পঞ্চভূত/নরনারী

উইকিসংকলন থেকে


নরনারী


 সমীর এক সমস্যা উত্থাপিত করিলেন। তিনি বলিলেন, ‘ইংরাজি সাহিত্যে গদ্য অথবা পদ্য কাব্যে নায়ক এবং নায়িকা উভয়েরই মাহাত্ম্য পরিস্ফুট হইতে দেখা যায়। ডেস্‌ডিমোনার নিকট ওথেলো এবং ইয়াগো কিছুমাত্র হীনপ্রভ নহে; ক্লিয়োপাট্রা আপনার শ্যামল বঙ্কিম বন্ধনজালে অ্যাণ্টনিকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছে বটে, কিন্তু তথাপি লতাপাশবিজড়িত ভগ্ন জয়স্তম্ভের ন্যায় অ্যাণ্টনির উচ্চতা সর্বসমক্ষে দৃশ্যমান রহিয়াছে। লামার্মুরের নায়িকা আপনার সকরুণ সরল মুকুমার সৌন্দর্যে যতই আমাদের মনোহরণ করুক না কেন, রেভ্‌নস্বুডের বিষাদঘনঘোর নায়কের নিকট হইতে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া লইতে পারে না। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে দেখা যায় নায়িকারই প্রাধান্য। কুন্দনন্দিনী এবং সূর্যমুখীর নিকট নগেন্দ্র ম্লান হইয়া আছে, রোহিণী এবং ভ্রমরের নিকট গোবিন্দলাল অদৃশ্যপ্রায়, জ্যোতির্ময়ী কপালকুণ্ডলার পার্শ্বে নবকুমার ক্ষীণতম উপগ্রহের ন্যায়। প্রাচীন বাংলা কাব্যেও দেখো। বিদ্যাসুন্দরের মধ্যে সজীব মূর্তি যদি কাহারও থাকে তবে সে কেবল বিদ্যার ও মালিনীর, সুন্দর-চরিত্রে পদার্থের লেশমাত্র নাই। কবিকঙ্কণ-চণ্ডীর সুবৃহৎ সমভূমির মধ্যে কেবল ফুল্লরা এবং খুল্লনা একটু নড়িয়া বেড়ায়, নতুবা ব্যাধটা একটা বিকৃত বৃহৎ স্থাণুমাত্র এবং ধনপতি ও তাঁহার পুত্র কোনো কাজের নহে। বঙ্গসাহিত্যে পুরুষ মহাদেবের ন্যায় নিশ্চল ভাবে ধুলিশয়ান এবং রমণী তাহার বক্ষের উপর জাগ্রত জীবন্ত ভাবে বিরাজমান। ইহার কারণ কী?'

 সমীরের এই প্রশ্নের উত্তর শুনিবার জন্য স্রোতস্বিনী অত্যন্ত কৌতূহলী হইয়া উঠিলেন এবং দীপ্তি নিতান্ত অমনোযোগের ভাণ করিয়া টেবিলের উপর একটা গ্রন্থ খুলিয়া তাহার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া রাখিলেন।  ক্ষিতি কহিলেন, ‘তুমি বঙ্কিমবাবুর যে কয়েকখানি উপন্যাসের উল্লেখ করিয়াছ সকলগুলিই মানসপ্রধান, কার্যপ্রধান নহে। মানসজগতে স্ত্রীলোকের প্রভাব অধিক, কার্যজগতে পুরুষের প্রভুত্ব। যেখানে কেবলমাত্র হৃদয়বৃত্তির কথা সেখানে পুরুষ স্ত্রীলোকের সহিত পারিয়া উঠিবে কেন। কার্যক্ষেত্রেই তাহার চরিত্রের যথার্থ বিকাশ হয়।’

 দীপ্তি আর থাকিতে পারিল না; গ্রন্থ ফেলিয়া এবং ঔদাসীন্যের ভাণ পরিহার করিয়া বলিয়া উঠিল, ‘কেন। দুর্গেশনন্দিনীতে বিমলার চরিত্র কি কার্যেই বিকশিত হয় নাই। এমন নৈপুণ্য, এমন তৎপরতা, এমন অধ্যবসায় উক্ত উপন্যাসের কয় জন নায়ক দেখাইতে পারিয়াছে। আনন্দমঠ তো কার্যপ্রধান উপন্যাস। সত্যানন্দ জীবানন্দ ভবানন্দ প্রভৃতি সন্তানসম্প্রদায় তাহাতে কাজ করিয়াছে বটে, কিন্তু তাহা কবির বর্ণনামাত্র; যদি কাহারও চরিত্রের মধ্যে যথার্থ কার্যকারিতা পরিস্ফুট হইয়া থাকে তাহা শান্তির। দেবীচৌধুরানীতে কে কর্তৃত্বপদ লইয়াছে। রমণী। কিন্তু সে কি অন্তঃপুরের কর্তৃত্ব। নহে।”

