পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৩৪

উইকিসংকলন থেকে
৩৪
Craig Mount
Darjeeling
শনিবার
২০।১১।১৫

 এখানে পরশুদিন আসিয়াছি। এক হিসাবে কার্সিয়াং-এর চেয়ে এ স্থানটি ভাল। খাবার দাবার ভাল পাওয়া যায় এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব সুন্দর পাওয়া যায়। তা ছাড়া দেখিবার কয়েকটী জিনিষ আছে। Observatory Hill, Botanical Gardens, Museum, Race Course, গোরাদের Barracks এবং Mount Sinchal গিয়াছিলাম। Mt. Sinchal থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ত দেখাই যায়—তা ছাড়া Everestও দেখিলাম। সিঞ্চল প্রায় ৮৪০০ ফুট উচ্চ— সেখানে আজ সকালে গিয়াছিলাম। প্রায় ছয় মাইল Uphill. ভাগ্যচক্রে আকাশ পরিষ্কার ছিল এবং Everest দেখা গেল।

 তবে এ সহরটা হচ্ছে—“Calcutta transferred to the hills” এই যা দোষ। এখন নির্জ্জন—লোকেরা নেমে গেছে—তাই বেশ লাগছে।

 বারান্দা থেকে পরিষ্কার Snowview পাওয়া যায়। চারিদিকে পাহাড়, খালি পাহাড়—আর অভ্রভেদী হিমশিখর শুভ্রতুষার কিরীটী কাঞ্চনজঙ্ঘা। কত সুন্দর এ স্থান! ভাবিতে গেলে চোখে জল আসে। গগনের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত শুভ্রতুষারময় গিরিমালা—তরঙ্গায়িত আকাশপৃষ্ঠে। বহুদূরে পর্ব্বতগাত্রে লামাদের বৌদ্ধ মঠ আছে, Extreme individualistic life যাপন করিতে গেলে পরিব্রাজকের জীবনের মত এত আনন্দময় জীবন নাই। ইচ্ছা করে পাহাড় দিয়ে সিকিম নেপাল চলিয়া যাইতে। তিব্বত যাইবার পথ আছে। সেখান দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যও চলে।

 কিন্তু পরিব্রাজকের জীবন যাপন বর্ত্তমান যুগে বঙ্গীয় যুবকের সাজায় না। তার স্কন্ধে গুরুতর কর্ত্তব্য রহিয়াছে।

 কার্সিয়ং-এ এক ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন “কেমন enjoy করিতেছেন?” ভদ্রতার খাতিরে আমি উত্তর করিলাম “বেশ ভালই।” কিন্তু নিজ মনে হইল যে enjoyment-এর কাল গিয়াছে। মনে আছে ৮ বৎসর পূর্ব্বে যখন পূজার ছুটীতে—প্রথমবার দার্জ্জিলিঙ আসি তখন কি আনন্দ! আমরা বাড়ীতে একরকম বাঁধা থাকিতাম তাই বাড়ী ছাড়িব ভাবিয়া কি আনন্দ! তখন এসেছিলাম অবশ্য enjoyment-এর জন্য। কিন্তু আজ আমার কি পরিবর্ত্তন! তখন boyish emotion-এর বশবর্ত্তী হইয়া বলিয়াছিলাম——“জীবনের সর্ব্বাপেক্ষা আনন্দের দিন হইবে—যেদিন independent হইব এবং তারপর সবচেয়ে আনন্দ হইবে যেদিন দার্জ্জিলিঙ্গ যাইব।”

 কিন্তু আজ জীবন আমার enjoyment-এর জন্য নহে। অবশ্য আমার জীবন নিরানন্দ নহে কিন্তু আমার জীবন enjoyment-এর জন্য নহে—my life is a mission—a duty. ভদ্রলোকটী বোধ হয় enjoy করিবার জন্য কার্সিয়ং এসেছিলেন কিন্তু আমি জানি আমি এসেছি physical and moral improvement-এর জন্য। এ পাহাড় ছাড়িয়া যাইতে ইচ্ছা হয় না। অবশ্য বঙ্গদেশের অন্যান্য আকর্ষণ আছে—কিন্তু তা ছাড়া এ “পাহাড়ী জঙ্গলী” দেশ অতুলনীয়। বাস্তবিক হিমাচল প্রদেশ দেবতার বাসস্থান—স্বর্গ। আমাদের এক অজ্ঞ পাচক ঠাকুর কার্সিয়ং-এ কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া বলিল—“ঐ দিকে স্বর্গ।” সকলে তার কথা শুনিয়া হাসিল। আমি কিন্তু মনে ২ করিলাম তার কথা metaphorically সত্য।

 যাক্—বলিতে গেলে কথার শেষ হইবে না।

 আমি এখানে এসে এক বড়লোক আত্মীয়ের কাছে আছি, ওঁরা খুব যত্ন করিতেছেন—আশাতীত যত্ন। আমি এবং এক মাতুল এখানে আসিয়াছি। আমার পাগলামির কথা এখানে সকলে জানে এবং এবার আসাতে আরও কিছু জানিল।

 যাক্—আমার কথা অনেক লিখিলাম। কাল কার্সিয়ং যাব— পরশু কলিকাতায় রওনা হইব। পরশুদিন ১১টায় শিয়ালদহে পঁহুছিব—সেইদিনই কলেজ করিবার চেষ্টা করিব।

 তোমার সঙ্গে দেখা হইলে তোমার উপর বিচার বসিবে। শরীর অবহেলার কারণ investigate করিতে হইবে।

তোমার পত্র পাই—কিন্তু তোমার সম্বন্ধে বড় একটা কথা থাকে না। তারও বিচার হইবে।