পথের দাবী/১১
১১
অপূর্ব্বর যাইবার জায়গা একমাত্র ছিল তলওয়ারকরের বাটী। এখানে বাঙালীর অভাব নাই, কিন্তু আসিয়া পর্য্যন্ত এমন ঝড়-ঝাপটার মধ্যেই তাহার দিন কাটিয়াছে যে কাহারও সহিত পরিচয় করিবার আর ফুরসৎ পায় নাই। বাহির হইয়া আজও সে রেলওয়ে স্টেশনের দিকেই চলিয়াছিল, কিন্তু হঠাৎ মনে পড়িল আজ শনিবার, তাহার সস্ত্রীক থিয়েটারে যাইবার কথা। অতএব পথে পথে ঘুরিয়া বেড়ানো ব্যতীত অন্য কিছু করিবার যখন রহিল না এবং কোথায় যাইবে ভাবিতেছে, তখন অকস্মাৎ ভারতীকে মনে পড়িয়া তাহার প্রতি গভীর অকৃতজ্ঞতা আজ তাহাকে তীক্ষ্ণ করিয়া বিঁধিল। তাহার আহত অপরাধী মন তাহারি কাছে যেন জবাবদিহি করিয়া বারবার বলিতে লাগিল, সে ভালই আছে, তাহার কিছুই হয় নাই; নহিলে এতবড় জীবন-মরণ সমস্যার একটা খবর পর্য্যন্ত দিত না তাহা হইতেই পারে না, তবুও সে ওই জবাবদিহির বেশি আর অগ্রসর হইল না। তেলের কারখানার কাছাকাছি কোথায় তাহার নূতন বাসা ইহা সে ভুলে নাই, ইহাই খুঁজিয়া বাহির করিবার কল্পনায় মন তাহার নাচিয়া উঠিল, কিন্তু এমন করিয়া যে-লোক আত্মগোপন করিয়া আছে, এতকাল পরে তাহার তত্ত্ব লইতে যাওয়ার লজ্জাও সে সম্পূর্ণ কাটাইয়া উঠিতে পারিল না। হয়ত সে ইহাও চাহে না, হয়ত সে তাহাকে দেখিয়া বিরক্ত হইবে, তাই চলিতে চলিতে আপনাকে আপনি সে একশতবার করিয়া বলিতে লাগিল, পুলিশের লোকে তাহার সই চাহে, অতএব কাজের জন্যই সে আসিয়াছে; সে কেমন আছে কোথায় আছে এ-সকল অকারণ কৌতূহল তাহার নাই। এতদিন পরে এ অভিযোগ ভারতী কোন মতেই তাহার প্রতি আরোপ করিতে পারিবে না।
এ অঞ্চলে অপূর্ব্ব আর কখনো আসে নাই। পূর্ব্বমুখে প্রশস্ত রাস্তা সোজা গিয়াছে, অনেক দূর হাঁটিয়া ডান দিকে নদীর ধারে যে পথ, সেইখানে আসিয়া একজনকে সে জিজ্ঞাসা করিল, এদিকে সাহেব মেমেরা কোথায় থাকে জানো? লোকটি প্রত্যুত্তরে আশে-পাশে যে সকল ছোট-বড় বাঙলো দেখাইয়া দিল তাহাদের আকৃতি, অবয়ব ও সাজসজ্জা দেখিয়াই অপূর্ব্ব বুঝিল তাহার প্রশ্ন করা ভুল হইয়াছে, সংশোধন করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, অনেক বাঙালীরাও ত থাকে এখানে কেউ কারিকর, কেউ মিস্ত্রী, তাদের ছেলেমেয়েরা—
লোকটি কহিল, ঢের ঢের। আমিই ত একজন মিস্ত্রী। আমার তাঁবেই ত পঞ্চাশজন কারিকর—যা করব তাই! ছোট সাহেবকে বলে জবাব পর্য্যন্ত দিতে পারি। কাকে খোঁজেন?
অপূর্ব্ব চিন্তা করিয়া কহিল, দেখো, আমি যাকে খুঁজি—আচ্ছা, যারা বাঙালী ক্রীশ্চান কিংবা—
লোকটি আশ্চর্য্য হইয়া বলিল, বলচেন বাঙালী,—আবার খ্রীষ্টান কি রকম? খ্রীষ্টান হলে আবার বাঙালী থাকে না কি? খ্রীষ্টান—খ্রীষ্টান। মোচলমান—মোচলমান। ব্যস, এই ত জানি মশায়!
অপূর্ব্ব বলিল, আহা! বাঙলা দেশের লোক ত! বাঙলা ভাষা বলে ত?
সে গরম হইয়া কহিল, ভাষা বললেই হ’ল? যে জাত দিয়ে খ্রীষ্টান হয়ে গেল তাতে আর পদার্থ রইল কি মশায়? কোন বাঙালী তার সঙ্গে আচার-ব্যবহার করুক্ একবার দেখি ত! ওই যে কোত্থেকে সব মেয়ে-মাস্টার এসেচে ছেলেপুলেদের পড়ায়—ব্যস্! তা বলে কেউ কি তাদের সঙ্গে খাচ্ছে, না বসচে?
অপূর্ব্ব কূল দেখিতে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তিনি কোথায় থাকেন জানেন!
সে কহিল, তা আর জানিনে। এই রাস্তায় সোজা গাঙের ধারে গিয়ে জিজ্ঞেসা করবেন নতুন ইস্কুল-ঘর কোথায়,—কচি ছেলেটা পর্য্যন্ত দেখিয়ে দেবে। ডাক্তারবাবু থাকেন কি না। মানুষ ত নয়,—দেবতা। মরা বাঁচাতে পারেন!—এই বলিয়া সে নিজের কাজে চলিয়া গেল। সেই পথে সোজা আসিয়া অপূর্ব্ব লাল রঙের একখানি কাঠের বাড়ি দেখিতে পাইল। বাড়িটি দ্বিতল, একেবারে নদীর উপরে। তখন রাত্রি হইয়াছে, পথে লোক নাই—উপরে খোলা জানালা হইতে আলো আসিতেছে, কাহাকেও জিজ্ঞাসা করিবার জন্য সে সেইখানে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল, কিন্তু মনের মধ্যে তাহার সন্দেহ রহিল না যে এইখানেই ভারতী থাকে এবং ওই জানালাতেই তাহার দেখা মিলিবে।
মিনিট পনর পরে জন দুই-তিন লোক বাহির হইয়া তাহাকে দেখিয়া সহসা যেন চকিত হইয়া উঠিল। একজন প্রশ্ন করিল, কে? কাকে চান?
তাহার সন্দিগ্ধ কণ্ঠস্বরে অপূর্ব্ব সঙ্কুচিত হইয়া বলিল, মিস্ জোসেফ বলে কোন স্ত্রীলোক থাকেন এখানে?
