বিষয়বস্তুতে চলুন

পথের দাবী/৫

উইকিসংকলন থেকে

 রাত্রে আহারাদির পরে তেওয়ারী করজোড়ে সাশ্রুনয়নে কহিল, আর না ছোটবাবু, এইবার বুড়োমানুষের কথাটা রাখুন। চলুন, কাল সকালেই আমরা যেখানে হোক চলে যাই।

 অপূর্ব্ব কহিল, কাল সকালেই, কোথায় শুনি? তুই কি ধর্ম্মশালায় গিয়ে থাকতে বলিস নাকি?

 তেওয়ারী বলিল, এর চেয়ে সেও ভাল। মকদ্দমা জিতেছে, এইবার কোনদিন ঘরে ঢুকে আমাদের দু’জনকে মেরে যাবে?

 অপূর্ব্ব আর সহিতে পারিল না, রাগ করিয়া কহিল, তোকে কি আমার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতেই মা সঙ্গে দিয়েছিলেন? তোকে আর আমার দরকার নেই; কাল জাহাজ আছে, তুই বাড়ি চলে যা, আমার কপালে যা আছে তা হবে।

 তেওয়ারী আর তর্ক করিস না, আস্তে আস্তে শুইতে চলিয়া গেল। তাহার কথাগুলা অপূর্ব্বকে অপমানের একশেষ করিল বলিয়াই সে এরূপ কঠোর জবাব দিল, না হইলে সে যে বিশেষ অসঙ্গত কিছু কহে নাই অপূর্ব্ব মনে মনে তাহা অস্বীকার করিতে পারিল না। যাহা হৌক পরদিন সকাল হইতে একটা নূতন বাসার খোঁজ চলিতে লাগিল এবং শুধু তলওয়ারকর ছাড়া অফিসের প্রায় সকলকেই সে এই মর্ম্মে অনুরোধ করিয়া রাখিল! অতঃপর তেওয়ারীও অনুযোগ করিল না, অপূর্ব্বও মনের কথা প্রকাশ করিল না, কিন্তু প্রভু ও ভৃত্য উভয়েরই এক প্রকার সশঙ্কিত ভাবেই দিন কাটিতে লাগিল। আফিস হইতে ফিরিবার পথে অপূর্ব্ব প্রত্যহই ভয় করিত, আজ না জানি কি গিয়া শুনিতে হয়! কিন্তু কোনদিন কিছুই শুনিতে হইল না। মকদ্দমাবিজয়ী জোসেফ পরিবারের নানাবিধ ও বিচিত্র উপদ্রব নব নব রূপে নিত্য প্রকাশ পাইবে ইহাই স্বাভাবিক, কিন্তু উৎপাত ও দূরের কথা, উপরে কেহ আছে কি-না অনেক সময় তাহাই সন্দেহ হইতে লাগিল। কিন্তু এ সম্বন্ধে কেহই কাহাকে কোন কথা কহিত না। নিরুপদ্রবেই দিন কাটিতেছিল— এই ভাল। সপ্তাহখানেক পরে একদিন আফিস হইতে ফিরিবার পরে তেওয়ারী প্রফুল্লমুখে মনের আনন্দ যথাসাধ্য সংযত করিয়া কহিল, আর শুনেচেন ছোটবাবু?

 অপূর্ব্ব কহিল, কি?

 সাহেব যে ঠ্যাঙ-ভেঙে একেবারে হাসপাতালে। বাঁচে কি না বাঁচে! আজ ছ’দিন হ’ল—ঠিক তার পরের দিনই!

 অপূর্ব্ব বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল,—তুই কি করে জানলি?

 তেওয়ারী বলিল, বাড়িয়ালার সরকার আমাদের জেলায় লোক কিনা, তার সঙ্গে আজ পরিচয় হ’ল। ভাড়া আদায় করতে এসেছিল। কে বা ভাড়া দেবে,—মদ খেয়ে মারামারি করে জেটি থেকে নীচে পড়ে সাহেব ত গিয়ে হাসপাতালে শুয়ে আছেন।

