পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৫৬

উইকিসংকলন থেকে
৫৬

(পরবর্ত্তী তিনখানি পত্র শরৎচন্দ্র বসুকে লিখিত)

লে-অন্-সী
এসেক্স
২২।৯।২০

পরম পূজনীয় মেজদাদা,

 আপনার অভিনন্দনসূচক পত্র পাইয়া যারপরনাই আনন্দিত হইয়াছি। জানি না আই. সি. এস. পরীক্ষা পাশ করিয়া আমার কী তেমন লাভ হইয়াছে, কিন্তু এই খবরে যে সকলে খুসী হইয়াছেন এবং বিশেষতঃ বাবা ও মায়ের মন এই দুর্দ্দিনে যে একটু হাল্কা হইয়াছে ইহাতেই আমার আনন্দ।

 আমি এখানে বেট্‌স্ পরিবারের অতিথিরূপে বাস করিতেছি। শ্রীমতী বেট্‌স্‌-এর মধ্যে ইংরাজ চরিত্রের শ্রেষ্ঠ পরিচয় পাই। ভদ্রলোক মার্জ্জিত, মতামতে উদার এবং ভাবে সর্ব্বদেশিক।···রুশ, পোল্যাণ্ডবাসী, লিথুয়ানীয়, আয়র্লণ্ডীয় ও অন্যান্য বিদেশী বন্ধুদের সঙ্গে তাঁহার বন্ধুত্ব। রাশিয়ান, আইরিশ ও ভারতীয় সাহিত্যে তাঁহার প্রচুর উৎসাহ, রমেশ দত্ত এবং রবীন্দ্রনাথের রচনায় তাঁহার গভীর অনুরাগ।···পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করায় আমি রাশিকৃত অভিনন্দন পাইতেছি। তবে আই. সি. এস. গোষ্ঠীতে প্রবেশ করার চিন্তায় যে কিছুমাত্র আনন্দ পাইতেছি একথা বলা চলে না। যদি এই চাকুরিতে যোগ দিতে হয় তবে এ পরীক্ষার জন্য পড়াশুনা করিতে যেরূপ অনিচ্ছা লইয়া বসিয়াছিলাম সেরূপ অনিচ্ছার সঙ্গেই তাহা করিতে হইবে।

 চাকুরি জীবনে মোটা মাহিনা এবং তাহার পর মোটা পেন্‌সন্‌ আমার বরাদ্দ থাকিবে তাহা জানি। দাসত্বে যদি যথেষ্ট কুশলতা অর্জ্জন করি তাহা হইলে একদিন কমিশনার পদে অধিষ্ঠিত হইবার আশা আছে। যোগ্যতা থাকিলে, গোলামিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হইলে হয়ত, কোন প্রদেশ সরকারের চীফ্ সেক্রেটারী হওয়া অসম্ভব নহে। কিন্তু চাকুরিকেই কি আমার জীবনের শেষ লক্ষ্য বলিয়া মানিয়া লইতে হইবে? চাকুরিতে সাংসারিক সুখ পাওয়া যাইবে, কিন্তু সেটা কি আত্মার মূল্য দিয়াই ক্রয় করিব? আমার মনে হয় আই. সি. এস. গোষ্ঠীর কোন লোককে চাকুরির আইন-কানুনকে যে ভাবে মাথা নিচু করিয়া মানিয়া লইতে হয় তাহার সঙ্গে জীবনের উচ্চ আদর্শকে মানাইয়া লইবার চেষ্টা ভণ্ডামি ভিন্ন কিছু নয়।

