পথের দাবী/৭

উইকিসংকলন থেকে

 আশ্চর্য্য, এই যে, এত বড় সব্যসাচী ধরা পড়িল না। কোন দুর্ঘটনা ঘটিল না এমন সৌভাগ্যকেও অপূর্ব্বর মন যেন গ্রাহ্যই করিল না। বাসায় ফিরিয়া দাড়ি গোঁফ কামানো হইতে শুরু করিয়া সন্ধ্যাহ্নিক, স্নানাহার, পোষাকপরা, অফিস যাওয়া প্রভৃতি নিত্য কাজগুলায় বাধা পাইল না সত্য, কিন্তু ঠিক কি যে সে ভাবিতে লাগিল তাহার নির্দ্দেশ নাই, অথচ চোখ কান ও বুদ্ধি তাহার সাংসারিক সকল ব্যাপার হইতে একেবারে যেন বিচ্ছিন্ন হইয়া কোন্ এক অদৃষ্ট অপরিজ্ঞাত রাজবিদ্রোহীর চিন্তাতেই ধ্যানস্থ হইয়া রহিল। এই অত্যন্ত অন্যমনস্কতা তলওয়ারকর লক্ষ্য করিয়া চিন্তিতমুখে জিজ্ঞাসা করিল, আজ বাড়ি থেকে কোন চিঠি পেয়েচেন না কি?

 কই না।

 বাড়ির খবর সব ভাল ত?

 অপূর্ব্ব কিছু আশ্চর্য্য হইয়া কহিল, যতদূর জানি সবাই ভালই ত আছেন।

 রামদাস আর কোন প্রশ্ন করিল না। টিফিনের সময় উভয়ে একত্রে বসিয়া জলযোগ করিত। রামদাসের স্ত্রী অপুর্ব্বকে একদিন সনির্বন্ধ অনুরোধ করিয়াছিলেন, যতদিন তাঁহার মা কিংবা বাটীর আর কোন আত্মীয়া নারী এদেশে আসিয়া বাসার উপযুক্ত ব্যবস্থাদি না করেন, ততদিন এই ছোট বহিনের হাতের তৈরি যৎসামান্য মিষ্টান্ন প্রত্যহ তাঁহাকে গ্রহণ করিতেই হইবে। অপূর্ব্ব রাজি হইয়াছিল। আফিসের একজন ব্রাহ্মণ পিয়াদা এই সকল বহিয়া আনিত। আজও সে নিরালা পাশের ঘরটায় ভোগ্যবস্তুগুলি যখন সাজাইয়া দিয়া গেল, তখন আহারে বসিয়া অপূর্ব্ব নিজেই কথা পাড়িল। কাল তাহার ঘরে চুরি হইয়া গেছে; সমস্তই যাইতে পারিত কেবল উপরের সেই ক্রীশ্চান মেয়েটির কৃপায় টাকাকড়ি ছাড়া আর সমস্ত বাঁচিয়াছে। সে চোর তাড়াইয়া দরজায় নিজের তালা বন্ধ করিয়াছে, আমি বাসায় পৌঁছিলে চাবি খুলিয়া দিয়া অনাহূত আমার ঘরে ঢুকিয়া ছড়ানো জিনিসপত্র গুছাইয়া দিয়াছে, সমস্ত ফর্দ্দ করিয়া কি আছে আর কি গেছে তার এমন নিখুঁত হিসাব করিয়া দিয়াচে যে, বোধ হয় তোমার মত পাশ করা একাউণ্টেণ্টের পক্ষেও তা বিস্ময়কর,—বাস্তবিক এমন তৎপর, এতবড় কার্য্যকুশলা মেয়ে আর যে কেহ আছে মনে হয় না হে, তলওয়ারকর। তা ছাড়া এত-বড় বন্ধু!

 রামদাস কহিল, তারপর?

 অপূর্ব্ব কহিল, তেওয়ারী ঘরে ছিল না, বর্ম্মা-নাচ দেখতে ফয়ার গিয়েছিল, ইত্যবসরে এই ব্যাপার। তার বিশ্বাস এ-কাজ ও-ছাড়া আর কেউ করেনি। আমারও অনুমান কতকটা তাই। চুরি না করুক সাহায্য করেচে।

 তারপর?