 তা হবে, বলিয়া অপূর্ব্ব কাপড় ছাড়িতে নিজের ঘরে চলিয়া গেল। কলিকাতা ত্যাগ করার পরে এই প্রথম তেওয়ারীর মন সত্যকার প্রসন্নতায় ভরিয়া উঠিয়াছে। তাহার একান্ত অভিলাষ ছিল এই লইয়া সে আজ বেশ একটুখানি আলোচনা করে, কিন্তু মনিব তাহাতে উৎসাহ দিলেন না। নাই দিন, তবুও সে বাহির হইতে নানা উপায়ে শুনাইয়া দিল যে এরূপ একদিন ঘটিবেই তাহা সে জানিত। তেওয়ারী সন্ধ্যা আহ্নিক শিখিতে পারে নাই, কিন্তু গায়ত্রীটা তাহার মুখস্ত হইয়াছিল, সেই গায়ত্রী সে জরিমানার দিন হইতে সকাল-সন্ধ্যা একশত আট করিয়া দুইশত ষোল বার প্রত্যহ জপ করিয়াছে। সাহেবের পা ভাঙার যথার্থ হেতু কি, ছেলেমানুষ মনিব তাহা অনুধাবন করিল কি-না সন্দেহ, কিন্তু এই মন্ত্রের অসাধারণ শক্তির প্রতি তেওয়ারীর বিশ্বাস সহস্রগুণে বাড়িয়া গেল। ম্লেচ্ছ হইয়া ব্রাহ্মণের মাথার উপরে যে ঘোড়ার মত পা ঠুকিয়াছে পা তাহার ভাঙ্গিবে না ত কি!

 পরদিন সকালে তাহার আফিসের আরদালির কাছে খবর পাইয়া অপূর্ব্ব তেওয়ারীকে ডাকিয়া কহিল, একটা বাসার সন্ধান পাওয়া গেছে তেওয়ারী, গিয়ে দেখে আয় দেখি পোষাবে কি না।

 তেওয়ারী একটু হাসিয়া কহিল, আর বোধ হয় দরকার হবে না বাবু, সে-সব আমি ঠিক করে নিয়েচি। আসচে পয়লা তারিখে যারা যাবার তারাই যাবে। বাসা বদলানো ত সোজা ঝঞ্ঝাট নয় ছোটবাবু!

 ঝঞ্ঝাট যে সোজা নয় অপূর্ব্ব নিজেও তাহা জানিত সাহেবের অবর্ত্তমানে উৎপাত বন্ধ হইয়াছে, তাঁহার প্রত্যাগমনের পরেও যে তাহা বজায় থাকিবে এ ভরসা তাহার ছিল না। বাসা তাহাকে বদল করিতেই হইবে, কিন্তু আফিস যাইবার পূর্ব্বে তেওয়ারী যখন ছুটি চাহিয়া জানাইল যে আজ দুপুরবেলা সে বর্ম্মীদের ফয়ার মন্দিরে তামাসা দেখিতে যাইবে, তখন অপূর্ব্ব না হাসিয়া থাকিতে পারিল না। সকৌতুকে প্রশ্ন করিল, তোর যে আবার তামাসা দেখতে সখ হল তেওয়ারী?

 তেওয়ারী কহিল, বিদেশের যা কিছু সব দেখা ভাল ছোটবাবু

 অপূর্ব্ব বলিল, তা বটে। খোঁড়া সাহেব হাসপাতালে, এখন আর রাস্তায় বেরোতে ভয় নাই। তা যাস, কিন্তু একটু সকাল সকাল ফিরে আসিস। কেউ সঙ্গে থাকবে ত?

 তাহার স্বদেশবাসী যে লোকটির সহিত কাল তেওয়ারীর আলাপ হইয়াছে সেই আসিয়া আজ তাহাকে তামাসা দেখাইয়া আনিবে স্থির হইয়াছিল। সাহেবের দুর্ঘটনার সংবাদে সে এতই খুশী হইয়াছিল যে তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইতে তাহার মুহুর্ত্ত বিলম্ব ঘটে নাই।

 তাহাকে বাহিরে যাইবার হুকুম দিয়া অপূর্ব্ব যথাসময়ে আফিস চলিয়া গেল, এবং ইহার ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই তেওয়ারীর দেশের লোক আসিয়া তাহাকে বর্ম্মী তামাসা দেখাইয়া আনিতে সঙ্গে লইয়া গেল। তালার একটা চাবি অপূর্ব্বর নিজের কাছেই থাকিত, সুতরাং ফিরিয়া আসিতে বিলম্ব ঘটিলেও ছোটবাবুর যে বিশেষ অসুবিধা হইবে না তেওয়ারীর তাহা জানা ছিল। নিষ্কণ্টক হইয়া আজ আর তাহার ফুর্ত্তির অবধি ছিল না।

