পঞ্চক মালা/জীবন

উইকিসংকলন থেকে
জীবন।
১। গ্রন্থ।
(১)

সুদৃঢ় গৌরবে বাঁধা গ্রন্থ মনোহর;
সম্পদের স্বর্ণজলে নামের অক্ষর
দীপ্ত তাহে। লুব্ধ মনে আগ্রহের ভরে
তুলিয়া লইনু গ্রন্থ কোলের উপরে।

উদঘাটিতে জীবনের সুসম্বন্ধ খাতা।—
দুঃখ কাহিনীর এক কোণাভাঙ্গা পাতা
প্রথমে সম্মুখে মোর পড়িল খুলিয়া।
এ স্মারক চিহ্নে যাই গৌরব ভুলিয়া।

(২)


লিখেছিনু বসি বসি যত্নে অযতনে—
কভূ স্বপ্নদৃষ্ট কথা; কিম্বা জাগরণে
অনুভূত বিষাদের ছোট ছোট গাথা,
কুড়ায়ে কুড়ায়ে পথে যত ছেঁড়া পাতা।

এত ছিন্ন, তবু তারা আছে সুসজ্জিত,
দেব-আশীর্বাদ-সূত্রে একত্র গ্রথিত।
তোমারি চরণতলে লহ দেব, টানি—
তোমারি করুণা-পূত ছিন্ন গ্রন্থখানি।

২। সুখ।
(১)

শ্রম-খিন্ন হয় তনু উৎসব-পরবে;
উৎকণ্ঠায় কাটে দিন, লভিতে গরবে
সকলের পুরোভাগে আসন সুন্দর।
উৎসাহের অভিনয়ে কম্পিত অন্তর।

সযত্নে উৎসব-অন্তে শুষ্ক পুষ্পগুলি,
নৃত্য সঙ্গীতের স্মৃতি সহ রাখি তুলি।
সদ্যজাত বেদনার বাসি-অনুভবে,
পরম সম্ভোগ সুখ জীবন-পরবে।

(২)


ঘুরিয়া আবর্ত্ত-চক্রে হের স্রোতস্বতী
আছাড়িছে অঙ্গখানি উপল-বিষমে;
বহিয়া বর্দ্ধিত বেগে, তাহে সেই নদী
সংগ্রহিছে নবশক্তি আঘাত ভীষণে।

আছাড়িয়া পড়ি মোরা কর্ম্ম-শিলাপরে,
বুদ্ধুদ তুলিয়া দুঃখ মরে কলকলে;
জীবন-বাহিনী বহে উচ্ছ্বাসের ভরে।
আঘাত-গৌরবে সুখ জাগে নব বলে।

৩। কীর্ত্তি।
(১)

“কীর্ত্তিমান চিরজীবী”। মরণের পরে
লেখা থাকে যদি নাম, অক্ষয় অক্ষরে —
আমার অক্ষরময়ী কীর্ত্তির ফলকে!
আলোকের বর্ণে নর-নয়নে ঝলকে
নিত্য যদি সেই লিপি!
“ঠিক তাই হবে।”
সমালোচকেরা মোরে কহিলেন সবে।
রাবে পরাজিয়া মুতু্য, কীর্ত্তির পাষাণ;
মৃত্যু আলিঙ্গিয়া মোর হবে অবসান।

(২)

“অতীতের অশ্রুহাসি গাঁথিয়া মালায়
গলে পরি আসি মোরা নবীন ধারায়।
আমাদের বিষাদের আনন্দের গাথা,
ভবিষ্যৎ মহাকাব্যে রবে সব গাঁথা।

জীবন যাঁহার কীর্ত্তি, সেই কীর্ত্তিমান—
এ যুগের ভিত্তি-পরে বিশাল মাহান
রচিবেন মহা সৌধ, নবীন ভুবনে।
কালজয়ী হব মোরা কালের জীবনে।

৪। আশ।
(১)

“জীবনের পরে আছে নবীন জীবন।
“উৎকণ্ঠার নিদ্রা আর যাতনা স্বপন,
“ক্লান্তিপূর্ণ জাগরণ, লভিবে বিরাম;
“পাবে অভিমত তৃপ্তি ক্ষুব্ধ এ পরাণ।”

মৃত্যুর ভীষণ পুরী অন্ধকার কারা;
নিরুদ্ধ পবনে কণ্ঠ শ্বসি হয় সারা।
বিবর্ণ সুবর্ণ কান্তি মলিন ছায়ায়।
দীপ্ত হবে আশা তথা আলোক-আভায়?

(২)


যুগ যুগান্তের পরে ভূস্তরে রক্ষিত
অস্থিকণা হবে মোর যত্নে পরীক্ষিত,
গণিতে কালের আয়, নরতত্ত্ব কথা।:—
দুর্ব্বোধ্য হইবে যবে মানব-সভ্যতা।

কোথা রবে প্রেম মোর, অস্থি যার দেহ?
কোথা রবে আমি মোর, প্রেম যার গেহ?
পাষাণের বিশ্ব হবে শ্মশানে অক্ষয়!
লভিবে নির্ব্বাণ শুধু প্রাণ প্রেমময়?

৫। সাধনা।
(১)

যতনে দুহাতে মুছি’ অঙ্গ হতে কালী,
করি কলঙ্কিত মোর করতল খালি।
প্রক্ষালিতে হস্ত, ঢালি অনুতাপ-জল;
ধূলায় জনমে। তাহে কর্দ্দম কেবল।

উজ্জ্বল বিমল পুণ্য শুভ্র অনিবার।
কোথা সে তাপস ঋদ্ধি —সিদ্ধি সাধনার?
ধূলি-বিনিময়ে মোরা সাধনার নামে
ধূলা মাঝে লভি পঙ্ক এ জগত-ধামে।

(২)

হাসি খেলা, ভালবাসা, আনন্দের গান,
রোদন, বিরাগ, ক্রোধ, কিম্বা অভিমান,
সাগরে তরঙ্গসম মথিয়া জীবন,
তুলিয়া গরল, তাহে করিছে সৃজন
দেবতা-বাঞ্ছিত সুধা পরাণে পরাণে;
অমরত্ব লাভে নর সে অমৃত পানে।

জনমি জীবন মাঝে সহজ সাধনা,
আপনি সৃজিছে সুখ, বিনাশি যাতনা।