বিষয়বস্তুতে চলুন

নেপালে বঙ্গনারী/নেপালে বৌদ্ধ ধর্ম্ম

উইকিসংকলন থেকে

নেপালে বৌদ্ধধর্ম্ম।

 শাক্যসিংহের জীবদ্দশায় কিম্বা তাঁহার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই নেপালে বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচারিত হয়। যে কুশীনগরে তিনি দেহত্যাগ করেন, তাহা নেপালের অন্তর্গত ছিল, ইহাও অনেকে প্রমাণ করিতে আয়াস করিয়াছেন। কুশীনগর নেপালের অন্তর্গত ছিল কি না তা নিশ্চিত প্রমাণীকৃত না হইলেও, শুদ্ধোদনের রাজ্য যে নেপালের পাদদেশ পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল তাহাতে আর সন্দেহ নাই। যেখানে শাক্যসিংহ ভূমিষ্ঠ হন তথা হইতে নেপাল বহুদূর নয়, সুতরাং নেওয়ারদিগের কিম্বদন্তী অনুসারে শাক্যসিংহ সে রাজ্যে পদার্পণ করিয়াছিলেন তাহা অবিশ্বাস করিবার বিশেষ কোন কারণ নাই।

 বর্ত্তমান সময়ে নেপালের অধিবাসীদিগের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ বৌদ্ধ, অবশিষ্ট হিন্দু। হিমাচলের ক্রোড়স্থ অধিকাংশ পার্ব্বত্য রাজ্যসমূহে—যথা নেপাল, সিকিম, ভুটান প্রভৃতি দেশে বৌদ্ধধর্ম্মই লৌকিক ধর্ম্ম। কিন্তু নেপালের বৌদ্ধধর্ম্মের যে বিশেষত্ব দেখিতে পাওয়া যায় তিব্বত, চীন, জাপান, সিংহল প্রভৃতি অপর কোন দেশে প্রচলিত বৌদ্ধধর্ম্মের সহিত ইহার তেমন সৌসাদৃশ্য নাই। হিন্দুধর্ম্মের সহিত অপূর্ব্ব সংমিশ্রণে ইহা এক অপূর্ব্ব বেশ ধারণ করিয়াছে। অতি পুরাকাল হইতে বর্ত্তমান সময় পর্য্যন্ত নেপালে ভারতবর্ষ হইতে নানাবিধ সম্প্রদায়ের লোক আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। সেই সঙ্গে অনেক ধর্ম্মমত, অনেক প্রকার আচার ব্যবহার এই দেশে প্রচারিত হইয়াছে। শুধু প্রচারিত হওয়া নয়, সর্ব্বধর্ম্মের এবং সর্ব্বজাতির এক অপূর্ব্ব সংমিশ্রণ ঘটিয়াছে। বৌদ্ধ নেওয়ারগণের সহিত নেপালের আশ্রিত হিন্দুগণ বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হইয়া পড়েন এবং সেই সঙ্গে বৌদ্ধগণ অজ্ঞাতসারে হিন্দুভাবাপন্ন হইয়া পড়িয়াছেন। নেওয়ারদিগের ভিতর দুইটি সম্প্রদায় আছে,—বৌদ্ধমার্গী এবং শিবমার্গী। শিবমার্গিগণ প্রকৃত পক্ষে হিন্দু। গুর্খাগণের আগমনের পূর্ব্বেই নেপালে এই উভয় সম্প্রদায় ছিল। নেওয়ার রাজাগণ সকলেই প্রায় হিন্দু ছিলেন। তাঁহারা বৌদ্ধ প্রজাদিগের ধর্ম্মে কখন হস্তক্ষেপ করেন নাই, বরং অনেক সাহায্য; তথাপি হিন্দু প্রজাগণই যে অধিকতর অনুগ্রহ এবং সহায়তা লাভ করিতেন, তাহাতে সংশয় নাই। বর্ত্তমান গুর্খারাজগণ বৌদ্ধপ্রজাদিগের ধর্ম্মে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করেন না বটে, কিন্তু তাঁহারা তাহাদের ধর্ম্ম অতি অবজ্ঞার চক্ষে দর্শন করেন; সুতরাং কি পুরাকালে কি বর্ত্তমান সময়ে নেপালের বৌদ্ধগণ কখনই বিশেষভাবে রাজপ্রসাদ লাভে সমর্থ হয় নাই। কেবল এই কারণেই নয়, নেপালের বৌদ্ধগণের দোষেই ঐ ধর্ম্ম এখন তথায় অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত হইয়াছে। যেরূপ লক্ষণ দেখা যাইতেছে তাহাতে বৌদ্ধধর্ম্ম তথায় শীঘ্রই লুপ্তধর্ম্ম হইবে।