 অপরাহ্ণ বেলায় ঘরে ফিরিয়া অপূর্ব্ব দেখিল দরজায় তালা বন্ধ, তেওয়ারী তখন পর্য্যন্ত তামাসা দেখিয়া ফিরে নাই। পকেট হইতে চাবি বাহির করিয়া খুলিতে গিয়া দেখিল চাবি লাগে না, এ কোন্ এক অপরিচিত তালা, এত তাহাদের নয়! তেওয়ারী এ কোথায় পাইল, কেনই বা সে তাহাদের পুরাতন ভাল তালার বদলে এই একটা নূতন তালা দিতে গেল, ইহার চাবিই বা কোথায়, কেমন করিয়াই বা সে ঘরে ঢুকিবে কিছুই ভাবিয়া পাইল না। বোধ হয় মিনিট দুই সে এই ভাবে দাঁড়াইয়া, ত্রিতলের দ্বার খুলিয়া সেই ক্রীশ্চান মেয়েটি মুখ বাহির করিয়া কহিল, দাঁড়ান, আমি খুলে দিচ্চি, এই বলিয়া সে নীচে নামিয়া আসিয়া অসঙ্কোচে অপূর্ব্বর পাশে আসিয়া দাঁড়াইতে সে বিষয়ে ও লজ্জায় যেন একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া গেল। তেওয়ারী নাই, কি তার হইল, এবং কি জন্য কেমন করিয়া ঘরের চাবি সাহেবের মেয়ের হাতে গিয়া পড়িল তাহা সে ভাবিয়া পাইল না। স্বল্প আলোকিত এই সংকীর্ণ সিঁড়িটায় দুইজনের দাঁড়াইবার মত যথেষ্ট স্থান ছিল না, অপূর্ব্ব এক ধাপ নীচে নামিয়া আর এক দিকে মুখ ফিরাইয়া রহিল। অনাত্মীয় যুবতী রমণীর সহিত নির্জ্জনে পাশাপাশি দাঁড়াইয়া কথা কহা তাহার অভ্যাসই ছিল না, তাই মেয়েটি যখন তাহাকে উদ্দেশ করিয়া কহিল, মা, বলছিলেন চাবি বন্ধ করে আমি ভাল কাজ করিনি, হয়ত বিপদে পড়তেও পারি, তখন অপূর্ব্বর মুখ দিয়া সহসা কোন উত্তরই বাহির হইল না। ভারতী কপাট খুলিয়া ফেলিয়া কহিল, আমার মা ভয়ানক ভীতু মানুষ, তিনি আমাকে তখন থেকে বক্‌চেন যে আপনি বিশ্বাস না করলে আমাকেই চুরির দায়ে জেল খাটতে হবে। আমার কিন্তু সে ভয় একটুও নেই।

 অপূর্ব্ব বুঝিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি হয়েছে?

 ভারতী কহিল, ঘরে গিয়ে দেখুন না কি হয়েছে। এই বলিয়া সে পথ ছাড়িয়া এক পাশে সরিয়া দাঁড়াইল। অপূর্ব্ব ঘরে ঢুকিয়া যাহা দেখিল তাহাতে দুই চক্ষু তাহার কপালে উঠিল। তোরঙ্গ দুটায় তালা ভাঙ্গা, বই, কাগজ, বিছানা, বালিশ, কাপড়চোপড় সমস্ত মেঝের উপর ছড়ান, তাহার মুখ দিয়া কেবল বাহির হইল, কি কোরে এমন হ’ল? কে করলে?

