পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/১৩২

উইকিসংকলন থেকে

বিভাবতী বসুকে লিখিত

১৩২

সহায়

কেলসল লজ
শিলং
৩।৮।২৭

পূজনীয়া মেজবৌদিদি,

 আপনার ২৮শে জুলাই-র পত্র যথা সময়ে পেয়েছি। এখানে কয়েকদিন যাবৎ দিনরাত বৃষ্টি হয়েছে—আজ একটু পরিষ্কার আকাশ পেয়ে আমরা সকলেই বেড়াতে গিছলুম। আপনার শরীর এখন কি রকম আছে? মেজদাদার শরীর এখন কি রকম? আমার অনুরোধ জানাবেন, যেন বেশী রাত্রে খাওয়াটা বন্ধ করেন। আমি যে কয়দিন কল্পকাতায় ছিলুম খাওয়াদাওয়া সম্বন্ধে অনিয়ম দেখতুম। আমি নিজে বোধ হয় এত অনিয়ম কখনও করিনি। আর একটা অনুরোধ জানাবেন, যেন সেপ্টেম্বর মাসটা বিশ্রাম করেন। টাকার চেয়ে স্বাস্থ্য বড়—যদিও এখন টাকার খুব বেশী দরকার। তাঁর অবস্থা হচ্ছে যাকে ইংরাজীতে বলে—he cannot afford to get ill—আমার মত তো আর vagabond নন, যে বাঁচলুম কি মরলুম তাতে কিছু এসে যায় না।

 পলি ক্রমশঃ ভাল হচ্ছে—তবে বড় ধীরে ধীরে উপকার হচ্ছে। মিস্ হার্মেন আজ অনেক দিন পরে তাকে দেখে বল্লেন যে বেশ উপকার হয়েছে। এক মাইল আন্দাজ হাঁটাও হয় যেদিন বেড়াতে যাওয়া সম্ভব হয়। তার মনটাও আজকাল ততটা বিমর্ষ নয়—শিশুকে পড়ান নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে। পলির জন্যে আপনার সমবেদনা দেখে আমি বড় খুশী হয়েছি।

 মা-র হাতের আঙ্গুলটা কষ্ট দিচ্ছে —fomentation দিয়ে বিশেষ উপকার হয়নি। বোধ হয় শেষ পর্য্যন্ত পাকবে।

 বীর আজকাল বিশেষ গোলমাল করে না। ড্রাইভার বরাবরই ঠিক মত কাজ করছে। ছোটখাটো মেরামত গাড়ীতে করতে হয়েছে। তাতে জুন ও জুলাই মাসের বিল ৩০ টাকা দাঁড়িয়েছে। গাড়ী আজকাল ভালই চলছে।

 ফলের পার্শ্বেল আমরা কাল পেয়েছি—মোটর উপর ফলের অবস্থা ভালই। ললিত (ননীর স্বামী) আবার ফলের পার্শ্বেল তাঁর একজন বন্ধু মারফৎ পাঠিয়েছেন—কাল আমরা পেয়েছি।

 আপনি যে কর্ত্তব্যবোধে কলিকাতায় গেছেন—তাতে আমি সুখী হয়েছি। আমি গোড়া থেকেই মনে করেছিলুম যে আপনার এখানে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। তাই আপনাকে বার বার বলেছি এবং মেজদাদাকে লিখেছি—যাতে কোনও প্রকার সঙ্কোচ না বোধ করেন। আমার সুবিধার জন্য আপনি যদি কর্ত্তব্যহানি করে বা নিজের কষ্ট করে এখানে থাকতেন তাতে আমি বিশেষ দুঃখিত হতুম। আমি যে রাস্তায় চলেছি তাতে নিজের সুবিধা বা সুখের জন্য কাহাকেও কষ্ট বা অসুবিধায় ফেলা আমার পক্ষে মহাপাপ। আদর্শটা বড় কঠিন তা আমি জানি এবং আমার জন্য অপরের যে অসুবিধা ও কষ্ট হয়, তাহা সব সময়ে নিবারণ করা যায় না—তবুও সাধ্যমত আমাকে এই আদর্শটা সামনে রেখে কাজ করে যেতে হবে।

