পদাবলী-মাধুর্য্য/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

মান-মিলন

 মান ও অভিসারের পর মিলন। শুধু দুঃখের কথা বলিয়া বৈষ্ণব কবিরা কোন কিছু পরিসমাপ্ত করেন না। শুভ-অশুভ দুইই সংসারে আছে, কিন্তু আমাদের বিশ্বাস করিতে হইবে যে, আপাত সমস্ত অশুভের পরিণতি শুভে। শুধু মনে আঘাত দেওয়ার উৎকট আনন্দ দানব-প্রকৃতির উপযোগী। আমরা বিশ্ব-প্রকৃতির অভিপ্রায় বুঝি আর না, বুঝি, এটুকু বিশ্বাস করিতে হইবে যে, সকলই সেই মঙ্গলময়ের বিধান—সুতরাং শুভান্ত। মানের পর মিলন না হইলে মান অসম্পূর্ণ, মাথুরের পর ভাব-সম্মেলন না হইলে মাথুর অসম্পূর্ণ। আমরা সমস্ত পথটা দেখিতে পাই না, কিন্তু পৌছাইবার যে একটা স্থান আছে—তাহা অন্তরে বুঝি। বিয়োগান্ত কথায় লোক রাস্তার এমন একটা জায়গায় পড়িয়া থাকে, যাহাতে মনে হয় পথ ফুরাইয়া গিয়াছে, কিন্তু পথ ফুরাইলে হৃদয়ের হাহাকার থাকিয়া যায় কেন, গম্যস্থানে গেলে কি আর ক্ষোভের কারণ থাকিতে পারে? বিয়োগান্ত রীতিটা গ্রীকগণ পছন্দ করিয়াছেন, তাঁহারা অশ্রু ও দীর্ঘ-নিঃশ্বাস ফেলিয়া—ফাঁসীতে প্রিয়জনকে ঝুলাইয়া আসর ছাড়িয়া উঠিবেন। হিন্দুর প্রাণ এই অবিশ্বাস ও অসোয়ান্তির রাজ্যের কথা দিয়া যবনিকা-পতন ইচ্ছা করেন না।

 তাঁহারা যদি দুঃখ বর্ণনা করিবেন, তবে তাহা কোন উন্নত আদর্শ লক্ষ্য করিয়া করেন। পিতৃসত্য রক্ষা করিবার জন্য রামের বনবাস, স্বামীপ্রেম দেখাইবার জন্য সাবিত্রী ও দময়ন্তীর কষ্ট বর্ণিত হইয়া থাকে। কিন্তু রাজকুমার শিশু-আর্থারের চক্ষু উৎপাটন বা শেষাঙ্কে হ্যামলেট-কর্ত্তৃক অকারন কতকগুলি মানুষ হত্যা—এই সকল বৃথা কষ্টের অবতারণা করিয়া শ্রোতার হৃদয়ে অহেতুক ব্যথা দেওয়া সংষ্কৃতের আলঙ্কারিকগণ নিষেধ করিয়াছেন।

 অভিসার ও মানের পর কৃষ্ণ রাধার সঙ্গে মিলিত হইয়াছেন। অভিসারে রাধা “দুই সখীর কাঁধে দুই ভুজ আরোপিয়া, বৃন্দাবনে প্রবেশিল শ্যাম-জয় দিয়া”“বৃন্দাবনে প্রবেশিয়া ধনী ইতি-উতি চায়, মাধবী তরুর মূলে দেখে শ্যাম রায়,”—গায়েন বলিতেছে, শ্যাম ধ্যান-ধরা যোগীর মত দাঁড়িয়ে আছে। তপ-সিদ্ধির প্রাক্কালে যোগী যেরূপ ধ্যানস্থ হইয়া আনন্দময়ের উপলদ্ধির পরীক্ষায় দাঁড়ায়—ইহা সেইরূপ ধ্যানের প্রতীক্ষা।

‘‘ধেয়ে গিয়ে শ্যামচাঁদ রাইকে ধরে কারে,
ললিতা দাঁড়িয়ে হাসে কুঞ্জলতার আঁড়ে।’’

 কুঞ্জলতার ঘন অথচ তরল পত্রান্তরাল হইতে ললিতার দুটি সকৌতুক চক্ষু যুগল-মিলনের এই দৃশ্য দেখিতেছিল।

