পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৫

উইকিসংকলন থেকে
শ্রীশ্রীদুর্গা সহায়
কটক
রবিবার

পরম পূজনীয়া
শ্রীমতী মাতাঠাকুরাণী
শ্রীচরণ কমলেষু,
মা,

 অনেকদিন হইল আপনাকে কোন পত্র দিই নাই তাই আজ অবসর পাইয়া কয়েক পংক্তি লিখিয়া হস্ত ও লেখনী উভয়কে পবিত্র করিতেছি।

 আমার হৃদয়কাননে সময়ে ২ যে ভাবকুসুম প্রস্ফুটিত হয় তাহার সহিত চোখের অশ্রুজল মিশাইয়া আপনার চরণকমলে উপহার দিই। কিন্তু সে কুসুমের গন্ধে আপনার হৃদয়ে আনন্দের উদ্রেক হয়, না তাহার তীব্রতায় আপনাকে নাসিকা কুঞ্চিত করিতে হয়, তাহা না জানিতে পারায় আমি কতকটা অশান্ত হইয়াছি।

 আমার হৃদয়ে সময়ে ২ অকালীন মেঘের ন্যায় যে ভাব উদয় হয় তাহা নিকটে কাহাকে বলিব তাহা ঠিক করিতে না পারিয়া দূরদেশে আপনার নিকট প্রেরণ করি। আপনি কিরূপ ভাবে তাহা গ্রহণ করেন তাহা জানিলে বড় আনন্দিত হই। কিন্তু আপনার নিকট আমার মনোগত ভাব প্রীতিকর হউক বা না হউক হৃদয়ের একমাত্র উপহার ভাবিয়া আমি তাহা প্রেরণ করিতে সাহসী হই।