 টাকা সম্বন্ধে যা লিখেছেন সে কথা ঠিক, কিন্তু আমি যা লিখেছিলুম সে কথাও ঠিক। টাকা যে রোজগার করবে তার পক্ষে “টাকা মাটী, মাটী টাকা”—এই ভাব হৃদয়ে রাখা ভাল। তা’ হ’লে মানুষ স্বার্থপর বা কৃপণ কখনও হবে না। কিন্তু আমার দিক থেকে এ কথা বল খাটে না। আমার কাছে প্রত্যেক টাকাটীর মূল্য খুব বেশী। যে টাকাটী আমার নিজের জন্য ব্যয় করি, প্রতি মুহূর্ত্তে মনে হয় যে ঐ টাকা অপরের জন্য ব্যয় করতে পারলে আমি বেশী সুখী হতুম। এ ভাব যেতে পারে না—এবং বোধ হয় যাওয়া উচিত নয় (অবশ্য আমি এখানে আমার দিক থেকেই বলছি—আপনার দিক থেকে নয়)। নিজের টাকাটা নিঃশেষে জনহিতের জন্য বিলিয়ে দিতে হবে—এইটা যখন আদর্শ করেছি তখন কোনও প্রকার স্বার্থপরতাকে যদি মনের মধ্যে স্থান দিই তা হলে তো আমি ভরাডুবি হব। এ সব কথা বলা বা লেখা সত্ত্বেও আমি যথেষ্ট স্বার্থপর এবং নিজের জন্য আমি অনেক কিছু করি। তার কারণ একদিনে আদর্শে পৌঁছান যায় না এবং স্বার্থপরতা সম্পূর্ণভাবে দূর করতে হলে অনেকদিন ধরে সাধনা করা চাই।

 ন-বৌদিদি যদি নিজের অসুবিধা করে বা ন-দাদার অসুবিধা করে আমাদের জন্য এখানে আসতেন, তাতে আমি মোটেই সুখী হতুম না। তবে যদি ছায়ার বা রাধুর জন্য বা নিজের একটু হাওয়া পরিবর্ত্তনের জন্য আসতেন তাতে সুখী হতুম—সে কথা বলা বাহুল্য। আমাকে সর্ব্বদা সকল রকম অবস্থার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে এবং এর জন্য বহুদিনের অভ্যাস চাই। তা’ না হ’লে হঠাৎ একদিন বিপদ যখন আসবে তখন তো মন ঠিক রাখতে পারব না। আমি অতি অধম, অতি দুর্ব্বল ছিলুম; গত ১৬।১৭ বৎসর নিজের মনের সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধ করতে করতে যা-কিছু সংগ্রহ করেছি। এ সংগ্রামের বোধ হয় শেষ নাই, কারণ মনের উন্নতিরও কোনও শেষ নাই—যত উঁচুতে ওঠা যায়, আরও বেশী উঁচুতে উঠতে ইচ্ছা হয়। ফলে যুদ্ধ চলতেই থাকে।

 যাক্ অনেক বাজে বকলুম, কিছু মনে করবেন না। পাগল আমি নই, তবে যদি মনে করেন তাতে আমার কোন আপত্তি নাই। একটু আধটু ছিট না থাকলে চলবে কেন? একেবারে স্থিরমস্তিষ্ক হওয়াটা কি ভাল!