 বৌদ্ধদিগের ভিতর দুইটি প্রধান শাখা আছে,—মহাযান বা উত্তরদেশীয়, হীনযান বা দক্ষিণদশীয় মহাযান সম্প্রদায়ই বোধ হয় এই নামের গৌরব স্বয়ং গ্রহণ করিয়াছেন, নতুবা হীনযান সম্প্রদায়ের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম্মের বিশুদ্ধতা অধিক পরিলক্ষিত হয়। নেপালের বৌদ্ধদিগকে মহাযান বলিব কি হীনযান আখ্যা দিব তাহা নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। অশোকের মহিমা এখনও তথায় ঘোষিত হয়, অশোকের প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধমন্দির। সকল এখনও তথায় দণ্ডায়মান আছে; কিন্তু তিব্বতের সহিত নেপালের ধর্ম্মগত এবং বংশগত সৌহৃদ্য অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। নেপালের বৌদ্ধধর্ম্মের আর এক বিশেষত্ব যাহা কুত্রাপি নাই তাহা এখানে আছে। নেপালের বৌদ্ধগণ হিন্দুদিগের ন্যায় বিভিন্ন বর্ণে বিভক্ত। এইরূপ জাতিভেদ তিব্বতেও নাই, চীনেও নাই, সিংহলেও নাই। ইহা নেপালের নেওয়ারগণের মধ্যেই বিবর্ত্তিত হইয়াছে। এই কারণেই নেপালের বৌদ্ধগণকে মহাযান বা হীনযান কোন বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত বলিতে পারিতেছি না। নেপালের বৌদ্ধদিগের ভিতর প্রচলিত বর্ণবিভাগ সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আভাস দিতেছি;—

বর্ণবিভাগ।

 পূর্ব্বে যাহারা ভিক্ষু সন্নাসী—বিহারবাসী ছিল, এখন নেপালের বৌদ্ধদিগের মধ্যে তাহারা ব্রাহ্মণের স্থান অধিকার করিয়াছে; তাহারা “বাঁহরা” নামে অভিহিত হয়। “বন্দ্য” হইতে “বাঁহরা” নামের উৎপত্তি। বৌদ্ধদিগের মধ্যে ইহাই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ জাতি। কিন্তু বর্ত্তমান সময়ে বাঁহরাগণ অনেকস্থলে বিহারবাসী বটে, কিন্তু তাহারা সন্ন্যাসধর্ম্ম বিসর্জন দিয়া ভোগাসক্ত গৃহী হইয়াছে। তাহারা অধিকাংশই আমাদের দেশের সুবর্ণবণিকের কর্ম্মে নিযুক্ত। “অহিংসা পরমোধর্ম্ম” বাদী বৌদ্ধগণের ভিতর ক্ষত্রিয়ের স্থান অধিকার করিবার কোন জাতি নাই। বৈশ্যদিগের মধ্যে দ্বিতীয় জাতি “উদাসী” ইহারা সকলেই প্রায় ব্যবসা বাণিজ্যে লিপ্ত। চীন, জাপান, তিব্বত প্রভৃতি দেশেও ইহারা বাণিজ্যার্থে গমনাগমন করিয়া থাকে। উদাসীগণ নেপালের বৌদ্ধদিগের মধ্যে ধনিশ্রেষ্ঠ।

 ৩। “জাপু”—ইহারা শূদ্রদিগের ন্যায় কৃষিকর্ম্ম দাসবৃত্তি এবং নীচকার্যে লিপ্ত থাকে।

 নেওয়ারদিগের ভিতর এই প্রধান তিনবর্ণ আবার নানা শ্রেণীতে বিভক্ত। উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণের সহিত আহার বিহার আদান প্রদান করে না, করিলে জাতিচ্যুত হয়। এই প্রধান তিন জাতি ভিন্ন আট প্রকার অস্পৃশ্য জাতি আছে। তাহাদিগকে নছুনি জাত বলে, অর্থাৎ তাহাদিগের জলগ্রহণ করা যায় না