 সমীর কহিলেন, ‘ভাই ক্ষিতি, তর্কশাস্ত্রের সরল রেখার দ্বারা সমস্ত জিনিসকে পরিপাটি রূপে শ্রেণীবিভক্ত করা যায় না। শতরঞ্চ-ফলকেই ঠিক লাল কালো রঙের সমান ছক কাটিয়া ঘর আঁকিয়া দেওয়া যায়, কারণ তাহা নির্জীব কাষ্ঠমূর্তির রঙ্গভূমি মাত্র; কিন্তু মনুষ্যচরিত্র বড়ো সিধা জিনিস নহে। তুমি যুক্তিবলে ভাবপ্রধান কর্মপ্রধান প্রভৃতি তাহার যেমনই অকাট্য সীমা নির্ণয় করিয়া দেও না কেন, বিপুল সংসারের বিচিত্র কার্যক্ষেত্রে সমস্তই উলট-পালট হইয়া যায়। সমাজের লৌহকটাহের নিম্নে যদি জীবনের অগ্নি না জ্বলিত, তবে মনুষ্যের শ্রেণীবিভাগ ঠিক সমান অটল ভাবে থাকিত। কিন্তু জীবনশিখা যখন প্রদীপ্ত হইয়া উঠে, তখন টগ্‌বগ্‌ করিয়া সমস্ত মানবচরিত্র ফুটিতে থাকে, তখন নব নব বিস্ময়জনক বৈচিত্র্যের আর সীমা থাকে না। সাহিত্য সেই পরিবর্ত্যমান মানবজগতের চঞ্চল প্রতিবিম্ব। তাহাকে সমালোচনাশাস্ত্রের বিশেষণ দিয়া বাঁধিবার চেষ্টা মিথ্যা। হৃদয়বৃত্তিতে স্ত্রীলোকই শ্রেষ্ঠ এমন কেহ লিখিয়া পড়িয়া দিতে পারে না। ওথেলো তো মানসপ্রধান নাটক, কিন্তু তাহাতে নায়কের হৃদয়াবেগের প্রবলতা কী প্রচণ্ড। কিং লিয়ারে হৃদয়ের ঝটিকা কী ভয়ংকর!’

 ব্যোম সহসা অধীর হইয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘আহা, তোমরা বৃথা তর্ক করিতেছ। যদি গভীর ভাবে চিন্তা করিয়া দেখ, তবে দেখিবে কার্যই স্ত্রীলোকের। কার্যক্ষেত্র ব্যতীত স্ত্রীলোকের অন্যত্র স্থান নাই। যথার্থ পুরুষ যোগী, উদাসীন, নির্জনবাসী। ক্যাল্‌ডিয়ার মরুক্ষেত্রের মধ্যে পড়িয়া পড়িয়া মেষপাল পুরুষ যখন একাকী উর্দ্ধেনেত্রে নিশীথগগনের গ্রহতারকার গতিবিধি নির্ণয় করিত, তখন সে কী সুখ পাইত! কোন্‌ নারী এমন অকাজে কালক্ষেপ করিতে পারে। যে জ্ঞান কোনো কার্যে লাগিবে না কোন নারী তাহার জন্য জীবন ব্যয় করে। যে ধ্যান কেবলমাত্র সংসারনির্মুক্ত আত্মার বিশুদ্ধ আনন্দ-জনক, কোন্‌ রমণীর কাছে তাহার মূল্য আছে। ক্ষিতির কথামতো পুরুষ যদি যথার্থ কার্যশীল হইত তবে মহাসমাজের এমন উন্নতি হইত না— তবে একটি নূতন তত্ত্ব, একটি নূতন ভাব বাহির হইত না। নির্জনের মধ্যে, অবসরের মধ্যে জ্ঞানের প্রকাশ— ভাবের আবির্ভাব। যথার্থ পুরুষ সর্বদাই সেই নির্লিপ্ত নির্জনতার মধ্যে থাকে। কার্যবীর নেপোলিয়ানও কখনোই আপনার কার্যের মধ্যে সংলিপ্ত হইয়া থাকিতেন না; তিনি যখন যেখানেই থাকুন একটা মহানির্জনে আপন ভাবাকাশের দ্বারা বেষ্টিত হইয়া থাকিতেন, তিনি সর্বদাই আপনার একটা মস্ত আইডিয়ার দ্বারা পরিরক্ষিত হইয়া তুমুল কার্যক্ষেত্রের মাঝখানেও বিজনবাস যাপন করিতেন। ভীষ্ম তো কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের একজন নায়ক কিন্তু সেই ভীষণ জনসংঘাতের মধ্যেও তাঁহার মতো একক প্রাণী আর কে ছিল। তিনি কি কাজ করিতেছিলেন না ধ্যান করিতেছিলেন। স্ত্রীলোকই যথার্থ কাজ করে। তাহার কাজের মাঝখানে কোনো ব্যবধান নাই। সে একেবারে কাজের মধ্যে লিপ্ত, জড়িত। সেই যথার্থ লোকালয়ে বাস করে, সংসার রক্ষা করে। স্ত্রীলোকই যথার্থ সম্পূর্ণরূপে সঙ্গদান করিতে পারে; তাহার যেন অব্যবহিত স্পর্শ পাওয়া যায়, সে স্বতন্ত্র হইয়া থাকে না।’

 দীপ্তি কহিল, ‘তোমার সমস্ত সৃষ্টিছাড়া কথা— কিছুই বুঝিবার জো নাই। মেয়েরা যে কাজ করিতে পারে না এ কথা আমি বলি না, তোমরা তাহাদের কাজ করিতে দাও কই।’

 ব্যোম কহিলেন, ‘স্ত্রীলোকেরা আপনার কর্মবন্ধনে আপনি বদ্ধ হইয়া পড়িয়াছে। জ্বলন্ত অঙ্গার যেমন আপনার ভস্ম আপনি সঞ্চয় করে, নারী তেমনি আপনার স্তূপাকার কার্যাবশেষের দ্বারা আপনাকে নিহিত করিয়া ফেলে; সেই তাহার অন্তঃপুর, তাহার চারি দিকে কোনো অবসর নাই। তাহাকে যদি ভস্মমুক্ত করিয়া বহিঃসংসারের কার্যরাশির মধ্যে নিক্ষেপ করা যায় তবে কি কম কাণ্ড হয়। পুরুষের সাধ্য কী তেমন দ্রুতবেগে তেমন তুমুল ব্যাপার করিয়া তুলিতে। পুরুষের কাজ করিতে বিলম্ব হয়; সে এবং তাহার কার্যের মাঝখানে একটা দীর্ঘ পথ থাকে, সে পথ বিস্তর চিন্তার দ্বারা আকীর্ণ। রমণী যদি এক বার বহিবিপ্লবে যোগ দেয়, নিমেষের মধ্যে সমস্ত ধূধূ করিয়া উঠে। এই প্রলয়কারিণী কার্যশক্তিকে সংসার বাঁধিয়া রাখিয়াছে, এই অগ্নিতে কেবল শয়নগৃহের সন্ধ্যাদীপ জ্বলিতেছে, শীতার্ত প্রাণীর শীত নিবারণ ও ক্ষুধার্ত প্রাণীর অন্ন প্রস্তুত হইতেছে। যদি আমাদের সাহিত্যে এই সুন্দরী বহ্নিশিখাগুলির তেজ দীপ্যমান হইয়া থাকে তবে তাহা লইয়া এত তর্ক কিসের জন্য।’  আমি কহিলাম, ‘আমাদের সাহিত্যে স্ত্রীলোক যে প্রাধান্য লাভ করিয়াছে তাহার প্রধান কারণ, আমাদের দেশের স্ত্রীলোক আমাদের দেশের পুরুষের অপেক্ষা অনেক শ্রেষ্ঠ।’

