পঞ্চভূত/বৈজ্ঞানিক কৌতূহল
বৈজ্ঞানিক কৌতূহল
বিজ্ঞানের আদিম উৎপত্তি এবং চরম লক্ষ্য লইয়া ব্যোম এবং ক্ষিতির মধ্যে মহা তর্ক বাধিয়া গিয়াছিল। তদুপলক্ষে ব্যোম কহিল, ‘যদিও আমাদের কৌতূহলবৃত্তি হইতেই বিজ্ঞানের উৎপত্তি তথাপি আমার বিশ্বাস, আমাদের কৌতূহলটা ঠিক বিজ্ঞানের তল্লাশ করিতে বাহির হয় নাই; বরঞ্চ তাহার আকাঙ্ক্ষাটা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। সে খুঁজিতে যায় পরশ-পাথর, বাহির হইয়া পডে একটা প্রাচীন জীবের জীর্ণ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ; সে চায় আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ, পায় দেশালাইয়ের বাক্স। আল্কিমিটাই তাহার মনোগত উদ্দেশ্য, কেমিষ্ট্রি তাহার অপ্রার্থিত সিদ্ধি; অ্যাস্ট্রলজির জন্য সে আকাশ ঘিরিয়া জাল ফেলে, কিন্তু হাতে উঠিয়া আসে অ্যাস্ট্রনমি। সে নিয়ম খোঁজে না, সে কার্যকারণশৃঙ্খলের নব নব অঙ্গুরি গণনা করিতে চায় না; সে খোঁজে নিয়মের বিচ্ছেদ; সে মনে করে কোন্ সময়ে এক জায়গায় আসিয়া হঠাৎ দেখিতে পাইবে, সেখানে কার্যকারণের অনন্ত পুনরুক্তি নাই। সে চায় অভূতপূর্ব নূতনত্ব— কিন্তু বৃদ্ধ বিজ্ঞান নিঃশব্দে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিয়া তাহার সমস্ত নূতনকে পুরাতন করিয়া দেয়, তাহার ইন্দ্রধনুকে পরকলা-বিচ্ছুরিত বর্ণমালার পরিবর্ধিত সংস্করণ, এবং পৃথিবীর গতিকে পক্কতালফলপতনের সমশ্রেণীয় বলিয়া প্রমাণ করে।
‘যে নিয়ম আমাদের ধূলিকণার মধ্যে, অনন্ত আকাশ ও অনন্ত কালের সর্বত্রই সেই এক নিয়ম প্রসারিত; এই আবিষ্কারটি লইয়া আমরা আজকাল আনন্দ ও বিস্ময় প্রকাশ করিয়া থাকি। কিন্তু এই আনন্দ, এই বিস্ময় মানুষের যথার্থ স্বাভাবিক নহে। সে অনন্ত আকাশে জ্যোতিষ্করাজ্যের মধ্যে যখন অনুসন্ধানদূত প্রেরণ করিয়াছিল তখন বড়ো আশা করিয়াছিল যে, ঐ জ্যোতির্ময় অন্ধকারময় ধামে ধূলিকণার নিয়ম নাই, সেখানে অত্যাশ্চর্য একটা স্বর্গীয় অনিয়মের উৎসব; কিন্তু এখন দেখিতেছে ঐ চন্দ্রসূর্য গ্রহনক্ষত্র, ঐ সপ্তর্ষিমণ্ডল, ঐ অশ্বিনী ভরণী কৃত্তিকা আমাদের এই ধূলিকণারই জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠ সহোদর-সহোদরা। এই নূতন তথ্যটি লইয়া আমরা যে আনন্দ প্রকাশ করি তাহা আমাদের একটা নূতন কৃত্রিম অভ্যাস, তাহা আমাদের আদিম-প্রকৃতি-গত নহে।’
সমীর কহিল, ‘সে কথা বড়ো মিথ্যা নহে। পরশপাথর এবং আলাদিনের প্রদীপের প্রতি প্রকৃতিস্থ মানুষ-মাত্রেরই একটা নিগৃঢ় আকর্ষণ আছে। ছেলেবেলায় কথামালার এক গল্প পড়িয়াছিলাম যে কোনো কৃষক মরিবার সময় তাহার পুত্রকে বলিয়া গিয়াছিল যে, অমুক ক্ষেত্রে তোমার জন্য আমি গুপ্তধন রাখিয়া গেলাম। সে বেচারা বিস্তর খুঁড়িয়া গুপ্তধন পাইল না, কিন্তু প্রচুর খননের গুণে সে জমিতে এত শস্য জন্মিল যে তাহার আর অভাব