পথের দাবী/২৭

উইকিসংকলন থেকে

২৭

 শশী অতিশয়োক্তি করে নাই। ভিতরে প্রবেশ করিয়া দেখা গেল খাদ্যবস্তুর অত্যন্ত বাহুল্যে ঘরের দক্ষিণ ধারটা একেবারেই ভারাক্রান্ত হইয়া রহিয়াছে। ছোট-বড় ডেকচি, প্লেট, কাগজের ঠোঙা, মাটির বাসন পরিপূর্ণ করিয়া নানাবিধ আহার্য্য দ্রব্য সম্ভার দোকানদার ও হোটেলওয়ালার দল নিজেদের রুচি ও মর্জ্জি মত ওপার হইতে এপারে অবিশ্রাম সরবরাহ করিয়া স্তূপাকার করিয়াছে—অভাব বা ত্রুটি কিছুরই ঘটে নাই, ঘটিয়াছে কেবল সেগুলি উদরসাৎ করিবার লোকের। ডাক্তার ক্ষণকালমাত্র নিরীক্ষণ করিয়াই সোল্লাসে চীৎকার করিয়া উঠিলেন, তোফা! তোফা! চমৎকার! শশী কি হিসেবী লোক দেখেচ ভারতী, কে কি খাবে না-খাবে সমস্ত চিন্তা করে দেখেচ। বহুৎ আচ্ছা!

 ভারতী অন্যদিকে চাহিয়া রহিল এবং শশী হাসিবার একটুখানি বিফল চেষ্টা করিল মাত্র। কোন দিক হইতে কোন সাড়া না পাইয়াও ডাক্তারের উল্লাস অকস্মাৎ অট্টহাস্যে ফাটিয়া পডিল, হাঃ হাঃ হাঃ! গৃহস্থের জয়জয়কার হোক,—শশী! কবি। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!

 ভারতী আর সহিতে পারিল না, মুখ ফিরাইয়া সজলচক্ষে রুষ্ট দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, তোমার মনের মধ্যে কি একটু দয়া-মায়াও নেই দাদা? কি কোরচ বল ত?

 বাঃ! যাদের কল্যাণে আজ ভাল ভাল জিনিস পেট পুরে খাবো,—তাদের একটু আশীর্ব্বাদ—বাঃ! হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।

 ভারতী রাগ করিয়া বারান্দায় চলিয়া গেল। মিনিট-দুই পরে শশী গিয়া তাহাকে ফিরাইয়া আনিলে সে প্লেটে করিয়া মাংস, পোলাও, ফল-মূল, মিষ্টান্নাদি সযত্নে সাজাইয়া ডাক্তারের সম্মুখে রাখিয়া দিয়া কৃত্রিম কুপিতস্বরে কহিল, নাও, এবার নাও, দশ হাত বার করে রাক্ষসের মত খাও। হাসি বন্ধ হোক, পাড়ার লোকের ঘুম ভেঙে যাবে।

 ডাক্তার নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আহা উপাদেয় খাদ্য। এর স্বাদ গন্ধও ভুলে গেছি।

 কথাটা ভারতীর বুকে গিয়া বিঁধিল। তাহার সে রাত্রের শুকনা ভাত ও পোড়া মাছের কথা মনে পড়িল।

 ডাক্তার আহারে নিযুক্ত হইয়া কহিলেন, কবিকে দিলে না ভারতী।

 এই যে দিচ্ছি, এই বলিয়া সে প্লেট সাজাইয়া আনিয়া শশীর কাছে রাখিয়া দিয়া ডাক্তারের সম্মুখে বসিয়া বলিল, কিন্তু সমস্ত খেতে হবে দাদা, ফেলতে পারবে না।

 নাঃ—কিন্তু, তুমি খাবে না?

 আমি? কোন মেয়েমানুষ এ সব খেতে পারে? তুমিই বল?