 স্রোতস্বিনীর মুখ ঈষৎ রক্তিম এবং সহাস্য হইয়া উঠিল। দীপ্তি কহিল, ‘এ আবার তোমার বাড়াবাড়ি।’

 বুঝিলাম দীপ্তির ইচ্ছা আমাকে প্রতিবাদ করিয়া স্বজাতির গুণগান বেশি করিয়া শুনিয়া লইবে। আমি তাহাকে সে কথা বলিলাম, এবং কহিলাম, স্ত্রীজাতি স্তুতিবাক্য শুনিতে অত্যন্ত ভালোবাসে। দীপ্তি সবলে মাথা নাড়িয়া কহিল, ‘কখনোই না।’

 স্রোতস্বিনী মৃদু ভাবে কহিল, ‘সে কথা সত্য। অপ্রিয় বাক্য আমাদের কাছে অত্যন্ত অধিক অপ্রিয় এবং প্রিয় বাক্য আমাদের কাছে বড়ো বেশি মধুর।’

 স্রোতস্বিনী রমণী হইলেও সত্য কথা স্বীকার করিতে কুণ্ঠিত হয় না।

 আমি কহিলাম, ‘তাহার একটু কারণ আছে। গ্রন্থকারদের মধ্যে কবি এবং গুণীদের মধ্যে গায়কগণ বিশেষরূপে স্তুতিমিষ্টান্নপ্রিয়। আসল কথা, মনোহরণ করা যাহাদের কাজ, প্রশংসাই তাহাদের কৃতকার্যতাপরিমাপের একমাত্র উপায়। অন্য সমস্ত কার্যফলের নানারূপ প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে, স্তুতিবাদলাভ ছাড়া মনোরঞ্জনের আর কোনো প্রমাণ নাই। সেই জন্য গায়ক প্রত্যেক বার সমের কাছে আসিয়া বাহবা প্রত্যাশা করে। সেই জন্য অনাদর গুণীমাত্রের কাছে এত অধিক অপ্রীতিকর।’

 সমীর কহিলেন, ‘কেবল তাহাই নয়, নিরুৎসাহ মনোহরণকার্যের একটি প্রধান অন্তরায়। শ্রোতার মনকে অগ্রসর দেখিলে তবেই গায়কের মন আপনার সমস্ত ক্ষমতা বিকশিত করিতে পারে। অতএব, স্তুতিবাদ শুদ্ধ যে তাহার পুরস্কার তাহা নহে, তাহার কার্যসাধনের একটি প্রধান অঙ্গ।’

 আমি কহিলাম, ‘স্ত্রীলোকেরও প্রধান কার্য আনন্দ দান করা। তাহার সমস্ত অস্তিত্বকে সংগীত ও কবিতার ন্যায় সম্পূর্ণ সৌন্দর্যময় করিয়া তুলিলে তবে তাহার জীবনের উদ্দেশ্য সাধিত হয়। সেই জন্যই স্ত্রীলোক স্তুতিবাদে বিশেষ আনন্দ লাভ করে। কেবল অহংকার-পরিতৃপ্তির জন্য নহে; তাহাতে সে আপনার জীবনের সার্থকতা অনুভব করে। ক্রটিঅসম্পূর্ণতা দেখাইলে একেবারে তাহাদের মর্মের মূলে গিয়া আঘাত করে। এই জন্য লোকনিন্দা স্ত্রীলোকের নিকট বড়ো ভয়ানক।’

