পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/১১

উইকিসংকলন থেকে
পরিভ্রমণে চলুন অনুসন্ধানে চলুন
১১
কটক
১৭।৯।১২

পরম পূজনীয় মেজদাদা,

 আশা করি লণ্ডনের ঠিকানায় লেখা আমার পত্রখানি ইতিমধ্যে পাইয়াছেন। আপনি কলিকাতায় থাকাকালীন আমি আপনাকে একখানি পত্র দিয়াছিলাম কিন্তু সেই পত্রখানি আপনার হস্তগত হইয়াছিল কিনা সঠিক জানিতে পারি নাই। মাতাঠাকুরাণীকে এডেন হইতে লেখা আপনার পত্রখানি পড়িলাম। তাহা হইতে আমার পত্রখানি আপনি পাইয়াছিলেন জানিয়া অতিশয় আনন্দিত হইলাম। লিখিবার সময় একবারও ভাবি নাই যে ইহা আপনাকে আনন্দ দিবে। তাই আপনি আনন্দ পাইয়াছেন জানিয়া বিশেষ তৃপ্তি বোধ করিলাম! যাহা লিখিয়াছিলাম অন্তর হইতে আসিয়াছিল বলিয়াই এরূপ হইয়াছে। হৃদয়ের আবেদন হৃদয়কে স্পর্শ করে; এবং তাহাই হইয়াছিল। যে চিন্তা হৃদয় হইতে উদ্ভূত, তাহা অতি সরল ও স্বাভাবিক ভাষায় লিখিত হইলেও যাহা হৃদয় হইতে আসে নাই কিন্তু প্রচুর অলঙ্কারযুক্ত তাহা অপেক্ষা ফলপ্রসূ। জানি না কেন সে সব লিখিয়াছিলাম কিছুই মনে পড়িতেছে না। সহসা আবেগে অভিভূত হইয়া কলম ধরিয়াছিলাম, জানি না কি লিখিয়াছি; কেন লিখিয়াছি। সেই সময়ে হৃদয়ে যে চিন্তা সর্ব্বোপরি ছিল আমি শুধু তাহাই প্রকাশ করিয়াছিলাম। হয়ত রাত্রির গভীর নিস্তব্ধতা—কারণ তখন প্রায় মধ্য রাত্রি—এই সব বিচিত্র অনুভূতির উন্মেষ ঘটাইয়াছিল। আমার বিশ্বাস প্রত্যেকেই অনুরূপ অনুভূতি লাভ করিয়া থাকিবেন; বিশেষতঃ যাঁহারা বিদায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তাঁহাদের অভিজ্ঞতা তীব্রতর হইয়াছিল। ইহা এমন একটি আবেগপূর্ণ মুহূর্ত্ত যে আমার পক্ষে তাহা সহ্য করা খুবই কঠিন হইত। না থাক; যাহা অতীত, তাহার কথা তুলিয়া, আপনাকে বিষন্ন ও বিচলিত করিতে চাই না।

 সেখানে বাংলার ঋষি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্বন্ধে আপনি হয়ত অনেক কিছু পড়িবেন ও শুনিতে পাইবেন। তাঁহার সম্বন্ধে পড়িয়া ও বিদেশীরা তাঁহাকে যে সম্মান দেখাইয়াছে তাহা জানিয়া আমরা সকলে এত গৌরব অনুভব করি যে, তাহাতে সাময়িক ভাবে হইলেও আমরা বাংলা ও ভারতের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও আশান্বিত হই। আমি আত্ম-অনুশোচনায় পীড়িত বোধ করি যখন ভাবি বাংলা দেশ তাঁহার প্রতিভার প্রতি কত উদাসীন ছিল; যখন ভাবি তাঁহার অমানুষিক প্রতিভাকে অস্বীকারের অন্ধকারে কতদিন আচ্ছন্ন রাখিয়া ছিল; অথচ বিদেশীরা, যাহারা বিজাতীয় ভাষাভাষী, যাহাদের চিন্তা ও অনুভূতি কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের সম্পূর্ণ বিরোধী, তাহারাই তাঁহার প্রতিভাকে রাহুমুক্ত করিয়া পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবির আসনে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। আমরা কি অদ্ভুত; আমাদের হৃদয়ে বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নাই। তাই কবি বলিয়াছেন:

“জ্ঞান হোক মহীয়ান নিজ মহিমাতে
তবু যেন শ্রদ্ধা রয় সাথে।”

 আমার বিশ্বাস একদিন রবি ঠাকুরের কবিতাগুলির মর্ম্ম আমি উপলব্ধি করিতে পারি।

 কোন পুরাতন বন্ধুর সহিত দেখা হইয়াছে কি? তাঁহাদের মধ্যে শ্রীযুক্ত বীরেন বসু আছেন কি?

 ইংরাজেরা তাহাদের মাতৃভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের কথায় পঞ্চমুখ। তাহা কি সত্য? ভারত ও বিলাতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের আপনি এবার তুলনা করিতে পারিবেন!

 আমরা ভালই আছি। আশা করি কুশলে আছেন। ভক্তিপূর্ণ প্রণাম গ্রহণ করিবেন! ইতি—

আপনার স্নেহের 
সুভাষ 

(ইংরাজী হইতে অনূদিত)