সে তৎক্ষণাৎ বলিল, থাকেন বই কি—আসুন।
অপূর্ব্বর ঠিক যাইবার সঙ্কল্প ছিল না, কিন্তু দ্বিধা করিতেই লোকটি কহিল, আপনি কতক্ষণ দাড়িয়ে ছিলেন? কিন্তু তিনি ত ঘরেই আছেন, আসুন। আমরা আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি, এই বলিয়া সে অগ্রসর হইল।
তাহার ত্বরা দেখিয়া স্পষ্টই বুঝা গেল ইহারা তাহাকে যাচাই করিয়া লইতে চায়। অতএব, দ্বার হইতে এখন না বলিয়া ফিরিতে চাহিলে সন্দেহ ইহাদের এমনিই বিশ্রী হইয়া উঠিবে যে সে তাহা ভাবিতেই পারিল না। তাই চলুন, বলিয়া সে লোকটির অনুসরণ করিয়া এক মুহূর্ত্ত পরেই এই কাঠের বাড়ির নীচেকার ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইল। ইহারই এক পাশ দিয়া উপরে উঠিবার সিঁড়ি। ঘরটি হলের মত প্রশস্ত। ছাদ হইতে ঝুলানো একটা মস্ত আলো, গোটা কয়েক টেবিল চেয়ার, একটা কালো বোর্ড এবং সমস্ত দেয়াল জুড়িয়া নানা আকারের ও নানা রঙের ম্যাপ টাঙানো। ইহাই যে নূতন স্কুলঘর অপূর্ব্ব তাহা দেখিয়াই চিনিল। তথায় চার-পাঁচ জন স্ত্রীলোক ও পুরুষে মিলিয়া বোধ হয় একটা তর্কই করিতেছিল, সহসা একজন অপরিচিত লোককে প্রবেশ করিতে দেখিয়া চুপ করিল। অপূর্ব্ব একবার মাত্র তাহাদের প্রতি কটাক্ষে চাহিয়া যে তাহাকে আনিয়াছিল তাহারই পিছনে পিছনে উপরে উঠিয়া গেল। ভারতী ঘরেই ছিল, অপূর্ব্বকে দেখিয়া তাহার মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, কাছে আসিয়া হাত ধরিয়া তাহাকে অভ্যর্থনা করিয়া চেয়ারে বসাইয়া কহিল, এতদিন আমার খোঁজ নেননি যে বড়?
অপূর্ব্ব বলিল, আপনিও ত আমাদের খোঁজ নেননি! কিন্তু কথাটা যে জবাব হিসাবে ঠিক হইল না তাহা সে বলিয়াই বুঝিল। ভারতী শুধু একটু হাসিল, কহিল, তেওয়ারী বাড়ি যেতে চাচ্ছে, যাক। না গেলে সে সারবে না।
অপূর্ব্ব কহিল, অর্থাৎ আপনি যে আমাদের খবর নেন না এ অভিযোগ সত্য নয়।
ভারতী পুনশ্চ একটু হাসিয়া কহিল, কাল রবিবার, কাল কিছু আর হবে না, কিন্তু পরশু বারোটার মধ্যেই কোর্টে গিয়ে টাকা আর জিনিসগুলো আপনার ফিরিয়ে আনবেন। একটু দেখে-শুনে নেবেন, যেন ঠকায় না।
আপনার কিন্তু একটা সই চাই।
তা জানি।
অপূর্ব্ব প্রশ্ন করিল, আপনার সঙ্গে তেওয়ারীর বোধ হয় দেখা হয়, না?
ভারতী মাথা নাড়িয়া বলিল, না। কিন্তু আপনি যেন গিয়ে তার ওপর দিছে রাগ করবেন না।
অপূর্ব্ব কহিল, মিছে না হোক, সত্যি রাগ করা উচিত। আপনি তার প্রাণ দিয়েচেন এটুকু কৃতজ্ঞতা তার থাকা উচিত ছিল।
ভারতী বলিল, নিশ্চয়ই আছে। নইলে, সে তো আমাকে জেলে পাঠাবার একবার অন্ততঃ চেষ্টা করেও দেখতো।
অপূর্ব্ব এ ইঙ্গিত বুঝিল। আনতমুখে ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া শেষে বলিল, আপনি আমার উপর ভয়ানক রাগ করে আছেন।
ভারতী বলিল, কখ্খনো না। সারাদিন ইস্কুলে ছেলেমেয়ে পড়িয়ে, ঘরে ফিরে আবার সমিতির সেক্রেটারির কাজে অসংখ্য চিঠিপত্র লিখে, বিছানায় শুতে-না-শুতেই ত ঘুমিয়ে পড়ি,—রাগ করবার সময় কোথায় আমার?
অপূর্ব্ব কহিল, ওঃ—রাগ করবারও সময়টুকু নেই?
ভারতী বলিল, কই আর আছে। আপনি বরঞ্চ কোনদিন সকাল থেকে এসে দেখবেন সত্যি না মিছে!
অপূর্ব্বর মুখ দিয়া অলক্ষিত একটা দীর্ঘশ্বাস পড়িল। কহিল, দেখবার আমার দরকার কি! একটুখানি থামিয়া কহিল, ইস্কুলে আপনাকে কত মাইনে দেয়?
ভারতী হাসি চাপিয়া গম্ভীর হইয়া কহিল, বেশ ত আপনি। মাইনের কথা বুঝি কাউকে জিজ্ঞাসা করতে আছে? এতে তার অপমান হয় না?
অপূর্ব্ব ক্ষুণ্ণকণ্ঠে কহিল, অপমান করবার জন্যে ত আর বলিনি। চাকরিই যখন করচেন—
ভারতী কহিল, না করে কি শুকিয়ে মরতে বলেন?
অপূর্ব্ব বলিল, ও যা চাকরি, এই ত শুকিয়ে মরা! তার চেয়ে বরঞ্চ আমাদের আফিসে একটা চাকরি আছে, মাইনে একশ’ টাকা—হয়ত দু-এক ঘণ্টার বেশী খাটতেও হবে না।
ভারতী প্রশ্ন করিল, আমাকে সেই চাকরি করতে বলেন?
অপূর্ব্ব কহিল, দোষই বা কি?
ভারতী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না, আমি করব না। আপনি ও তার কর্ত্তা, কাজে ভুলচুক হলেই লাঠি হাতে দরজায় এসে দাঁড়াবেন।
অপূর্ব্ব জবাব ছিল না। সে মনে মনে বুঝিল, ভারতী শুধু পরিহাস করিয়াছে, তথাপি তাহার সেই একটা দিনের আচরণের ইঙ্গিত করায় তাহার গা জ্বলিয়া গেল। কিছুক্ষণ হইতেই একটা তর্ক-বিতর্কের কলরোল নীচে হইতে শুনা যাইতেছিল, সহসা তাহা উদ্দাম হইয়া উঠিল। অপূর্ব্ব ভালমানুষটির মত জিজ্ঞাসা করিল, আপনাদের ইস্কুল বোস্লো বোধ হয়—ছেলেরা সব পড়ায় মন দিয়েচে।
ভারতী গম্ভীর মুখে কহিল, তাহলে হাঁকা-হাঁকিটা কিছু কম হ’তো। তাদের শিক্ষকেরা বোধ করি বিষয় নির্ব্বাচনে মন দিয়েচেন।
আপনি যাবেন না?