 কিন্তু রেঁধেচে যেন অমৃত।

 ভারতী কহিল, এর চেয়ে ভাল অমৃত রেঁধে আমি বোজ রোজ তোমাকে খাওয়াতে পারি দাদা।

 ডাক্তার বাঁ হাতটা নিজের কপালে ঠেকাইয়া কহিলেন, কি করবে দিদি, অদৃষ্ট! যাকে খাওয়াবার কথা, সে এসব খাবে না, যে খাবে, তাকে একদিনের ওপর দুদিন খাওয়াবার চেষ্টা করিলেই সুখ্যাতিতে তোমার দেশ ভরে যাবে। ভগবানের এমনি উল্টো বিচার! কি বল কবি, ঠিক না? হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।

 এবার ভারতী নিজেও হাসিয়া ফেলিল; কিন্তু তৎক্ষণাৎ আপনাকে সম্বরণ করিয়া লজ্জিত হইয়া বলিল, তোমার দুষ্টুমির জ্বালায় না হেসে পারা যায় না, কিন্তু এ তোমার ভারি অন্যায়। তার পরে পেট পুরে খেয়ে দেয়ে টাকার থলিটিও নিয়ে চলে যাবে না কি?

 ডাক্তার মুখের গ্রাস গিলিয়া লইয়া কহিলেন, নিশ্চয় নিশ্চয়, অর্দ্ধেকটা ত গেছে নবতারার বাড়ি তৈরীর খাতায়, বাকীটা কি রেখে যাবো আহমেদ-আবদুল্লা সাহেবের গাড়ি-জুড়ি কিনতে? তামাসা সর্ব্বাঙ্গসুন্দর করতে নেহাৎ মন্দ পরামর্শ দাওনি ভারতী। কি বল শশী? হাঃ হাঃ হাঃ—

 ভারতী বলিল, দাদা, তোমাকে হাসি-ঠাট্টা করতে আগেও দেখেচি বটে, কিন্তু এমন ক্ষ্যাপার মত হাসতে আর কখনো দেখিনি।

 ডাক্তার জবাব দিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু ভারতীর মুখের প্রতি চাহিয়া সহসা কিছু বলিতে পারিলেন না। ভারতী পুনশ্চ কহিল, নর-নারীর ভালবাসা কি তোমারি মত সকলের উপহাসের বস্তু যে, তাসের ছক্কা-পাঞ্জা হারার মত এর হারজিতে অট্টহাসি করা ছাড়া আর কিছুই করবার নাই? স্বাধীনতা পরাধীনতা ছাড়া মানুষের ব্যথা পাবার কি দুনিয়ায় কিছুই তুমি ভাবতে পারবে না! দেখ ত একবার শশীবাবুর মুখের দিকে চেয়ে। একটা বেলার মধ্যে উনি কি হয়ে গেছেন। অপূর্ব্বরাবু যখন চলে গেলেন সেদিন আমাকে উপলক্ষ্য করেও হয়ত তুমি এমনি করেই হেসেচ।

 না, না, সে হ’ল—

 ভারতী বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, না না বলচো কিসের জন্য দাদা? শশীবাবু তোমার স্নেহের পাত্র, তুমি এই ভেবে খুশী হয়ে উঠেচ যে, নির্ব্বোধ তাঁকে ফাঁদের মধ্যে ফেলে নবতারা অনেক দুঃখ দিত। ভবিষ্যতের সেই দুঃখের হাত থেকে তিনি এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু ভবিষ্যতই কি মানুষের সব? আজকের এই একটিমাত্র দিন যে ব্যথার ভারে তাঁর সমস্ত ভবিষ্যৎকে ডিঙিয়ে গেল এ তুমি কি করে জানবে বল? তুমি ত কখনো ভালবাসোনি!

 শশী অতিশয় অপ্রতিভ হইয়া পড়িল। সে কোন মতে বলিতে চাহিল যে তাহারই অন্যায়, তাহারই ভুল, সাংসারিক সাধারণ বুদ্ধি না থাকার জন্যই—

 ভারতী ব্যগ্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, লজ্জা কিসের শশীবাবু? এ ভুল কি সংসারে একা আপনিই করেচেন? আপনার শতগুণ ভুল আমি করিনি? তারও সহস্রগুণ বেশি ভুল করে যে দুর্ভাগিনী নিঃশব্দে এ দেশ ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যেতে উদ্যত হয়েছে, তাকে কি ডাক্তার চেনেন না? নবতারা ঠকিয়েছে? ঠকাক না। তবু ত আমাদেরই বঞ্চনার গান গেয়ে জগতের অর্দ্ধেক কাব্য অমর হয়ে আছে।

