পথের দাবী/৩

উইকিসংকলন থেকে

 অপূর্ব্বর ইচ্ছা ছিল সকালে বাজারটা একবার ঘুরিয়া আসে। ইহার ম্লেচ্ছাচারের দুর্নাম ত সমুদ্র পার হইয়া তাহার কানে পর্য্যন্ত গিয়া পৌঁছিয়াছে, অতএব তাহাকে অস্বীকার করা চলে না,—মানিয়া লইতেই হইরে। কিন্তু হিন্দুত্বের ধ্বজা বহিয়া সেই ত প্রথম কালাপানি পার হইয়া আসে নাই।—সত্যকার হিন্দু আরও ত থাকিতে পারেন যাঁহারা চাকরির প্রয়োজন ও শাস্ত্রের অনুশাসন দুয়ের মাঝামাঝি একটা পথ ইতিপূর্ব্বেই আবিষ্কার করিয়া ধর্ম্ম ও অর্থের বিরোধ ভঞ্জন করতঃ সুখে বসবাস করিতেছেন। সেই সুগম পথের সন্ধান লইতে ইঁহাদের সহিত পরিচিত হওয়া অত্যাবশক, এবং বিদেশে ঘনিষ্ঠ হইয়া উঠিবার এত বড় সুযোগ বাজার ছাড়া আর কোথায় মিলিবে? বস্তুতঃ নিজের কানে শুনিয়া ও চোখে দেখিয়া এই জিনিসটাই তাহার স্থির করা প্রয়োজন, যে, জননীর বিরুদ্ধাচারী না হইয়া এ দেশে বাস্তবিক বাস করা চলে কি না। কিন্তু বাহির হইতে পারিল না, কারণ, উপরের সাহেবটা যে কখন ক্ষমা প্রার্থনা করিতে আসিবে তাহার ঠিকানা নাই। সে যে আসিবেই তাহাতে সন্দেহ ছিল না। একে ত, উৎপাত সে সজ্ঞানে করে নাই, এবং আজ যখন তাহার নেশা ছুটিবে, তখন স্ত্রী ও কন্যা তাহাকে কিছুতেই অব্যাহতি দিবে না, তাহাদের মুখের এই অনুচ্চারিত ইঙ্গিত যে গতকল্যই আদায় করিয়া আসিয়াছে। মেয়েটিকে আজ ঘুম ভাঙিয়া পর্য্যন্ত অনেকবার মনে পড়িয়াছে। ঘুমের মধ্যেও যেন তাহার ভদ্রতা, তাহার সৌজন্য, তাহার বিনয়নম্র কণ্ঠস্বর কানে কানে একটা জানা-সুখের রেশের মত আনাগোনা করিয়া গেছে। মাতাল পিতার দুরাচারে ওই মেয়েটিরও যেমন লজ্জার অবধি ছিল না, মূর্খ তেওয়ারীর রূঢ়তায় অপূর্ব্ব নিজেও তেমনি লজ্জা বোধ না করিয়া পারে নাই। পরের অপরাধে অপরাধী হইয়া এই দুটি অপরিচিত মনের মাঝখানে বোধ করি এইখানেই একটি সমবেদনার সূক্ষ্ম সুত্র ছিল, যাহাকে না বলিয়া অস্বীকার করিতে অপূর্ব্বর মন সরিতে ছিল না। হঠাৎ মাথার উপরে প্রতিবেশীদের জাগিয়া উঠার সাড়া নীচে আসিয়া পৌঁছিল, এবং প্রত্যেক সবুট পদক্ষেপেই সে আশা করিতে লাগিল, এইবার সাহেব তাহার দরজায় নামিয়া আসিয়া দাঁড়াইবেন। ক্ষমা সে করিবে তাহা স্থির, কিন্তু বিগত দিনের বীভৎসতা কি করিলে যে সহজ এবং সামান্য হইয়া বিবাদের দাগ মুছাইয়া দিবে ইহাই হইল তাহার চিন্তা। কিন্তু মার্জ্জনা চাহিবার সময় বহিয়া যাইতে লাগিল। উপরে ছোটোখাটো পদক্ষেপের সঙ্গে মিশিয়া সাহেবের জুতার শব্দ ক্রমশঃ সুস্পষ্টতর হইয়া উঠিতে লাগিল, তাহাতে তাহার পায়ের বহর ও দেহের ভারের পরিচয় দিল, কিন্তু দীনতার কোন লক্ষণ প্রকাশ করিল না। এইরূপে আশায় ও উদ্বেগে প্রতীক্ষা করিয়া ঘড়িতে যখন নয়টা বাজিল এবং নিজের নূতন আফিসের জন্য প্রস্তুত হইবার সময় তাহার আসন্ন হইয়া উঠিল তখন শোনা গেল সাহেব নীচে নামিতে শুরু করিয়াছেন। তাহার পিছনে আরও দুটি পায়ের শব্দ অপূর্ব্ব কান পাতিয়া শুনিল। অনতিবিলম্বে তাহার কপাটের লোহার কড়ার ভীষণ ঝনঝনা উঠিল, এবং রান্নাঘর হইতে তেওয়ারী ছুটিয়া আসিয়া খবর দিল, বাবু, কালকের সাহেব ব্যাটা এসে কড়া নাড়চে। তাহার উত্তেজনা কণ্ঠস্বরে গোপন রহিল না।

 অপূর্ব্ব কহিল, দোর খুলে দিয়ে তাকে আসতে বল্।

 তেওয়ারী দ্বার খুলিয়া দিতেই অপূর্ব্ব অত্যন্ত গম্ভীর কণ্ঠের ডাক শুনিতে পাইল,— এই, তুম্হারা সাব কিধর্?

 উত্তরে তেওয়ারী কি কহিল, ভাল শুনা গেল না, খুব সম্ভব সসম্ভ্রমে অভ্যর্থনা করিল, কিন্তু প্রত্যুত্তরে সাহেবের আওয়াজ সিঁড়ির কাঠের ছাদে ধাক্কা খাইয়া যেন হুঙ্কার দিয়া উঠিল, বোলাও!