 ভারতী একটু হাসিয়া কহিল, আর যেই করুক কিন্তু আমি নয়, তা শত্রু হলেও আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে। এই বলিয়া সে ঘটনাটা যাহা বিবৃত করিল তাহা এই—দুপুরবেলা তাহার সদ্য পরিচিত দেশওয়ালী বন্ধুর সহিত তেওয়ারী যখন তামাশা দেখিতে বাহির হইয়া যায়, ভারতীর মা বারান্দায় বসিয়া তাহাদের দেখতে পান। অল্পক্ষণ পরেই নীচের ঘর হইতে একপ্রকার সন্দেহজনক শব্দ শুনিতে পাইয়া ভারতীকে দেখিতে বলেন। তাহাদের মেঝের একধারে একটা ফুটো আছে, চোখ পাতিয়া দেখিলে অপূর্ব্বর ঘরের সমস্তই দেখা যায়। সেই ফুটা দিয়া দেখিয়াই সে চীৎকার করিতে থাকে। যাহারা বাক্স ভাঙ্গিতেছিল তাহারা সবেগে পলায়ন করে, তখন নীচে নামিয়া সে দ্বারে তালা বন্ধ করিয়া পাহারা দিতে থাকে পুনরায় না তাহারা ফিরিয়া আসে। এখন অপূর্ব্বকে দেখিতে পাইয়া সে ঘর খুলিয়া দিতে আসিয়াছে!

 বিবর্ণ, পাংশুমুখে অপূর্ব্ব তাহার খাটের উপর ধপ্ করিয়া বসিয়া পড়িয়া স্তব্ধ হইয়া রহিল। ভারতী দরজা হইতে মুখ বাড়াইয়া কহিল, এঘরে আপনার কোন খাবার জিনিস আছে কি? আমি ঘরে এসে একবার দেখতে পারি?

 অপূর্ব্ব ঘাড় নাড়িয়া শুধু কহিল, আসুন।

 সে ঘরে আসিলে তাহার মুখপানে চাহিয়া অপূর্ব্ব বিমূঢ়ের মত প্রশ্ন করিল, এখন কি করা যায়?

 ভারতী কহিল, করা ত অনেক কিছু যায়, কিন্তু সকলের আগে দেখতে হবে কি কি চুরি গেছে।

 অপূর্ব্ব বলিল, বেশ ত তাই দেখুন না কি কি চুয়ি গেল।

 ভারতী হাসিয়া কহিল, আসবার সময় আপনার তোরঙ্গ গুছিয়েও আমি দিইনি, চুরিও করিনি,—সুতরাৎ কি ছিল আর কি নেই আমি জানাব কি করে?

 অপূর্ব্ব লজ্জা পাইয়া কহিল, সে তো ঠিক কথা। তাহলে তেওয়ারী আসুক, সে হয় ত সমস্ত জানে। এই বলিয়া সে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত জিনিসগুলোর প্রতি করুণচক্ষে চাহিল।

 তাহার নিরুপায়ের মত মুখের চেহারায় ভারতী আমোদ বোধ করিল! হাসিমুখে কহিল, সে জানতে পারে আর আপনি পারেন না? আচ্ছা, কি করে জানতে হয় আপনাকে আমি শিখিয়ে দিচ্চি। এই বলিয়া সে তৎক্ষণাৎ মেঝের উপর বসিয়া পড়িয়া সুমুখের ভাঙ্গা তোরঙ্গটা হাতের কাছে টানিয়া আনিয়া কহিল, আচ্ছা, জামা-কাপড়গুলো আগে সব গুছিয়ে তুলি। এসব নিয়ে যাবার বোধ হয় তারা সময় পায়নি। এই বলিয়া সে এলোমেলো ধুতি, চাদর, পিরাণ, কোট প্রভৃতি একটির পরে একটি ভাঁজ করিয়া সাজাইয়া তুলিতে লাগিল। তাহায় শিক্ষিত হস্তের নিপুণতা কয়েক মুহূর্ত্তেই অপূর্ব্বর চোখে পড়িল। এটা কি? মুর্শিদাবাদ সিল্কের সুট বুঝি? এরকম ক’ জোড়া আছে বলুন ত?

 অপূর্ব্ব কহিল, দুজোড়া।

 ঠিক মিলেচে। এই এখানে আর এক জোড়া, এই বলিয়া সে সুট দুটি সাজাইয়া বাক্সে তুলিল। ঢাকাই ধুতি—একটা, দুটো, তিনটে;—চাদর এক, দুই, তিন,—ঠিক মিলেচে। বোধ হয় তিন জোড়াই ছিল, না?