 সাধারণ লোকের কথায় যাহাকে বলে জীবনে উন্নতি করা তাহার তোরণে দাঁড়াইয়া আমার মনের অবস্থা কী হইয়াছে তাহা আপনি নিশ্চয় বোঝেন। এ চাকুরির স্বপক্ষে বলিবার অনেক কিছু আছে। প্রত্যহ অগণ্য লোকে যে অন্নের চিন্তায় হাবুডুবু খাইতেছে সেই অন্নচিন্তা ইহাতে চিরকালের জন্য মিটিয়া যাইবে। জীবনের সম্মুখে দাঁড়াইয়া সাফল্য অসাফল্য সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নাই, সংশয় নাই। কিন্তু আমার মত মনোবৃত্তির লোক যে চিরকাল “উদ্ভট” জিনিসেরই পূজা করিয়া আসিয়াছে তাহার পক্ষে স্রোতে গা ভাসাইয়া নিশ্চিন্ত হওয়াটাই শ্রেষ্ঠ পথ নহে। সংগ্রাম ভিন্ন বিপদ ভিন্ন জীবনের স্বাদই অনেকখানি অন্তর্হিত হইয়া যায়। যাহার অন্তরের মধ্যে সাংসারিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার দংশন নাই তাহার নিকট জীবনের সংশয়, বিপদ ততটা ভয়াবহ নহে। উপরন্তু, একথা ঠিক যে সিভিল সার্ভিসের শৃঙ্খলের মধ্যে আবদ্ধ থাকিয়া দেশের সত্যকারের কাজ করা চলে না। এক কথায় সিভিল সার্ভিসের আইন কানুনের প্রতি আনুগত্যের সঙ্গে জাতীয় ও আধ্যাত্মিক আকাঙক্ষাকে মেলানো চলে না।

 আমি বুঝিতেছি যে এসব কথা বলিয়া কোনো ফল হইবে না, কারণ আমার ইচ্ছায় কিছু হইবে না। সিভিল সার্ভিস সম্বন্ধে আপনার কোন মোহ নাই তাহা আমি জানি, কিন্তু আমার চাকুরি ছাড়ার কথাতে বাবা যে খড়্গহস্ত হইয়া উঠিবেন সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। তিনি আমাকে যত শীঘ্র সম্ভব জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত দেখবার জন্য উদগ্রীব!....

 ·····সুতরাং দেখিতেছি যে অর্থনৈতিক কারণে ও স্নেহের বন্ধনের ফলে আমার ইচ্ছাকে আদৌ আমার বলিয়া দাবী করিতে পারি না। কিন্তু একথা বিনা দ্বিধায় বলিতে পারি যে আমার ইচ্ছাই যদি চূড়ান্ত হইত তাহা হইলে সিভিল সার্ভিসে আমি কখনই যোগ দিতাম না।

 আপনি হয়ত বলিবেন যে এ চাকুরি এড়াইবার চেষ্টা না করিয়া ইহার ভিতরে প্রবেশ করিয়া ইহার পাপকে দূর করাই উচিত এবং সে কথা বলিলে অবশ্যই অন্যায় বলা হইবে না। কিন্তু যদি তাহাই করি তাহা হইলেও যে কোনোদিন অবস্থা এমন অসহ্য হইয়া দাঁড়াইতে পারে যে ইস্তফা দেওয়া ভিন্ন আমার গত্যন্তর থাকিবে না। এখন হইতে পাঁচ দশ বৎসর পরে যদি এরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তাহা হইলে জীবনে নূতন করিয়া পথ করিয়া লইবার উপায় থাকিবে না। সেক্ষেত্রে আজ আমার সম্মুখে অন্য পথ উন্মুক্ত রহিয়াছে।

 সন্দেহবাদী লোকে বলিবে যে চাকুরি প্রশস্ত কোলে একবার ঠাঁই করিয়া লইবার পর আমার সমস্ত তেজ উবিয়া যাইবে। কিন্তু এই ক্ষয়কারী প্রভাব আমার উপর কিছুতেই পড়িতে দিব না, এ বিষয়ে আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমি বিবাহ করিব না, সুতরাং যখন যাহা সত্য বুঝিব তাহাকে পালন করার পথে সাংসারিক বিবেচনার অধীন হইয়া থাকিতে হইবে না।

 আমার মনের গঠন যেরূপ তাহাতে আমার সত্যই সন্দেহ হয় যে সিভিল সার্ভিসের পক্ষে আমার যোগ্যতা আছে কি না। বরঞ্চ আমার ধারণা, যেটুকু ক্ষমতা আমার আছে তাহা অন্য ভাবে আমার নিজের এবং আমার দেশের উপকারে লাগাইতে পারিব।

 এবিষয়ে আপনার মতামত জানিতে পারিলে আনন্দিত হইব। বাবাকে এ বিষয়ে কিছু লিখি নাই—কেন তাহা ভাবিয়া পাইতেছি না। তাঁহার মতও জানিতে পারিলে সুবিধা হইত।

(ইংরাজী হইতে অনূদিত)