 তারপয় সকালে গেলাম পুলিশে খবর দিতে। কিন্তু পুলিশের দল এমন কাণ্ড করলে, এমন তামাসা দেখালে যে ও কথা আর মনেই হল না। এখন ভাবচি, যা গেছে তা যাক, তাদের চোর ধরে দিয়ে আর কাজ নেই, তারা বরঞ্চ এমনিধারা বিদ্রোহী ধরে ধরেই বেড়াক। এই বলিয়া তাহার গিরীশ মহাপাত্র ও তাহার পোষাকপরিচ্ছদের বাহার মনে পড়িয়া হঠাৎ হাসির ছটায় যেন দম আটকাইবার উপক্রম হইল। হাসি থামিলে সে বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রে অসাধরণ পারদর্শী বিলাতের ডাক্তার উপাধিধারী রাজশত্রু মহাপাত্রের স্বাস্থ্য, তাহার শিক্ষা ও রুচি, তাহার বলবীর্য্য, তাহার রামধনু-রঙের জামা, সবুজ রঙের মোজা ও লোহার নাল-ঠোকা পাম্প-শু, তাহার লেবুর তেলের গন্ধবিলাস, সর্ব্বোপরি তাহার পরহিতায় গাঁজার কলিকাটির আবিষ্কারের ইতিহাস সবিস্তারে বর্ণনা করিতে করিতে তাহার উৎকট হাসির বেগ কোন মতে আর একবার সংবরণ করিয়া শেষে কহিল, তলওয়ারকর, মহা হুঁশিয়ারি পুলিশের দলকে আজকের মত নির্ব্বোধ আহম্মক হতে বোধকরি কেউ কখনো দেখেনি। অথচ, গভর্ণমেণ্টের কত টাকাই না এরা বুনো হাঁসের পিছনে ছুটোছুটি করে অপব্যয় করলে।

 রামদাস হাসিয়া কহিল, কিন্তু বুনো হাঁস ধরাই যে এদের কাজ, আপনার চোর ধরে দেবার জন্যে এরা নেই। আচ্ছা, এরা কি আপনাদের বাঙলা দেশের পুলিশ?

 অপূর্ব্ব কহিল, হ্যাঁ। তা’ ছাড়া আমার বড় লজ্জা এই যে, এঁদের যিনি কর্ত্তা তিনি আমার আত্মীয়, আমার পিতার বন্ধু। বাবাই একদিন এর চাকরি করে দিয়েছিলেন।

 রামদাস কহিল, তাহলে আপনাকেই হয়ত আর একদিন তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। কিন্তু কথাটা বলিয়া ফেলিয়া সে-ই একটু অপ্রতিভ হইয়া চুপ করিল— আত্মীয়ের সম্বন্ধে এরূপ একটা মন্তব্য প্রকাশ করা হয়ত শোভন হয় নাই।

 অপূর্ব্ব তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া অর্থ বুঝিল, কিন্তু এ ধারণা যে সত্য নয়, ইহাই সতেজে ব্যক্ত করিতে সে জোর করিয়া বলিল, আমি তাঁকে কাকা বলি, আমাদের তিনি আত্মীয়, শুভাকাঙ্খী, কিন্তু তাই বলে আমার দেশের চেয়ে ত তিনি আপনার নন। বরঞ্চ, যাঁকে তিনি দেশের টাকায়, দেশের লোক দিয়ে শিকারের মত তাড়া করে বেড়াচ্চেন, তিনি ঢের বেশি আমার আপনার।