 ডাক্তার বিস্মিতচক্ষে তাহার প্রতি চাহিলেন, কিন্তু ভারতী গ্রাহ্য করিল না। বলিতে লাগিল, শশীবাবু, সাংসারিক বুদ্ধি আপনার কম। কিন্তু আমার ত কম ছিল না? সুমিত্রাদিদির বুদ্ধির তুলনাই হয় না। অথচ, কিছুই তা কারও কাজে লাগেনি। এ শুধু পরাভূত হল, দাদা, তোমার বুদ্ধির কাছে। যে চিরদিন অজেয়, পথ যার কখনো বাধা পায়নি, সেও তোমারই পাষাণ দ্বারে কেবল আছাড় খেয়ে খান খান হয়ে পড়ে গেল,—প্রবেশ করার এতটুকু পথ পেলে না!

 ডাক্তার এ অভিযোগের উত্তর দিলেন না, শুধু তাহার মুখপানে চাহিয়া একটুখানি হাসিলেন। ভারতী বলিল, শশীবাবু, আমি আপনার প্রতি মহা অপরাধ করেচি, আজ তার ক্ষমা চাই—

 শশী বুঝিতে পারিল না, কিন্তু কুণ্ঠিত হইয়া উঠিল। ভারতী নিমেষমাত্র মৌন থাকিয়া বলিতে লাগিল, একদিন দাদার কাছে বলেছিলাম, কোন মেয়েমানুষেই কোনদিন আপনাকে ভালবাসতে পারে না। সেদিন আপনাকে আমি চিনিনি। আজ মনে হচ্ছে অপূর্ব্ববাবুকে যে ভালবেসেছিল সে আপনাকে পেলে ধন্য হয়ে যেতো। সবাই আপনাকে উপেক্ষা করে এসেছে, শুধু একটি লোক করেনি, সে এই ডাক্তার।

 ডাক্তার অধোমুখে এক টুকরা মাংস হইতে হাড় পৃথক করিবার কার্য্যে ব্যাপৃত ছিলেন, মুখ তুলিবার অবকাশ পাইলেন না। ভারতী তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিল, দাদা, মানুষকে চিনে নিতে তোমার ভুল হয় না, তাই সেদিন দুঃখ করে আমার কাছে বলেছিলে, শশী যদি আর কাউকে ভালবাসত। কিন্তু এক দিনও কি তুমি আমাকে সাবধান করে বলে দিতে পারতে না, ভারতী, এতবড় ভুল তুমি করো না! পুরুষের দুই আদর্শ তোমরা দুজনে আমার মুখে বসে,—আজ আমার বিতৃষ্ণার আর অবধি নেই।

 ডাক্তার মাংসখণ্ড মুখে পুরিয়া দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, অপূর্ব্ব কি বললে শশী?

 জবাব দিল ভারতী। কহিল, মা পীড়িত। চিকিৎসার প্রয়োজন, অতএব টাকা চাই। ফিরে এসে লুকিয়ে গোলামি করলে কেউ জানতে পারবে না। ভয় তলওয়ারকরকে, ভয় ব্রজেন্দ্রকে। কিন্তু, কাকা পুলিশ-কর্ম্মচারী,——সে ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হয়ে গেছে। তুমি আমিও বোধ হয় এখন আর বাদ যাবো না। ক্ষুদ্র! লোভী। সঙ্কীর্ণ-চিত্ত ভীরু! ছি!

 ডাক্তার মুচকিয়া হাসিলেন। ধীরে ধীরে বলিলেন, যথার্থ ভাল না বাসলে এমন প্রাণ খুলে যশোগান করা যায় না। কবি, এবার তোমার পালা। বাগ্দেবীকে স্মরণ করে তুমি এবার নবতারার গুণকীর্ত্তন শুরু কর, আমরা অবহিত হই।

 ভারতী চকিত হইয়া কহিল, দাদা, তুমি আমাকে তিরস্কার করলে?