 ‘‘(তখন) শির হইতে গুঞ্জা ফল তুলি শ্যাম রায়,
 নমো প্রেমময়ী বলিয়া দিলা রাধার পায়।”
এবং “খুলিয়া চাঁপার মালা এলায়ে কবরী,
 বধুঁর যুগল পদ বাঁধেন কিশোরী।’’

 এই যুগল-মিলনে দেব-দেবী উভয়ে উভয়ের পূজা করিতেছেন। দেহের চাঞ্চল্যের উর্দ্ধে—ভোগলালসার দুর্নীত হাওয়া যেখানে পৌঁছিতে পারে না, সেই অম্নান অধ্যাত্ম কুঞ্জবনে–ইঁহাদের লীলা, এবং ইহাই উচ্চাঙ্গের ভক্তের নিত্য বৃন্দাবন। ইন্দ্রিয় প্রশমিত না হইলে, দৈহিক কামনা একেবারে পুড়িয়া ছাই না হইয়া গেল কেহ বৃন্দাবনের কিশোর-কিশোরীর প্রেম বুঝিতে পারিবেন না, কবিরাজ ঠাকুর এই প্রেমকে “নির্ম্মল ভাস্কর” এবং লালসাকে “অন্ধ তম” বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন (“কাম অন্ধ তম প্রেম নির্ম্মল ভাস্কর”)।

 এই মিলনের চিত্র নানা কবি নানা ভাবে আঁকিয়াছেন; একজন লিখিয়াছেন:—

“মোহন বিজন বনে, দূর গেল সখীগনে–
একেলি রহল ধনি রাই।
দুটি আঁখি ছল ছল, চরণ কমলতল
কানু আসি পড়ল লুটাই।
কমলিনী জীবন সফল ভেল মোর,
তোমা হেন গুণনিধি, পথে আনি দিল বিধি,
আজিকে সুখের নাহি ওর।”

 যে দেশে শীতে জল জমিয়া বরফ হইয়া যায়, সেখানকার হাওয়া বাঙালা দেশে আসিয়া লাগাতে অশ্রু শুকাইয়া গিয়াছে। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকে এখন চক্ষের জলের মূল্য স্বীকার করেন না। প্রেম-স্নেহ প্রভৃতি কোমল ভাবের সর্ব্বপ্রধান নিদর্শন এই অশ্রুর মূল্য স্বীকার করিতে হইলে নিগৃহীত পিতামাতার ও উপেক্ষিতা স্ত্রীর ঋণ স্বীকার করিতে হয়, শিক্ষিত সংজ্ঞায় অভিহিত দুর্নীত পুত্র ও স্বামীর তাহা হইলে খামখেয়ালী করায় বাঁধা জন্মে। অন্য দেশের কি তাহা জানি না, কিন্তু এই অশ্রুই বঙ্গদেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ্‌। চৈতন্য বক্তৃতা করেন নাই—উপদেশ দেন নাই—ধর্ম্মপ্রচার করেন নাই। তিনি চোখের জল দিয়া সমস্ত দেশটা বিজয় করিয়াছিলেন। তাঁহার একবিন্দু অশ্রুতে যে প্লাবন আনাইয়াছিল, তাহা এখনও সমস্ত নগর ও পল্লী ভাসাইয়া লইয়া যাইতেছে। বড় ব্যথা—বড় আনন্দের ক্ষেত্রে এই অশ্রুর জন্ম, ইহা এখন Sentimentalism-এর লক্ষণ বলিয়া যাঁহারা অগ্রাহ্য করিতে চান, তাঁহাদের মত কাটখোট্টা পণ্ডিত ইতিপূর্ব্বেও এদেশে অনেক ছিল। পাঁচ শত বৎসর পূর্ব্বে একদা শ্রীবাস গীতার আলোচনা-সভায় কাঁদিতেছিলেন, এইজন্য সে-সভার পণ্ডিতেরা তাঁহাকে গলাধাক্কা দিয়া তাড়াইয়া দিয়াছিল এবং স্বয়ং চৈতন্যদেবও বাসুদেব সার্ব্বভৌমের নিকট “ভাবুক” বলিয়া ভর্ৎসিত হইয়াছিলেন ও কাশীর প্রকাশানন্দ স্বামীও চৈতন্যকে ইহার জন্য নিন্দা করিয়াছিলেন। কিন্তু সমস্ত পণ্ডিতকে মূঢ় প্রতিপন্ন করিয়া চৈতন্যের দুইটি চক্ষুর মুক্তাসম অশ্রু কোটী কোটী লোকের মহাশাস্ত্র হইয়া আছে। এই পরমানন্দজ অশ্রুর কথাই কবি এখানে বলিতেছেন—