 ঘরের মধ্যে অপূর্ব্ব চমকিয়া উঠিল। বাপরে! একি অনুতাপের গলা! একবার মনে করিল সাহেব সকালেই মদ খাইয়াছে, অতএব এ সময়ে যাওয়া উচিত কি-না ভাবিবার পূর্ব্বেই পুনশ্চ হুকুম আসিল, বোলাও জল্‌দি।

 অপূর্ব্ব আস্তে আস্তে কাছে গিয়া দাঁড়াইল। সাহেব এক মুহূর্ত্ত তাহার আপাদ-মস্তক নিরীক্ষণ করিয়া ইংরাজীতে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি ইংরাজী জান?

 জানি।

 আমি ঘুমিয়ে পড়ায় পরে কাল তুমি আমার উপরে গিয়েছিলে?

 হাঁ।

 সাহেব কহিলেন, ঠিক। লাঠি ঠুকেছিলে? অনধিকার প্রবেশের জন্য দোর ভাঙতে চেষ্টা করেছিলে?

 অপূর্ব্ব বিস্ময়ে স্তব্ধ হইয়া গেল। সাহেব বলিলেন, দৈবাৎ ঘর খোলা থাকলে ঘরে ঢুকে তুমি আমার স্ত্রীকে কিংবা মেয়েকে আক্রমণ করতে। তাই আমি জেগে থাকতে যাওনি?

 অপু ধীরে ধীরে কহিল, তুমি ত ঘুমিয়েছিলে, এ-সব জানলে কি করে?

 সাহেব কহিলেন, সমস্ত আমার মেয়ের কাছে শুনেচি। তাকে তুমি গালিগালাজ করে এসেচ। এই বলিয়া সে তাহার পার্শ্ববর্ত্তিনী কন্যাকে অঙ্গুলি-সংকেত করিল। এ সেই মেয়েটি, কিন্তু কালও ইহাকে ভাল করিয়া অপূর্ব্ব দেখিতে পায় নাই, আজও সাহেবের বিপুলায়তনের অন্তরালে তাহার কাপড়ের পাড়টুকু ছাড়া আর কিছু দেখিতে পাইল না। সে ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল কিনা তাহাও বুঝা গেল না, কিন্তু এটুকু বোঝা গেল ইহারা সহজ মানুষ নয়। সমস্ত ব্যাপারটাকে ইচ্ছা করিয়া বিকৃত ও উল্টা করিয়া প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা করিতেছে। অতএব, অত্যন্ত সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

 সাহেব কহিলেন, আমি জেগে থাকলে তোমাকে লাথি মেরে রাস্তায় ফেলে দিতাম, এবং একটা দাঁতও তোমার মুখে আস্ত রাখতাম না, কিন্তু সে সুযোগ যখন হারিয়েছি, তখন পুলিশের হাতে যেটুকু বিচার পাওয়া যায় সেইটুকু নিয়েই এখন সন্তুষ্ট হতে হবে। আামরা যাচ্ছি, তুমি এ জন্য প্রস্তুত থাক গে।

 অপূর্ব্ব মাথা নাড়িয়া কহিল, আচ্ছা। কিন্তু তাহার মুখ অত্যস্ত স্নান হইয়া গেল।

 সাহেব মেয়ের হাত ধরিয়া কহিলেন, এসো। এবং নামিতে নামিতে বলিলেন, কাওয়ার্ড! অরক্ষিত স্ত্রীলোকের গায়ে হাত দেবার চেষ্টা। আমি তোমাকে এমন শিক্ষা দেব যা তুমি জীবনে ভুলবে না।

 তেওয়ায়ী পাশে দাঁড়াইয়া সমস্ত শুনিতেছিল, তাঁহারা অন্তর্হিত হইতেই কাঁদ-কাঁদ হইয়া কহিল, কি হবে ছোটবাবু?

 অপূর্ব্ব তাচ্ছিল্যভাবে কহিল, হবে আবার কি!

 কিন্তু তাহার মুখের চেহারা যে অন্য কথা কহিল, তেওয়ারী তাহা বুঝিল। কহিল, তখন ত বলেছিলুম বাবু, যা হবার হয়ে গেছে, আর ওদের ঘেঁটিয়ে কাজ নেই। ওরা হ’ল সাহেব-মেম।

 অপূর্ব্ব কহিল, সাহেব-মেম তা কি?

 তেওয়ারী কহিল, ওরা যে পুলিশে গেল!

 অপূর্ব্ব বলিল, গেল তা কি?

 তেওয়ারী ব্যাকুল হইয়া কহিল, বড়বাবুকে একটা তার করে দিই ছোটবাবু, তিনি না হয় এসে পড়ুন।

 তুই ক্ষেপলি তেওয়ারী! যা দেখ গে ওদিকে বুঝি সব পুড়ে-ঝুড়ে গেল। সাড়ে দশটায় আমাকে বেরোতে হবে। এই বলিয়া সে নিজের ঘরে চলিয়া গেল। তেওয়ারী রান্নাঘরে গিয়া প্রবেশ করিল, রাঁধা-বাড়ার কাজ হইতে বাবুর অফিসে যাওয়া পর্য্যন্ত যা কিছু সমস্তই তাহার কাছে একেবারে অর্থহীন হইয়া গেল। এবং যতই সে মনে মনে আপনাকে সমস্ত আপদের হেতু বলিয়া ধিক্কার দিতে লাগিল, ততই তাহার উদ্‌ভ্রান্ত চিত্ত এদেশের ম্লেচ্ছতার উপরে, গ্রহ নক্ষত্রের মন্দ দৃষ্টির উপরে পুরোহিতের গণনার ভ্রমের উপরে এবং সর্ব্বোপরি করুণাময়ীর অর্থলিপ্সার উপরে দোষ চাপাইয়া কোনমতে একটু সান্ত্বনা খুঁজিয়া ফিরিতে লাগিল।

 এমনিধারা মন লইয়াই তাহাকে রান্নার কাজ শেষ করিতে হইল। করুণাময়ীর হাতে গড়া মানুষ সে, অতএব মন তাহার যতই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাক, হাতের কাজে কোথাও ভুলচুক হইল না। যথাসময়ে আহারে বসিয়া অপূর্ব্ব তাহাকে সাহস দিবার অভিপ্রায়ে রন্ধনের কিছু বাড়াবাড়ি প্রশংসা করিল। একদফা অন্নব্যঞ্জনের চেহারার যশোকীর্ত্তন করিল, এবং দুই এক গ্রাস মুখে পুরিয়াই কহিল, আজ রেঁধেচিস্ যেন অমৃত তেওয়ারী। ক’দিন খাইনি, ভেবেছিলাম বুঝি বা সব পুড়িয়ে-ঝুড়িয়ে ফেলবি! যে ভীতু লোক তুই—আচ্ছা মানুষটিকে মা বেছে বেছে সঙ্গে দিয়েছিলেন।

 তেওয়ারী কহিল, হুঁ।

 অপূর্ব্ব তাহার প্রতি চাহিয়া সহাস্যে কহিল, মুখখানা যে একেবারে তোলো হাঁড়ি করে রেখেছিল রে? এবং শুধু কেবল তেওয়ারীর নয়, নিজের মন হইতেও ব্যাপারটা লঘু করিয়া দিবার চেষ্টায় কৌতুক করিয়া বলিল, হারামজাদা ফিরিঙ্গির শাসানোর ঘটাটা একবার দেখলি? পুলিশে যাচ্চেন!—আরে, যা না তাই। গিয়ে করবি কি শুনি? তোর সাক্ষী আছে?

