পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/১১৬

উইকিসংকলন থেকে

শ্রীগোপাললাল সান্যালকে লিখিত

১১৬
ইনসিন জেল
৫ই এপ্রিল, ১৯২৭

পরম প্রীতিভাজনেষু—

 আপনার ৫ই চৈত্রের পত্র পাইয়া আনন্দিত হইয়াছি। অনেক প্রশ্ন করিয়াছেন—কি উত্তর দিব জানি না। অনেক কথাই ত লিখিতে ইচ্ছা করে, কিন্তু লেখা যায় কি?

 শরীরের সম্বন্ধে নুতন কিছু বলিবার নাই—“যথা পূর্ব্বং তথা পরং”। পরিণামে কি দাঁড়াইবে জানি না—এখন আর শরীরের কথা ভাবি না। গত কয়েক মাসের মধ্যে আমার মনের গতি কোনও কোনও দিকে দ্রুতবেগে চলিয়াছে। আমার এই ধারণা বদ্ধমূল হইতেছে যে, জীবনে ষোল আনা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত না হইলে মেরুদণ্ড ঠিক রাখা মুস্কিল হইয়া পড়ে। জীবন প্রভাতে এই প্রার্থনা বুকে লইয়া কর্ম্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছিলাম—“তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি।” ভবিষ্যতের কথা জানি না। তবে এখন পর্য্যন্ত ভগবান সে প্রার্থনা সফল করিয়া আসিতেছেন। তাই আমি বড় সুখী—সময়ে সময়ে মনে হয়, আমার মত সুখী জগতে আর কয়জন আছে? এখন এই বৃত্তাকার উন্নত প্রাচীরের বাহিরে যাইবার আশা যে পরিমাণে সুদূরপরাহত হইতেছে, সেই পরিমাণে আমার চিত্ত শান্ত ও উদ্বেগশূন্য হইয়া আসিতেছে। অন্তরের মধ্যে বাস করা ও অন্তরের আত্মবিকাশের স্রোতে জীবনতরী ভাসাইয়া দেওয়ার মধ্যে পরম শান্তি আছে এবং বেশীদিন রুদ্ধ অবস্থায় বাস করিতে হইলে অন্তরের শান্তিই একমাত্র সম্বল—তাই সুদীর্ঘ কারাবাসের সম্ভাবনায় আমি এক অপূর্ব শান্তি পাইতেছি। Emerson বলিয়াছেন, “We must live wholly from within.” এ-কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য এবং এই সত্যের উপর আমার বিশ্বাস দিন দিন দৃঢ়তর হইতেছে।

 আমার মত যাঁহাদের অবস্থা তাঁহারা যদি বাহিরের ঘটনার দ্বারা জীবনের সার্থকতা বা বিফলতা নির্দ্ধারণ করেন তবে—“মৃত্যুরেব ন সংশয়ঃ।” যে মাপকাঠির দ্বারা আমাদের (অর্থাৎ বন্দীদের) বিচার করিতে হইবে—তাহা অন্তরের, বাহিরের নয়। কারণ বাহিরের মাপকাঠিতে হয় তো আমাদের জীবনের মূল্য শূন্যবৎ। এইখানেই যদি যবনিকাপাত হয় তবে বাস্তব সংসারের উপর আমাদের জীবনের স্থায়ী ছাপ না থাকিতেও পারে। কিন্তু জীবনে যদি আর কোনও কাজ না করিতে পারি—আদর্শকে বাস্তবের ভিতর দিয়া যদি ফুটাইয়া তুলিবার সুযোগ না পাই—তাহা হইলেও আমার জীবন ব্যর্থ হইবে না। মহান্ আদর্শ যদি প্রাণের মধ্যে গ্রহণ করিয়া থাকি—কায়মন যদি সেই মহান্ আদর্শের সুরে বাঁধিয়া থাকি— আদর্শের সহিত নিজের অস্তিত্ব যদি মিশিয়া থাকে—তাহা হইলে আমি সন্তুষ্ট—আমার জীবন জগতের কাছে ব্যর্থ হইলেও, আমার (এবং বোধ হয় ভাগ্যবিধাতার) কাছে ব্যর্থ নয়। জগতে সব কিছুই ক্ষণভঙ্গুর—শুধু একটা বস্তু ভাঙ্গে না বা নষ্ট হয় না—সে বস্তু,— ভাব বা আদর্শ। আমাদের আদর্শ সমাজের আশা আকাঙ্ক্ষা। আমাদের চিন্তাধারা—অবিনশ্বর। ভাবকে প্রাচীরের দ্বারা কি কেহ ঘিরিয়া রাখিতে পারে?

 ষোল আনা দিতে হইলে অপর দিকে আদর্শকে ষোল আনা পাওয়া চাই। অথবা আদর্শকে ষোল আনা পাইতে হইলে নিজের ষোল আনা দেওয়া চাই। ত্যাগ ও উপলব্ধি—renunciation and realisation একই বস্তুর এপিঠ আর ওপিঠ। এখনই ষোল আনা পাওয়া ও ষোল আনা দেওয়ার জন্য আমার মনপ্রাণ আকুল হইয়া উঠিয়াছে।

 যিনি এত দুর্ব্বলতার মধ্য দিয়া আমাকে শক্তির উচ্চ শিখরে লইয়া আসিয়াছেন—তিনি কি দয়া করিবেন না? উপনিষদে বলে, “যমেবৈষবৃণুতে তেন লভ্যঃ”—এখন দেখা যাক্।

 Systematic Study অনেক দিন হইল ছাড়িতে বাধ্য হইয়াছি। জাতীয়তার ভিত্তিস্বরূপ কয়েকটি মূল সমস্যার সমাধানের জন্য লেখাপড়া ও গবেষণা আরম্ভ করিয়াছিলাম। আপাততঃ কাজ বন্ধ আছে। কবে আবার আরম্ভ করিতে পারিব জানি না। বাহিরে গেলে এই কাজ চাপা পড়িবে—তাই এখানে থাকিতে থাকিতেই কাজ শেষ করিবার ইচ্ছা ছিল। আমার কারাবাসের কাজ বোধ হয় এখনও সমাপ্ত হয় নাই—তাই বোধ হয় যাইবারও বিলম্ব আছে।

 ভগবান আপনাদের সকলকে কুশলে রাখুন এবং আপনাদের ক্রিয়াকলাপের উপর তাঁহার আশীষ নিরন্তর বর্ষিত হউক—ইহাই আমার একান্ত প্রার্থনা। ইতি—