 ক্ষিতি কহিলেন, ‘তুমি যাহা বলিলে দিব্য কবিত্ব করিয়া বলিলে, শুনিতে বেশ লাগিল; কিন্তু আসল কথাটা এই যে, স্ত্রীলোকের কার্যের পরিসর সংকীর্ণ। বৃহৎ দেশে ও বৃহৎ কালে তাহার স্থান নাই। উপস্থিতমতো স্বামীপুত্র আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশীদিগকে সস্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত করিতে পারিলেই তাহার কর্তব্য সাধিত হয়। যাহার জীবনের কার্যক্ষেত্র দূর দেশ ও দূর কালে বিস্তীর্ণ, যাহার কর্মের ফলাফল সকল সময় আশু প্রত্যক্ষগোচর নহে, নিকটের লোকের ও বর্তমান কালের নিন্দাস্তুতির উপর তাহার তেমন একান্ত নির্ভর নহে; সুদূর আশা ও বৃহৎ কল্পনা, অনাদর উপেক্ষা ও নিন্দার মধ্যে ও তাহাকে অবিচলিত বল প্রদান করিতে পারে। লোকনিন্দা লোকস্তুতি সৌভাগ্যগর্ব এবং মান-অভিমানে স্ত্রীলোককে যে এমন বিচলিত করিয়া তোলে তাহার প্রধান কারণ, জীবন লইয়া তাহাদের নগদ কারবার, তাহাদের সমুদায় লাভ লোকসান বর্তমানে; হাতে হাতে যে ফল প্রাপ্ত হয় তাহাই তাহাদের একমাত্র পাওনা; এই জন্য তাহারা কিছু কষাকষি করিয়া আদায় করিতে চায়, এক কানা কড়ি ছাড়িতে চায় না।’  দীপ্তি বিরক্ত হইয়া যুরোপ ও আমেরিকার বড়ো বড়ো বিশ্বহিতৈষিণী রমণীর দৃষ্টান্ত অন্বেষণ করিতে লাগিলেন। স্রোতস্বিনী কহিলেন, ‘বৃহত্ত্ব ও মহত্ত্ব সকল সময়ে এক নহে। আমরা বৃহৎ ক্ষেত্রে কার্য করি না বলিয়া আমাদের কার্যের গৌরব অল্প, এ কথা আমি কিছুতেই মনে করিতে পারি না। পেশী স্নায়ু অস্থিচর্ম বৃহৎ স্থান অধিকার করে, মর্মস্থানটুকু অতি ক্ষুদ্র এবং নিভৃত। আমরা সমস্ত মানবসমাজের সেই মর্মকেন্দ্রে বিরাজ করি। পুরুষ-দেবতাগণ বৃষ মহিষ প্রভৃতি বলবান পশুবাহন আশ্রয় করিয়া ভ্রমণ করেন; স্ত্রী-দেবীগণ হৃদয়শতদলবাসিনী, তাঁহারা একটি বিকশিত ধ্রুব সৌন্দর্যের মাঝখানে পরিপূর্ণ মহিমায় সমাসীন। পৃথিবীতে যদি পুনর্জন্মলাভ করি তবে আমি যেন পুনর্বার নারী হইয়া জন্মগ্রহণ করি। যেন ভিখারি না হইয়া, অন্নপূর্ণা হই। একবার ভাবিয়া দেখো, সমস্ত মানবসংসারের মধ্যে প্রতি দিবসের রোগশোক ক্ষুধাশ্রান্তি কত বৃহৎ, প্রতি মুহূর্তে কর্মচক্রোৎক্ষিপ্ত ধূলিরাশি কত স্তূপাকার হইয়া উঠিতেছে, প্রতি গৃহের রক্ষাকার্য কত অসীমপ্রতিসাধ্য। যদি কোনো প্রসন্নমূর্তি প্রফুল্লমুখী ধৈর্যময়ী লোকবৎসল দেবী প্রতি দিবসের শিয়রে বাস করিয়া তাহার তপ্ত ললাটে স্নিগ্ধ স্পর্শ দান করেন, আপনার কার্যকুশল সুন্দর হস্তের দ্বারা প্রত্যেক মুহূর্ত হইতে তাহার মলিনতা অপনয়ন করেন এবং প্রত্যেক গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া অশ্রান্ত স্নেহে তাহার কল্যাণ ও শাস্তি বিধান করিতে থাকেন, তবে তাঁহার কার্যস্থল সংকীর্ণ বলিয়া তাঁহার মহিমা কে অস্বীকার করিতে পারে। যদি সেই লক্ষ্মীমূর্তির আদর্শখানি হৃদয়ের মধ্যে উজ্জ্বল করিয়া রাখি, তবে নারীজন্মের প্রতি আর অনাদর জন্মিতে পারে না।’

 ইহার পর আমরা সকলেই কিছু ক্ষণ চুপ করিয়া রহিলাম। এই অকস্মাৎ নিস্তব্ধতায় স্রোতস্বিনী অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া উঠিয়া আমাকে বলিলেন, ‘তুমি আমাদের দেশের স্ত্রীলোকের কথা কী বলিতেছিলে— মাঝে হইতে অন্য তর্ক আসিয়া সে কথা চাপা পড়িয়া গেল।’

 আমি কহিলাম, ‘আমি বলিতেছিলাম, আমাদের দেশের স্ত্রীলোকেরা আমাদের পুরুষের চেয়ে অনেক শ্রেষ্ঠ!’

 ক্ষিতি কহিলেন, ‘তাহার প্রমাণ?’

 আমি কহিলাম, ‘প্রমাণ হাতে হাতে। প্রমাণ ঘরে ঘরে। প্রমাণ অন্তরের মধ্যে। পশ্চিমে ভ্রমণ করিবার সময় কোনো কোনো নদী দেখা যায় যাহার অধিকাংশে তপ্ত শুষ্ক বালুকা ধু ধূ করিতেছে, কেবল এক পার্শ্ব দিয়া স্ফটিকস্বচ্ছসলিলা স্নিগ্ধ নদীটি অতি নম্রমধুর স্রোতে প্রবাহিত হইয়া যাইতেছে। সেই দৃশ্য দেখিলে আমাদের সমাজ মনে পড়ে। আমরা অকর্মণ্য, নিস্ফল নিশ্চল বালুকারাশি স্তূপাকার হইয়া পড়িয়া আছি, প্রত্যেক সমীরশ্বাসে হুহু করিয়া উড়িয়া যাইতেছি এবং যে কোনো কীর্তিস্তম্ভ নির্মাণ করিবার চেষ্টা করিতেছি তাহাই দুই দিনে ধসিয়া ধসিয়া পড়িয়া যাইতেছে। আর, আমাদের বাম পার্শ্বে আমাদের রমণীগণ নিম্নপথ দিয়া বিনম্র সেবিকার মতো আপনাকে সংকুচিত করিয়া স্বচ্ছ সুধাস্রোতে প্রবাহিত হইয়া চলিতেছে। তাহাদের এক মুহূর্ত বিরাম নাই। তাহাদের গতি, তাহাদের প্রীতি, তাহাদের সমস্ত জীবন এক ধ্রুব লক্ষ্য ধরিয়া অগ্রসর হইতেছে। আমরা লক্ষ্যহীন, ঐক্যহীন, সহস্রপদতলে দলিত হইয়াও মিলিত হইতে অক্ষম। যে দিকে জলস্রোত, যে দিকে আমাদের নারীগণ, কেবল সেই দিকে সমস্ত শোভা এবং ছায়া এবং সফলতা; এবং যে দিকে আমরা সে দিকে কেবল মরুচাকচিক্য, বিপুল শূন্যতা এবং দগ্ধ দাস্যবৃত্তি। সমীর, তুমি কী বল।’