 অপূর্ব্ব কহিল, হাঁ, আমার মনে আছে, তিন জোড়াই বটে।

 এটা কি আলপাকার কোট? কই ওয়েস্ট-কোট, প্যাণ্ট দেখচি না যে? ও—না এ যে গলা-বন্ধ দেখচি। এর সুট ছিল না, না?

 অপূর্ব্ব বলিল, না, ওটা আলাদাই বটে। ওর সুট ছিল না

 তাহাদের গুছাইয়া তুলিয়া ভারতী আর একটা হাতে তুলিয়া কহিল, এটা দেখচি ফ্লানেল সুট,—আপনি সেখানে টেনিস খেলতেন বুঝি? তাহলে একটা, দুটো, তিনটে, ওই আলনায় একটা, আপনার গায়ে একটা,—সুট তাহলে পাঁচ জোড়া না?

 অপুর্ব্ব খুশী হইয়া কহিল, ঠিক তাই। পাঁচ জোড়াই বটে।

 কাপড়ের ভাঁজের মধ্যে উজ্জ্বল কি একটা পদার্থ চোখে পড়িতে টানিয়া বাহির করিয়া কহিল, এ যে সোনার চেন, ঘড়ি গেল কোথায়?

 অপূর্ব্ব খুশী হইয়া কহিল, বাঁচা গেছে—চেনটা তারা দেখতে পায়নি। এটি আমার পিতৃদত্ত, তাঁরই স্মৃতিচিহ্ন—

 কিন্তু ঘড়িটা?

 এই যে, বলিয়া অপূর্ব্ব তাহার কোটের পকেট হইতে সোনার ঘড়ি বাহির করিয়া দেখাইল!

 ভারতী কহিল, চেন, ঘড়ি পাওয়া গেল, বলুন ত আঙটি আপনার কটা? হাতে একটিও নেই দেখচি

 অপূর্ব্ব বলিল, হাতে নেই, বাক্সেও ছিল না। আঙটিই আমার কখনো হয়নি।

 তা ভাল। সোনার বোতাম? সে বোধ হয় আপনার গায়ে সার্টে লাগানো আছে?

 অপূর্ব্ব ব্যস্ত হইয়া বলিল, কই না। সে যে একটা গরদের পাঞ্জাবির সঙ্গে তোরঙ্গের মধ্যে সুমুখেই ছিল।

 ভারতী আলনার প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করিল, যে-সকল বস্ত্র তখনও তোলা হয় নাই একপাশে ছিল, তাহার মধ্যে অনুসন্ধান করিল, তার পরে একটু হাসিয়া কহিল, জামাসুদ্ধ এটা গেছে দেখচি। অন্য বোতাম ছিল না তা?

 অপূর্ব্ব মাথা নাড়াইয়া জানাইল, ছিল না। ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, ট্রাঙ্কে টাকা ছিল ত? অপূর্ব্ব ‘ছিল’ বলিয়া সায় দিলে ভারতী উদ্বিগ্নমূখে কহিল, তাহলে তাও গেছে। কত ছিল জানেন না? তা আমি আগেই বুঝেচি। আপনার মনিব্যাগ আছে জানি। বার করে আমাকে দিন ত দেখি—

 অপূর্ব্ব পকেট হইতে তাহার ছোট চামড়ার থলেটি বাহির করিয়া ভারতীর হাত দিতে সে মেঝের উপর ঢালিয়া ফেলিয়া সমস্ত গণনা করিয়া বলিল, দু’শ পঞ্চাশ টাকা আট আনা। বাড়ি থেকে কত টাকা নিয়ে বার হয়েছিলেন মনে আছে?

 অপূর্ব্ব কহিল, আছে বৈ কি। ছ’শ টাকা।

 ভারতী টেবিলের উপর হইতে এক টুকরা কাগজ ও পেন্সিল লইয়া লিখিতে লাগিল, জাহাড় ভাড়া, ঘোড়ারগাড়ি ভাড়া, কুলিভাড়া—পৌছে বাড়িতে টেলিগ্রাম করেছিলেন ত? আচ্ছা তারও এক টাকা, তারপরে এই দশ দিনের খরচ—