 আমার জন্য কোনও চিন্তা নাই, বেশ আছি। পলি বোধ হয় একটু একলা পড়ে গেছে। সমবয়সী কেহ নাই।

 রাঙ্গা মামাবাবুর আসা সম্বন্ধে কিছু স্থির হলে আমাকে জানাবে এবং অশোককে বলবেন বইগুলি পাঠিয়ে দিতে।

 ওজনের কলের ভাঙ্গা অংশটা মেরামত হয়ে এসেছে। কিন্তু, আগেকার মত ঠিক record হয় না। ২।৪ পাউণ্ড এদিক-ওদিক হয়। মেজদাদাকে বলবেন যে আমার এখনকার ওজন ১৪৪-১৪৬: কলিকাতা থেকে যখন আসি তখন ছিল ১৩৪ পাউণ্ড।

 “Mother” বইটা আমার আর একবার পড়ার ইচ্ছা আছে। যদি লোক মারফৎ পাঠাবার সুবিধা হয় তো পাঠিয়ে দিবেন। ঐ বই-এর একটা সমালোচনা লিখবার ইচ্ছা আছে।

 যে প্রশ্ন নিয়ে আমি খুব চিন্তা করছিলুম—তার মীমাংসা হয়ে গেছে।

 আপনারা যখন কলিকাতায় যান তখন শান্তাহার ষ্টেশনে সাহা মহাশয় কি বাবার দুধ এনেছিলেন? এ বিষয়ে আপনারা কেহ লেখেন নাই। তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে একটা চিঠি লেখা দরকার। এখানে থাকার সম্বন্ধে আমার মত এই।

 (১) যদি প্রয়োজন হয় তবে এই মাসের ২০।২২ তারিখ নাগাদ কলিকাতা যাব—কাউন্সিলের জন্য। কাউন্সিল শেষ হয়ে গেলে কলিকাতা ছেড়ে কোথাও যাব।

 (২) আপনারা সকলে যদি সেপ্টেম্বর মাসে শিলং-এ আসেন তবে আমি শিলং ফিরে আসব। তারপর সেপ্টেম্বরের শেষে (অথবা সুবিধা হলে অক্টোবরের মাঝামাঝি) আমরা সকলে একসঙ্গে কলিকাতায় নেমে যাব।

 (৩) আপনি ও ছেলেরা না এলে মেজদাদা বোধ হয় একলা এখানে আসবেন না। উনি বলবেন—আমার Change দরকার নেই—শরীর বেশ ভালই আছে—সুতরাং কলিকাতায় থেকে কিছু টাকা রোজগার করি। আপনি যদি বলেন যে ছেলেমেয়েদের Change দরকার, তখন উনি সহজে কথা কাটাতে পারবেন না। বদি Vacation-এর মধ্যে টাকা রোজগার করা বিশেষ দরকার হয়, তবে সেপ্টেম্বর মাস এখানে কাটিয়ে উনি অক্টোবর মাসটা কলিকাতায় থাকতে পারেন। কিন্তু একমাস বিশ্রাম অন্ততঃপক্ষে তাঁর নেওয়া একান্ত দরকার।

 (৪) আপনারা এলে বড়দাদা বৌদিদি প্রভৃতিও আসতে পারেন। আপনাদের ঘর তো খালি পড়ে আছে—আপনারা এসে দখল করলেই পারেন। বড়দাদা বৌদিদি আমার ঘরে থাকবেন। আমি বড় ছেলেদের (যেমন অশোক, অমি) নিয়ে Cottage-এ থাকতে পারি—তাতে আমার Cottage দখল করবার সুযোগ হবে।

 (৫) যদি কলিকাতা থেকে সেপ্টেম্বর মাসে কেহ না আসেন তা হলে Council-এর শেষে আমার এখানে ফিরবার ইচ্ছা নাই। তা হলে আমি বরং কটক পুরীর দিকে যাব।

 (৬) যদি কাউন্সিলে যাওয়া না হয় এবং সেপ্টেম্বর মাসে কেহ না আসেন তা হলে আমরা সকলে (এখন যাঁরা এখানে আছেন) এই মাসের শেষে নেমে যেতে পারি।

 অনেক কথা লিখলুম। আমার শরীর ক্রমশঃ ভালই হচ্ছে। পেটের অবস্থা পূর্ব্বাপেক্ষা কিছু ভাল। রাত্রে এখন লঘু আহার করি—যেমন Benjers food, toast ইত্যাদি।

 আশা করি ওখানকার সব কুশল। আমার প্রণাম জানবেন।

ইতি—

আপনাদের সেবক

শ্রীসুভাষ।