 বাঁহরাগণ ১। আরহান ২। ভিক্ষু ৩। শ্রাবক ৪। চৈলাক এই চারিশ্রেণীতে বিভক্ত।

 উদাসীদিগের ভিতর ৭টি শ্রেণী আছে। জাপুগণ ৩০টি শাখায় বিভক্ত।

 নেওয়ারদিগের এই বর্ণবিভাগ যেরূপ বৌদ্ধধর্ম্মকে মলিন এবং নিষ্প্রভ করিয়াছে এমন আর কিছুই নয়। নেপালে বৌদ্ধধর্ম্মের পতনের ইহাই প্রধান কারণ।

ধর্ম্মমত।

 বৌদ্ধদর্শনশাস্ত্র দুইটি প্রধান শাখায় বিভক্ত,—আস্তিক এবং নাস্তিক। এক সম্প্রদায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করে, অন্য সম্প্রদায় আদিবুদ্ধ এই নামে সর্ব্বজ্ঞ সর্ব্বশক্তিমান্ জগতের স্রষ্টাপাতা বিধাতা, পুরুষকে অভিহিত করে। আদিবুদ্ধ অনাদিকাল হইতে শান্তভাবে অবস্থিতি করিতেছেন, অনন্তকাল এই ভাবেই স্থিতি করিবেন। আদিবুদ্ধ স্বয়ম্ভু ভগবান্ আদিবর্ম্ম বা আদি প্রজ্ঞার (জড় শক্তির), সহিত মিলিত হইয়া এই বিচিত্র জগৎ রচনা করিয়াছেন। ইহাই নেপালের বৌদ্ধধর্ম্মের মূল ধর্ম্মমত। ইহারা মানবাত্মার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করে। আদিবুদ্ধের অংশ এবং, সেই সত্তায় বিলীন হওয়াই মুক্তি বলিয়া বিবেচনা করে।

 আদিবুদ্ধ ইচ্ছাক্রমে পঞ্চবুদ্ধের সৃষ্টি করিয়াছেন। আস্তিক নাস্তিক উভয় সম্প্রদায়ই আদিশক্তির ত্রিত্ব স্বীকার করিয়া থাকেন। বৌদ্ধশাস্ত্রে তাহা ত্রিরত্ন নামে অভিহিত, যথা—বুদ্ধ, ধর্ম্ম ও সংঙ্ঘ। এই ত্রিরত্নের মধ্যে আস্তিকেরা বুদ্ধের এবং নাস্তিকেরা ধর্ম্মের প্রাধান্য স্বীকার করিয়া থাকেন। বুদ্ধ প্রাণ শক্তি অথবা চিৎধর্ম্ম জড়শক্তি এবং সঙ্ঘ উভয়ের - মিলন সম্ভুত, এই দৃশ্যমান্ জগৎ, কিন্তু অন্য এক অর্থে সকল সম্প্রদায়ই এই ত্রিরত্নের ব্যাখ্যা করিয়া থাকেন; যথা—বুদ্ধ—শাক্যসিংহ, ধর্ম্ম—তাঁহার বিধি বা শাস্ত্র, সঙ্ঘ, অর্থাৎ সম্প্রদায় বা সাধকদল। এই ত্রিরত্নের সাঙ্কেতিক চিহ্নরূপে নেপালে এবং বৌদ্ধজগতে সর্ব্বত্রই একটি মধ্যবিন্দু সমন্বিত ত্রিকোণ ব্যবহৃত হয়। এই ত্রিকোণের অনেক প্রকার গুহ্যার্থ আছে। সাঙ্কেতিক “ওম্” শব্দে এই ত্রিরত্ন বৌদ্ধজগতে ব্যবহৃত হয়। বৌদ্ধদিগের নিকট “ওম্” এই বাক্যের অর্থ বুদ্ধ, ধর্ম্ম ও সঙ্ঘ। সমুদায় বৌদ্ধজগতে “ওম্ মণিপদ্মে হুম্” বাক্যটি পদ্মপাণির পূজার মন্ত্ররূপে ব্যবহৃত হয়। ইহার প্রকৃত অর্থ লইয়া অনেক মতভেদ দৃষ্ট হয়। কিন্তু নেপালের পূর্ব্বতন রেসিডেণ্ট সুবিখ্যাত হড‍্সন্ সাহেব ইহার এইরূপ অর্থ করিয়াছেন,—“সেই ত্রিরত্নের অন্তরে পদ্ম এবং মণি নিহিত আছে।” পদ্মের মধ্য স্থানে একটি মণি পদ্মপাণির চিহ্ন। পদ্মপাণির বৌদ্ধসঙ্ঘেরই মুর্ত্তি। এই মন্ত্র মহাযান, সম্প্রদায়েরই বিশেষত্ব। সিংহল প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধগণ এ মন্ত্র ব্যবহার করে না। নেপালে এই মন্ত্র সর্ব্বদাই ব্যবহৃত হয়। আস্তিক বৌদ্ধগণ বিশ্বাস করে এক জন্মে না হউক জন্ম জন্মান্তরের পর বিশুদ্ধাত্মা ও নিষ্কাম হইয়া মানবাত্মা পরমাত্মা বা আদিবুদ্ধে বিলীন হইবে। এই জন্মান্তর বিশ্বাস বৌদ্ধধর্ম্মের একটি মূলভাব। এই বিশ্বাসই “অহিংসা পরমোধর্ম্ম” এই বাক্যের প্রণোদক। এই হেতু জীবহিংসা বৌদ্ধশাস্ত্রে একান্ত নিষিদ্ধ। কিন্তু ইহা অপেক্ষা বিস্ময়কর ব্যাপার কি হইতে পারে যে, নেপালের বৌদ্ধগণ অতি নৃশংস উপায়ে সর্ব্বদা জীবহিংসা করিয়া থাকে। বৌদ্ধধর্ম্মের মূলভাব কিরূপে এরূপ ভাবে পদদলিত হয়, ইহাও এক আশ্চর্য্য কথা। বৌদ্ধশাস্ত্রানুসারে পরলোকে স্বর্গভোগের ব্যবস্থা নাই। বৌদ্ধের স্বর্গ নির্ব্বান বা পরমাত্মায় বিলীন হওয়া। এই প্রকার মুক্তজীব বৌদ্ধশাস্ত্রে বুদ্ধ নামে অভিহিত হয়।