 অপূর্ব্ব বাধা দিয়া কহিল, সে ত তেওয়ারীকে জিজ্ঞাসা না করলে জানা যাবে না।

 ভারতী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, তা যাবে, দু’এক টাকার তফাৎ হতে পারে, বেশি হবে না। যে ফুটা দিয়া আজ সে চুরি করা দেখিয়াছিল, সেই পথে চোখ পাতিয়া সে যে এই ঘরের যাবতীয় ব্যাপার নিরীক্ষণ করিত, তেওয়ারীর বাজার করা হইতে আরম্ভ করিয়া খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন পর্য্যন্ত কিছুই বাদ যাইত না, এ কথা বলিল না, কাগজে ইচ্ছামত একটা অঙ্ক লিখিয়া সাহসা মুখ তুমিয়া কহিল, এ ছাড়া আর বাজে খরচ নেই ত?

 না।

 ভারতী কাগজের উপর হিসাব করিয়া কহিল, তাহলে দু’শ আশি টাকা চুরি গেছে।

 অপূর্ব্ব চমকিয়া কহিল, এত টাকা? রোস রোস, আরো কুড়ি টাকা বাদ দাও,— জরিমানার টাকাটা ধরা হয়নি।

 ভারতী মাথা নাড়িয়া বলিল, না সে তো অন্যায়, মিথ্যে জরিমানা, এ টাকা আমি বাধ দেব না।

 অপূর্ব্ব আশ্চর্য্য হইয়া কহিল, কি বিপদ! জরিমানা করাটা মিথ্যে হতে পারে, কিন্তু আমার টাকা দেওয়াটা ত মিথ্যে নয়।

 ভারতী কহিল, দিলেন কেন? ও টাকা আমি বাদ দেব না। দু’শ আশি টাকা চুরি গেছে।

 অপূর্ব্ব বলিল, না দু’শ ষাট টাকা।

 ভারতী বলিল, না, দু’শ আশি টাকা।

 অপূর্ব্ব আর তর্ক করিল না। এই মেয়েটির প্রখর বুদ্ধি ও সকল দিকে অদ্ভূত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখিয়া সে আশ্চর্য্য হইয়া গিয়াছিল; অথচ, এই সোজা বিষয়টা না বুঝিবার দিকে তাহার জিদ দেখিয়া তাহার বিস্ময়ের পরিসীমা রহিল না। বিচারের ন্যায় অন্যায় যাহাই হৌক, টাকা ব্যয় হইলে সে যে আর হাতে থাকে না এ কথা যে বুঝিতে চাহে না তাহাকে সে আর কি বলিবে?

 ভারতী অবশিষ্ট কাপড়গুলি গোছ করিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। অপূর্ব্ব জিজ্ঞাসা করিল, পুলিশে খবর দেওয়া কি আপনি উচিত মনে করেন?

 ভারতী মাথা নাড়িয়া কহিল, তা বটে। উচিত শুধু এই দিক থেকে হতে পারে যে তাতে আমার টানাটানির আর অন্ত থাকবে না। নইলে, তারা এসে আপনার টাকার কিনারা করে দিয়ে যাবে এ আশা বোধ হয় করেন না?

 অপূর্ব্ব চুপ করিয়া রহিল। ভারতী রলিল, ক্ষতি যা হবার হয়েছে, এর পরে আবার তারা এলে অপমান শুরু হবে।

 কিন্তু আইন আছে—

 অপূর্ব্বর কথা শেষ হইল না, ভারতী অসহিষ্ণু হইয়া উঠিল; বলিল, আইন থাকে থাক; এ আপনাকে আমি কিছুতে করতে দিতে পারবো না। আইন সেদিনও ছিল আপনি যেদিন জরিমানা দিয়ে এসেছিলেন। এর মধ্যেই তা ভুলে গেছেন?

 অপূর্ব্ব কহিল, লোকে যদি মিথ্যে বলে, মিথ্যে যামলা সাজায়, সে কি আইনের দোষ?