যাওয়া ত উচিত, কিন্তু আপনাকে ছেড়ে যেতে যে মন সরে না। এই বলিয়া সে মুখ টিপিয়া হাসিল। কিন্তু অপূর্ব্বর কান পর্য্যন্ত রাঙা হইয়া উঠিল। সে আর একদিকে চোখ ফিরাইয়া পাশের দেয়ালের গায়ে সাজানো কাঁচা ঝাউপাতা দিয়া লেখা কয়েকটা অক্ষরের প্রতি সহসা দৃষ্টিপাত করিয়া বলিয়া উঠিল, ওটা কি লেখা ওখানে?
ভারতী কহিল, পড়ুন না।
অপূর্ব্ব ক্ষণকাল মনঃসংযোগ করিয়া বলিল, পথের দাবী। তার মানে?
ভারতী কহিল, ওই আমাদের সমিতির নাম, ওই আমাদের মন্ত্র, ওই আমাদের সাধনা! আপনি আমাদের সভ্য হবেন?
অপূর্ব্ব বলিল, আপনি নিজে একজন সভ্য নিশ্চয়ই, কিন্তু কি আমাদের করতে হবে?
ভারতী বলিল, আমরা সবাই পথিক। মানুষের মনুষ্যত্বের পথে চলবার সর্ব্বপ্রকার দাবী অঙ্গীকার করে আমরা সকল বাধা ভেঙে-চুরে চলবো। আমাদের পরে যারা আসবে তারা যেন নিরুপদ্রবে হাঁটতে পারে, তাদের অবাধ মুক্ত গতিকে কেউ যেন না রোধ করতে পারে, এই আমাদের পণ। আসবেন আমাদের দলে?
অপূর্ব্ব কহিল, আমরা পরাধীন জাতি, ইংরেজ নই, ফরাসী নই, আমেরিকান নই,—কোথায় পাবো আমরা অপ্রতিহত গতি? স্টেশনের একটা বেঞ্চে বসবার আমাদের অধিকার নেই,—অপমানিত হয়ে নালিশ করবার পথ নেই,—বলিতে বলিতে সেদিনের সমস্ত লাঞ্ছনা,—ফিরিঙ্গী ছোঁড়াদের বুটের আঘাত হইতে স্টেশন মাস্টারের বাহির করিয়া দেওয়া অবধি সকল অপমান কষ্ট অনুভব করিয়া তাহার দুই চক্ষু প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল, কহিল, আমরা বসলে বেঞ্চ অপবিত্র হয়, আমরা গেলে ঘরের হাওয়া কলুষিত হয়,—আমরা যেন মানুষ নই! আমাদের যেন মানুষের প্রাণ, মানুষের রক্ত-মাংস গায়ে নেই! এই যদি আমাদের সাধনা হয়, আছি আমি আপনাদের দলে।
ভারতী কহিল, আপনি কি মানুষের জ্বালা টের পান অপূর্ব্ববাবু? সত্যই কি মানুষের ছোঁয়ায় মানুষের আপত্তি করবার কিছু নেই, তার গায়ের বাতাসে আর একজনের ঘরের বাতাস অপবিত্র হয়ে ওঠে না?
অপূর্ব্ব তীব্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, নিশ্চয় নয়। মানুষের চামড়ার রঙ ত তার মনুষ্যত্বের মাপকাঠি নয়। কোন একটা বিশেষ দেশে জন্মানই ত তার অপরাধ হতে পারে না। মাপ করবেন আপনি, কিন্তু জোসেফ সাহেব ক্রীশ্চান বলেই ত শুধু আদালতে আমার কুড়ি টাকা দণ্ড হয়েছিল। ধর্ম্মমত ভিন্ন হলেই কি মানুষ হীন প্রতিপন্ন হবে? এ কোথাকার বিচার! এই বলচি আপনাকে আমি, এর জন্যই এরা একদিন মরবে। এই যে মানুষকে অকারণে ছোট করে দেখা, এই যে ঘৃণা এই যে বিদ্বেষ, এ অপরাধ ভগবান কখ্খনো ক্ষমা করবেন না।
বেদনা ও লাঞ্ছনার মত মানুষের সত্যবস্তুটিকে টানিয়া বাহিরে আনিতে ত দ্বিতীয় পদার্থ নাই, তাই সে সমস্ত তুলিয়া অপমানকারীর বিরুদ্ধে অপমানিতের, পীড়কের বিরুদ্ধে পাড়িতের মর্ম্মান্তিক অভিযোগে সহস্রমুখ হইয়া উঠিয়াছিল। ভারতী তাহার দৃপ্ত মুখের প্রতি চাহিয়া এতক্ষণ নিঃশব্দে বসিয়াছিল। কিন্তু কথা তাহার শেষ হইতেই সে শুধু একটু মুচকিয়া হাসিয়া মুখ ফিরাইল। অপূর্ব্ব চমকিয়া উঠিল, তাহার মুখের উপর কে যেন সজোরে মারিল। ভারতীয় কোন প্রশ্নই এতক্ষণ সে খেয়াল করে নাই, কিন্তু সেগুলি অগ্নিরেখার মত তাহার মাথার মধ্যে দিয়া সশব্দে খেলিয়া গিয়া তাহাকে একেবারে বাক্যহীন করিয়া দিল।
মিনিট খানেক পরে ভারতী পুনরায় যখন মুখ ফিরাইয়া চাহিল, তখন তাহার ওষ্ঠাধারে হাসির চিহ্নমাত্র ছিল না, কহিল, আজ শনিবারে আমাদের স্কুল বন্ধ, কিন্তু সমিতির কাজ হয়। চলুন না, নীচে গিয়ে আপনাকে ডাক্তারের সঙ্গে পরিচিত করে দিয়ে পথের দাবীর সভ্য করে দিই।
তিনি বুঝি সভাপতি?
সভাপতি? না, তিনি আমাদের মূল শিকড়। মাটির তলায় থাকেন, তাঁর কাজ চোখে দেখা যায় না।
শিকড়ের প্রতি অপূর্ব্বর কিছুমাত্র কৌতূহল জন্মিল না। জিজ্ঞাসা করিল, আপনাদের সভ্যরা বোধহয় সকলে ক্রীশ্চান?
ভারতী কহিল, না, আমি ছাড়া সকলেই হিন্দু।
অপূর্ব্ব আশ্চর্য্য হইয়া কহিল, কিন্তু মেয়েদের গলা পাচ্ছি যে?
ভারতী কহিল, তাঁরাও হিন্দু।
অপূর্ব্ব মুহূর্ত্তকাল দ্বিধা করিয়া বলিল, কিন্তু তাঁরা বোধ হয় জাতিভেদ—অর্থাৎ কিনা, খাওয়া ছোঁয়ায় বিচার বোধ করি করেন না?