 মা, আপনার মতে আমাদের এই শিক্ষার উদ্দেশ্য কি? আমাদের জন্য এত খরচ করিতেছেন—দুইবেলা গাড়ী করিয়া স্কুলে পাঠাইতেছেন এবং পুনরায় বাড়ী ফিরাইয়া আনিতেছেন—দিনে ৪/৫ বার করিয়া আমাদিগকে পেট ভরিয়া খাওয়াইতেছেন—বস্ত্র পরিচ্ছদে সর্ব্বাঙ্গ আবৃত রাখিতেছেন—দাসদাসী নিযুক্ত করিতেছেন—আমি ভাবি এত কষ্ট এত পরিশ্রম, এত ক্লেশ আমাদের জন্য কেন? ইহার উদ্দেশ্যই বা কি? আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারি না। ছাত্রজীবন শেষ করিলে আমাদিগকে কর্মমক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে হইবে—প্রবেশ করিয়া সারাজীবন গাধার ন্যায় অবিশ্রান্ত ভাবে খাটিতে হইবে এবং তৎপরে ভবলীলা সাঙ্গ করিতে হইবে। মা, আমাদিগকে কর্ম্মক্ষেত্রের কোন্ বিভাগে দেখিলে আপনি সর্ব্বাপেক্ষা সুখী হইবেন? বড় হইলে আমাদিগকে কোন্ কার্য্যে নিযুক্ত দেখিলে আপনি সর্ব্বাধিক আনন্দ লাভ করিবেন—জানি না আপনার মনে ইচ্ছা কি। মা, জজ ম্যাজিস্ট্রেট ব্যারিষ্টার কিংবা অন্য কোনও বড় হাকিমের গদীতে বসিলে আপনার সর্ব্বাপেক্ষা আনন্দ হইবে—ধনকুবের বলিয়া সংসারী লোকের দ্বারা পূজিত হইলে আপনার সর্ব্বাপেক্ষা আনন্দ হইবে—প্রচুর ধনশালী, গাড়ী, ঘোড়া, মোটর প্রভৃতির অধিকারী, নানা দাসদাসীর প্রভু, প্রকাণ্ড অট্টালিকা ও বিপুল জমিদারীর অধিকারী হইলে আপনার সর্ব্বাপেক্ষা আনন্দ হইবে—না দরিদ্র হইলেও পণ্ডিতদিগের দ্বারা এবং গুণিজনের দ্বারা “প্রকৃত মানুষ” বলিয়া পূজিত হইলে আপনার সর্ব্বাপেক্ষা আনন্দ হইবে তাহা জানি না। আপনার পুত্রকে কিরূপ দেখিলে আপনার সর্ব্বাধিক আনন্দ হইবে—তাহা জানিতে বড় ইচ্ছা হয়। দয়াময় ভগবান আমাদিগকে মানবজন্ম—সুস্থ দেহ—বুদ্ধি শক্তি প্রভৃতি অমূল্য পদার্থ দিয়াছেন—কেন? তাঁহার পূজা এবং তাঁহার সেবারই জন্য অবশ্য তিনি এত দিয়াছেন—কিন্তু মা—আমার কার্য্য করি কি? সমস্ত দিনের মধ্যে একবারও তাঁহাকে প্রাণ খুলিয়া ডাকিতে পারি না। মা, ভাবিলে প্রাণে বড় কষ্ট হয়, ভাবিলে মর্ম্মাহত হইতে হয়—যিনি আমাদের জন্য এত করিতেছেন, যিনি কি সম্পদে বিপদে, কি গৃহে কি অরণ্যে, সর্ব্বদাই আমাদের বন্ধু, যিনি সর্ব্বদা আমাদের হৃদয়-মন্দিরে বসিয়া আছেন—যিনি আমাদের এত নিকটে আছেন—যিনি আমাদের খুব আপনারই জিনিস, আমরা তাঁহাকে একবারও প্রাণ খুলিয়া ডাকি না। আমরা সংসারের ছার বস্ত লইয়া কত অশ্রুত্যাগ করি কিন্তু একবারও তাঁহার উদ্দেশে একবিন্দুও অশ্রু ফেলি না—মা, আমরা যে পশু অপেক্ষাও অকৃতজ্ঞ ও কঠিনহৃদয়। ধিক্ সেই শিক্ষা—যাহাতে ঈশ্বরের নাম নাই—নিষ্ফল তাহার মানব জন্ম যাহার মুখে ঈশ্বরের নাম শুনিতে পাওয়া যায় না! লোকে তৃষ্ণার্ত্ত হইলে পুষ্করিণী বা নদীর জল পান করিয়া তৃষ্ণা নিবারণ করে, কিন্তু তাহাতে কি মানসিক তৃষ্ণা মেটে? কখনই না— মানসিক তৃষ্ণর নিবৃত্তি কখনও হয় না। এই জন্যই আমাদের শাস্ত্রকারগণ বলিয়া গিয়াছেন:

“ভজ গোবিন্দং, ভজ গোবিন্দং, ভজ গোবিন্দং মূড়মতে।”

ভগবান কলিযুগে একটি নূতন সৃষ্টি করিয়াছেন—যাহা অন্য কোনও যুগে ছিল না। সেই নূতন—“বাবু”-সৃষ্টি। আমরাই সেই “বাবু” সম্প্রদায়ভুক্ত। আমাদের ঈশ্বরদত্ত পদযান আছে কিন্তু আমরা ২০।২২ ক্রোশ হাঁটিয়া যাইতে পারি না—কারণ অমবা বাবু। আমাদের দুইটি অমূল্য হস্ত আছে—কিন্তু আমরা শারীরিক পরিশ্রমে কুণ্ঠিত হই—আমরা হস্তের উপযুক্ত ব্যবহার করি না—কারণ আমরা “বাবু”। আমাদের এই ঈশ্বরদত্ত সবল দেহ আছে কিন্তু আমরা শারীরিক পরিশ্রমকে “ছোটলোকের কাজ” বলিয়া ঘৃণা করি কারণ আমরা “বাবুলোক”। আমরা সব কাজে চাকরকে হাঁক মারি—আমাদের হাত পা চালাইতে যে কষ্ট হয়— কারণ আমরা যে “বাবু”। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে জন্মিলেও আমরা গ্রীষ্ম সহ্য করিতে পারি না কারণ আমরা “বাবু”। আমরা সামান্য শীতকে এত ভয় করি যে সর্ব্বাঙ্গ বোঝায় চাপাইয়া রাখি কারণ আমরা “বাবু”। আমরা সর্ব্বত্র “বাবু” বলিয়া পরিচয় দিই কারণ আমরা “বাবু” কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে আমরা মনুষ্যত্বহীন মনুষ্যরূপধারী পশু। পশু অপেক্ষাও আমরা অধম— কারণ আমাদের জ্ঞান ও বিবেক আছে—পশুদিগের তাহাও নাই। জন্মাবধি সুখের এবং বিলাসিতার মধ্যে লালিত-পালিত হওয়াতে আমরা তিলমাত্র কষ্টসহিষ্ণু হইতে পারি না—এই কারণে ইন্দ্রিয়গণকে আমরা জয় করিতে পারি না—সারাজীবন ইন্দ্রিয়ের দাস হইয়া আমরা এক দুর্ব্বহ জীবনভার বহন করি।