 রামদাস মুচকিয়া একটু হাসিয়া কহিল, বাবুজী, এ-সব কথা বলায় দুঃখ আছে।

 অপূর্ব্ব কহিল, থাকে, তাই নেব। কিন্তু তাই বলে তলওয়ারকর,—শুধু কেবল আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর যে কোন দেশে, যে-কোন যুগে যে-কেউ জন্মভূমিকে তার স্বাধীন করবার চেষ্টা করেচে, তাকে আপনার নয় বলবার সাধ্য আর যার থাক্‌ আমার নেই। বলিতে বলিতে কণ্ঠস্বর তার তীক্ষ্ণ এবং চোখের দৃষ্টি প্রখর হইয়া উঠিল, মনে মনে বুঝিল কি কথায় কি কথা আসিয়া পড়িতেছে, কিন্তু সামলাইতে পারিল না, বলিল, তোমার মত সাহস আমার নেই, আমি ভীরু, কিন্তু তাই বলে অবিচারে দণ্ডভোগ করার অপমান আমাকে কম বাজে না রামদাস। বিনা দোযে ফিরিঙ্গী ছোঁড়ারা আমাকে যখন লাথি মেরে প্ল্যাটফর্ম থেকে বার করে দিলে, এবং এই অন্যায়ের প্রতিবাদ যখন করতে গেলাম, তখন সাহেব স্টেশন মাস্টার কেবলমাত্র আমাকে দেশী লোক বলেই দেশের স্টেশন থেকে কুকুরের মত দূর করে দিলে,—তার লাঞ্ছনা এই কালো চামড়ার নীচে কম জ্বলে না, তলওয়ারকার। এমন ত নিত্য নিয়তই ঘটচে,—আমার মা, আমার ভাই-বোনকে যারা এইসব সহস্র কোটী অত্যাচার থেকে উদ্ধার করতে চায়, তাদের আপনার বলে ডাকবার যে দুঃখই থাক্, আমি আজ থেকে মাথায় তুলে নিলাম।

 রামদাসের সুশ্রী গৌরবর্ণ মুখ ক্ষণকালের জন্য আরক্ত হইয়া উঠিল, বলিল, কই এ ঘটনা ত আমাকে বলেননি।

 অপূর্ব্ব কহিল, বলা কি সহজ রামদাস? হিন্দুস্থানের লোক সেখানে কম ছিল না, কিন্তু আমার অপমান কারও গায়েই ঠেকল না, এমনি তাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। লাথির চোটে আমার যে হাডপাঁজরা ভেঙ্গে যায়নি এই সুখবরে তারা সব খুশী হয়ে গেল। তোমাকে জানাবো কি মনে হলে দুঃখে লজ্জায় ঘৃণায় নিজেই যেন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে যাই।

 রামদাস চুপ করিয়া রহিল, কিন্তু তাহার দুই চোখ ছল্‌ছল্ করিয়া আসিল। সুমুখের ঘড়িতে তিনটা বাজিতে সে উঠিয়া দাঁড়াইল। বোধহয় কি একটা বলিতে গেল, কিন্তু কিছুই না বলিয়া হঠাৎ হাত বাড়াইয়া অপুর্ব্বর ডান হাতটা টানিয়া লইয়া একটা চাপ দিয়া নিঃশব্দে নিজের ঘরে চলিয়া গেল।

 সেইদিন বিকালে আফিসের ছুটি হইবার পূর্ব্বে বড়-সাহেব একখানা লম্বা টেলিগ্রাম হাতে অপূর্ব্বর ঘরে ঢুকিয়া কহিলেন, আমাদের ভামোর অফিসে কোন শৃঙ্খলাই হচ্ছে না। ম্যানডালে, শোএবো, মিক্‌থিলা এবং এদিকে প্রোম, সব ক’টা অফিসেই গোলযোগ ঘটচে। আমার ইচ্ছা তুমি একবার সবগুলো দেখে এসো। আমার অবর্ত্তমানে সমস্ত ভারই ত তোমার,—একটা পরিচয় থাকা চাই,—সুতরাং বেশি দেরি না করে কাল-পরশু যদি একবার—