ভারতী বলিল, না। তারপরে হাসিমুখে কহিল, কিন্তু কেউ যদি মেনে চলেন, তার মুখেও আমরা কেউ খাবার জিনিস জোর করে গুঁজে দিইনে। মানুষের ব্যক্তিগত প্রবৃত্তিকে আমরা অত্যন্ত সম্মান করে চলি। আপনার ভয় নেই।
অপূর্ব্ব বলিল, ভয় আবার কিসের? কিন্তু—আচ্ছা, আপনার মত শিক্ষিতা মহিলাও বোধ করি আপনাদের দলে আছেন?
আমার মত? এই বলিয়া সে হাসিয়া কহিল, আমাদের প্রেসিডেণ্ট যিনি, তাঁর নাম সুমিত্রা, তিনি একলা পৃথিবী ঘুরে এসেচেন,—শুধু ডাক্তার ছাড়া তাঁর মত বিদুষী বোধ হয় এ দেশে কেউ নেই।
অপূর্ব্ব বিস্ময়াপন্ন হইয়া প্রশ্ন করিল, আর ডাক্তার যাঁকে বলচেন, তিনি?
ডাক্তার? শ্রদ্ধায় ও ভক্তিতে ভারতীয় দুইচক্ষু যেন সজল হইয়া উঠিল, কহিল, তাঁর কথা থাক্ অপূর্ব্ববাবু। পরিচয় দিতে গেলেই হয়ত তাঁকে ছোট করে ফেলবো।
অপূর্ব্ব আর কোন প্রশ্ন না করিয়া চুপ করিয়া রহিল। দেশের প্রতি ভালবাসার নেশা তাহার রক্তের মধ্যে—এই দিক দিয়া পথের দাবীয় বিচিত্র নামটা তাহাকে টানিতে লাগিল। এই সঙ্গীহীন, বন্ধুহীন বিদেশে এতগুলি অসাধারণ শিক্ষিত নরনারীর আশা ও আকাঙ্খা, চেষ্টা ও উদ্যম, তাহাদের ইতিহাস, তাহাদের রহস্যময় কর্ম্মজীবনের অপরিজ্ঞাত পদ্ধতি ওই যে অদ্ভুত নামটাকে জড়াইয়া উঠিতে চাহিতেছে তাহার সহিত ঘনিষ্ঠ মিলনের লোভ সংবরণ করা কঠিন, কিন্তু তবুও কেমন যেন একপ্রকার বিজাতীয়, ধর্ম্মবিহীন, অস্বাস্থ্যকর বাষ্প নীচে হইতে উঠিয়া তাহার মনটাকে ধীরে ধীরে গ্লানিতে ভরিয়া আনিতে লাগিল।
কলরব বাড়িয়া উঠিতেই ছিল, ভারতী কহিল, চলুন যাই।
অপূর্ব্ব সায় দিয়া বলিল, চলুন—
উভয়ে নীচে আসিলে ভারতী তাহাকে একটা বেতের সোফায় বসিতে দিয়া স্থানাভাবে তাহার পার্শ্বে ই উপবেশন করিল।
এই আসনটি এমন সঙ্কীর্ণ যে এতে লোকের সম্মুখে ভদ্রতা রক্ষা করিয়া দুজনের বসা চলে না। এরূপ অদ্ভুত আচরণ ভারতী কোনদিন করে নাই, অপূর্ব্বর শুধু সঙ্কোচ নয়, অত্যন্ত লজ্জা বোধ করিতে লাগিল, কিন্তু এখানে এই সকল ব্যাপারে ভ্রূক্ষেপ করিবারও যেন কাহারও অবসর নাই। সে আর একটা বস্তু লক্ষ্য করিল যে, তাহার মত অপরিচিত ব্যক্তিকে আসন গ্রহণ করিতে দেখিয়া প্রায় সকলেই চাহিয়া দেখিল, কিন্তু, যে বিতণ্ডা উদ্দাম বেগে বহিতেছিল তাহাতে লেশমাত্র বাধা পড়িল না। কেবল একটি মাত্র লোক যে পিছন ফিরিয়া কোণের টেবিলে বসিয়া লিখিতেছিল সে লিখিতেই রহিল তাহার আগমন বোধ হয় জানিতেই পারিল না। অপূর্ব্ব গনিয়া দেখিল ছয়জন রমণী এবং আটজন পুরুষে মিলিয়া এই ভীষণ আলোচনা চলিতেছে। ইহাদের সকলেই অচেনা কেবল একটি ব্যক্তিকে অপূর্ব্ব চক্ষের পলকে চিনিতে পারিল। বেশভূষার কিছু পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে বটে, কিন্তু এই মূর্ত্তিকেই সে কিছুকাল পূর্ব্বে মিক্থিলা রেলওয়ে স্টেশনে টিকিট না কেনার দায় হইতে পুলিশের হাত হইতে রক্ষা করিয়াছিল এবং টাকাটা যত শীঘ্র সম্ভব ফিরাইয়া দিতে যিনি স্বেচ্ছায় প্রতিশ্রুত হইয়াছিলেন। লোকটি চাহিয়া দেখিল, কিন্তু মদের নেশায় যাহার কাছে হাত পাতিয়া উপকার গ্রহণ করিয়াছিলেন, মদ না-খাওয়া অবস্থায় তাহাকে স্মরণ করিতে পারিলেন না। কিন্তু ইহার জন্য নয়, ভারতীকে মনে করিয়া তাহার বুকে এই ব্যথাটা অতিশয় বাজিল যে এরূপ সংসর্গে সে আসিয়া পড়িল কিরূপে?