 তেওয়ারী শুধু কহিল, সাহেব-মেমদের কি সাক্ষী-সাবুদ লাগে বাবু, ওরা বললেই হয়।

 অপূর্ব্ব কহিল, হাঁ বললেই হয়! আইন-কাহন যেন নেই! তাছাড়া, ওরা আবার কিসের সাহেব-মেম? রঙটি তো একেবারে আমার-বার্নিস করা জুতো! ব্যাটা কচি ছেলেকে যেন জুজুর ভয় দেখিয়ে গেল! নচ্ছার পাজি হারামজাদা!

 তেওয়ারী চুপ করিয়া রহিল। আড়ালে গালি-গালাজ করিবার মত তেজও আর তাহার ছিল না।

 অপুর্ব্ব কিছুক্ষণ নিঃশব্দে আহার করার পরে হঠাৎ মুখ তুলিয়া কহিল, আর ঐ মেয়েটা কি বজ্জাত, তেওয়ারী? কাল এলো যেন ভিজে বেড়ালটি, আর ওপরে গিয়েই যত সব মিছে কথা লাগিয়েচে! চেনা ভার!

 তেওয়ারী কহিল, খিষ্টান যে!

 তা বটে! অপূর্ব্বর তৎক্ষণাৎ মনে হইল, ইহাদের খাদ্যাখাদ্যের জ্ঞান নাই, এঁটোকাঁটা মানে না, সামাজিক ভাল-মন্দের কোন বোধ নাই,—কহিল, হতভাগা, নচ্ছার ব্যাটারা। জানিস তেওয়ারী, আসল সাহেবরা এদের কি রকম ঘেন্না করে—এক টেবিলে বসে কখনো খায় না পর্য্যন্ত—যতই হ্যাটকোট পরুন, আর যতই কেননা গির্জ্জেয় আনাগোনা করুন। যারা জাত দেয়, তারা কি কখ্‌খনো ভাল হতে পারে তুই মনে করিস?

 তেওয়ারী তাহা কোন দিনই মনে করে না, কিন্তু নিজেদের এই আসন্ন সর্ব্বনাশের সম্মুখে দাঁড়াইয়া অপরে কে ভাল আর কে মন্দ, এ আলোচনায় তাহার প্রবৃত্তি হইল না। ছোটবাবুর আফিসে যাইবার সময় হইয়া আসিতেছে, তখন একাকী ঘরের মধ্যে যে কি করিয়া তাহার সময় কাটিবে সে জানে না। সাহেব থানায় খবর দিতে গিয়াছে ফিরিয়া আসিয়া হয়ত দোর ভাঙিয়া ফেলিবে, হয়ত পুলিশের দল সঙ্গে করিয়া আনিবে,—হয়ত তাহাকে বাঁধিয়া লইয়া যাইবে,—কি যে হইবে, আর কি যে হইবে না সমস্ত অনিশ্চিত। এ অবস্থায় আসল ও নকল সাহেবের প্রভেদ কতখানি, একের টেবিলে অপরে খায় কি না, এবং না খাইলে অন্যপক্ষের লাঞ্ছনা ও মনস্তাপ কতদুর বৃদ্ধি পায়, এ-সকল সংবাদের প্রতি সে লেশমাত্র কৌতূহল অনুভব করিল না। আহারাদি শেষ করিয়া অপুর্ব্ব কাপড় পরিতেছিল, তেওয়ারী ঘরের পর্দ্দাটা একটুখানি সরাইয়া মুখ বাহির করিয়া কহিল, একটু দেখে গেলে হ’ত না?

 কি দেখে গেলে?

 ওদের ফিরে আসা পর্য্যন্ত—

 অপূর্ব্ব কহিল, অ কি হয়! আজ আমার চাকরির প্রথম দিন,—কি তারা ভাববে বল্‌ত?

 তেওয়ারী চুপ করিয়া রহিল। অপূর্ব্ব কহিল, তুই দোর দিয়ে নির্ভয়ে বসে থাক্‌ না,—আমি যত শীঘ্র পারি ফিরে আসবো—দোর ত আর ভাঙতে পারবে না, কি করবে ব্যাটা!

 তেওয়ারী কহিল, আচ্ছা। কিন্তু সে যে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপিবার চেষ্টা করিল অপূর্ব্ব তাহা স্পষ্ট দেখিতে পাইল। বাহির হইবার সময়ে দ্বারে খিল দেয়ার পূর্ব্বে তেওয়ারী গলাটা খাটো করিয়া বলিল, আজ আর হেঁটে যাবেন না ছোটবাবু, রাস্তায় একটা গাড়ি ডেকে নেবেন।

 আচ্ছা, সে দেখা যাবে, এই বলিয়া অপূর্ব্ব সিঁড়ি বাহিয়া নীচে নামিয়া গেল। তাহার চলার ভঙ্গী দেখিয়া মনে হইল না যে তাহার মনের মধ্যে নূতন চাকরির আনন্দ আর কিছুমাত্র অবশিষ্ট আছে।