 অপূর্ব্ব তৎক্ষণাৎ সম্মত হইয়া বলিল, আমি কালই বার হয়ে যেতে পারি। বস্তুতঃ, নানা কারণে রেঙ্গুনে তাহার আর এক মুহূর্ত্ত মন টিঁকিতেছিল না। উপরন্তু এই সূত্রে দেশটাও একবার দেখা হইবে। অতএব যাওয়াই স্থির হইল, এবং পর দিনই অপরাহ্ন বেলায় সুদূর ভামো নগরের উদ্দেশে যাত্রা করিয়া সে ট্রেনে চাপিয়া বসিল। সঙ্গে রহিল আরদালি এবং আফিসের একজন হিন্দুস্থানী ব্রাহ্মণ পিয়াদা। তেওয়ারী খবরদারীর জন্যই বাসাতেই রহিল। পা-ভাঙ্গা সাহের হাসপাতালে পড়িয়া, সুতরাং তেমন আর ভয় নাই। বিশেষতঃ এই ম্লেচ্ছদেশের রেঙ্গুন সহরটা বরং সহিয়াছিল, কিন্তু আরও অজানা স্থানে পা বাড়াইবার তাহার প্রবৃত্তিই ছিল না। তলওয়ারকর তেওয়ারীর পিঠ ঠুকিয়া দিয়া কহিল, তোমার চিন্তা নেই ঠাকুর, কোন কিছু হলেই আফিসে গিয়ে আমাকে সংবাদ দিয়ো।

 গাড়ি ছাড়িতে বোধ করি তখনও মিনিট পাঁচেক বিলম্ব ছিল, অপু হঠাৎ চকিত হইয়া বলিয়া উঠিল, ওই যে!

 তলওয়ারকর ঘাড় ফিরাইতে বুঝিল, এই সেই গিরীশ মহাপাত্র। সেই বাহারে জামা, সেই সবুজ রঙের ফুল-মোজা, সেই পাম্প-শু এবং ছড়ি, প্রভেদের মধ্যে এখন কেবল সেই বাঘ-আঁকা রুমালখানি বুক-পকেট ছাড়িয়া তাঁহার কণ্ঠে জড়ানো। মহাপাত্র এই দিকেই আসিতেছিল, সুমুখে আসিতেই অপূর্ব্ব ডাকিয়া কহিল, কি হে গিরীশ, আমাকে চিনতে পারো? কোথায় চলেচ?

 গিরীশ শশব্যস্তে একটা নমস্কার করিয়া কহিল, আজ্ঞে চিনতে পারি বই কি বাবুমশায়। কোথায় আগমন হচ্ছেন?

 অপূর্ব্ব সহাস্যে কহিল, আপাততঃ ভামো যাচ্চি। তুমি কোথায়?

 গিরীশ কহিল, আজে, এনাজাং থেকে দুজন বন্ধু লোক আসার কথা ছিল,— আমাকে কিন্তু বাবু ঝুটমুট হয়রাণ করা। হ্যাঁ আনে বটে কেউ কেউ আফিং সিদ্ধি নুকিয়ে, কিন্তু আমি বাবু ধর্ম্মভীরু মানুষ। বলি কাজ কি বাপু জুচ্চুরিতে—কথায় বলে পরোধর্ম্ম ভয়াবহ। ললাটের লেখা ত খণ্ডাবে না!

 অপুর্ব্ব হাসিয়া কহিল, আমারও ত তাই বিশ্বাস। কিন্তু তোমার বাপু একটা ভুল হয়েচে, আমি পুলিশের লোক নই, আফিম সিদ্ধির কোন ধার ধারিনে,—সেদিন কেবল তামাশা দেখতে গিয়েছিলাম।

 তলওয়ারকর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাহাকে দেখিতেছিল, কহিল, বাবুজী, ম্যায়নে আপ্‌কো তো জরুর কঁহা দেখা—

 গিরীশ কহিল, আশ্চর্য্য নেহি হ্যায়, বাবু-সাহেব, নোকরির বাস্তে কেত্তা জায়গায় তো ঘুমতা হ্যায়,—

 অপূর্ব্বকে বলিল, কিন্তু আমার ওপর মিথ্যে সন্দেহ রাখবেন না বাবু-মশায় আপনাদের নজর পড়লে চাকরিও একটা জুটবে না। বামুনের ছেলে, বাঙলা লেখাপড়া, শাস্তর-টাস্তর সবই কিছু কিছু শিখেছিলাম, কিন্তু এমন অদেষ্ট যে—রাবুমশায় আপনারা—

 অপূর্ব্ব কহিল, আমি ব্রাহ্মণ!