‘‘দুটি আঁখি ছল ছল,   চরণ-কমলতল,
  কানু আসি পড়ল লুটাই।’’

 আর এক কবি এই মিলনকালে বলিতেছেন, “আদরেতে আগুসারি, রাইকে হৃদয়ে ধরি”—কৃষ্ণ জানুর উপরে রাধার পা দু’খানি রাখিয়া মুগ্ধনেত্রে চাহিয়া আছেন, “নিজ কর-কমলে চরণযুগ মুছই, হেরই চির থির আঁখি।” রাধার পা দু’খানি দেখিয়া কৃষ্ণের চোখের তৃষ্ণা মিটিতেছে না, “এ ভর দুপুর বেলা, তাতিল পথের ধুলা, কমল তিহনিয়া পদ তোর,” পথে কোথায় কাঁটা পায়ে ফুটিয়াছে, দেখিতে যাইয়া কৃষ্ণ অশ্রুসংবরণ করিতে পারিতেছেন না এবং “পুছই পহু কি দুখ”—পথে কি কি কষ্ট পাইয়াছেন, অতি আদরে জিজ্ঞাসা করিতেছেন।

 রাধা ও কৃষ্ণ উভয়েরই পরস্পরের পদের দিকে দৃষ্টি—ইহাতে প্রমাণ হয়, এ প্রেমের জন্ম পূজার ঘরে। কবি কৃষ্ণকমল বলিয়াছেন—

‘‘অতুল রাতুল কিবা চরণ দুখানি,
আলতা পরাত বঁধু কতই বাখানি।’’

এই চরণ-পদ্মের শোভা এখনকার উচ্চ-গোড়ালী, খুরওয়ালা জুতার দিনে আমরা এ-যুগের তরুণদের কি করিয়া বুঝাইব? রবীন্দ্র বাবুর পরে আর কেহ রমণী-চরণের সৌন্দর্য্য বর্ণন করেন নাই।

 এই মিলন-দৃশ্যে রাধা-কৃষ্ণের গীতিকা অপূর্ব্ব আনন্দের ছবি অঙ্কিত করিয়াছে। পদ-সাহিত্যের কৌস্তুভমণি “জনম অবধি” এই পদটী মিলনের গীতি।

‘‘জনম অবধি হাম রূপ নেহারিলু—
নয়ন না তিরপিত ভেল।
সোহি মধুর বোল শ্রবণে হি শুনিলু,
শ্রুতিপথে প্রবেশ না গেল।
কত মধু যামিনী—রভসে গোয়াইলু,
না বুঝিলু কৈছন কেলি,
লাখ লাখ যুগ হিরে হিয়া রাখিলু
তবু হিয়া জুড়ন না গেলি।’’

 এই গানটি সর্ব্বত্রই কবি-বল্লভের ভণিতায় পাওয়া যায়। কোন কোন স্থানে নাকি অন্য গানে বিদ্যাপতির কবি-বল্লভ উপাধি পাওয়া গিয়াছে—–যাহা হউক তাহাতে সন্দেহের কারণ আছে। বিচারপতি সারদাচরণ যখন বিদ্যাপতির সংস্করণ প্রকাশ করেন, তখন তিনি এই সূত্রে “কবিবল্লভ” অর্থে বিদ্যাপতি বুঝিয়াছিলেন; অক্ষয় সরকার মহাশয় নির্ব্বিচারে সারদাচরণকেই অবলম্বন করিয়া পদটি বিদ্যাপতির খাতায় লিখিয়াছিলেন। কিন্তু বিদ্যাপতির যদিই বা “কবিবল্লভ” উপাধি থাকিয়া থাকে, তবে, যাহার উপাধি “কবিবল্লভ” তিনিই যে বিদ্যাপতি হইবেন—তাহা নহে। তারপর “বিদ্যাসাগর” বলিতে যেরূপ ঈশ্বরচন্দ্রকেই বুঝায়, “কবিবল্লভ” উপাধি সম্বন্ধে বিদ্যাপতির সেরূপ কোন যোগরূঢ়ত্ব হয় নাই। যদিই বা স্বীকার করা যায় যে, বিদ্যাপতির “কবিবল্লভ” উপাধি ছিল, তাহার এই উপাধি জনসমাজে কতকটা অবিদিত ছিল। বরঞ্চ “নব জয়দেব”, “কবিরঞ্জন”—এই দুটিই ছিল তাঁহার উল্লেখযোগ্য উপাধি।

 ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিতে ঈশ্বরচন্দ্র বুঝাইলেও, উহাতে তাঁহার একচেটিয়া সত্ব জন্মিয়াছে, একথা স্বীকার করা যায় না। বঙ্গের কয়েক জন বিশিষ্ট লোক ঈশ্বরচন্দ্রের সময়েই “বিদ্যাসাগর” উপাধি গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের ক্ষুদ্র পরিবেষ্টনীয় মধ্যে ‘বিদ্যাসাগর’ বলিলে তাঁহাদিগকে বুঝাইত, যথা ঢাকার কালীপ্রসন্ন ঘোষ এবং বিবিধ সংস্কৃত গ্রন্থের টীকাকার ও সম্পাদক জীবানন্দ। এদেশে পল্লী খুঁজিলে আরও বিদ্যাসাগর মিলিতে পারে, সুতরাং “কবিবল্লভ” বলিতে যে শুধু বিদ্যাপতিকেই বুঝাইবে, এ-কথা একেবারেই বলা চলে না। ‘কবিবল্লভ’ উপাধি বিদ্যাপতির আদৌ ছিল কিনা—তাহারই নিশ্চয়তা নাই। এই উপাধিটি বাঙালা দেশেরই উপাধি বলিয়া মনে হয়, মিথিলায় ইহার তাদৃশ প্রচলন ছিল কিনা সন্দেহ। ‘কবিবল্লভ’ বলিতে এদেশে কিংবা মিথিলায় পূর্ব্বে কখনও বিদ্যাপতিকে বুঝাইত না। তবে আমাদের দেশে যাঁহারা কোন প্রাচীন কাব্য সম্পাদন করেন, তাঁহারা বিচারবুদ্ধি তাদৃশ ব্যবহার করেন না—যতটা গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধি করিতে ব্যগ্র হন। সুতরাং যদি পূর্ব্বের কোনো সংস্করণে ভুলক্রমে কোন সম্পাদক কোন পদ কবি-বিশেষের খাতায় লিখিয়া ফেলেন, পরবর্ত্তী কবিরা কিছুতেই তাহা বাদ দিতে স্বীকৃত হন না, পাছে পূর্ব্ব সংষ্করণ ছোট হইয়া যায়। এই ভাবে গতানুগতিকদের প্রসাদে কবিবল্লভ উপাধিক বাঙালী-কবির পদটি মিথিলার বিদ্যাপতির খাতায় উঠিয়াছে। বিদ্যাপতির মত শ্রেষ্ঠ কবির মর্য্যাদা এই একটি পদে বাড়ে নাই, কিন্তু কবিবল্লভ নামক বাঙালী-কবি এই পদটি হারাইয়া হৃতসর্ব্বস্ব হইয়াছেন। শুধু কবিবল্লভ নহে, রায়শেখর এবং অন্যান্য কয়েক জন বাঙালী কবিকে নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত মহাশয় বিদ্যাপতির নামে চালাইয়াছেন। যখন তিনি মিথিলায় বিদ্যাপতির পদ-সংগ্রহ করেন, তখন একদিন আমাকে বলিয়াছিলেন, মিথিলার কোন পুঁথিতেই তিনি “জনম অবধি হাম রূপ নেহারলু” পদটি পান নাই, অথচ বিদ্যাপতির ভক্ত টীকাকার তাঁহার সংস্করণে পূর্ব্ববর্ত্তী সম্পাদকদের অনুসরণ করিয়া বিদ্যাপতির পদ বলিয়াই উহা চালাইয়াছেন। যিনি বঙ্গের বৈষ্ণবকবিকুলচূড়ামণি গোবিন্দ দাসকে অজ্ঞাতনামা মৈথিল কবি গোবিন্দ দাস ভ্রম করিয়া তাঁহার সমন্তগুলি উৎকৃষ্ট পদ মিথিলায় সংগ্রহ-পুস্তকে সঙ্কলিত করিবার প্রেরণা দিয়াছেন, তাঁহার পক্ষে কবিবল্লভ ও রায়শেখরকে এইভাবে বিদ্যাপতির পদাবলীতে স্থান দেওয়ায় আমরা দুঃখিত হইয়াছি, কিন্তু আশ্চর্য্য হই নাই। বর্ত্তমান দ্বারবঙ্গাধিপ সেই অজ্ঞাতনাম মৈথিল-কবি গোবিন্দ দাসের বংশধর, সুতরাং এই সকল কার্য্যে রাজ-মনস্তুষ্টি ও মিথিলাবাসীদের প্রীতি সাধিত হইয়াছে; সুপ্রসিদ্ধ বৈষ্ণবশাস্ত্রবিৎ পণ্ডিত এবং সাহিত্য পরিষৎ হইতে প্রকাশিত পদকল্পতরুর সম্পাদক সতীশচন্দ্র রায় এম-এ, নগেন্দ্রবাবুর এই কার্য্যের বিস্তারিত সমালোচনা করিয়াছেন, আমি এইটুকু মাত্র বলিতে পারি যে, যখন তিনি বিদ্যাপতির পদ সংগ্রহ করেন, তখন সম্ভবতঃ তিনি জানিতেন না, বাঙালী বহু বৈষ্ণব কবি মৈথিলভাষার ছন্দে ব্রজবুলিতে পদ লিখিয়া গিয়াছেন। সুতরাং ব্রজবুলি পাইলেই তাহা মৈথিল-পদ মনে করিয়া যাহা কিছু হাতের কাছে পাইয়াচেন—তাহাই বিদ্যাপতির রচনা মনে করিয়াছিলেন। তাহার পর যখন জানিতে পারিলেন যে, বাঙালী কবিদের এক বিরাট্‌ ব্রজবুলি-সাহিত্য আছে, তখন পূর্ব্বকৃত কার্য্যের সমর্থনের জন্য ভাষাতত্ত্বের বিশ্লেষণ করিয়া তৎসঙ্কলিত পদগুলি যে মৈথিলী-ব্রজবুলী নহে—তাহাই প্রমাণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। কিন্তু একথা নিশ্চিত নহে যে, ব্রজবুলী ও মৈথিলীর সুক্ষ্মতার তারতম্য করিতে পারেন, এরূপ বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত অল্পই আছেন। নগেন্দ্রবাবু আদৌ ভাষাবিৎ নহেন, যেক্ষেত্রে তাঁহার বর্ণপরিচয় পর্য্যন্ত হয় নাই, সেখানে তাঁহার ‍বিচার কেহ মানিয়া লইবে না। পূর্ব্বভারতীয় ভাষাগত নানা সূক্ষ্ম বিভিন্নতা বুঝিতে স্বয়ং গ্রিয়ারসন সাহেব ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছেন; অপরের কি কথা!