 বোথা কোম্পানির অংশীদার, পূর্ব্ব অঞ্চলের ম্যানেজার রোজেন সাহেব সম্প্রতি বর্ম্মায় ছিলেন, রেঙ্গুনের আফিস তিনিই প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, অপূর্ব্বকে যথেষ্ট সহৃদয়তার সহিত গ্রহণ করিলেন, এবং তাহার চেহারা কথাবার্ত্তা ও ইউনিভার্সিটির ডিগ্রী প্রভৃতি দেখিয়া অতিশয় প্রীত হইলেন। সমস্ত কর্ম্মচারীদের ভাকিয়া পরিচয় করাইয়া দিলেন, এবং যে মাস-দুই-তিন কাল তিনি এখানে আছেন তাহার মধ্যে ব্যবসায়ের সমস্ত রহস্য শিখাইয়া দিবেন আশা দিলেন। কথায় বার্ত্তায় আলাপে পরিচয়ে ও নূতন উৎসাহে ভিতরের গ্লানিটা তাহার এক সময়ে কাটিয়া গেল। একটি লোক তাহাকে বিশেষ করিয়া আকৃষ্ট করিল, সে আফিসের এ্যাকাউণ্টেণ্ট। মারাঠি ব্রাহ্মণ, নাম রামদাস তলওয়ারকর। বয়স বোধ হয় তারই মত,—হয়ত বা কিছু বেশি। দীর্ঘাকৃতি, বলিষ্ঠ, গৌরবর্ণ,—সুপুরুষ বলিলে অতিশয়োক্তি হয় না। পরণে পায়জামা ও লম্বা কোট, মাথায় পাগড়ী, কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা,—ইংরাজী কথাবার্ত্তা চমৎকার শুদ্ধ, কিন্তু অপূর্ব্বর সহিত সে প্রথম হইতে হিন্দীতে কথাবার্ত্তা শুরু করিল। অপূর্ব্ব হিন্দী ভাল জানিত না, কিন্তু যখন দেখিল সে হিন্দী ছাড়া আর কিছুতেই জবাব দেয় না, তখন সেও হিন্দী বলিতে আরম্ভ করিল। অপূর্ব্ব কহিল, এ-ভাষা আমি ভাল জানিনে, অনেক ভুল হবে।

 রামদাস কহিল, ভুল আমারও হয়, আমাদের কারও এটা মাতৃভাষা নয়।

 অপূর্ব্ব বলিল, যদি পরের ভাষাতেই বলতে হয় ত, ইংরিজি দোষ করলে কি?

 রামদাস কহিল, ইংরিজি আমার আরও ঢের বেশি ভুল হয়। একটু হাসিয়া কহিল, আপনি না হয় ইংরিজিতেই বলবেন, কিন্তু আমি হিন্দীতে জবাব দিলে আমাকে মাপ করতে হবে।

 এই আলাপের মধ্যে রোজেন সাহেব নিজেই ম্যানেজারের ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, হল্যাণ্ডের লোক, বেশ-ভূষার পারিপাট্য নাই; মুখে প্রচুর দাড়ি-গোঁফ, ইংরাজী উচ্চারণ ভাঙা-ভাঙা, পাকা ব্যবসায়ী—ইতিমধ্যেই বর্ম্মার নানাস্থানে ঘুরিয়া, নানা লোকের কাছে তথ্য সংগ্রহ করিয়া কাজ-কর্ম্মের একটা খসড়া প্রস্তুত করিয়া ফেলিয়াছেন, সেই কাগজখানা অপূর্ব্বর টেবিলের উপর ফেলিয়া দিয়া কহিলেন, এ সম্বন্ধে আপনার মন্তব্য একটা জানতে চাই। তলওয়ারকরকে কহিলেন, আপনার ঘরেও এক কপি পাঠিয়ে দিয়েছি। না না, এখন থাক্‌—আজ ম্যানেজারের সম্মানে দু’টোর সময় আফিসের ছুটি। দেখুন, আমি ত শীঘ্রই চলে যাবো তখন আপনাদের দুজনের ’পরেই সমস্ত কাজ-কর্ম্ম নির্ভর করবে। আমি ইংলিশম্যান নই,—যদিচ এ রাজ্য একদিন আমাদেরই হতে পারত,—তবুও তাদের মত আমরা ইণ্ডিয়ানদের ছোট মনে করিনে, নিজেদের সমকক্ষই ভাবি,—কেবল ফার্ম্মের নয়, আপনাদের নিজেদের উন্নতিও আপনাদের নিজেদের কর্ত্তব্য জ্ঞানের উপরে—আচ্ছা, গুড্‌ডে—আফিস দু’টার সময় বন্ধ হওয়া চাই—ইত্যাদি বলিতে বলিতে তিনি যেমন ক্ষিপ্রপদে প্রবেশ করিয়াছিলেন, তেমনি ক্ষিপ্রপদে বাহির হইয়া গেলেন। এবং ইহার অল্পক্ষণ পরেই তাঁহার মোটরের শব্দ বাহিরের দ্বারের কাছে শুনিতে পাওয়া গেল।

 বেলা দুইটার সময় উভয়ে একত্রে পথে বাহির হইল। তলওয়ারকর সহরে থাকে না, প্রায় দশ মাইল পশ্চিমে ইন্‌সিন্ নামক স্থানে তাহার বাসা। বাসায় তাহার স্ত্রী ও একটি ছোট মেয়ে থাকে, সঙ্গে খানিকটা জমি আছে, সেখানে তরি-তরকারী অনায়াসে জন্মাইতে পারা যায়, চমৎকার খোলা জায়গা, সহরের গণ্ডগোল নাই,—যথেষ্ট ট্রেন, যাতায়াতের কোন অসুবিধা হয় না।—হালদার বাবুজী, কাল আফিসের পরে আমার ওখানে চায়ের নিমন্ত্রণ রইল।

 অপূর্ব্ব কহিল, আমি চা খাইনে বাবুজী!