রহিল না। বালকপ্রকৃতি বালক-মাত্রেরই এ গল্পটি পড়িয়া কষ্ট বোধ হইয়া থাকে। চাষ করিয়া শস্য তো পৃথিবীসুদ্ধ সকল চাষাই পাইতেছে, কিন্তু গুপ্তধনটা গুপ্ত বলিয়াই পায় না— তাহা বিশ্বব্যাপী নিয়মের একটা ব্যভিচার, তাহা আকস্মিক, সেই জন্যই তাহা স্বভাবতঃ মানুষের কাছে এত বেশি প্রার্থনীয়। কথামালা যাহাই বলুন, কৃষকের পুত্র তাহার পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ হয় নাই সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। বৈজ্ঞানিক নিয়মের প্রতি অবজ্ঞা মানুষের পক্ষে কত স্বাভাবিক আমরা প্রতিদিনই তাহার প্রমাণ পাই। যে ডাক্তার নিপুণ চিকিৎসার দ্বারা অনেক রোগীর আরোগ্য করিয়া থাকেন তাঁহার সম্বন্ধে আমরা বলি লোকটার ‘হাতযশ’ আছে। শাস্ত্রসংগত চিকিৎসার নিয়মে ডাক্তার রোগ আরাম করিতেছে, এ কথায় আমাদের আন্তরিক তৃপ্তি নাই; উহার মধ্যে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম-স্বরূপ একটা রহস্য আরোপ করিয়া তবে আমরা সন্তুষ্ট থাকি।’ আমি কহিলাম, ‘তাহার কারণ এই যে, নিয়ম অনন্ত কাল ও অনন্ত দেশে প্রসারিত হইলেও তাহা সীমাবদ্ধ, সে আপন চিহ্নিত রেখা হইতে অণুপরিমাণ ইতস্তত করিতে পারে না— সেই জন্যই তাহার নাম নিয়ম এবং সেই জন্যই মানুষের কল্পনাকে সে পীড়া দেয়। শাস্ত্রসংগত চিকিৎসার কাছে আমরা অধিক আশা করিতে পারি না— এমন রোগ আছে যাহা চিকিৎসার অসাধ্য। কিন্তু এ পর্যন্ত হাতযশ-নামক একটা রহস্যময় ব্যাপারের ঠিক সীমানির্ণয় হয় নাই; এই জন্য সে আমাদের আশাকে কল্পনাকে কোথাও কঠিন বাধা দেয় না। এই জন্যই ডাক্তারি ঔষধের চেয়ে অবধৌতিক ঔষধের আকর্ষণ অধিক। তাহার ফল যে কত দূর পর্যন্ত হইতে পারে তৎসম্বন্ধে আমাদের প্রত্যাশা সীমাবদ্ধ নহে। মানুষের যত অভিজ্ঞতাবৃদ্ধি হইতে থাকে, অমোঘ নিয়মের লৌহপ্রাচীরে যতই সে আঘাত প্রাপ্ত হয়, ততই মানুষ নিজের স্বাভাবিক অনন্ত আশাকে সীমাবদ্ধ করিয়া আনে, কৌতূহলবৃত্তির স্বাভাবিক নূতনত্বের আকাঙ্ক্ষা সংযত করিয়া আনে, নিয়মকে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করে, এবং প্রথমে অনিচ্ছাক্রমে পরে অভ্যাসক্রমে তাহার প্রতি একটা রাজভক্তির উদ্রেক করিয়া তোলে।’
ব্যোম কহিল, ‘কিন্তু সে ভক্তি যথার্থ অন্তরের ভক্তি নহে, তাহা কাজ আদায়ের ভক্তি। যখন নিতান্ত নিশ্চয় জানা যায় যে জগৎকার্য অপরিবর্তনীয় নিয়মে বদ্ধ, তখন কাজেই পেটের দায়ে, প্রাণের দায়ে, তাহার নিকট ঘাড় হেঁট করিতে হয়। তখন বিজ্ঞানের বাহিরে অনিশ্চয়ের হস্তে আত্মসমর্পণ করিতে সাহস হয় না; তখন মাদুলি তাগা জল পড়া প্রভৃতিকে গ্রহণ করিতে হইলে ইলেক্ট্রিসিটি ম্যাগ্রেটিজ্ম্ হিপ্নটিজম্ প্রভৃতি বিজ্ঞানের জাল মার্ক দেখিয়া আপনাকে ভুলাইতে হয়। আমরা নিয়ম অপেক্ষা অনিয়মকে যে ভালোবাসি তাহার একটা গোড়ার কারণ আছে। আমাদের নিজের মধ্যে