 ভারতীর মুখ দেখিয়া মনে হইল না সে কিছুমাত্র লজ্জা পাইল। বলিল, লোকে মিথ্যে বলবে না, মিধ্যে মামলা সাজাবে না, তবেই আইন নির্দ্দোষ হয়ে উঠবে, এই আপনার মত না কি? এ হলে ত ভালই হয়, কিন্তু সংসারে তা হয় না এবং হবার বোধ করি বিস্তর বিলম্ব আছে। এই বলিয়া সে একটু হাসিল, কিন্তু অপূর্ব্ব চুপ করিয়া রহিল, তর্কে যোগ দিল না। সেই প্রথম দিনে এই মেয়েটির কণ্ঠস্বরে, তাহার সুমিষ্ট সলজ্জ ব্যবহারে, বিশেষ করিয়া তাহার সেই সকরুণ সহানুভুতিতে অপূর্ব্বর মনের মধ্যে যে একটুখানি মোহের মত জন্মিয়াছিল, তাহার পরবর্ত্তী আচরণে সে ভাব আর তাহার ছিল না। ভারতীর এই চুরি গোপন করিবার আগ্রহ এখন হঠাৎ কেমন তাহার ভারি খারাপ লাগিল। এই সকল অযাচিত সাহায্যকেও আর যেন সে প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করিতে পারিল না এবং কি একপ্রকায় অজানা শঠতায় সংশয়ে সমস্ত অন্তঃকরণ তাহার দেখিতে দেখিতে কালো হইয়া উঠিল। সে দিনের সেই সভয়ে, সঙ্কোচে, গোপনে ফল-মূল দিতে আসা, পরক্ষণেই আবার ঘরে গিয়া সমস্ত ঘটনা বিকৃত করিয়া মিথ্যা করিয়া বলা, তারপরে সেই আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া,—নিমিষে সমস্ত ইতিহাস মনের মধ্যে তড়িত রেখায় খেলিয়া গিয়া মুখ তাহার গম্ভীর ও কণ্ঠস্বর ভারী হইয়া উঠিল। এ সমস্তই অভিনয়, সমস্তই ছলনা! তাহার মুখের এই আকস্মিক পরিবর্ত্তন ভারতী লক্ষ্য করিল, কিন্তু কারণ বুঝিতে পারিল না, বলিল, আমার কথার জবাব দিলেন না যে বড়?

 অপূর্ব্ব কহিল, এর আর জবাব কি? চোরকে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না,—পুলিশে একটা খবর দিতেই হবে।

 ভারতী ভয় পাইয়া কহিল, সে কি কথা! চোরও ধরা পড়বে না, টাকাও আদায় হবে না; মাঝে থেকে আমাকে নিয়ে যে টানাটানি করবে। আমি দেখেচি, তালাবন্ধ করেচি, সমস্ত গুছিয়ে তুলে রেখেচি,—আমি যে বিপদে পড়ে যাবো।

 অপূর্ব্ব কহিল, যা ঘটেচে তাই বলবেন।

 ভারতী ব্যাকুল হইয়া জবাব দিল, বললে কি হবে? এই সেদিন আপনার সঙ্গে তুমূল কাণ্ড হয়ে গেল, মুখ দেখা-দেখি নেই, কথাবার্ত্তা বন্ধ, হঠাৎ আপনার জন্যে আমার এত মাথাব্যথা পুলিশ বিশ্বাস করবে কেন?

 অপূর্ব্বর মন সন্দেহে অধিকতর কঠোর হইয়া উঠিল, কহিল, আপনার আগাগোড়া মিছে কথা তারা বিশ্বাস করতে পারলে আর সত্য কথা পারবে না? টাকা সামান্যই গেছে, কিন্তু চোরকে আমি শাস্তি না দিয়ে ছাড়ব না।

 তাহার মুখের পানে ভারতী হতবুদ্ধির ন্যায় চাহিয়া রহিল; কহিল, আপনি বলেন কি অপূর্ব্ববাবু? বাবা ভাল লোক নন, তিনি অকারণে আপনার প্রতি অত্যন্ত অন্যায় করেচেন, আমি যে সাহায্য করেচি তাও আমি জানি, কিন্তু তাই বলে ঘর ভেঙে বাক্স ভেঙে আপনার টাকা চুরি করবো আমি? একথা আপনি ভাবতে পারলেন, কিন্তু আমি ত পারিনি। এ দুর্নাম রটলে আমি বাঁচব কি করে! বলিতে বলিতে তাহার ওষ্ঠাধর ফুলিয়া কাঁপিয়া উঠিল এবং দাঁত দিয়া জোর করিয়া ঠোঁট চাপিতে চাপিতে সে যেন ঝড়ের বেগে বাহির হইয়া গেল।