 সমীর স্রোতস্বিনী ও দীপ্তির প্রতি কটাক্ষপাত করিয়া হাসিয়া কহিলেন, ‘অদ্যকার সভায় নিজেদের অসারতা স্বীকার করিবার দুইটি মূর্তিমতী বাধা বর্তমান। আমি তাঁহাদের নাম করিতে চাহি না। বিশ্বসংসারের মধ্যে বাঙালি পুরুষের আদর কেবল আপন অন্তঃপুরের মধ্যে। সেখানে তিনি কেবলমাত্র প্রভু নহেন, তিনি দেবতা। আমরা যে দেবতা নহি, তৃণ ও মৃত্তিকার পুত্তলিকামাত্র, সে কথা আমাদের উপাসকদের নিকট প্রকাশ করিবার প্রয়োজন কী ভাই। ঐ যে আমাদের মুগ্ধ বিশ্বস্ত ভক্তটি আপন হৃদয়কুঞ্জের সমুদয় বিকশিত সুন্দর পুষ্পগুলি সোনার থালে সাজাইয়া আমাদের চরণতলে আনিয়া উপস্থিত করিয়াছে, ও কোথায় ফিরাইয়া দিব। আমাদিগকে দেবসিংহাসনে বসাইয়া ঐ যে চিরব্রতধারিণী সেবিকাটি আপন নিভৃত নিত্য প্রেমের নির্নিমেষ সন্ধ্যাদীপটি লইয়া আমাদের এই গৌরবহীন মুখের চতুর্দিকে অনন্ত অতৃপ্তি-ভরে শতসহস্র বার প্রদক্ষিণ করাইয়া আরতি করিতেছে, উহার কাছে যদি খুব উচ্চ হইয়া না বসিয়া রহিলাম, নীরবে পূজা না গ্রহণ করিলাম, তবে উহাদেরই বা কোথায় সুখ আর আমাদেরই বা কোথায় সম্মান! যখন ছোটো ছিল, তখন মাটির পুতুল লইয়া এমনি ভাবে খেলা করিত যেন তাহার প্রাণ আছে, যখন বড়ো হইল তখন মানুষ-পুতুল লইয়া এমনি ভাবে পূজা করিতে লাগিল যেন তাহার দেবত্ব আছে। তখন যদি কেহ তাহার খেলার পুতুল ভাঙিয়া দিত তবে কি বালিকা কাঁদিত না। এখন যদি কেহ ইহার পূজার পুতুল ভাঙিয়া দেয় তবে কি রমণী ব্যথিত হয় না। যেখানে মনুষ্যত্বের যথার্থ গৌরব আছে সেখানে মনুষ্যত্বের বিনা ছদ্মবেশে সম্মান আকর্ষণ করিতে পারে, যেখানে মনুষ্যত্বের অভাব সেখানে দেবত্বের আয়োজন করিতে হয়। পৃথিবীতে কোথাও যাহাদের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা নাই তাহারা কি সামান্য মানব-ভাবে স্ত্রীর নিকট সম্মান প্রত্যাশা করিতে পারে। কিন্তু আমরা যে এক-একটি দেবতা, সেই জন্য এমন সুন্দর সুকুমার হৃদয়গুলি লইয়া অসংকোচে আপনার পঙ্কিল চরণের পাদপীঠ নির্মাণ করিতে পারিয়াছি।’  দীপ্তি কহিলেন, ‘যাহার যথার্থ মনুষ্যত্ব আছে সে মানুষ হইয়া দেবতার পূজা গ্রহণ করিতে লজ্জা অনুভব করে, এবং যদি পূজা পায় তবে আপনাকে সেই পূজার যোগ্য করিতে চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায়, পুরুষসম্প্রদায় আপন দেবত্ব লইয়া নির্লজ্জ ভাবে আস্ফালন করে। যাহার যোগ্যতা যত অল্প তাহার আড়ম্বর তত বেশি। আজকাল স্ত্রীদিগকে পতিমাহাত্ম্য পতিপূজা শিখাইবার জন্য পুরুষগণ কায়মনোবাক্যে লাগিয়াছেন। আজকাল নৈবেদ্যের পরিমাণ কিঞ্চিং কমিয়া আসিতেছে বলিয়া তাঁহাদের আশঙ্কা জন্মিতেছে। কিন্তু পত্নীদিগকে পূজা করিতে শিখানো অপেক্ষা পতিদিগকে দেবতা হইতে শিখাইলে কাজে লাগিত। পতিদেবপূজা হ্রাস হইতেছে বলিয়া যাঁহারা আধুনিক স্ত্রীলোকদিগকে পরিহাস করেন, তাঁহাদের যদি লেশমাত্র রসবোধ থাকিত তবে সে বিদ্রূপ ফিরিয়া আসিয়া তাঁহাদের নিজেকে বিদ্ধ করিত। হায় হায়, বাঙালির মেয়ে পূর্বজন্মে কত পুণ্যই করিয়াছিল তাই এমন দেবলোকে আসিয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে! কী বা দেবতার শ্রী! কী বা দেবতার মাহাত্ম্য!’