 শুধু এই পদটি ও রায়শেখরের পদগুলি নহে, কত বাঙালা পদ যে বিদ্যাপতির উপর আরোপ করা হইয়াছে, তাহা নির্ণয় করা সহজ নহে। “মরিব মরিব সখী নিশ্চয় মরিব, কানু হেন গুণনিধি কারে দিয়া যাব”—গানটি, যাহার অস্থি, পঞ্জর, ত্বক, মাংস সমস্তই বাঙালার মাটী ও বাতাসের উপাদানে গড়া—তাহা কেন যে বিদ্যাপতির ঘাড়ে চাপানো হইয়াছে, তাহা একটা সমস্যা। এই গানটির ভাব সুপ্রাচীন কাল হইতে বাঙালার হাওয়ায় ঘুরিতেছে। মিথিলার সঙ্গে ইহার কোনই সম্পর্ক নাই। আমি ত্রিপুরার জঙ্গলে গ্রাম্য কৃষকের মুখে ভাটিয়াল সুরে এই গানের মর্ম্ম শুনিয়াছি—“আমি মৈলে এই করিও, না পেড়োয়ো না ভাসায়ো”, অন্যান্য বহু বঙ্গীয় বৈষ্ণব কবির কণ্ঠে ভিন্ন ভিন্ন ছন্দে মনোহরসাই রাগিণীতে এই গীতি শোনা গিয়াছে। “আমার নীরে নাহি ডারবি, অনলে নাহি পোড়াবি” কিম্বা “দেহ দাহন ক’র না দহন দাহে, ভাসায়ো না তাহা যমুনা প্রবাহে” এবং “প্রাণ যদি দেহ ‍ছাড়া, না দ’হ বহ্নিতে মোরে না ভাসায়ো যমুনা সলিলে” প্রভৃতি বহু পদে, বাঙালার প্রতি কোণে কোণে শত শত নরনারী-কণ্ঠে যে-কথা বহুকাল হইতে প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হইয়া আসিয়াছে, বাঙালা দেশের সেই মর্ম্মোক্তি, বাঙালা ভাষায় রচিত। বাঙালা ছন্দে গ্রথিত সেই গানটি কেন যে বিদ্যাপতির পদাবলীর মধ্যে আসন পাইল এবং সুবিজ্ঞ সম্পদকেরাই বা কেন এই অনধিকার-প্রবেশ সম্বন্ধে চুপ করিয়া রহিলেন, তাহা তাঁহারাই জানেন! এইরূপ আরও অনেক বাহিরের পদ বিদ্যাপতির পদ-সংগ্রহে ঢুকিয়া বইখানি ধাউসের মত বৃহদাকৃতি করিয়া তুলিয়াছে। দৃষ্টান্ত স্থলে আরও কয়েকটি পদের প্রথম দুই এক ছত্র উল্লেখ করিতেছি—সেগুলি নিছক বাঙ্গালা পদ—“আজি কেন তোমায় এমন দেখি, সঘনে ঘুরিছে অরুণ আঁখি”“শুনলো রাজার ঝি তোরে কহিতে আসিয়াছি, কানু হেন ধন, পরাণে বধিলি, এ কাজ করিলি কি?”