বৌদ্ধ দেব দেবীগণ।

 যে ধর্ম্মে কোন প্রকার পূজা অর্চ্চনা স্তব স্তুতির ব্যবস্থা নাই, সেই সাধনশীল ধর্ম্মেও অনেক দেব দেবীর আবির্ভাব হইয়াছে। আদিবুদ্ধ ইচ্ছাক্রমে পঞ্চবুদ্ধের সৃষ্টি করিয়াছেন। ইহাদিগের সহিত আদিবুদ্ধের পিতাপুত্রের সম্বন্ধ। ইঁহারা অমর বুদ্ধ বা দেববুদ্ধ। সে সকল মানবাত্মা স্বীয় চেষ্টায় জন্ম জন্মান্তরের পর নির্ব্বাণ লাভ করিয়াছেন তাঁহারাও মানবীয় বুদ্ধ। ইহারা পূজার্হ বটে, কিন্তু দেবতা নন। মহাযান সম্প্রদায়ভুক্ত বৌদ্ধদিগের মতে শাক্যসিংহ স্বয়ং মানবীয় বুদ্ধদিগের মধ্যে শেষ ব্যক্তি। সেই অবধি অন্য কেহ বুদ্ধত্ব লাভে সক্ষম হন। নাই। নিম্নে আদিবুদ্ধ হইতে যে পঞ্চবুদ্ধ প্রসূত হইয়াছেন তাহাদের তালিকা প্রদত্ত হইল;

আদিবুদ্ধ।
বৈরচনঅশ্বোভরত্নসম্ভূঅমিতাভঅমোঘসিদ্ধ

আদিবুদ্ধের সহিত এই পঞ্চবুদ্ধের পিতা পুত্র সম্বন্ধ।

 বৈরচন যেন জ্যেষ্ঠভ্রাতা—সেই হেতু তিনি এবং চতুর্থ ভ্রাতা অমিতাভ পদ্মপাণির পিতা বলিয়া অধিক পূজা লাভ করেন। এই পঞ্চবুদ্ধ হইতে আবার বোধিসত্ত্বগণ প্রস্তুত হইয়াছেন। এখানেও পঞ্চবুদ্ধের সহিত বোধিসত্ত্বগণের পিতাপুত্র সম্বন্ধ। এই বোধিসত্ত্বগণকে জন্ম দিয়া পঞ্চবুদ্ধ আদিবুদ্ধে লীন হইয়াছেন। এই বোধিসত্ত্বগণই দৃশ্যমান্ জগতের সাক্ষাৎ কর্ত্তা। পঞ্চবুদ্ধের সহিত পত্নীভাবে পঞ্চবুদ্ধ-শক্তি মিলিত হইয়া পঞ্চ বোধিসত্ত্বকে জন্ম দিয়াছেন। নিম্নে পঞ্চবুদ্ধ, বুদ্ধশক্তি এবং পঞ্চ বোধিসত্ত্বের তালিকা প্রদত্ত হইল;—