 স্রোতস্বিনীর পক্ষে ক্রমে অসহ্য হইয়া আসিল। তিনি মাথা নাড়িয়া গম্ভীর ভাবে বলিলেন, ‘তোমরা উত্তরোত্তর সুর এমনি নিখাদে চড়াইতেছ যে, আমাদের স্তবগানের মধ্যে যে মাধুর্যটুকু ছিল তাহা ক্রমেই চলিয়া যাইতেছে। এ কথা যদি বা সত্য হয় যে, আমরা তোমাদের যতটা বাড়াই তোমরা তাহার যোগ্য নহ, তোমরাও কি আমাদিগকে অযথারূপে বাড়াইয়া তুলিতেছ না। তোমরা যদি দেবতা না হও, আমরাও দেবী নহি। আমার যদি উভয়েই আপোষের দেবদেবী হই, তবে আর ঝগড়া করিবার প্রয়োজন কী। তা ছাড়া, আমাদের তো সকল গুণ নাই— হৃদয়মাহাত্ম্যে যদি আমরা শ্রেষ্ঠ হই, মনোমাহাত্ম্যে তো তোমরা বড়ো।’

 আমি কহিলাম, ‘মধুর কণ্ঠস্বরে এই স্নিগ্ধ কথাগুলি বলিয়া তুমি বড়ো ভালো করিলে। নতুবা দীপ্তির বাক্যবাণবর্ষণের পর সত্য কথা বলা দুঃসাধ্য হইয়া উঠিত। দেবী, তোমরা কেবল কবিতার মধ্যে দেবী, মন্দিরের মধ্যে আমরা দেবতা। দেবতার ভোগ যাহা কিছু সে আমাদের, আর তোমাদের জন্য কেবল মনুসংহিতা হইতে দুইখানি কিম্বা আড়াইখানি মাত্র মন্ত্র আছে। তোমরা আমাদের এমনি দেবতা যে, তোমরা যে সুখস্বাস্থ্যসম্পদের অধিকারী এ কথা মুখে উচ্চারণ করিলে হাস্যাস্পদ হইতে হয়। সমগ্র পৃথিবী আমাদের, অবশিষ্ট ভাগ তোমাদের; আহারের বেলা আমরা, উচ্ছিষ্টের বেলা তোমরা। প্রকৃতির শোভা, মুক্ত বায়ু, স্বাস্থ্যকর ভ্রমণ আমাদের; এবং দুর্লভ মানবজন্ম ধারণ করিয়া কেবল গৃহের কোণ, রোগের শয্যা এবং বাতায়নের প্রান্ত তোমাদের। আমরা দেবতা হইয়া সমস্ত পদসেবা পাই এবং তোমরা দেবী হইয়া সমস্ত পদপীড়ন সহ্য কর— প্রণিধান করিয়া দেখিলে এ দুই দেবত্বের মধ্যে প্রভেদ লক্ষিত হইবে।...

 ‘একটা কথা মনে রাখিতে হইবে, বঙ্গদেশে পুরুষের কোনো কাজ নাই। এ দেশে গার্হস্থ্য ছাড়া আর কিছু নাই, সেই গৃহগঠন এবং গৃহবিচ্ছেদ স্ত্রীলোকেই করিয়া থাকে। আমাদের দেশে ভালোমন্দ সমস্ত শক্তি স্ত্রীলোকের হাতে; আমাদের রমণীরা সেই শক্তি চিরকাল চালনা করিয়া আসিয়াছে। একটি ক্ষুদ্র ছিপ্‌ছিপে তক্‌তকে স্ট্রীম্‌নৌকা যেমন বৃহৎ বোঝাই-ভরা গাধা-বোটটাকে স্রোতের অনুকুলে ও প্রতিকূলে টানিয়া লইয়া চলে, তেমনি আমাদের দেশীয় গৃহিণী লোকলৌকিকতা আত্মীয় কুটুম্বিতা পরিপূর্ণ বৃহৎ সংসার এবং স্বামী-নামক একটি চলৎশক্তিরহিত অনাবশ্যক বোঝা পশ্চাতে টানিয়া লইয়া আসিয়াছে। অন্য দেশে পুরুষেরা সন্ধিবিগ্রহ রাজ্যচালনা প্রভৃতি বড়ো বড়ো পুরুষোচিত কার্যে বহু কাল ব্যাপৃত থাকিয়া নারীদের হইতে স্বতন্ত্র একটি প্রকৃতি গঠিত করিয়া তোলে। আমাদের দেশে পুরুষেরা গৃহপালিত, মাতৃলালিত, পত্নীচালিত। কোনো বৃহৎ ভাব, বৃহৎ কার্য, বৃহৎ ক্ষেত্রের মধ্যে তাহাদের জীবনের বিকাশ হয় নাই; অথচ অধীনতার পীড়ন, দাসত্বের হীনতা, দুর্বলতার লাঞ্ছনা তাহাদিগকে নতশিরে সহ্য করিতে হইয়াছে। তাহাদিগকে পুরুষের কোনো কর্তব্য করিতে হয় নাই এবং কাপুরুষের সমস্ত অপমান বহিতে হইয়াছে। সৌভাগ্যক্রমে স্ত্রীলোককে কখনো বাহিরে গিয়া কর্তব্য খুঁজিতে হয় না, তরুশাখায় ফলপুষ্পের মতো কর্তব্য তাহার হাতে আপনি আসিয়া উপস্থিত হয়। সে যখ্‌নি ভালোবাসিতে আরম্ভ করে তখনি তাহার কর্তব্য আরম্ভ হয়; তখনি তাহার চিন্তা বিবেচনা যুক্তি কার্য, তাহার সমস্ত চিত্তবৃত্তি, সজাগ হইয়া উঠে; তাহার সমস্ত চরিত্র উদ্ভিন্ন হইয়া উঠিতে থাকে। বাহিরের কোনো রাষ্ট্রবিপ্লব তাহার কার্যের ব্যাঘাত করে না, তাহার গৌরবের হ্রাস করে না, জাতীয় অধীনতার মধ্যেও তাহার তেজ রক্ষিত হয়।’