 আমি প্রায় ভাবি—বাঙ্গালী কবে মানুষ হইবে—কবে ছার টাকার লোভ ছাড়িয়া উচ্চ বিষয়ে ভাবিতে শিখিবে—কবে সকল বিষয়ে নিজের পায়ের উপর দাঁড়াইতে শিখিবে—কবে একত্র শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন করিতে শিখিবে— কবে অন্যান্য জাতির ন্যায় নিজের পায়ের উপর দাঁড়াইয়া নিজেকে “মানুষ” বলিয়া পরিচয় দিতে পারিবে। আজকাল বাঙ্গালীদিগের মধ্যে অনেকে পাশ্চাত্ত্য শিক্ষা পাইয়া নাস্তিক ও বিধর্ম্মী হইয়া যায়—দেখিলে বড় কষ্ট হয়। আজকাল বাঙ্গালীরা বাবুয়ানি ও বিলাসিতার স্রোতে ভাসিয়া গিয়া নিজের মনুষ্যত্ব হারাইতেছে—— দেখিলে বড় কষ্ট হয়। আজকাল বাঙ্গালীরা নিজের জাতীয় পরিচ্ছদকে ঘৃণা করিতে শিখিয়াছে—দেখিলে বড় কষ্ট হয়। বাঙ্গালীদের মধ্যে সবল, সুস্থ এবং বলিষ্ঠকায় লোক খুব কমই আছে—দেখিলে প্রাণে কষ্ট হয়। এবং সর্ব্বোপরি, বাঙ্গালীদিগের মধ্যে প্রত্যহ ভগবানের নাম করে এরূপ ভদ্রলোক খুব কমই আছে—দেখিলে প্রাণে বড় কষ্ট হয়। বাঙ্গালীরা আজকাল হইয়াছে—বিলাসিতাপ্রিয়, পরচর্চ্চাকারী, কুটিলহৃদয়, পর-সুখদ্বেষী এবং মনুষ্যত্ববিহীন—মা, ভাবিলে বড় কষ্ট হয়। আমরা পড়িতেছি—সম্মুখে যদি চাকরীর এবং অর্থের লোভ থাকে—তাহা হইলে কি লেখাপড়া—তাহা হইলে কি মনুষ্যত্বের অধিকারী হইতে পারা যায়? মা বাঙ্গালী কি কখনও মানুষ হইতে পারিবে? আপনার কি মত? মা, আমরা এবং আমাদের দেশ দিন ২ অধঃপতনে যাইতেছে। কে উদ্ধার করিবে? একমাত্র উদ্ধার কর্ত্তা—বঙ্গজননী—বঙ্গমাতা যদি বঙ্গসন্তানকে নূতনভাবে প্রস্তুত করিতে পারেন—তাহা হইলে পুনরায় বাঙ্গালী মানুষ হইবে।

 আমরা ভাল আছি। ছোটদাদাকে পত্র দিলাম। বাবা সোমবার গোপণীপালান যাত্রা করিবেন। আমরা ভাল আছি। আমার প্রণাম জানিবেন। এবার পাগলের মত অনেক লিখিয়াছি। পড়িতে কষ্ট হয় ত ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিবেন। ক্ষমা করিবেন। ইতি—

আপনার সেবক 
সুভাষ