 মিলনের দৃশ্য আরও অনেক কবি দেখাইয়াছেন, তাহাদের কোন কোনটিতে অধ্যাত্মরাজ্যের ছায়া পড়িয়াছে। “আজি নিধুবনে শ্যাম-বিনোদিনী ভোর, দোঁহার রূপের নাহিক উপমা, সুখের নাহিক ওর” পদটি দৃষ্টান্ত-স্বরূপ গৃহীত হইতে ‍পারে। এই জগতে একদিকে ঘননীল বনান্ত ও সুনীল নভস্তল, অপরদিকে সোনালী রৌদ্র ঝক্ ঝক্ করিতেছে। এই বিশ্বপ্রকৃতির রূপ লইয়া যুগলমূর্ত্তি সখিদিগের মন মুগ্ধ করিতেছে—

‘‘আজি হিরণ-কিরণ, আধ-বরণ আধ-নীলমণি জ্যোতি,
আধ-গলে বনমালা বিরাজিত, আধ-গলে গজমতি,
আধ-শিরে শোভে ময়ুর-শিখণ্ড, আধ-শিরে দোলে বেণী,
কনক-কমল করে ঝলমল ফণী উগারয়ে মণি,
আধই শ্রবণে মকর-কুণ্ডল, আধ রতন ছবি,
আধ-কপালে চাঁদের উদয়, আধ-কপালে রবি।
মন্দ পবন মলয় শীতল তাহে শ্রীঅঙ্গের বাস!
রসের সায়রে না জানি সাঁতার ডুবিল অনন্ত দাস।’’