 খান না? আমিও পূর্ব্বে খেতাম না, আমার স্ত্রী এখনও রাগ করেন,—আচ্ছা, না হয়, ফলমূল—সরবৎ—কিংবা—আমরা ত আপনার মতই ব্রাহ্মণ—

 অপূর্ব্ব হাসিয়া কহিল, ব্রাহ্মণ ত বটেই। কিন্তু আপনারা যদি আমাদের হাতে খান, তবেই আমি শুধু আপনার স্ত্রীর হাতে খেতে পারি।

 রামদাস কহিল, আমি ত খেতে পারিই, কিন্তু আমার স্ত্রীর কথা—আচ্ছা সে তাঁকে জিজ্ঞেস করে বলব। আমাদের মেয়েরা বড়,—আচ্ছা, আপনার বাসা ত কাছেই, চলুন না আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। আমার ট্রেন ত সেই পাঁচটায়।

 অপূর্ব্ব প্রমাদ গনিল। এতক্ষণ সে সমস্ত ভুলিয়াছিল, বাসার কথায় চক্ষের নিমিষে তাহার সমস্ত হাঙ্গামা, সমস্ত কদর্য্যতা বিদ্যুৎ-স্ফূরণের ন্যায় চমকিয়া মুখের সরসশ্রী মুছিয়া দিয়া গেল। এখানে পা দিয়াই সে এমন একটা কদর্য্য নোঙরা ব্যাপারে লিপ্ত হইয়া পড়িয়াছে, এ-কথা জানিতে দিতে তাহার মাথা কাটা গেল। এতক্ষণ সেখানে যে কি হইয়াছে সে কিছুই জানে না। হয়ত, কত কি হইয়াছে। একাকী তাহারই মাঝখানে গিয়া দাঁড়াইতে হইবে। এমন একজন পরিচিত মানুষকে সঙ্গে পাইলে কত সুবিধা, কত সাহস। কিন্তু সদ্য পরিচয়ের এই আরম্ভকালেই সে যে হঠাৎ কি ভাবিয়া বসিবে এই কথা মনে করিয়া অপূর্ব্ব একান্ত সঙ্কুচিত হইয়া উঠিল, কহিল, দেখুন, সমস্ত বিশৃঙ্খল—মুখের কথাটা সে শেষ করিতেও পারিল না। তাহার সঙ্কোচ ও লজ্জা অনুভব করিয়া রামদাস সহাস্যে কহিল, এক রাত্রে শৃঙ্খলা আমি ও আশা করিনে বাবুজী। আমাকেও একদিন নূতন বাসা পাততে হয়েছিল, তবু ত আমার স্ত্রী ছিলেন, আপনার তাও সঙ্গে নেই। আপনি লজ্জা পাচ্ছেন, কিন্তু তাঁকে না নিয়ে এলে এক বছর পরেও এই লজ্জা আপনার ঘুচবে না তা বলে রাখচি। চলুন, দেখি কি করতে পারি,—বিশৃঙ্খলার মাঝখানেই ত বন্ধুর দরকার।

 অপূর্ব্ব চুপ করিয়া রহিল। সে স্বভাবতঃ রহস্যপ্রিয় লোক, তাহার স্ত্রীর একান্ত-অসদ্ভাবের কথাটা সে অন্য সময়ে কৌতুক করিয়া বলিতেও পারিত, কিন্তু এখন হাসি-তামাসার কথা তাহার মনেও আসিল না। এই নির্ব্বান্ধব দেশে আজ তাহার বন্ধুর একান্ত প্রয়োজন, কিন্তু সদ্য পরিচিত এই বিদেশী বন্ধুটিকে সেই প্রয়োজনে আহ্বান করিতে তাহার লজ্জা করিতে লাগিল। তাহার কথায় সে যে ঠিক সায় দিল তাহা নহে, কিন্তু উভয়ে চলিতে চলিতে যখন তাহার বাসার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন তলওয়ারকরকে গৃহে আমন্ত্রণ না করিয়া পারিল না। উপরে উঠিতে গিয়া দেখিতে পাইল সেই ক্রীশ্চান মেয়েটিও ঠিক সেই সময়ে অবতরণ করিতেছে। বাপ তাহার সঙ্গে নাই, সে একা। দুজনে একপাশে সরিয়া দাঁড়াইল। মেয়েটি কাহারও প্রতি দৃষ্টিপাত করিল না, ধীরে ধীরে নামিয়া কিছু দূরে রাস্তায় গিয়া যখন পড়িল রামদাস জিজ্ঞাসা করিল, এঁরা তেতলায় থাকেন বুঝি?

 অপূর্ব্ব কহিল, হাঁ!

 আপনাদেরই বাঙালী?

 অপূর্ব্ব মাথা নাড়িয়া কহিল, না, দেশীয় ক্রীশ্চান। খুব সম্ভব, মাদ্রাজী, কিম্বা গোয়ানিজ কিংবা আর কিছু—কিন্তু বাঙালী নয়।

 রামদাস কহিল, কিন্তু কাপড় পরার ধরণ ত ঠিক আপনাদের মত?

 অপূর্ব্ব কিছু আশ্চর্য্য হইয়া প্রশ্ন করিল, আমাদের ধরণ আপনি জানলেন কি করে?

 রামদাস বলিল, আমি? বোম্বায়ে, পুনায়, সিমলায় অনেক বাঙালী মহিলাকে আমি দেখেচি, এমন সুন্দর কাপড় পরা ভারতবর্ষের আর কোন জাতের নেই।

 তা হবে,—এই বলিয়া অন্যমনস্ক অপূর্ব্ব তাহার বাসার রুদ্ধদ্বারে আসিয়া পুনঃ পুনঃ আঘাত করিতে লাগিল। খানিক পরে ভিতর হইতে সতর্ক কণ্ঠের সাড়া, আসিল, কে?

 আমি রে, আমি, দোর খোল, তোর ভয় নেই, বলিয়া অপূর্ব্ব হাসিল। কারণ ইতিমধ্যে ভয়ানক কিছু ঘটে নাই, তেওয়ারী নিরাপদে ঘরের মধ্যেই আছে অনুভব করিয়া তাহার মস্ত যেন একটা ভার নামিয়া গেল।

 ভিতরে প্রবেশ করিয়া রামদাস এ-ঘর ও-ঘর ঘুরিয়া খুশী হইল, কহিল, আমি যা ভয় করেছিলাম তা নয়। আপনার চাকরটি ভাল, সমস্তই একপ্রকার গুছিয়ে ফেলেচে। আসবাবগুলি আমিই পছন্দ করে কিনেছিলাম। আপনার আরও কি-কি দরকার আমাকে জানালেই কিনে পাঠিয়ে দেব—রোজেন সাহেবের হুকুম আছে।

 তেওয়ারী মৃদুম্বরে কহিল, আর আসবাবে কাজ নেই বাবু, ভালয় ভালয় বেরুতে পারলে বাঁচি।

 তাহার মন্তব্যে কেহ মনোযোগ করিল না, কিন্তু অপূর্ব্বর কানে গেল। সে একসমরে আড়ালে জিজ্ঞাসা করিল, আর কিছু হয়েছিল রে?

 না।

 তবে যে ও কথা বললি?