 ডাক্তার ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, তাই হবে হয়ত।

 অভিমানে, ব্যথায়, ক্রোধে ভারতীর মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল, বলিল, তুমি কখ্‌খনো আমায় বকতে পাবে না। ভেবেচ সবাই শশীবাবুর মত মুখ বুঁজে সইতে পারে? তুমি কি জানো কি হয় মানুষের? উচ্ছ্বসিত বেদনায় কণ্ঠস্বর তাহার অবরুদ্ধ হইয়া আসিল, কহিল, তিনি ফিরে এসেচেন, এবার আমাকে তুমি কোথাও সরিয়ে নিয়ে যাও দাদা,—আমি এ কোন্ দুর্ভাগ্যের পায়ে আমার সমস্ত বিসর্জ্জন দিয়ে বসে আছি। বলিতে বলিতে মেঝের উপর মাথা রাখিয়া ভারতী ছেলেমানুষের মত কাঁদিয়া ফেলিল।

 ডাক্তার স্থিতমুখে নীরবে আহার করিতে লাগিলেন। তাঁর নির্ব্বিকার ভাব দেখিয়া মনে হয় না যে, এই সকল প্রণয় উচ্ছ্বাস তাঁহাকে লেশমাত্র বিচলিত করিয়াছে। মিনিট পাঁচ-সাত পরে ভারতী উঠিয়া পাশের ঘরে গিয়া চোখ মুখ ভাল করিয়া ধুইয়া মুছিয়া যথাস্থানে ফিরিয়া আসিয়া বসিল। জিজ্ঞাসা করিল, দাদা, আর তোমাদের কিছু দেব?

 ডাক্তার পকেট হইতে রুমাল বাহির করিয়া বলিলেন, বামুনের ছেলে, কিছু ছাঁদা বেঁধে দাও, দিন দুই যেন নিশ্চিন্ত হইতে পারি।

 ময়লা রুমালটা ফিরাইয়া দিয়া ভারতী খোঁজ করিয়া একখানা ধোয়া তোয়ালে বাহির করিল এবং রকমারি খাদ্যবস্তুর একটি পুঁটুলি বাঁধিয়া ডাক্তারের পাশে রাখিয়া দিয়া কহিল, এই ত হল বামুনের ছেলের ছাঁদা। আর ঐ টাকার ছোট্ট থলিটি?

 ডাক্তার সহাস্যে কহিলেন, ওটি হল বামুনের ছেলের ভোজন দক্ষিণা।

 ভারতী বলিল, অর্থাত্‍ তুচ্ছ বিবাহ ব্যাপারটা ছাড়া আসল দরকারি কাজগুলো সমস্তই নির্ব্বিঘ্নে সমাধা হল।

 অকস্মাৎ হাঃ হাঃ—করিয়া আরম্ভ করিয়াই ডাক্তার সজোরে হাত দিয়া নিজের মুখ চাপিয়া ধরিয়া হাসি থামাইলেন, গম্ভীর হইয়া কহিলেন, কি যে ভগবানের অভিশাপ, ভারতী, হাসতে গেলেই মুখ দিয়ে আমার অট্টহাসি ছাড়া আর কিছু বার হতেই চায় না। অট্টকান্না কাঁদবার জন্যে তোমাকে সঙ্গে না নিয়ে এলে আজ মুখ দেখানোই ভার হতো।

 দাদা। আবার জ্বালাতন করচ?

 জ্বালাতন করচি। আমি ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশের চেষ্টা করচি।

 ভারতী রাগ করিয়া আর একদিকে মুখ ফিরাইল, জবাব দিল না।

 বরাবর চুপ করিয়াই ছিল, এতক্ষণে কথা কহিল। অকস্মাৎ অতিশয় গাম্ভীর্য্যের সহিত বলিল, আপনি যদি রাগ না করেন ত একটা কথা বলতে পারি। কেউ কেউ ভয়ানক সন্দেহ করে যে, আপনার সঙ্গেই একদিন ভারতীর বিবাহ হবে।

 ডাক্তার মুহূর্ত্তের জন্য চমকিত হইলেন, কিন্তু পরক্ষণেই আত্মসম্বরণ করিয়া উল্লাসভরে বলিয়া উঠিলেন, বল কি হে শশী, তোমার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক, এমন সুদিন কি কখনো এতবড় দুর্ভাগার অদৃষ্টে হবে? এ যে স্বপ্নের অতীত, কবি!