 আজ্ঞে, তাহলে নমস্কার। এখন তবে আসি বাবুসাহের। রাম রাম—বলিতে বলিতে গিরীশ মহাপাত্র একটা উদ্গত কাশির বেগ সামলাইয়া লইয়া ব্যগ্রপদে সম্মুখের দিকে অগ্রসর হইয়া গেল।

 অপূর্ব্ব কহিল, এই সব্যসাচীটির পিছনেই কাকাবাবু সদলবলে এদেশ-ওদেশ করে বেড়াচ্চেন তলওয়ারকর! বলিয়া সে হাসিল।

 কিন্তু এই হাসিতে তলওয়ারকর যোগ দিল না। পরক্ষণে বাঁশী বাজাইয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিলে সে হাত বাড়াইয়া বন্ধুর করমর্দ্দন করিল, কিন্তু তখনও মুখ দিয়া তাহার কথাই বাহির হইল না। নানা কারণে অপূর্ব্ব লক্ষ্য করিল না, কিন্তু করিলে দেখিতে পাইত মুহূর্ত্ত কালের মধ্যে রামদাসের প্রশস্ত উজ্জ্বল ললাটের উপর যেন কোন এক অদৃশ্য মেঘের ছায়া আসিয়া পড়িয়াছে, এবং সেই সুদূর দুর্নিরীক্ষ-লোকেই তাহার সমস্ত মনশ্চক্ষু একেবারে উধাও হইয়া গিয়াছে।

 অপূর্ব্ব প্রথম শ্রেণীর যাত্রী, তাহার কামরায় আর কেহ লোক ছিল না। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইলে সে পিরাণের মধ্যে হইতে পৈতা বাহির করিয়া বিনা জলেই সায়ং সন্ধ্যা সমাপন করিল এবং যে সকল ভোজ্যবস্তু শাস্ত্রমতে স্পর্শদুষ্ট হয় না জানিয়া সে সঙ্গে আনিয়াছিল, পিতলের পাত্র হইতে বাহির করিয়া আহার করিল, জল ও পান তাহার ব্রাহ্মণ আরদালি পূর্ব্বাহ্নে রাখিয়া গিয়াছিল, এবং শয্যাও সে প্রস্তুত করিয়া দিয়া গিয়াছিল, অতএব রাত্রির মত অপূর্ব্ব ভোজনাদি শেষ করিয়া হাত-মুখ ধুইয়া পরিতৃপ্ত সুস্থচিত্তে শয্যা আশ্রয় করিল। তাহার ভরসা ছিল প্রভাতকাল পর্য্যন্ত আর তাহার নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটিবে না। কিন্তু ইহা যে কতবড় ভ্রম তাহা কয়েকটা স্টেশন পরেই সে অনুভব করিল। সেই রাত্রির মধ্যে বার-তিনেক তাহার ঘুম ভাঙাইয়া পুলিশের লোক তাহার নাম-ধাম ও ঠিকানা লিখিয়া লইয়াছে। একবার সে বিরক্ত হইয়া প্রতিবাদ করায় বর্ম্মা সব-ইনস্পেক্টর সাহেব কটুকণ্ঠে জবাব দেয়, তুমি ও ইউরোপীয়ান নও।

 অপূর্ব্ব কহে, না। কিন্তু আমি ফার্স্টক্লাস প্যাসেঞ্জার,—রাত্রে ত আমার তুমি ঘুমের বিঘ্ন করতে পার না।

 সে হাসিরা বলে, ও নিয়ম রেলওয়ে কর্ম্মচারীর জন্য,—আমি পুলিশ, ইচ্ছা করিলে আমি তোমাকে টানিয়া নীচে নামাইতে পারি।