সুমুখে কে একজন দাঁড়াইয়াছিল, বসিয়া পড়িতেই অপূর্ব্বর কানের কাছে মুখ আনিয়া ভারতী চুপি চুপি কহিল, উনিই আমাদের প্রেসিডেণ্ট সুমিত্রা।
বলিবার প্রয়োজন ছিল না। অপূর্ব্ব দেখিয়াই চিনিল। কারণ, নারীকে দিয়াই যদি কোন সমিতি পরিচালনা করিতে হয়, এই ত সেই বটে! বয়স বোধ করি ত্রিশের কাছে পৌঁছিয়াছে, কিন্তু যেন রাজ-রাণী! বর্ণ কাঁচা সোনার মত, দাক্ষিণাত্যের ধরণে এলো করিয়া মাথায় চুল বাঁধা, হাতে গাছ-কয়েক করিয়া সোনায় চুড়ি, ঘাড়ের কাছে সোনার হারের কিয়দংশ চিক্ চিক্ করিতেছে, কানে সবুজ পাথরের তৈরী দুলের উপর আলো পড়িয়া যেন সাপের চোখের মত জ্বলিতছে,—এই ত চাই! ললাট, চিবুক, নাক, চোখ, ভ্রূ, ওষ্ঠাধর,—কোখাও যেন আর খুঁত নাই—একি ভয়ানক আশ্চর্য্য রূপ! কালো বোর্ডের গায়ে একটা হাত রাখিয়া তিনি দাঁড়াইয়াছিলেন, অপূর্ব্বর চোখে আর পলক পড়িল না। সে আঁক কষিয়াই মানুষ হইয়াছে, কাব্যের সহিত পরিচয় তাহার অত্যন্ত বিরল, কিন্তু, কাব্য যাঁহারা লেখেন, কেন যে তাঁহারা এত কিছু থাকিতে তরুণ লতিকার সঙ্গেই নারীদেহের তুলনা করেন তাহার জানিবার কিছু আর রহিল না। সম্মুখে একটি বিশ-বাইশ বছরের সাধারণ গোছের মহিলা আনতমুখে বসিয়াছিলেন, ভাবে বোধ হয় তাঁহাকেই কেন্দ্র করিয়া এই তর্কের ঝড় উঠিয়াছে। আবার তাঁহারই অনতিদূরে রসিয়া প্রৌঢ় গোছের একজন ভদ্রলোক; তাঁহার পরনের কাটছাঁট পরিশুদ্ধ বিলাতি পোষাক দেখিয়া অবস্থাপন্ন বলিয়াই মনে হয়। খুব সম্ভব তিনিই প্রতিপক্ষ, কি বলিতেছিলেন অপূর্ব্ব ভাল শুনিতেও পায় নাই, মনোযোগও করে নাই, তাদের সমস্ত চিত্ত সুমিত্রার প্রতিই একেবারে একাগ্র হইয়া গিয়াছিল। তাঁহার কণ্ঠস্বরে কি জানি কোন পরম বিস্ময় ঝরিয়া পড়িবে এই ছিল তার আশা। অনতিকাল পূর্ব্বের ক্ষোভের হেতু তাঁহার মনেও ছিল না। সাহেবি পোষাক-পরা ভদ্রলোকটির প্রত্যুত্তরে এইবার তিনি কথা কহিলেন। এই ত! নারীর কণ্ঠস্বর ত একেই বলে! ইহার কণাটুকুও না বাদ যায়, অপূর্ব্ব এমনি করিয়াই কান পাতিয়া রহিল। সুমিত্রা কহিলেন, মনোহরবাবু, আপনি ছেলেমানুষ উকিল নয়, আপনার তর্ক অসংলগ্ন হয়ে পড়লে ত মীমাংসা করতে পারব না।
মনোহরবাবু উত্তর দিলেন, অসংলগ্ন তর্ক করা আমার পেশাও নয়।
সুমিত্রা হাসিমুখে কহিলেন, তাই ত আশা করি। বেশ, বক্তব্য আপনার ছোট করে আনলে এইরূপ দাঁড়ায়। আপনি নবতারার স্বামীর বন্ধু। তিনি জোর করে তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান, কিন্তু স্ত্রী স্বামীর ঘর করতে চান না, দেশের কাজ করতে চান, এতে অন্যায় কিছু ত দেখিনে।
মনোহর বলিলেন, কিন্তু স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্ত্তব্য আছে ত? দেশের কাজ করব বললেই ত তার উত্তর হয় না।
সুমিত্রা কহিলেন, দেখুন মনোহরবাবু, নবতারা কোন্ কাজ করবেন, না-করবেন, সে বিচার তার উপর, কিন্তু তাঁর স্বামীরও স্ত্রীর প্রতি যে কর্ত্তব্য ছিল, তিনি তা কোনদিন করেননি, এ-কথা আপনারা সবাই জানেন! কর্ত্তব্য ত কেবল একদিকে নয়।
মনোহর রাগিয়া কহিলেন, কিন্তু তাই বলে স্ত্রীকেও যে অসতী হয়ে যেতে হবে, সেও ত কোন যুক্তি হতে পারে না। এই বয়সে এই দলের মধ্যে থেকেও উনি সতীত্ব বজায় রেখে যে দেশের সেবা করতে পারবেন, এ ত কোন মতেই জোর করে বলা চলে না।
সুমিত্রার মুখ ঈষৎ আরক্ত হইয়াই তখনি সহজ হইয়া গেল, বলিলেন, জোর করে কিছু বলাও উচিত নয়। কিন্তু আমরা দেখচি নবতারার হৃদয় আছে, প্রাণ আছে, সাহস আছে এবং সবচেয়ে বড় কথা সেই ধর্ম্মজ্ঞান আছে। দেশের সেবা করতে এইটুকুই আমরা যথেষ্ট জ্ঞান করি। তবে, আপনি যাকে সতীত্ব বলচেন, সে বজায় রাখবার ওঁর সুবিধে হবে কিনা সে উনিই জানেন!
মনোহর নবতারার আনত মুখের প্রতি একবার কটাক্ষে চাহিয়া বিদ্রূপ করিয়া বলিয়া উঠিলেন, খাসা ধর্ম্মজ্ঞান ত! দেশের কাজে এই শিক্ষাই বোধ হয় উনি দেশের মেয়েদের দিয়ে বেড়াবেন?
সুমিত্রা বলিলেন, ওঁর দায়িত্ববোধের প্রতি আমাদের বিশ্বাস আছে। ব্যক্তিবিশেষের চরিত্র আলোচনা করা আমাদের নিয়ম নয়, কিন্তু যে স্বামীকে উনি ভালবাসতে পারেননি, আর একটা বড় কাজের জন্য যাঁকে ত্যাগ করে আসা উনি অন্যায় মনে করেননি, সেই শিক্ষাই যদি দেশের মেয়েদের উনি দিতে চান ত আমরা আপত্তি করব না।
মনোহর কহিলেন, আমাদের এই সীতা-সাবিত্রীর দেশে এখন শিক্ষা উনি গৃহস্থ মেয়েদের দেবেন?
সুমিত্রা সায় দিয়া বলিলেন, দেওয়া ত উচিত। মেয়েদের কাছে শুধু অর্থহীন বুলি উচ্চারণ না করে নবতারা যদি বলেন যে এই দেশে একদিন সীতা আত্মসম্মান রাখতে স্বামী ত্যাগ করে পাতালে গিয়েছিলেন এবং রাজকন্যা সাবিত্রী দরিদ্র সত্যবানকে বিবাহের পূর্ব্বে এত ভালবেসেছিলেন যে অত্যন্ত স্বল্পায়ু জেনেও তাঁকে বিবাহ করতে তাঁর বাধেনি, এবং আমি নিজেও যে দুর্বৃত্ত স্বামীকে ভালোবাসতে পারিনি, তাকে পরিত্যাগ করে এসেছি, অতএব আমার মত অবস্থায় তোমরাও তাই কোরো,—এ শিক্ষায় ত দেশের মেয়েদের ভালই হবে মনোহরবাবু।
মনোহরের ওষ্ঠাধর ক্রোধে কাঁপিতে লাগিল, প্রথমটা ত তাঁহার মুখ দিয়া কথাই বাহির হইল না, তারপর বলিয়া উঠিলেন, তাহলে দেশ উচ্ছন্নে যাবে। হঠাৎ হাত জোড় করিয়া কহিলেন, দোহাই আপনাদের, নিজেরা যা ইচ্ছে করুন, কিন্তু অপরকে এ শিক্ষা দেবেন না। ইউরোপের সভ্যতা আমদানি করে যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু মেয়েদের মধ্যে তার প্রচার করে সমস্ত ভারতবর্ষটাকে আর রসাতলে পাঠাবেন না।
সুমিত্রার মুখের উপর বিরক্তি ও ক্লান্তি যেন একই সঙ্গে ফুটিয়া উঠিল, কহিলেন, রসাতল থেকে বাঁচাবার যদি কোন পথ থাকে ত এই। কিন্তু, ইউরোপীয় সভ্যতা সম্বন্ধে আপনার বিশেষ কোন জ্ঞান নেই, সুতরাং, এ নিয়ে তর্ক করলে শুধু সময় নষ্ট হবে। অনেক সময় গেছে,—আমাদের অন্য কাজ আছে।
মনোহরবাবু যথাসাধ্য ক্রোধ দমন করিয়া কহিলেন, সময় আমারও অপর্য্যাপ্ত নয়। নবতারা তাহলে যাবেন না?