 শশী কহিল, কিন্তু অনেকে ত তাই ভাবেন।

 ডাক্তার কহিলেন, হায়! হায়! অনেকে না ভেবে যদি একটি মাত্র লোক একটি পলকের জন্য ও ভাবতেন।

 ভারতী হাসিয়া ফেলিল! মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, দুর্ভাগার ভাগ্য ত একটি পলকেই বদলাতে পারে দাদা। তুমি হুকুম করে যদি বল, ভারতী, কালই আমাকে তোমার বিয়ে করতে হবে, আমি তোমার দিব্যি করে বলচি, বলব না যে আর একটা দিন সবুর কর।

 ডাক্তার কহিলেন, কিন্তু বেচারা যে প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে ফিরে এল, তার উপায়টা কি হবে?

 ভারতী বলিল, তাঁর কনে-বৌ দেশে মজুত আছে, তাঁর জন্যে তোমার দুশ্চিন্তার কারণ নেই। তিনি বুক ফেটে মারা যাবেন না।

 ডাক্তার গম্ভীর হইয়া কহিলেন, কিন্তু আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাও, তোমার ভরসা ত কম নয় ভারতী!

 ভারতী কহিল, তোমার হাতে পড়ব তার আর ভয়টা কিসের?

 ডাক্তার শশীর প্রতি চাহিয়া বলিলেন, শুনে রেখো কবি। ভবিষ্যতে যদি অস্বীকার করে তোমাকে সাক্ষী দিতে হবে।

 ভারতী বলিল, কাউকে সাক্ষী দিতে হবে না দাদা, আমি তোমার নাম নিয়ে এত বড় শপথ কথনো অস্বীকার কোরব না। শুধু তুমি স্বীকার করলেই হয়।

 ডাক্তার কহিলেন, আচ্ছা দেখে নেবো তখন।

 দেখো। এই বলিয়া ভারতী হাসিয়া কহিল, দাদা, আমিই বা কি, আর সুমিত্রাই বা কি,—স্বর্গের ইন্দ্রদেব যদি ঊর্ব্বশী মেনকা রম্ভাকে ডেকে বলতেন সেকালের মুনি-ঋষিদের বদলে তোমাদের একালের সব্যসাচীর তপস্যা ভঙ্গ করতে হবে ত আমি নিশ্চয় বলচি দাদা, মুখে কালি মেখে তাদের ফিরে যেতে হ’তো। রক্ত-মাংসের হৃদয় জয় করা যায়, কিন্তু পাথরের সঙ্গে কি চলে। পরাধীনতার আগুনে পুড়ে সমস্ত বুকে তোমার একেবারে পাষাণ হয়ে গেছে?

 ডাক্তার মুচকিয়া হাসিলেন। ভারতীর দুইচক্ষু শ্রদ্ধা ও স্নেহে অশ্রুসজল হইয়া উঠিল, কহিল, এ বিশ্বাস না থাকলে কি এমন করে তোমাকে আত্মসমর্পণ করতে পারতাম? আমি ত নবতারা নই। আমি জানি, আমার সমস্ত ভুল হয়ে গেছে,—কিন্তু এ জীবনে সংশোধনের পথও আর নেই। একদিনের জন্যেও যাঁকে মনে মনে—

 ভারতীর চোখ দিয়া পুনরায় জল গড়াইয়া পড়িল। তাড়াতাড়ি হাত দিয়া মুছিয়া ফেলিয়া হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, দাদা, ফেরবার সময় হয়নি? ভাঁটার দেরি কত?

 ডাক্তার দেওয়ালের ঘড়ির দিকে চাহিয়া বলিলেন, এখনো দেরি আছে বোন। তাহার পরে ধীরে ধীরে ডান হাত বাড়াইয়া ভারতীর মাথার উপরে রাখিয়া কহিলেন, আশ্চর্য্য! এত দুর্দ্দশাতেও এ অমূল্য রত্নটি আজও বাঙলার খোয়া যায়নি। থাক্‌ না নবতারা, তবু ত ভারতীও আমাদের আছে। শশী সমস্ত পৃথিবীতে এর আর জোড়া মেলে না! এমন সহস্র সব্যসাচীরও সাধ্য নেই তুচ্ছ অপূর্ব্বকে আড়াল করে দাঁড়ায়। ভাল কথা শশী, মদের বোতল কই?

 প্রশ্ন শুনিয়া শশী যেন কিছু লজ্জিত হইল, কিনিনি ডাক্তার। ও আমি আর খাবো না।

 ভারতী বলিল, তোমার মনে নেই দাল, নবতারা ওকে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন?