 স্রোতস্বিনীর দিকে ফিরিয়া কহিলাম, ‘আজ আমরা একটি নূতন শিক্ষা এবং বিদেশী ইতিহাস হইতে পুরুষকারের নূতন আদর্শ প্রাপ্ত হইয়া বাহিরের কর্মক্ষেত্রের দিকে ধাবিত হইতে চেষ্টা করিতেছি। কিন্তু ভিজা কাষ্ঠ জ্বলে না, মরিচা-ধরা চাকা চলে না; যত জলে তাহার চেয়ে ধোঁয়া বেশি হয়, যত চলে তাহার চেয়ে শব্দ বেশি করে। আমরা চিরদিন অকর্মণ্য ভাবে কেবল দলাদলি কানাকানি হাসাহাসি করিয়াছি, তোমরা চিরকাল তোমাদের কাজ করিয়া আসিয়াছ। এই জন্য শিক্ষা তোমরা যত সহজে যত শীঘ্র গ্রহণ করিতে পার, আপনার আয়ত্ত করিতে পার, তাহাকে আপনার জীবনের মধ্যে প্রবাহিত করিতে পার, আমরা তেমন পারি না।’

 স্রোতস্বিনী অনেক ক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন; তার পর ধীরে ধীরে কহিলেন, ‘যদি বুঝিতে পারিতাম আমাদের কিছু করিবার আছে এবং কী উপায়ে কী কর্তব্যসাধন করা যায়, তাহা হইলে আর কিছু না হউক চেষ্টা করিতে পারিতাম।’

 আমি কহিলাম, ‘আর তো কিছু করিতে হইবে না। যেমন আছ তেমনি থাকো। লোকে দেখিয়া বুঝিতে পারুক, সত্য, সরলতা, শ্রী যদি মূর্তি গ্রহণ করে তবে তাহাকে কেমন দেখিতে হয়। যে গৃহে লক্ষ্মী আছে সে গৃহে বিশৃঙ্খলতা কুশ্রীতা নাই। আজকাল আমরা যে সমস্ত অনুষ্ঠান করিতেছি তাহার মধ্যে লক্ষ্মীর হস্ত নাই এই জন্য তাহার মধ্যে বড়ো বিশৃঙ্খলতা, বড়ো বাড়াবাড়ি— তোমরা শিক্ষিতা নারীরা তোমাদের হৃদয়ের সৌন্দর্য লইয়া যদি এই সমাজের মধ্যে, এই অসংযত কার্যস্তূপের মধ্যে আসিয়া দাঁড়াও তবেই ইহার মধ্যে লক্ষ্মীস্থাপনা হয়; তবে অতি সহজেই সমস্ত শোভন, পরিপাটি এবং সামঞ্জস্যবন্ধ হইয়া আসে।’

 স্রোতস্বিনী আর কিছু না বলিয়া সকৃতজ্ঞ স্নেহদৃষ্টির দ্বারা আমার ললাট স্পর্শ করিয়া গৃহকার্যে চলিয়া গেল।

 দীপ্তি ও স্রোতস্বিনী সভা ছাড়িয়া গেলে ক্ষিতি হাঁপ ছাড়িয়া কহিল, ‘এইবার সত্য কথা বলিবার সময় পাইলাম। বাতাসটা এইবার মোহমুক্ত হইবে। তোমাদের কথাটা অত্যুক্তিতে বড়ো, আমি তাহা সহ্য করিয়াছি; আমার কথাটা লম্বায় যদি বড়ো হয় সেটা তোমাদের সহ্য করিতে হইবে।

 ‘আমাদের সভাপতিমহাশয় সকল বিষয়ের সকল দিক দেখিবার সাধনা করিয়া থাকেন এইরূপ তাঁহার নিজের ধারণা। এই গুণটি যে সদ্‌গুণ আমার তাহাতে সন্দেহ আছে। ওকে বলা যায় বুদ্ধির পেটুকতা। লোভ সম্বরণ করিয়া যে মানুষ বাদসাদ দিয়া বাছিয়া খাইতে জানে সেই যথার্থ খাইতে পারে। আহারে যাহার পক্ষপাতের সংযম আছে সেই করে স্বাদগ্রহণ, এবং ধারণ করে সম্যক্‌রূপে। বুদ্ধির যদি কোনো পক্ষপাত না থাকে, যদি বিষয়ের সবটাকেই গিলিয়া ফেলার কুশ্রী অভ্যাস তাহার থাকে, তবে সে বেশি পায় কল্পনা করিয়া, আসলে কম পায়।

 ‘যে মানুষের বুদ্ধি সাধারণতঃ অতিরিক্ত পরিমাণে অপক্ষপাতী সে যখন বিশেষ ক্ষেত্রে পক্ষপাতী হইয়া পড়ে, তখন একেবারে আত্মবিস্মৃত হইতে থাকে, তখন তার সেই অমিতাচারে ধৈর্য রক্ষা করা কঠিন হয়। সভাপতিমহাশয়ের একমাত্র পক্ষপাতের বিষয় নারী। সে সম্বন্ধে তাঁহার অতিশয়োক্তি মনের স্বাস্থ্য-রক্ষার প্রতিকূল এবং সত্যবিচারের বিরোধী।