নবতারা এতক্ষণ মুখ তুলিয়াও চাহে নাই, সে মাথা নাড়িয়া জানাইল, না।
মনোহর সুমিত্রাকে প্রশ্ন করিলেন, এঁর দায়িত্ব তাহলে আপনারাই নিলেন।
নবতারাই ইহার জবাব দিল, কহিল, আমার দায়িত্ব আমিই নিতে পারবো, আপনি চিন্তিত হবেন না।
মনোহর বক্রদৃষ্টিতে তাহার প্রতি চাহিয়া সুমিত্রাকেই পুনশ্চ প্রশ্ন করিলেন, কহিলেন, আপনাকেই জিজ্ঞাসা করি, স্বামীগৃহে বিবাহিত জীবনের চেয়ে গৌরবের বস্তু নারীর আর কিছু আছে আপনি বলতে পারেন?
সুমিত্রা কহিলেন, অপরের যাই হোক, অন্ততঃ, নবতারার স্বামীগৃহে তার বিবাহিত জীবনকে আমি গৌরবের জীবন বলতে পারিনে।
এই উত্তরের পরে মনোহর আর আত্মসংবরণ করিতে পারিলেন না। অত্যন্ত কটুকণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন, কিন্তু এইবার ঘরের বাইরে তার অসতী জীবনটাকে বোধ করি গৌরবের জীবন বলতে পারবেন?
কিন্তু আশ্চর্য্য এই যে, এত বড় কদর্য্য বিদ্রূপেও কাহারও মুখে কোনরূপ চাঞ্চল্য প্রকাশ পাইল না। সুমিত্রা শান্তস্বরে বলিলেন, মনোহরবাবু, আমাদের সমিতির মধ্যে সংযতভাবে কথা বলা নিয়ম।
আর এ নিয়ম যদি না মানতে পারি?
আপনাকে বার করে দেওয়া হবে।
মনোহরবাবু যেন ক্ষেপিয়া গেলেন। জ্যা-মুক্ত শরের ন্যায় সোজা দাঁড়াইয়া উঠিয়া কহিলেন, আচ্ছা চললুম! গুড বাই। এই বলিয়া দ্বারের কাছে আসিয়া তাঁহার উন্মত্ত ক্রোধ যেন সহস্রধারে ফাটিয়া পড়িল। হাত পা ছুঁড়িয়া চীৎকার করিয়া বলিতে লাগিলেন, আমি সমস্ত খবর তোমাদের জানি। ইংরেজ রাজত্ব তোমরা ঘুচাবে? মনেও কোরো না! আমি চাষা নই, আমি অ্যাডভোকেট। কোথায় বিচার পেতে হয়, কোথায় তোমাদের হাতে শেকল পরাতে হয় ভাল রকম জানি? আচ্ছা,—এই বলিয়া তিনি অন্ধকারে দ্রুতবেগে অদৃশ্য হইয়া গেলেন।
হঠাৎ কি যেন একটা কাণ্ড ঘটিয়া গেল। উত্তেজনা কেহই প্রকাশ করিল না, কিন্তু সকলের মুখেই যেন কি একপ্রকার ছায়া পড়িল, কেবল যে লোকটা কোণে বসিয়া লিখিতেছিল, সে একবার চোখ তুলিয়াও চাহিল না। অপূর্ব্বর মনে হইল, হয় সে সম্পূর্ণ বধির, না হয়, একেবারে পাষাণের ন্যায় নিরাকুল, নির্ব্বিকার। ভারতীর মুখের চেহারাটা সে দেখিতে চাহিল, কিন্তু সে যেন ইচ্ছা করিয়াই আর একদিকে ঘাড় ফিরাইয়া রহিল। মনোহর ব্যক্তিটি যেই হোক, রাগের মাথায় এই সমিতির বিরুদ্ধে যে সকল কথা বলিয়া গেলেন তাহা অতিশয় সন্দেহজনক। এতগুলি আশ্চর্য্য নর-নারী কোথা হইতে আসিয়াই বা এখানে সমিতি গঠন করিলেন, কি বা তাহার সত্যকার উদ্দেশ্য, হঠাৎ ভারতীই বা কি করিয়া ইহাদের সন্ধান পাইল? আর ওই যে লোকটি টিকিটের পরিবর্ত্তে একদিন অনায়াসে মদ কিনিয়া খাইয়া তাহারই চোখের সম্মুখে ধরা পড়িয়াছিল,—আর সকলের বড় এই নবতারা! স্বামী ত্যাগ করিয়া দেশের কাজ করিতে আসিয়াছে, সতীত্ব রক্ষার কথা ভাবিবার এখন যাহার সময় নাই, অথচ এই লোকগুলা এত বড় অন্যায়কে শুধু সমর্থন নয়, প্রাণপণে প্রশ্রয় দিতেছে। এবং যিনি ইহাদের কর্ত্রী, স্ত্রীলোক হইয়াও তিনি প্রকাশ্য সভায় এতগুলি পুরুষের সমক্ষে সতীধর্ম্মের প্রতি তাঁহার একান্ত অবজ্ঞাই অসঙ্কোচে প্রকাশ করিতে লজ্জাবোধটুকুও করিলেন না।
কিছুক্ষণ অবধি সমস্ত ঘরটা নিস্তব্ধ হইয়া রহিল, বাহিরে অন্ধকার, অপ্রশস্ত রাজপথ তেমনি জনহীন নীরব, কেমন একপ্রকার উদ্বিগ্ন আশঙ্কায় অপূর্ব্বর মনের ভিতরটা যেন ভার হইয়া উঠিল।
হঠাৎ সুমিত্রার কণ্ঠ ধ্বনিত হইয়া উঠিল, অপূর্ব্ববাবু!
অপূর্ব্ব চকিত হইয়া মুখ তুলিয়া চাহিল।
সুমিত্রা কহিলেন, আপনি আমাদের চেনেন না, কিন্তু ভারতীর কাছ থেকে আমরা সবাই আপনাকে চিনি। শুনলাম আপনি আমাদের সমিতির মেম্বার হতে চান। সত্য?