 শশী তাহারই সায় দিয়া কহিল, সত্যিই নবতারার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম মদ আর খাবো না। এ সত্য আমি ভাঙবো না ডাক্তার।

 ডাক্তার সহাস্যে বলিলেন, কিন্তু বাঁচবে কি করে শশী? মদ গেল, নবতারা গেল, যথাসর্ব্বস্ব-বিক্রি-করা টাকা গেল, একসঙ্গে এত সইবে কেন?

 শশীর মুখের দিকে চাহিয়া ভারতী ব্যথা পাইল, কহিল, তামাসা করা সহজ, কিন্তু সত্যি সত্যি একবার ভেবে দেখ দিকি?

 ডাক্তার বলিলেন, ভেবে দেখেই ত বলচি ভারতী! এই টাকাটার উপরে যে শশীর কতখানি আশা-ভরসা ছিল তা আমার চেয়ে বেশী আার কেউ জানে না। এর পরিচিত এমন একটা লোকও নেই যে, এ বিবরণ শোনেনি। তার পরে এলো নবতারা। ছ-সাতমাস ধরে সেই ছিল ওর ধ্যান-জ্ঞান। আর মদ? সে তো শশীর সুখ-দুঃখে একমাত্র সাথী। কাল সবই ছিল, আজ ওর জীবনের যা-কিছু আনন্দ, যা কিছু সান্ত্বনা একদিনে একসঙ্গে ষড়যন্ত্র করে যেন ওকে ত্যাগ করে গেল। শুধু কারও বিরুদ্ধে ওর বিদ্বেষ নেই—নালিশ নেই,—এমন কি আকাশের পানে চেয়ে একবার সজল চক্ষে বলতে পারলে না যে, ভগবান! আমি কারও মন্দ চাই কিন্তু তুমি সত্যির যদি হও ত এর বিচার কোরো?

 ভারতীর মুখ দিয়া দীর্ঘনিশ্বাস বাহির হইয়া আসিল, তাই তোমার এত স্নেহ।

 ডাক্তার বলিলেন, শুধু স্নেহ নয়, শ্রদ্ধা। শশী সাধু লোক, সমস্ত অন্তরখানি যেন গঙ্গাজলের মত শুদ্ধ নির্ম্মল। ভারতী, আমি চলে গেলে বোন, একে একটু দেখো। তোমার হাতেই শশীকে আমি দিয়ে গেলাম, ও দুঃখ পাবে, কিন্তু দুঃখ কখনো কাউকে দেবে না।

 শশী লজ্জা ও কুণ্ঠায় আরক্ত হইয়া উঠিল। ইহার কিছু পরে কিছুক্ষণ পর্য্যন্ত বোধ করি কথার অভাবেই তিনজনেই নীরব হইয়া রহিলেন।

 ডাক্তার জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু এখন থেকে কি করবে কবি? তোমার বাকী রইল ত কেবল ওই বেহালাখানি। আগের মত আবার দেশে দেশে বাজিয়ে বেড়াবে?

 এবার শশী হাসিমুখেই বলিল, আপনার কাজে আমাকে ভর্ত্তি করে নিন,— বাস্তবিকই আমি আর মদ খাবো না।

 তাহার কথা এবং কথা বলার ভঙ্গি দেখিয়া ভারতী হাসিল। ডাক্তার নিজেও হাসিলেন, স্নেহার্দ্রকণ্ঠে কহিলেন, না কবি, ওতে তোমার আর ভর্ত্তি হয়ে কাজ নেই। তুমি আমার এই বোনটির কাছে থেকো, তাতেই আমার ঢের বড় কাজ হবে।

 শশী মাথা নাড়িয়া সম্মতি জানাইল। এক মুহূর্ত্ত মৌন থাকিয়া সঙ্কোচের সহিত কহিল, আগে আমি কবিতা লিখতে পারতাম ডাক্তার—হয়ত এখনও পারি।

 ডাক্তার খুশী হইয়া কহিলেন, তাও বটে! আর তাতেই যে আমার মস্ত কাজ হবে কবি।

 শশী কহিল, আমি আবার আরম্ভ করব! চাষাভূষা, কুলি-মজুরদের জন্যেই এবার শুধু লিখব।

 কিন্তু তারা ত পড়তে জানে না কবি?