 ১। বৈরচন+বজ্রদন্তেশ্বরী—সামন্ত ভদ্র

 ২। অশ্বোভ+লোচনী—বজ্রপাণি

 ৩। রত্নসম্ভব+মামুখী—রত্নপাণি

 ৪। অমিতাভ+ পানদারা—পদ্মপাণি

 ৫। অমোঘসিদ্ধ+তারা—বিশ্বপাণি

 ৬। ব্রজসত্ত্ব+বজ্রসত্বামিকা—ঘণ্টাপাণি

 নেপালে যে সকল বৌদ্ধ তান্ত্রিসাধনপ্রণালী গ্রহণ করিয়াছেন তাঁহারা পঞ্চবুদ্ধের সহিত বজ্রসত্ত্ব যুক্ত করিয়াছেন। নেপালের বৌদ্ধদিগের তান্ত্রিকসাধন গ্রহণ হিন্দুধর্ম্মের প্রভাবের অন্যতম প্রমাণ। তান্ত্রিকসাধনের সর্ব্বপ্রকার কুৎসিৎ অশ্লীলভাবও তাহারা গ্রহণ করিয়াছে কিন্তু গোপনভাবে এ সাধন সম্পন্ন হয় বলিয়া কদাচ কাহারো চক্ষে পড়ে না।

 এই পঞ্চবুদ্ধ ভিন্ন সাতজন মানবীয় বুদ্ধ আছেন; তন্মধ্যে শাক্যসিংহ শেষ।

 নেপালের বৌদ্ধাদগের মতে প্রথম তিন দেববুদ্ধ কার্য্যসমাধান করিয়া আদিবুদ্ধে বিলীন হইয়াছেন। চতুর্থ বুদ্ধ অমিতাভের পুত্র পদ্মপাণি মৎস্যেন্দ্রনাথের উপর বর্ত্তমান জগতের ভার পড়িয়াছে। তিনি ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর প্রভৃতি দেব দেবীগণের সাহায্যে জগতের তাবৎ কার্য্য পরিচালিত করিতেছেন। এইজন্য পদ্মপাণি মৎস্যেন্দ্রনাথের নেপালের নেওয়ারদিগের নিকট এতাদৃশ সম্মান। অন্য সকল বুদ্ধ কেবল নামমাত্র আছেন; পদ্মপাণিই সর্ব্বত্র পূজিত হয়েন। পদ্মপাণির কার্য্য সমাধা হইলে তিনিও আদিবুদ্ধে লীন। হইবেন।

 নেপালের নেওয়ারগণ মানবীয় বুদ্ধ ব্যতীত অন্যান্য মানবীয় বোধিসত্ত্বের পূজা করিয়া থাকেন। এই সকল মানবীয় বোধিসত্ত্বের মানবীয় বুদ্ধের সহিত পিতাপুত্রের সম্বন্ধ না হইয়া গুরুশিষ্যের সম্বন্ধ। যে মহাত্মা চীন হইতে আগমন করিয়া নেপালে বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচার করিয়াছিলেন, সেই মাঞ্জুশ্রী এই শ্রেণীর বোধিসত্ত্ব। নেপালে মাঞ্জুশ্রীর অনেক মন্দির আছে; এবং পদ্মপাণির পরেই নেওয়ারদিগের হৃদয়ে ইহার আসন। এই সকল মানবীয় বোধিসত্ত্বের নিম্নে আবার এক শ্রেণীর মানব আছেন যাঁহারা বিশুদ্ধ জ্ঞান, কঠোর সাধনা এবং পবিত্র জীবনদ্বারা বুদ্ধত্ব লাভ করিয়াছেন। তাঁহারা কেহ বা জীবিত আছেন, কেহ বা গতাসু হইয়াছেন। তিব্বতের লামাগণ এই শ্রেণীভুক্ত। তাঁহারা বুদ্ধের অবতার বলিয়া পূজিত হয়েন, কিন্তু লামাদিগের অবতারবাদ প্রকৃত বৌদ্ধশাস্ত্র মতে অসম্ভব ব্যাপার; কারণ, প্রকৃত বুদ্ধত্ব লাভ করিলে বা আদিবুদ্ধে লীন হইলে আর জন্মগ্রহণ সম্ভব নয়। কিন্তু বৌদ্ধগণ অন্য ভাবে লামাদিগের বুদ্ধত্ব প্রমাণ করিয়া থাকেন। তাঁহারা বলেন, মানবজাতির উপকারের জন্য যে সকল বোধিসত্ত্ব বারম্বর জন্মগ্রহণ করিয়া থাকেন লামাগণ সেই শ্রেণীর অবতার। নেপালে তিব্বতের লামার বিশেষ সম্মান আছে বটে, কিন্তু তাঁহার সহিত ঐ দেশের বিশেষ কোন সম্বন্ধ নাই।

