাস করেন তিনি নেপালরাজ্যের আভ্যন্তরীন কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতে পারেন না। কাটমণ্ডু বাসকালে তাঁহার গতিবিধি সমুদায় রাজমন্ত্রী নিয়মিত করিয়া দিয়াছেন। রেসিডেণ্টের সহিত সকল রাজমন্ত্রী বন্ধুতা রক্ষা করিয়া চলেন বলিয়া রাজ্যশাসন সংক্রান্ত কোন বিষয়ে তিনি হস্তক্ষেপ করেন না। এই সর্ত্ত হেতু ইংরাজ রেসিডেণ্টের চক্ষের সমক্ষে নেপালে কতবার কত বিপ্লব কত হত্যাকাণ্ড, সংঘটিত হইল? এতাবৎকাল নেপালে অনেক সুবিখ্যাত ব্যক্তি রেসিডেণ্টের পদে অভিষিক্ত হইয়াছেন। ইঁহাদিগের মধ্যে সুবিখ্যাত হডসন সাহেব একজন প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি প্রায় ২৫ বৎসর কাল কাটমণ্ডুতে বাস করিয়া নেপালের পুরাবৃত্ত সংগ্রহ করিয়াছিলেন। তিনি এই কার্য্যে কত যে অর্থব্যয় করিয়াছিলেন তাহা বলা যায় না। নেপালের চতুর্দ্দিক হইতে অর্থব্যয় করিয়া কত শত শত পুস্তক সংগ্রহ করিয়া লইয়া গিয়াছেন। আজও তাহা লণ্ডনে সযত্নে রক্ষিত আছে। রেসিডেণ্টের সঙ্গে একজন ইংরাজ চিকিৎসক কাটমণ্ডুতে থাকেন। ডাক্তার রাইট (Wright) ডাক্তার ওলড্ ফিল্ড (Old Field) কত যত্ন পূর্ব্বক নেপাল সম্বন্ধে কত ঐতিহাসিক তত্ত্ব সংগ্রহ করিয়াছেন। ইঁহাদিগেরই পুস্তক হইতে নেপাল ইতিহাস সংগৃহীত হইয়াছে। এই সকল গুণ ইঁহাদের জাতীয় মহত্ত্বের পরিচায়ক সন্দেহ নাই। কাটমণ্ডুর বর্ত্তমান রেসিডেণ্ট মেজর ম্যানার স্মিথ্ (Major Manner Smith) অতি উপযুক্ত ব্যক্তি। নেপালের নেপালের চতুর্দ্দিকেই এখন শান্তি এবং সমৃদ্ধির চিহ্ন দেখা যাইতেছে। নেপালের ভূতপূর্ব্ব রাজাধিরাজ পৃথ্বীবীর বিক্রম এবং বর্ত্তমান শিশু নৃপতি ত্রিভুবন বিক্রমশাহের প্রতিমূর্ত্তি এখানে সন্নিবিষ্ট হইল। এই শিশু নেপাল রাজের দীর্ঘজীবন এবং নেপালের সর্ব্বাঙ্গীন কল্যান কামনা করিয়া গ্রন্থের উপসংহার করি।