 তেওয়ারী জবাব দিল, বললুম সাধে? সারা দুপুরবেলাটা সাহেব যা ঘোড়দৌড় করে বেড়িয়েচে তাতে মানুষ টিকতে পারে?

 অপূর্ব্ব ভাবিল, ব্যাপারটা সত্যই হয়ত গুরুতর নয়, অন্ততঃ একটা ইতরের ছোটখাটো সমস্ত তুচ্ছ উপদ্রবকেই বড় করিয়া তুলিয়া অনুক্ষণ তেওয়ারীর সহিত একযোগে অশান্তির জের টানিয়া চলাও অত্যন্ত দুঃখের, তাই সে কতকটা তাচ্ছিল্যভরে কহিল, তা সে কি চলবে না তুই বলতে চাস? কাঠের ছাদে একটু বেশ শব্দ হয়ই।

 তেওয়ারী রাগ করিয়া কহিল, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘোড়ার মত পা ঠোকা কি চলা?

 অপূর্ব্ব বলিল, তা হলে হয়ত আবার মদ খেয়েছিল

 তেওয়ারী উত্তর দিল, তা হবে। মুখ শুঁকে তার দেখিনি। এই বলিয়া সে বিরক্ত— মুখে রান্নাঘরে চলিয়া গেল, এবং বলিতে বলিতে গেল, তা সে যাই হোক, এ ঘরে বাস করা আর পোষাবে না।

 তেওয়ারীর অভিযোগ অন্যায়ও নয় অপ্রত্যাশিতও নয়, দুর্জ্জনের অসমাপ্ত অত্যাচার যে একটা দিনেই সমাপ্ত হইবে এ ভরসা সে করে নাই, তথাপি অনিশ্চিত আশঙ্কায় মন তাহার অতিশয় বিষণ্ণ হইয়া উঠিল। প্রবাসের প্রথম প্রভাতটা তাহার কুয়াশার মধ্যেই আরম্ভ হইয়াছিল, মাঝে কেবল আফিসের সম্পর্কে একটুখানি আলোর আভাস দেখা দিয়াছিল, কিন্তু দিনান্তের কাছাকাছি মেঘাচ্ছন্ন আকাশ আবার তাহার চোখে পড়িল।

 ট্রেনের সময় হইতে রামদাস বিদায় গ্রহণ করিল। কি জানি তেওয়ারীর নালিশ ও তাহার মনিবের মুখের চেহারায় সে কিছু অনুমান করিয়াছিল কি-না, যাইবার সময় সহসা প্রশ্ন করিল, বাবুজী, এ বাসায় কি আপনার সুবিধা হচ্ছে না?

 অপূর্ব্ব ঈষৎ হাসিয়া কহিল, না। এবং রামদাস জিজ্ঞাসুমুখে চাহিয়া আছে দেখিয়া কহিল, উপরে যাঁরা আছেন আমার সঙ্গে বড় সদয় ব্যবহার করছেন না।

 রামদাস বিস্ময়াপন্ন হইয়া বলিল, ওই মহিলাটি?

 হাঁ, ওর বাপ ত বটেই। এই বলিয়া অপূর্ব্ব কাল বিকালে ও আজ সকালের ঘটনা বিবৃত করিল। রামদাস কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, আমি হলে এর ইতিহাস আর এক রকম হোতো। ক্ষমা প্রার্থনা না কোরে এই দরজা থেকে সে এক পা নীচে নামতে পারত না।

 অপূর্ব্ব কহিল, ক্ষমা না চাইলে কি করতেন!

 রামদাস কহিল, এই যে বললুম, নামতে দিতাম না।

 অপূর্ব্ব কথাটা যে তাহার বিশ্বাস করিল তাহা নয়, তবুও সাহসের কথায় একটু সাহস পাইল। সহাস্যে কহিল, কিন্তু এখন আমরা ত নামি চলুন, আপনার গাড়ির সময় হয়ে যাচ্ছে। এই বলিয়া সে বন্ধুর হাত ধরিয়া সিঁড়ি বাহিয়া নীচে নামিতে লাগিল। কিন্তু আশ্চর্য্য এই যে, আসিবার সময় যেমন, যাইবার সময়েও ঠিক তেমনি সিঁড়ির মুখেই সেই মেয়েটির সহিত দেখা হইল। হাতে তাহার ছোট একটি কাগজের মোড়ক, বোধ করি কিছু কিনিতে গিয়াছিল, ফিরিয়া আসিতেছে! তাহাকে পথ দিবার জন্য অপূর্ব্ব একধারে সরিয়া দাঁড়াইল, কিন্তু হঠাৎ হতবুদ্ধি হইয়া দেখিল, রামদাস পথ না ছাড়িয়া একেবারে সেটা সম্পূর্ণ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়াছে। ইংরেজি করিয়া কহিল, আমাকে এক মিনিট মাপ করতে হবে, আমি এই বাবুজির বন্ধু। এদের প্রতি দুর্ব্যবহারের জন্য আপনাদের অনুতপ্ত হওয়া উচিত।

 মেয়েটি চোখ তুলিয়া ক্রুদ্ধস্বরে কহিল, ইচ্ছা হয় এ সব কথা আমার বাবাকে বলতে পারেন।

 আপনার বাবা বাড়ি আছেন?

 না।

 তাহলে অপেক্ষা করবার আমার সময় নেই। আমার হয়ে তাঁকে বলবেন যে, তাঁর উপদ্রবে ইনি থাকতে পারচেন না।

 মেয়েটি তেমনি তিক্তকণ্ঠে কহিল, তাঁর হয়ে আমিই জবাব দিচ্ছি যে ইচ্ছে করলে ইনি চলে যেতে পারেন।

 রামদাস একটু হাসিল, কহিল, ভারতবর্ষীয় ক্রীশ্চান ‘বুলি’দের আমি চিনি এর চেয়ে বড় জবাব তাদের মুখে আমি আশা করিনি। কিন্তু তাতে তাঁর সুবিধে হবে না, কারণ এর জায়গায় আমি আসবো। আমার নাম রামদাস তলওয়ারকর—আমি মারাঠি ব্রাহ্মণ। তলওয়ার শব্দটার একটা অর্থ আছে, আপনার বাবাকে সেটা জেনে নিতে বলবেন। গুড ইভনিং। চলুন বাবুজি,—এই বলিয়া সে অপূর্ব্বর হাত ধরিয়া একেবারে রাস্তায় আসিয়া পড়িল।

 মেয়েটির মুখের চেহারা অপূর্ব্ব কটাক্ষে দেখিতে পাইয়াছিল, শেষ দিকটায় সে যে কিরূপ কঠিন হইয়া উঠিয়াছিল মনে করিয়া কিছুক্ষণ পর্য্যন্ত সে কথা কহিতেই পারিল না, তারপর আস্তে আস্তে বলিল, এটা কি হ’ল তলওয়ারকর?