অপূর্ব্ব না বলিতে পারিল না, ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইল। যে লোকটি একমনে লিখিতেছিল সুমিত্রা তাহাকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, ডাক্তার, অপূর্ব্ববাবুর নামটা লিখে নেবেন। অপূর্ব্বকে হাসিয়া বলিলেন, আমাদের কোনরকম চাঁদা নেই, টাকাকড়ি দিতে হয় না এইটে আমাদের সমিতির বিশেষত্ব।
প্রত্যুত্তরে অপূর্ব্ব নিজেও একটু হাসিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না। একটা মোটা বাঁধানো খাতায় যথার্থই তাহার নাম লেখা হইয়া গেল দেখিয়া মনে মনে সে অস্বস্তিতে ভরিয়া উঠিল। এবং চুপ করিয়া থাকিতে আর না পারিয়া বলিয়া ফেলিল, কিন্তু কি উদ্দেশ্য, কি আমাকে করতে হবে কিছুই ত জানতে পারলাম না।
ভারতী আপনাকে জানান নি।
অপূর্ব্ব ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বলিল, কিছু জানিয়েচেন, কিন্তু একটা কথা আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করি, নবতারার আচরণ আপনারা কি সত্যই অন্যায় মনে করেন না?
সুমিত্রা কহিলেন, অন্ততঃ আমি করিনে। কারণ, দেশের বড় আমার কাছে কিছুই নেই।
অপূর্ব্ব শ্রদ্ধাভরে কহিল, দেশকে আমিও প্রাণ দিয়ে ভালবাসি। এবং দেশের সেবা করবার অধিকার স্ত্রী-পুরুষ উভয়েরই সমান, কিন্তু এদের কর্ম্মক্ষেত্র ত এক নয়। আমরা পুরুষে বাইরে এসে কাজ করব, কিন্তু নারী গৃহের মধ্যে, শুদ্ধান্তঃপুরে স্বামী-পুত্রের সেবার মধ্যে দিয়েই সার্থক হবেন। তাঁদের সত্যকার কল্যাণে দেশের যত বড় কাজ হবে বাইরে এসে পুরুষের সঙ্গে ভিড় করে দাঁড়ালে ত সে কাজ কিছুতেই হবে না।
হুমিত্রা হাসিলেন। অপূর্ব্ব লক্ষ্য করিয়া দেখিল সকলেই যেন তাঁহার প্রতি চাহিয়া মুখ টিপিয়া হাসি গোপন করিল। সুমিত্রা কহিলেন, অপূর্ব্ববাবু, এটা অনেক দিনের এবং অনেকের মুখের কথা তা আমরা অস্বীকার করিনে। কিন্তু আপনি ত জানেন কোন একটা কথা কেবলমাত্র বহুদিন ধরে বহু লোকে বলতে থাকলেই তা সত্য হয়ে উঠে না। এ ফাঁকির কথা। যারা কোনদিন দেশের কাজ করেনি এ তাদের কথা, দেশের চেয়ে নিজের স্বার্থ যাদের ঢের বড় এ তাদের কথা। এর মধ্যে এতটুকু সত্য নেই। আপনি নিজে যখন কাজে লাগবেন, তখনই এই সত্য হৃদয়ঙ্গম করবেন যে যাকে আপনি নারীর বাইরে এসে ভিড় করা বল্চেন সে যদি কখনও ঘটে, তখনই দেশের কাজ হবে, নইলে পুরুষের ভিড়ে শুক্নো বালির মত সমস্ত ঝরে পড়বে, কোনদিন জমাট বাঁধবে না।
অপূর্ব্ব মনে মনে লজ্জা পাইয়া কহিল, কিন্তু এতে কি দুর্নীতি বাড়বে না? চরিত্র কলুষিত হবার ভয় থাকবে না?
সুমিত্রা বলিলেন, ভয় কি ভিতরেই কম থাকে নাকি? অপূর্ব্ববাবু, ওটা বাইরে আসার দোষ নয়, দোষ বিধাতার, যিনি নর-নারী সৃষ্টি করেছেন, তাদের মধ্যে অনুরাগের আকর্ষণ দিয়েচেন, তাঁর। অপূর্ব্ববাবু, মনের মধ্যে একটুখানি বিনয় রেখে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের দিকে একবার চেয়ে দেখুন দিকি?
এই মন্তব্য শুনিয়া অপূর্ব্ব খুশী হইতে পারিল না, বরঞ্চ একটুখানি তীব্রতার সঙ্গেই বলিয়া উঠিল, অন্য দেশের কথা অন্য দেশ ভাবুক, আমি আমাদের নিজেদের কল্যাণ চিন্তা করতে পারলেই যথেষ্ট মনে করব। আপনি আমায় ক্ষমা করবেন, কিন্তু এখানে একটা বস্তু আমি লক্ষ্য না করে পারিনি যে, বিবাহিত জীবনের প্রতি আপনাদের আস্থা নেই, এমন কি নারীত্বের যা চরম উৎকর্ষ, সেই সতীত্ব ও পাতিব্রত্য ধর্ম্মকেও আপনারা অবহেলার চক্ষে দেখেন। এর থেকে আসবে দেশের কল্যাণ?
সুমিত্রা ক্ষণকাল তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া সকৌতুক স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিলেন, অপূর্ব্ব বাবু আপনি একটু রাগ করে বলচেন, নইলে ঠিক ও ভাব ত আমি প্রকাশ করিনি। তবে, আগাগোড়াই যে আপনি ভুল বুঝেচেন তাও নয়। যে সমাজে কেবলমাত্র পুত্রার্থেই ভার্য্যা গ্রহণের বিধি আছে, নারী হয়ে তাকে ত আমি শ্রদ্ধার চোখে দেখতে পারিনে। আপনি সতীত্বের চরম উৎকর্ষের বড়াই করেছিলেন, কিন্তু, এই যে-দেশে বিবাহের ব্যবস্থা, সে-দেশে ও-বস্তু বড় হয় না, ছোটই হয়। সতীত্ব ত শুধু দেহেই পর্য্যবসিত নয় অপূর্ব্ববাবু, মনেরও ত দরকার? কায়মনে ভালবাসতে না পারলে ত ওর উচ্চস্তরে পৌঁছান যায় না? আপনি কি সত্যই মনে করেন মন্ত্র পড়ে বিয়ে দিলেই যে-কোন বাঙালী মেয়ে যে-কোন বাঙালী পুরুষকে ভালবাসতে পারে? এ কি পুকুরের জল যে যে-কোন পাত্রে ঢেলে মুখ বন্ধ করে দিলেই কাজ চলে যাবে?
অপূর্ব্ব হঠাৎ কথা খুঁজিয়া না পাইয়া কহিল, কিন্তু চিরকাল চলেও ত যাচ্চে?