নেপালের বৌদ্ধশাস্ত্র।

 তিব্বতের ন্যায় নেপালে বিস্তর প্রাচীন বৌদ্ধধর্ম্ম গ্রন্থ পাওয়া পাওয়া যায়। হড‍্সন্ সাহেব বিস্তর ধর্ম্মগ্রন্থ সংগ্রহ করিয়াছিলেন। এই সকল গ্রন্থ অধিকাংশই সংস্কৃত ভাষায় রচিত। নেপালের নেওয়ারদিগের দ্বারা এ সকল গ্রন্থ রচিত হয় নাই। তিব্বত হইতে আগত কোন লামা বা ভারতবর্ষ হইতে ধর্ম্মপ্রচারার্থ সমাগত সাধু মহাত্মাদিগের দ্বারা রচিত হইয়াছিল। এই সকল গ্রন্থ হইতে অনেক জ্ঞাতব্য বিষয় সংগ্রহ করা যাইতে পারে। দুঃখের বিষয় শঙ্কারাচার্য্য বিস্তর বৌদ্ধধর্ম্ম গ্রন্থ নেপালে দগ্ধ করিয়াছিলেন। অনুসন্ধান করিলে নেপালের চতুর্দ্দিকে এই সকল গ্রন্থ আজও পাওয়া যায়। গৃহস্থ এই সকল গ্রন্থ অত্যন্ত যত্নে রক্ষা করে। গৃহে অগ্নি লাগিলে সর্ব্বস্ব ত্যাগ করিয়া গ্রন্থ বুকে করিয়া পলাইয়া যায় এবং এই কারণেই এখনও নেপালে বৌদ্ধগ্রন্থ বিনষ্ট হয় নাই।

ধর্ম্মশাসন।

 তিব্বতের লামার ন্যায় নেপালের বৌদ্ধদিগের উপর কোন ব্যক্তিবিশেষের অপ্রতিহত শক্তি নাই। গুর্খারাজগুরু তাহাদিগের বর্ণসম্বন্ধীয় সমুদায় বিবাদ বিসম্বাদের মীমাংসা করিয়া থাকেন। ধর্ম্মসম্বন্ধীয় সমুদায় মীমাংসা বাহরাগণ সম্মিলিত ভাবে করিয়া থাকেন। সামাজিক নিয়ম লঙ্ঘন করিলে সামাজিক ভাবে তাহার প্রতিবিধান হইয়া থাকে; ইহাকে নেওয়ারগণ “গতি” বলে। কয়েকটি বিশেষ বিশেষ নিয়মানুসারে ইহা পরিচালিত হইয়া থাকে।

 ১। প্রত্যেক গৃহস্থকে একটি নির্দ্দিষ্ট সময়ে স্বজাতীয়গণকে ভোজ দিতে হয়। ইহা অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য ব্যাপার হইলেও ইহার অন্যথা হইবার নহে।

 ২। স্বজাতি কাহারও মৃত্যু হইলে প্রত্যেক পরিবার হইতে এক একজন ব্যক্তিকে মৃতের সৎকার এবং শ্রাদ্ধাদিতে যোগ দিতে হয়।

 গতির নিয়ম অগ্রাহ্য করিলে অর্থদণ্ড হইয়া থাকে। গুরুতর সামাজিক অপরাধ করিলে তাহাকে জাতিচ্যুত করা হয়। জাতিচ্যুতকে আত্মীয় স্বজন পর্যন্ত ত্যাগ করে। তাহার মৃতদেহের সৎকার কেহ করে না। ইহা অপেক্ষা গুরুতর শাস্তি আর কি হইতে পারে? সুতরাং নেওয়ারদিগের ভিতর সামাজিক শাসনের নিয়ম নিতান্ত শিথিল নহে।