এক জায়গায় আমরা নিয়মের বিচ্ছেদ দেখিতে পাই। আমাদের ইচ্ছাশক্তি সকল নিয়মের বাহিরে, সে স্বাধীন— অন্তত আমরা সেইরূপ অনুভব করি। আমাদের অন্তরপ্রকৃতিগত সেই স্বাধীনতার সাদৃশ্য বাহ্যপ্রকৃতির মধ্যে উপলব্ধি করিতে স্বভাবতঃই আমাদের আনন্দ হয়। ইচ্ছার প্রতি ইচ্ছার আকর্ষণ অত্যন্ত প্রবল; ইচ্ছার সহিত যে দান আমরা প্রাপ্ত হই সে দান আমাদের কাছে অধিকতর প্রিয়, সেবা যতই পাই তাহার সহিত ইচ্ছার যোগ না থাকিলে তাহা আমাদের নিকট রুচিকর বোধ হয় না। সেই জন্য যখন জানিতাম যে ইন্দ্র আমাদিগকে বৃষ্টি দিতেছেন, মরুৎ আমাদিগকে বায়ু জোগাইতেছেন, অগ্নি আমাদিগকে দীপ্তি দান করিতেছেন, তখন সেই জ্ঞানের মধ্যে আমাদের একটা আন্তরিক তৃপ্তি ছিল। এখন জানি রৌদ্রবৃষ্টিবায়ুর মধ্যে ইচ্ছা-অনিচ্ছা নাই, তাহারা যোগ্য-অযোগ্য প্রিয়অপ্রিয় বিচার না করিয়া নির্বিকারে যথানিয়মে কাজ করে, আকাশে জলীয় অণু শীতল বায়ু-সংযোগে সংহত হইলেই সাধুর পবিত্র মস্তকে বর্ষিত হইয়া সর্দি উৎপাদন করিবে এবং অসাধুর কুষ্মাণ্ডমঞ্চে জলসিঞ্চন করিতে কুষ্ঠিত হইবে না— বিজ্ঞান আলোচনা করিতে করিতে ইহা আমাদের ক্রমে একরূপ সহ্য হইয়া আসে, কিন্তু বস্তুত ইহা আমাদের ভালোই লাগে না।’
আমি কহিলাম, ‘পূর্বে আমরা যেখানে স্বাধীন ইচ্ছার কর্তৃত্ব অনুমান করিয়াছিলাম এখন সেখানে নিয়মের অন্ধ শাসন দেখিতে পাই, সেই জন্য বিজ্ঞান আলোচনা করিলে জগৎকে নিরানন্দ ইচ্ছাসম্পর্কবিহীন বলিয়া মনে হয়। কিন্তু ইচ্ছা এবং আনন্দ যত ক্ষণ আমার অন্তরে আছে তত ক্ষণ জগতের অন্তরে তাহাকে অনুভব করিতেই হইবে— পূর্বে তাহাকে যেখানে কল্পনা করিয়াছিলাম সেখানে না হউক তাহার অন্তরতর অন্তরতম স্থানে তাহাকে প্রতিষ্ঠিত না জানিলে আমাদের অন্তরতম প্রকৃতির প্রতি ব্যভিচার করা হয়। আমার মধ্যে সমস্ত বিশ্বনিয়মের যে একটি ব্যতিক্রম আছে জগতে কোথাও তাহার একটা মূল আদর্শ নাই, ইহা আমাদের অন্তরাত্মা স্বীকার করিতে চাহে না। এই জন্য আমাদের ইচ্ছা একটা বিশ্ব-ইচ্ছার, আমাদের প্রেম একটা বিশ্বপ্রেমের নিগূঢ় অপেক্ষ না রাখিয়া বাঁচিতে পারে না।’
সমীর কহিল, জড়প্রকৃতির সর্বত্রই নিয়মের প্রাচীর চীনদেশের প্রাচীরের অপেক্ষা দৃঢ় প্রশস্ত ও অভ্রভেদী, হঠাৎ মানবপ্রকৃতির মধ্যে একটা ক্ষুদ্র ছিদ্র বাহির হইয়াছে। সেইখানে চক্ষু দিয়াই আমরা এক আশ্চর্য আবিষ্কার করিয়াছি। দেখিয়াছি প্রাচীরের পরপারে এক অনন্ত অনিয়ম রহিয়াছে; এই ছিদ্রপথে তাহার সহিত আমাদের যোগ; সেইখান হইতেই সমস্ত সৌন্দর্য স্বাধীনতা প্রেম আনন্দ প্রবাহিত হইয়া আসিতেছে। সেই জন্য এই সৌন্দর্য ও প্রেমকে কোনো বিজ্ঞানের নিয়মে বাঁধিতে পারিল না।’
এমন সময়ে স্রোতস্বিনী গৃহে প্রবেশ করিয়া সমীরকে কহিল, ‘সে দিন দীপ্তির পিয়ানো বাজাইবার স্বরলিপি-বইখানা তোমরা এত করিয়া খুঁজিতেছিলে, সেটার কী দশা হইয়াছে জান?’