সুমিত্রা তাহার কথা শুনিয়া হাসিয়া মাথা নাড়িয়া কহিলেন, তা যাচ্চে। প্রাণাধিক স্বামী বলে পাঠ লিখতেও তার বাধে না, কর্ত্তব্যবোধে শ্রদ্ধাভক্তি করতেও হয়ত ভার আটকায় না। বস্তুতঃ ঘরকন্নার কাজে এর বেশি ভার প্রয়োজন হয় না। আপনি ও গল্প পড়েচেন, কোন্ এক ঋষি-পুত্রের দুধের বদলে চালের গুঁড়োর জল খেয়েই আরামে দিন কাটতো। কিন্তু আরাম যেমনই হোক, যা নয় তাকে তাই বলে গর্ব্ব করা ত যায় না।
এই আলোচনা অপূর্ব্বর অত্যন্ত বিশ্রী ঠেকিল, কিন্তু এবারেও সে জবাব দিতে না পারিয়া কহিল, আপনি কি বলতে চান এর অধিক কারও ভাগ্যেই জোটে না?
সুমিত্রা কহিলেন, না, তা আমি বলতেই পারিনে। কারণ, সংসারে দৈবাৎ বলেও একটা শব্দ আছে।
অপূর্ব্ব কহিল, ওঃ—দৈবাৎ। কিন্তু কথা যদি আপনার সত্যও হয়, তবুও আমি বলি সমাজের মঙ্গলের জন্য, উত্তর পুরুষের কল্যাণের জন্য, আমাদের এই-ই ভাল।
সুমিত্রা তেমনি শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলিলেন, না অপূর্ব্ববাবু, সমাজ এবং আপনার উত্তর পুরুষ কোনটারই এতে শেষ পর্য্যন্ত কল্যাণ হবে না। সমাজ ও বংশের নাম করে ব্যক্তিকে একদিন বলি দেওয়া হতো, কিন্তু ফল তার ভাল হয় নি;—আজ তা অচল। ভালবাসার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন উত্তর পুরুষের জন্য না হলে এমন ভয়ানক স্নেহের ব্যবস্থা তার মাঝখানে স্থান পেত না। এই ব্যর্থ বিবাহিত জীবনের মোহ নারীকে কাটাতেই হবে। তাকে বুঝাতেই হবে, এতে লজ্জাই আছে, গৌরব নেই।
অপূর্ব্ব ব্যাকুল হইয়া কহিল, কিন্তু ভেবে দেখুন আপনাদের এই সকল শিক্ষায় আমাদের সুনিয়ন্ত্রিত সমাজে অশান্তি এবং বিপ্লর এসেই উপস্থিত হবে।
সুমিত্রা বলিলেন, হলই বা। অশান্তি এবং বিপ্লব মানেই ত অকল্যাণ নয় অপূর্ব্ববাবু। যে রুগ্ন, জীর্ণ, জরাগ্রস্ত সেই শুধু উৎকণ্ঠিত সতর্কতায় আপনাকে আগলে রাখতে চায়, কোন দিক দিয়ে না তার গায়ে ধাক্কা লাগে। অনুক্ষণ এই ভয়েই সে কাঁটা হয়ে থাকে, এতটুকু নাড়াচাড়াতেই তার প্রাণবায়ু চোখের পলকে বেরিয়ে যাবে। আর এমনি অবস্থাই যদি সমাজের হয়ে থাকে ত যাক্ না একটা হেস্ত-নেস্ত হয়ে। দুদিন আগেপাছের জন্য কি-ই বা এমন ক্ষতি হবে?
এ-কথার অপূর্ব্ব আর অবাব দিল না, চুপ করিয়া রহিল। সুমিত্রা নিজেও ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিলেন, ঋষি-পুত্রের উপমা দিয়ে হয়তো আপনাকে আমি ব্যথা দিয়েচি। কিন্তু ব্যথা যে আপনার পাওনা ছিল, তার থেকে আপনাকে আমি বাঁচাতামই বা কি করে।
তাঁর শেষের কথাটা অপূর্ব্ব বুঝিতে পারিল না, কিন্তু বিরক্তির পাত্র তাহার পূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। তাই প্রত্যুত্তরে বলিয়া ফেলিল, জগন্নাথের পাশে দাঁড়িয়ে ক্রীশ্চান মিশনারীরা যাত্রীদের অনেক ব্যথা দেয়। তবুও সেই ঠুঁটো জগন্নাথকে ত্যাগ করে কেউ হাত-ওয়ালা খ্রীষ্টকেও ভজে না। ঠুঁটো নিয়েই তাদের কাজ চলে যায়, এই আশ্চর্য্য!
সুমিত্রা রাগ করিলেন না, হাসিয়া বলিলেন, সংসারে আশ্চর্য্য আছে বলেই ত মানুষের বাঁচা অসম্ভব হয়ে ওঠে না অপূর্ব্ববাবু। গাছের পাতার রঙ যে সবাই সবুজ দেখে না এ তারা জানেও না। তবুও যে লোকে তাকে সবুজ বলে, সংসারে এই কি কম আশ্চর্য্য! সতীত্বের সত্যিকার মূল্য জানলে কি—
সুমিত্রা! যে লোকটি নিঃশব্দে এতক্ষণ লিখিতেছিল সে উঠিয়া দাঁড়াইল। সকলেই সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়াইয়া উঠিল।
অপূর্ব্ব দেখিল—গিরীশ মহাপাত্র।
ভারতী তাহার কানে কানে বলিল, উনিই আমাদের ডাক্তার। উঠে দাঁড়ান।
কলের পুতুলের মত অপুর্ব্ব উঠিয়া দাঁড়াইল, কিন্তু ক্রুদ্ধ মনোহরের শেষ কথাগুলা তাহার চক্ষের নিমেষে মনে পড়িয়া সমস্ত দেহের রক্ত যেন হিম হইয়া গেল।
গিরীশ কাছে আসিয়া কহিলেন, আমাকে বোধ হয় আপনি ভুলে যানলি? আমাকে এঁরা সবাই ডাক্তার বলেন। এই বলিয়া তিনি হাসিলেন।
অপূর্ব্ব হাসিতে পারিল না; কিন্তু আস্তে আস্তে বলিল, আমার কাকাবাবুর খাতায় কি একটা ভয়ানক নাম লেখা আছে—
গিরীশ সহসা তাহার দুই হাত নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া চুপিচুপি কহিলেন, সব্যসাচী ত? এই বলিয়া পুনশ্চ হাসিয়া বলিলেন, কিন্তু রাত হয়ে গেছে অপূর্ব্ববাবু, চলুন আপনাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসি। পথটা তেমন ভাল নয়,—পাঠান ওয়ার্কমেনগুলোর মদ খেলে আর যেন কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। চলুন। এই বলিয়া যেন একপ্রকার জোর করিয়া তাহাকে ঘর হইতে বাহির করিয়া আনিলেন।
সুমিত্রাকে একটা নমস্কার করা হইল না, ভারতীকে একটা কথা বলা হইল না, কিন্তু সবচেয়ে যে কথাটা তাহার বুকে ধাক্কা মারিল সে ওই বাঁধানো খাতাটা,—তাহার নাম তাহাতে লেখা রহিল।