 তলওয়ায়কর উত্তরে কহিল, এই হ’ল যে আপনি উঠে গেলেই আমাকে আসতে হবে। শুধু খবরটা যেন পাই।

 অপূর্ব্ব কহিল, অর্থাৎ দুপুরবেলা আপনার স্ত্রী এখানে একাকী থাকবেন।

 রামদাস কহিল, না একাকী নয়, আমার দু’বছরের একটি মেয়ে আছে।

 অর্থাৎ আপনি পরিহাস করচেন?

 না, আমি সত্যি বলচি। পরিহাস করতে আমি জানিইনে।

 অপূর্ব্ব তাহার সঙ্গীর মুখের প্রতি একবার চাহিয়া দেখিল, তারপরে ধীরে ধীরে কহিল, তাহলে এ বাসা আমার ছাড়া চলবে না। তাহার মুখের কথা শেষ না হইতেই রামদাস অকস্মাৎ তাহার দুই হাত নিজের বলিষ্ঠ দুই হাতে ধরিয়া ফেলিয়া প্রচণ্ড একটা ঝাঁকানি দিয়া বলিয়া উঠিল, এই আমি চাই বাবুজি, এই ত আমি চাই। অত্যাচারের ভয়ে আমরা অনেক পালিয়েচি, কিন্তু—ব্যস্!

 একটা হাত সে ছাড়িয়া দিল, কিন্তু একটা হাত সে শেষ পর্য্যন্ত ধরিয়াই রহিল। কেবল ট্রেন ছাড়িলে সেই হাতে আর একবার মস্ত নাড়া দিয়া নিজের দুই হাত এক করিয়া নমস্কার করিল।

 সন্ধ্যা হইতে তখনও বিলম্ব ছিল, ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ট্রেনেরও আর সময় ছিল না বলিয়া স্টেশনের এই দিকের প্লাটফর্ম্মে যাত্রীর ভিড় ছিল না। এইখানে অপূর্ব্ব পায়চারি করিয়া বেড়াইতে লাগিল। হঠাৎ তাহার মনে হইল কাল হইতে আজ পর্য্যন্ত এই একটা দিনের ব্যবধানে জীবনটা যেন কোথা দিয়া কেমন করিয়া একেবারে বহুবৎসর দীর্ঘ হইয়া গিয়াছে। খেলা-ধূলা ও এমনি সব তুচ্ছ কাজের মধ্যে সে কখন যেন ক্লান্ত হইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, অকস্মাৎ যেখানে ঘুম ভাঙ্গিল, সেখানে সমস্ত দুনিয়ার কর্ম্মস্রোত কেবলমাত্র কাজের বেগেই যেন ক্ষেপিয়া উঠিয়াছে। বিশ্রাম নাই, বিরতি নাই, আনন্দ নাই, অবসর নাই, মানুষে মানুষে সংঘর্ষের মধ্যাহ্ন সূর্য্য দুই হাতে কেবল মুঠা মুঠা করিয়া অহরহ আগুন ছড়াইয়া চলিয়াছে। এখানে মা নাই, দাদারা নাই, বৌদিদিরা নাই—স্নেহছায়া কোথাও কিছু নাই,—কর্ম্মশালার অসংখ্য চক্র দক্ষিণে, বামে, মাথার উপরে, পায়ের নীচে, সর্ব্বত্র অন্ধবেগে ঘুরিয়া চলিয়াছে, এতটুকু অসতর্ক হইলে রক্ষা পাইবার কোন পথ নাই—সমস্ত একেবারে নিষ্ঠুরভাবে অবরুদ্ধ। চোখের দুই কোণ জলে ভরিয়া গেল, অদূরে একটা কাঠের বেঞ্চ ছিল, সে তাহারই উপরে বসিয়া পড়িয়া চোখ মুছিতেছে, হঠাৎ পিছন হইতে একটা প্রবল ধাক্কায় উপুড় হইয়া একেবারে মাটির উপর পড়িয়া গেল। তাড়াতাড়ি কোনমতে উঠিয়া দাঁড়াইতে দেখিল জন পাঁচ-ছয় ফিরিঙ্গী ছোঁড়া,—কাহারও মুখে সিগারেট, কাহারও মুখে পাইপ,—দাঁত বাহির করিয়া হাসিতেছে। সম্ভবতঃ যে ধাক্কা মারিয়াছিল সে বেঞ্চের গায়ে একটা লেখা দেখাইয়া কহিল, শালা, ইহা সাহেব লোকগা বাস্তে, তুম্‌হারা নেহি—

 লজ্জায় ক্রোধে ও অপমানে অপূর্ব্বর সজল চক্ষু আরক্ত হইয়া উঠিল, ঠোঁট কাঁপিতে লাগিল, সে প্রত্যুত্তরে কি যে বলিল, বুঝা গেল না। তাহার অবস্থা দেখিয়া ফিরিঙ্গীর দল অত্যন্ত আমোদ অনুভব করিল, একজন কহিল, শালা দুধবালা, আঙ্খি গরম করতা—ফাটক মে যায়গা? সকলে উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল,—একজন মুখের সামনে একটা অশ্লীল ভঙ্গী করিয়া শিস দিল।