সমীর কহিল, ‘না।’
স্রোতস্বিনী কহিল, ‘রাত্রে ইঁদুরে তাহা কুটি কুটি করিয়া কাটিয়া পিয়ানোর তারের মধ্যে ছড়াইয়া রাখিয়াছে। এরূপ অনাবশ্যক ক্ষতি করিবার তো কোনো উদ্দেশ্য খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।’
সমীর কহিল, ‘উক্ত ইন্দুরটি বোধ করি ইন্দুরবংশে একটি বিশেষক্ষমতাসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক। বিস্তর গবেষণায় সে বাজনার বহির সহিত বাজনার তারের একটা সম্বন্ধ অনুমান করিতে পারিয়াছে। এখন সমস্ত রাত ধরিয়া পরীক্ষা চালাইতেছে। বিচিত্র ঐক্যতানপূর্ণ সংগীতের আশ্চর্য রহস্য ভেদ করিবার চেষ্টা করিতেছে। তীক্ষ্ণ দন্তাগ্রভাগ দ্বারা বাজনার বহির ক্রমাগত বিশ্লেষণ করিতেছে। পিয়ানোর তারের সহিত তাহাকে নানা ভাবে একত্র করিয়া দেখিতেছে। এখন বাজনার বই কাটিতে শুরু করিয়াছে; ক্রমে বাজনার তার কাটিবে, কাঠ কাটিবে, বাজনাটাকে শতছিদ্র করিয়া সেই ছিদ্রপথে আপন সূক্ষ্ম নাসিকা ও চঞ্চল কৌতুহল প্রবেশ করাইয়া দিবে— মাঝে হইতে সংগীতও ততই উত্তরোত্তর স্বদূরপরাহত হইবে। আমার মনে এই তর্ক উদয় হইতেছে যে, ইন্দুরকুলতিলক যে উপায় অবলম্বন করিয়াছে তাহাতে তার এবং কাগজের উপাদান সম্বন্ধে নূতন তত্ত্ব আবিষ্কৃত হইতে পারে, কিন্তু উক্ত কাগজের সহিত উক্ত তারের যথার্থ যে সম্বন্ধ তাহা কি শতসহস্র বৎসরেও বাহির হইবে। অবশেষে কি সংশয়পরায়ণ নব্য ইন্দুরদিগের মনে এইরূপ একটা বিতর্ক উপস্থিত হইবে না যে, কাগজ কেবল কাগজমাত্র, এবং তার কেবল তার— কোনো জ্ঞানবান জীব-কর্তৃক উহাদের মধ্যে যে একটা আনন্দজনক উদ্দেশ্যবন্ধন বদ্ধ হইয়াছে তাহা কেবল প্রাচীন ইন্দুরদিগের যুক্তিহীন সংস্কার, এই সংস্কারের কেবল একটা এই শুভফল দেখা যাইতেছে যে তাহারই প্রবর্তনায় অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়া তার এবং কাগজের আপেক্ষিক কঠিনতা সম্বন্ধে অনেক পরীক্ষা সম্পন্ন হইয়াছে।
‘কিন্তু এক-এক দিন গহ্বরের গভীরতলে দন্তচালনকার্যে নিযুক্ত থাকিয়া মাঝে মাঝে অপূর্ব সংগীতধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশ করে এবং অন্তঃকরণকে ক্ষণকালের জন্য মোহাবিষ্ট করিয়া দেয়। সেটা ব্যাপারটা কী। সে একটা রহস্য বটে। কিন্তু সে রহস্য নিশ্চয়ই কাগজ এবং তার সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিতে করিতে ক্রমশ শতছিদ্র আকারে উদঘাটিত হইয়া যাইবে।’
বৈজ্ঞানিক কৌতূহল