 শশী কহিল, নাই জানলে, তবু তাদের জন্যেই আমি লিখবো।

 ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন, সেটা অস্বাভাবিক হবে এবং অস্বাভাবিক জিনিস টিকবে না। অশিক্ষিতের জন্যে অন্নসত্র খোলা যেতে পারে, কারণ, তাদের ক্ষুধাবোধ আছে কিন্তু সাহিত্য পরিবেশন করা যাবে না। তাদের সুখ-দুঃখের বর্ণনা করার মানেই তাদের সাহিত্য নয়। কোনদিন যদি সম্ভব হয়, তাদের সাহিত্য তারাই ভার নেবে,—নইলে তোমার গলায় লাঙ্গলের গান লাঙ্গলধারীর গীতিকাব্য হয়ে উঠবে। এ অসম্ভব প্রয়াস তুমি করো না কবি।

 শশী ঠিক বুঝিতে পারিল না, সন্দিগ্ধকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, তবে আমি কি করব?

 ডাক্তার বলিলেন, তুমি আবার বিপ্লবের গান কোরো। যেখানে জন্মেচ, যেখানে মানুষ হয়েচ, শুধু তাদেরই—সেই শিক্ষিত ভদ্র জাতের জন্যেই।

 ভারতী বিস্মিত হইল, ব্যথিত হইল, কহিল, দাদা, তুমিও জাত মানো? তোমার লক্ষ্যও সেই কেবল ভদ্র জাতির দিকে?

 ডাক্তার বলিলেন, আমি ত বর্ণাশ্রমের কথা বলিনি ভারতী, সেই জোর করা জাতিভেদের ইঙ্গিত ত আমি করিনি। সে বৈষম্য আমার নেই, কিন্তু শিক্ষিত অশিক্ষিতের জাতিভেদ, সে ত আমি না মেনে পারিনে। এই ত সত্যকার জাতি,—এই ত ভগবানের হাতে-গড়া সৃষ্টি! ক্রীশ্চান বলে কি তোমাকে ঠেলে রাখতে পেরেচি দিদি। তোমার মত আপনার জন আমার কে আছে?

 ভারতী শ্রদ্ধা-বিগলিত চক্ষে তাঁহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, কিন্তু তোমার বিপ্লবের গান ত শশীবাবুর মুখে সাজবে না দাদা! তোমার বিদ্রোহের গান, তোমার গুপ্ত সমিতির—

 ডাক্তার বাধা দিয়া বলিলেন, না, আমার গুপ্ত সমিতির ভার আমার ’পরেই থাক্ বোন্—ও বোঝা বইবার মত জোর—না না, সে থাক্‌—সে শুধু আমার! এই বলিয়া তিনি ক্ষণকাল যেন আপনাকে সামলাইয়া লইলেন। কহিলেন, তোমাকে ত বলেচি ভারতী, বিপ্লব মানেই শুধু রক্তারক্তি কাণ্ড নয়,—বিপ্লব মানে অত্যন্ত দ্রুত আমূল পরিবর্ত্তন। রাজনৈতিক বিপ্লব নয়,—সে আমার। কবি, তুমি প্রাণ খুলে শুধু সামাজিক বিপ্লবের গান শুরু করে দাও। যা কিছু সনাতন, যা কিছু প্রাচীন, জীর্ণ, পুরাতন, ধর্ম্ম, সমাজ, সংস্কার, সমস্ত ভেঙে চুরে ধ্বংস হয়ে যাক,—আর কিছু না পারো শশী, কেবল এই মহাসত্যই মুক্তকণ্ঠে প্রচার করে দাও—এর চেয়ে ভারতের বড় শত্রু আর নেই—তারপরে থাক্ দেশের স্বাধীনতার বোঝা আমার এই মাথায়? কে?

 শশী কান খাড়া করিয়া বলিল, সিঁড়িতে পায়ের যেন শব্দ—

 ডাক্তার চক্ষের পলকে পকেটের মধ্যে হাত পুরিয়া দিয়া নিঃশব্দে দ্রুতপদে অন্ধকার বারান্দার বাহির হইয়া গেলেন, কিন্তু ক্ষণেক পরেই ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, ভারতী, সুমিত্রা আসচেন।