 ‘পুরুষের জীবনের ক্ষেত্র বৃহৎ সংসারে, সেখানে সাধারণ মানুষের ভুলচুক ক্রটি পরিমাণে বেশি হইয়াই থাকে। বৃহতের উপযুক্ত শক্তি সাধনাসাপেক্ষ, কেবলমাত্র সহজ বুদ্ধির জোরে সেখানে ফল পাওয়া যায় না। স্ত্রীলোকের জীবনের ক্ষেত্র ছোটো সংসারে, সেখানে সহজ বৃদ্ধিই কাজ চালাইতে পারে। সহজ বুদ্ধি জৈব অভ্যাসের অনুগামী, তাহার অশিক্ষিতপটুত্ব,; তাই বলিয়াই সে স্বশিক্ষিতপটুত্বের উপরে বাহাদুরি লইবে, এ তো সহ্য করা চলে না। ক্ষুদ্র সীমার মধ্যে যাহা সহজে সুন্দর, তার চেয়ে বড়ো জাতের সুন্দর তাহাই, বৃহৎ সীমায় যুদ্ধের ক্ষতচিহ্নে যাহা চিহ্নিত, অসুন্দরের সংঘর্ষে ও সংযোগে যাহা কঠিন, যাহা অতিসৌষম্যে অতিললিত অতিনিখুঁত নয়।

 দেশের পুরুষদের প্রতি তোমরা যে ঐকান্তিক ভাবে অবিচার করিয়াছ তাহাকে আমি ধিক্কার দিই, তাহার অমিতভাষণেই প্রমাণ হয় তাহার অমূলকতা। পৃথিবীতে কাপুরুষ অনেক আছে, আমাদের দেশে হয়তো বা সংখ্যায় আরো বেশি। তার প্রধান কারণটার আভাস পূর্বেই দিয়াছি। যথার্থ পুরুষ হওয়া সহজ নয়, তাহা দুর্মূল্য বলিয়াই দুর্লভ। আদর্শ নারীর উপকরণ-আয়োজন অনেকখানিই জোগাইয়াছে প্রকৃতি। প্রকৃতির আদুরে সন্তান নয় পুরুষ, বিশ্বের শক্তিভাণ্ডার তাহাকে লুঠ করিয়া লইতে হয়। এই জন্য পৃথিবীতে অনেক পুরুষ অকৃতার্থ। কিন্তু যাহারা সার্থক হইতে পারে তাহাদের তুলনা তোমার মেয়েমহলে মিলিবে কোথায়। অন্তত আমাদের দেশে, এই অকৃতার্থতার কি একটা কারণ নয় মেয়েরাই। তাহাদের অন্ধসংস্কার, তাহাদের আসক্তি, তাহাদের ঈর্ষা, তাহাদের কৃপণতা! মেয়েরা সেখানেই ত্যাগ করে যেখানে তাহাদের প্রবৃত্তি ত্যাগ করায়, তাহাদের সন্তানের জন্য, প্রিয়জনের জন্য। পুরুষের যথার্থ ত্যাগের ক্ষেত্র প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে। এ কথা মনে রাখিয়া দুই জাতের তুলনা করিয়ো।

 ‘স্ত্রৈণকে মনে মনে স্ত্রীলোক পরিহাস করে; জানে সেটা মোহ, সেটা দুর্বলতা। একান্ত মনে আশা করি, দীপ্তি ও স্রোতস্বিনী তোমাদের বাড়াবাড়ি লইয়া উচ্চহাসি হাসিতেছে; না যদি হাসে তবে তাহাদের পরে আমার শ্রদ্ধা থাকিবে না। তাহারা নিজের স্বভাবের সীমা কি নিজেরাও জানে না। পরকে ভোলাইবার জন্য অহংকার মার্জনীয়, কিন্তু সেই সঙ্গে মনে মনে চাপা হাসি হাসা দরকার। নিজেকে ভোলাইবার জন্য যাহারা অপরিমিত অহংকার অবিচলিত গাম্ভীর্যের সহিত আত্মসাৎ করিতে পারে তাহারা যদি স্ত্রীজাতীয় হয় তবে বলিতে হইবে, মেয়েদের হাস্যতা-বোধ নাই—সেটাই হসনীয়, এমন কি শোচনীয়। স্বর্গের দেবীরা স্তবের কোনো অতিভাষণে কুণ্ঠিত হন না, আমাদের মর্তের দেবীদেরও যদি সেই গুণটি থাকে তবে তাঁহাদের দেবী উপাধি কেবলমাত্র সেই কারণেই সার্থক।  ‘তার পরে একটা কথা বলিতে ইচ্ছা করে না, কিন্তু তোমাদের আলোচনার ওজন রক্ষার জন্য বলা দরকার। মেয়েদের ছোটো সংসারে সর্বত্রই অথবা প্রায় সর্বত্রই যে মেয়ের লক্ষ্মীর আদর্শ এ কথা যদি বলি তবে লক্ষ্মীর প্রতি লাইবেল করা হইবে। তাহার কারণ, সহজ প্রবৃত্তি, যাহাকে ইংরেজিতে ইন্‌স্‌টিংক্‌ট্‌ বলে, তাহার ভালো আছে, মন্দও আছে। বুদ্ধির দুর্বলতার সংযোগে এই সমস্ত অন্ধ প্রবৃত্তি কত ঘরে কত অসহ্য দুঃখ, কত দারুণ সর্বনাশ ঘটায় সে কথা কি দীপ্তি ও স্রোতস্বিনীর অসাক্ষাতেও বলা চলিবে না। দেশের বক্ষে মেয়েদের স্থান বটে, সেই বক্ষে তাহারা মূঢ়তার যে জগদ্দল পাথর চাপাইয়া রাখিয়াছে, সেটাকে সুদ্ধ দেশকে টানিয়া তুলিতে পারিবে কি। তুমি বলিবে, সেটার কারণ অশিক্ষা। শুধু অশিক্ষা নয়, অতি মাত্রায় হৃদয়ালুতা।•••

 ‘তোমাদের শিভল্‌রি সাংঘাতিক তেজে উদ্যত হইয়া উঠিতেছে। আজ তোমরা অনেক কটু ভাষা নিক্ষেপ করিবে জানি, কেননা মনে মনে বুঝিয়াছ, আমার কথাটা সত্য। সেই গর্ব মনে লইয়া দৌড় মরিলাম; গাড়ি ধরিতে হইবে।’