 ইহার পরে আর অপূর্ব্ব প্রত্যুত্তর করে নাই। কিন্তু শেষের দিকে ঘণ্টা তিন চারেক নিরুপদ্রবে কাটার পরে সকালে যখন তাহার ঘুম ভাঙ্গিল, তখন বিগত রাত্রির গ্লানির কথা আর তাহার মনে ছিল না। একটা বড় পাহাড়ের অনতিদূর দিয়া গাড়ি মন্থর গতিতে চলিয়াছিল, খুব সম্ভব চড়াইয়ের পথ। এইখানে জানালার বাহিরে মুখ বাড়াইয়া সে অকস্মাৎ বিস্ময়ে একেবারে স্তব্ধ হইয়া রহিল। চক্ষের পলকে বুঝিল, পৃথিবীর এতবড় সৌন্দর্য্য-সম্পদ সে আর কখনও দেখে নাই। গিরিশ্রেণী অর্দ্ধবৃত্তাকারে বিস্তৃত হইয়া যেন পিছন ও সুমুখের পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহার বিরাট দেহ ব্যাপিয়া কি গভীর বন এবং গগনস্পর্শী কি বিপুলকায় বৃক্ষরাজীই না তাহার সুবিস্তীর্ণ পাদমূল ঘেরিয়া সারি দিয়া দাঁড়াইয়াছে! বোধহয় সবেমাত্র সূর্য্যোদয় হইয়াছে, বামদিকের শিখর ডিঙাইয়া রথ তাঁহার আকাশে এখনও দেখা দেয় নাই, কিন্তু অগ্রবর্ত্তী কিরণচ্ছটায় উপরের নীল অরণ্যে সোনা মাখাইয়া সেই তাঁহার আসার সংবাদ দিকে দিকে প্রচারিত হইতে আর বাকী নাই। খাদের মধ্যে শিখরনিঃসৃত জলের ধারা বহিয়াছে, বনের ছায়ার নীচে তাহার শান্ত প্রবাহ অশ্রু-রেখার মতই সকরুণ হইয়া উঠিয়াছে। অপূর্ব্ব মুগ্ধ হইয়া গেল। একি আশ্চর্য্য সুন্দর দেশ! এখানে যাহারা যুগ-যুগান্তর ধরিয়া বাসা বাঁধিতে পাইয়াছে তাহাদের সৌভাগ্যের কি সীমা আছে? কিন্তু কেবলমাত্র সীমা নাই বলিয়া, শুধু একটা অনির্দ্দিষ্ট আনন্দের আভাসমাত্র লইয়াই মানবের হৃদয় পূর্ণ তৃপ্তি মানিতে চাহে না,—তাই সে ইহাকে মূর্ত্তি দিয়া, রূপ দিয়া মনে মনে সহস্রবিধ রসে ও রঙে পল্লবিত করিয়া ক্রোশের পর ক্রোশ অতিক্রম করিয়া চলিতে লাগিল। এমনি করিয়া তাহার ভাবুক চিত্ত যখন অন্তরে-বাহিরে আচ্ছন্ন অভিভূত হইয়া আসিতেছিল, তখন হঠাৎ যেন কঠিন ধাক্কায় চমকিয়া দেখিল তাহার কল্পনার রথচক্র মেদিনী গ্রাস করিতেছে। রামদাস তলওয়ারকরের কথাগুলো মনে পড়িল। আসিয়া পর্য্যন্ত এই ব্রহ্মদেশের অনেক গুপ্ত ও ব্যক্ত কাহিনী সে সংগ্রহ করিতেছিল। সেই প্রসঙ্গে একদিন সে বলিয়াছিল, বাবুজী, শুধু কেবল শোভা সৌন্দর্য্যই নয় প্রকৃতি-মাতার দেওয়া এত সম্পদও কম দেশে আছে। ইহার বন ও অরণ্য অপরিমেয় মাটির মধ্যে ইহার অফুরন্ত তেলের প্রস্রবণ, ইহার মহামূল্য রত্নখনির মূল্য নিরূপিত হয় না, আর ওই যে আকাশচুম্বি মহাদ্রুমের সারি, জগতে ইহার তুলনা কোথায়? সে বেশিদিনের কথা নয়, সংবাদ পাইয়া একদিন ইংরাজ বণিকের লুব্ধদৃষ্টি ইহারই প্রতি একেবারে একান্ত হইয়া পড়িল। তাহার অনিবার্য্য পরিণাম অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এবং সোজা। বিবাদ বাধিল, মানোয়ারি জাহাজ আসিল, বন্দুক-কামান আসিল, সৈন্যসামন্ত আসিল, লড়াই বাধিল, যুদ্ধে হারিয়া দুর্ব্বল অক্ষম রাজা নির্ব্বাসিত হইলেন, এবং তাঁহার রাণীদের গায়ের গহনা বেচিয়া লড়াইয়ের খরচ আদায় হইল। অতঃপর দেশের ও দশের কল্যাণে, মানবতার কল্যাণে, সভ্যতা ও ন্যায়-ধর্ম্মের কল্যাণে ইংরাজ রাজশক্তি বিজিত দেশের শাসনভার গ্রহণ করিয়া তাহাদের অশেষবিধ ভাল করিতে কায়মনে লাগিয়া গেলেন। তাই ত আজ তথায় সতর্কতার অবধি নাই, তাই ত সেই বিজিত দেশের পুলিশ কর্ম্মচারী তাহারই মত আর এক পরাধীন দেশের নিরীহ ব্যক্তিকে বারংবার ঘুম ভাঙাইয়া নিঃসংকোচে বলিতে পারিল, তুমি ত সাহেব নও যে, তোমাকে অপমান করিতে আমায় বাধবে? অপূর্ব্ব মনে মনে কহিল, বটেই ত। বটেই ত! ইহার অধিক আমাকে সে কি দিবে? ইহার বড় আমিই বা কোন্ মুখে তাহার কাছে দাবী করিব?