 অপূর্ব্বর হিতাহিত জ্ঞান প্রায় লোপ হইয়া আসিতেছিল, হয়ত মুহূর্ত্ত পরে সে ইহাদের উপরে ঝাঁপাইয়া পড়িত, কিন্তু কতকগুলি হিন্দুস্থানী কর্ম্মচারী অনতিদূরে বসিয়া বাতি পরিষ্কার করিতেছিল, তাহারা মাঝখানে পড়িয়া তাহাকে টানিয়া প্লাটফর্ম্মের বাহির করিয়া দিল, একটা ফিরিঙ্গী ছোঁড়া ছুটিয়া আসিয়া ভিড়ের মধ্যে পা গলাইয়া অপূর্ব্বর শাদা পিরাণের উপর বুটের পদচিহ্ন আঁকিয়া দিল। এই হিন্দুস্থানী দলের হাত হইতে মুক্তিলাভের জন্য সে টানা-টানি করিতেছিল, একজন তাহাকে ঠেলিয়া দিয়া বিদ্রূপ করিয়া বলিল, আরে বাঙালী বাবু, সাহেব লোক্‌কা বদন ছুয়েগা ত ইঁহা এক বরস্ জেল খাটেগা——যাও—ভাগো—একজন কহিল, আরে বাবু হ্যায়, ধাক্কা মাৎ দেও—এই বলিয়া সে তারের গেটটা টানিয়া বন্ধ করিয়া দিল। বাহিরে তাহাকে ঘিরিয়া ভিড় জমিবার উপক্রম করিতেছিল, যাহারা দেখিতে পায় নাই তাহারা কারণ জিজ্ঞাসা করিল, যাহারা দেখিয়াছে তাহারা নানারূপ মন্তব্য প্রকাশ করিল, একজন হিন্দুস্থানী চানা-ভাজা বিক্রী করে, সে কলিকাতায় থাকিয়া বাঙলা শিখিয়াছিল, সেই ভাষায় বুঝাইয়া দিল যে, এদেশে চট্টগ্রামের অনেক লোক দুধের ব্যবসা করে, তাহারা পিরাণ গায়ে দেয়, জুতা পরে,—অপূর্ব্ব আফিসের পোষাক ছাড়িয়া সাধারণ বাঙালীর পোষাকে স্টেশনে আসিয়াছিল, সুতরাং,—সাহেবরা সেই দুধবালা মনে করিয়া মারিয়াছে, কেরাণীবাবু বলিয়া চিনিতে পারে নাই। তাহার কৈফিয়ৎ, সঙ্গ ও সহানুভুতির দায় এড়াইয়া অপূর্ব্ব স্টেশনে খোঁজ করিয়া সোজা স্টেশন মাস্টারের ঘরে গিয়া প্রবেশ করিল। তিনিও সাহেব,—কাজ করিতেছিলেন, মুখ তুলিয়া চাহিলেন। অপূর্ব্ব জুতার দাগ দেখাইয়া ঘটনা বিবৃত করিল। তিনি বিরক্তি ও অবজ্ঞা ভরে মিনিট খানেক শুনিয়া কহিলেন, ইউরোপীয়ানদের বেঞ্চে তুমি বসিতে গেলে কেন?

 অপূর্ব্ব উত্তেজনার সহিত কহিল, আমি জানতাম না—

 তোমার জানা উচিত ছিল।

 কিন্তু তাই বলে খামকা গায়ে হাত দেবে?

 সাহেব দ্বারের দিকে হাত বাড়াইয়া কহিলেন— গো—গো—গো—চাপ্‌রাশি ইস্‌কো বহর্ কর্ দেও—বলিয়া কাজে মন ছিলেন।

 তাহার পরে অপূর্ব্ব কি করিয়া যে বাসায় আসিল সে ঠিক জানে না। ঘণ্টা দুই পূর্ব্বে রামদাসের সহিত এই পথে একত্রে আসিবার কালে সব চেয়ে যে দুর্ভাবনা তাহার মনে বেশী বাজিতেছিল সে তাহার অকারণ মধ্যস্থতা। একে ত উৎপাত ও অশান্তির মাত্রা তাহাতে কমিবে না, বরঞ্চ বাড়িবে, তাছাড়া, সে ক্রীশ্চান মেয়েটির যত অপরাধই কেননা থাক, কেবলমাত্র মেয়েমানুষ বলিয়াই ত পুরুষের মুখ হইতে ওরূপ কঠিন কথা বাহির হওয়া সঙ্গত হয় নাই।—তাহাতে আবার সে তখন একাকী ছিল। তাহার শিক্ষিত ভদ্র অন্তঃকরণ রামদাসের কথায় ক্ষুণ্ণই হইয়াছিল,—কিন্তু এখন ফিরিবার পথে তাহার সে ক্ষোভ কোথায় যে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছিল তাহার ঠিকানা ছিল না। তাহাকে মনে যখন হইল, তখন মেয়েমানুষ বলিয়া আর মনে হইল না—মনে হইল ক্রীশ্চানের মেয়ে, সাহেবের মেয়ে বলিয়া,—যে ছোঁড়াগুলো তাহাকে এইমাত্র অকারণ অপমানের একশেষ করিয়াছে—যাহাদের কুশিক্ষা ইতরতা ও বর্ব্বরতার অবধি নাই—তাহাদেরই ভগিনী বলিয়া—যে-সাহেবটা একান্ত অবিচারে তাহাকে ঘর হইতে বাহির করিয়া দিল—মানুষের সামান্য অধিকারটুকুও দিল না—তাহারই পরম জাত্মীয় বলিয়া।

 তেওয়ারী আসিয়া কহিল, ছোটবাবু, আপনার খাবার তৈরী হয়েছে। অপূর্ব্ব কহিল, যাই—

 মিনিট দশ পনেরো পরে সে পুনরায় আসিয়া জানাইল, খাবার যে সব জুড়িয়ে গেল বাবু—

 অপূর্ব্ব রাগ করিয়া বলিল, কেন বিরক্ত করিস তেওয়ারী, আমি খাব না—আমার ক্ষিদে নেই।

 চোখে তাহার ঘুম আসিল না, রাত্রি যত বাড়িতে লাগিল, সমস্ত বিছানাটা যেন তাহার কাছে শয্যাকণ্টক হইয়া উঠিল। একটা মর্ম্মান্তিক বেদনা তাহার সকল অঙ্গে ফুটিতে লাগিল, এবং তাহারই মাঝে মাঝে মনে পড়িতে লাগিল স্টেশনের সেই হিন্দুস্থানী লোকগুলোকে, যাহারা সদলবলে উপস্থিত থাকিয়া তাহার লাঞ্ছনায় কোন অংশ লয় নাই, বরঞ্চ, তাহার অপমানের মাত্রা বাড়াইয়া তুলিতে সাহায্য করিয়াছে। দেশের লোকের বিরুদ্ধে দেশের এত বড় লজ্জা, এত বড় গ্লানি জগতের আর কোন দেশে আছে? কেন এমন হইল? কেমন করিয়া ইহা সম্ভব হইল?