 অরণ্যশিরে প্রভাত-সূর্য্যের কনক আভা তখনও রঙ হারায় নাই, কিন্তু তাহার চোখে অত্যন্ত ম্লান ও ক্লান্তিহীন ঠেকিল— সমুন্নত পর্ব্বতমালা তাহার কাছে সামান্য এবং বৃক্ষশ্রেণীর যে বিপুলতা দেখিরা সে ক্ষণেক পূর্ব্বে বিস্ময়-মুগ্ধ হইয়াছিল, তাহারাই তাহার দৃষ্টিতে সাধারণ ও নিতান্ত বিষেত্ববর্জ্জিত বলিয়া বোধ হইল। তাহার নদীমাতৃক সমতল শস্যশ্যামল বঙ্গভূমিকে মনে পড়িয়া দুই চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল— প্রবাসী পীড়িত চিত্ত তাহার বুকের মধ্যে আর্ত্তনাদ করিয়া যেন বারবার করিয়া বলিতে লাগিল, ওরে দুর্ভাগা দেশের শক্তিহীন নর-নারী। ওই অশেষ ঐশ্বর্য্যময়ী জন্মভূমির প্রতি তোদের অধিকার কিসের? যে ভার, যে গৌরব তোরা বহিতে পারিবি না, তাহার প্রতি এই ব্যর্থ লোভ তোদের কিসের জন্য? স্বাধীনতার জন্মগত অধিকার আছে কেবল মনুষ্যত্বের, শুধু মানুষ বলিয়াই থাকে না; এ কথা আজ কে অস্বীকার করিবে? ভগবানও যে ইহা হরণ করিতে পারেন না! তোদের ওই সব ক্ষুদ্র, তুচ্ছ, পঙ্গু হাত-পাগুলোকেই কি তোরা মানুষ বলিয়া স্থির করিয়া বলিয়া আছিস্? ভুল ভুল; ইহার বড় আত্মঘাতী ভুল ত আর হইতেই পারে না! এমনি কত কি যে আপনাকে আপনি বলিতে বলিতে তাহার সময় কাটিতে লাগিল তাহার হিসাব ছিল না, অকস্মাৎ, ট্রেনের গতি মন্দীভূত হওয়ায় তাহার চেতনা হইল। তাড়াতাড়ি চোখ মুছিয়া বাহিরে চাহিয়া দেখিল গাড়ি স্টেশনের মধ্যে প্রবেশ করিতেছে।