 হেম-কান্তি ও নীলকান্তিতে, ময়ূরপুচ্ছ ও বেণীর লহরে আধ সিন্দূর বিন্দুর সঙ্গে আধ-কপালের চন্দনবিন্দুতে গজমতি হার ও বনমালায়—চিরপিপাসিত বহু কৃচ্ছ্র উত্তীর্ণ প্রকৃতি-পুরুষের আনন্দময় মিলন—এই চিত্র দেখিয়া কবি ভুলিয়া গিয়াছেন, তিনি লিখিয়াছেন, এ রস-সৌন্দর্য্য সমুদ্র পার হইবার সাধ্য তাঁহার নাই—কারণ তিনি সাঁতার জানেন না, এই জন্য ডুবিয়া গেলেন। এই চিত্র কি? মন্দিরে মন্দিরে আরতিকালে ধূপধূমচ্ছায়ার মন্দীভূত পঞ্চপ্রদীপের আলোকে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্ত্তি লক্ষ্য করুন, তারপর বাহিরে চাহিয়া রৌদ্রকরোজ্জ্বল গগনে বনাস্তবীথিকার শিশিরবিন্দুতে ও নীলিম পল্লবে সেই মূর্ত্তির প্রভা দেখিতে পাইবেন। এই জগৎ সেই আনন্দময় প্রকৃতি-পুরুষের মিলন-দৃশ্য উদ্ঘাটিত করিয়া দেখাইতেছে। ইহা এ-পার ও পরপারের কথা একসঙ্গে মনে জাগাইবে।

 আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি, বৈষ্ণব কবিরা সাধারণের নিকট তাঁহাদের কাব্য এক হইতে দেন নাই; কেবলই মিষ্টরসে রসনায় জড়তা আসে—কেবলই সন্দেশ খাওয়া যায় না, মাঝে মাঝে মুখরোচক কিছু দিয়া স্বাদ বদলাইতে হয়। পরিহাস-রসের দৃষ্টান্ত আমরা মান-মিলন উপলক্ষে দেখাইয়াছি। ইহা ছাড়া আরও কোন কোন স্থানে ইহা প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। সেই সেই অংশে আমরা যেন হঠাৎ স্বর্গরাজ্য হইতে বাস্তবরাজ্যে পড়িয়া যাই। যাত্রা ও কীর্ত্তনে এই পরিহাস-রসিকতা অতি স্পষ্ট হইয়া উঠিয়া শ্রোতার মনোরঞ্জন করে। কিন্তু পাঠকেরা মনে করিবেন না, এই রসের বাহ্যিক তারল্য বৈষ্ণব আদর্শকে কোন স্থানে ক্ষুণ্ণ করিয়াছে, এই রস ইতর লোকের তাড়ি নহে, শিক্ষিত সম্প্রদায়ের টেবিলের বাহ্যিক রুচিসঙ্গত ‘বিয়ার’ নহে—ইহা ঘন খর্জ্জুর রস। ইহার জন্ম মাতালের বাহবা-দেওয়া ঘন করতালির মধ্যে নহে—ইহার জন্ম অসাধারণ ‍তপস্যা ও কৃচ্ছ্রের মধ্যে—বিদীর্ণ ও কর্ত্তিত হৃদয়ের মধ্যে হইতে বাহির হয়, এই হাস্য-রস উপভোগের সময় মাঝে মাঝে চোখে জল আসে, কারণ হাসি হইলেও ইহা বড় কষ্টের হাসি।

 মান-মিলনের পূর্ব্বে হাস্যরসের দ্বিতীয় অবকাশ খণ্ডিতা। রাধিকা বুঝিয়াছেন, কৃষ্ণ সমস্ত জগতের—তাঁহার একার নহেন। তিনি তাঁহাকে শুধু রাধা নামের ছাপ দিয়া ধরিয়া রাখিবেন কিরূপে? এই সন্দেহে সারারাত্রি প্রতীক্ষায় কাটাইয়াছেন, তাঁহার বকুলমালার ফুলগুলি বাসি হইয়া গিয়াছে। বেণী শিথিল হইয়াছে, দুরন্ত সূর্য্যের আলো যেরূপ পশ্চিম গগনে মিশিয়া যায়, তাঁহার অধরপ্রান্তে বিলীন হইয়া গিয়াছে। প্রভাতে কৃষ্ণ আসিয়াছেন, বড় কষ্টের মধ্যে সখীরা তাঁহাকে পরিহাস করিতেছে:—

‘‘ভাল হৈল ওরে বঁধু আইলে সকালো,
প্রভাতে দেখিলাম মুখ দিন যাবে ভালো।’’

 বহু বৎসর পূর্ব্বে একদা শিবু কীর্ত্তনীয়া শ্রীযুক্ত গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের বাড়ীতে কীর্ত্তন গাহিয়া শ্রোতৃবৃন্দকে মুগ্ধ করিয়াছিল। পূর্ব্বরাগ, মাথুর, গোষ্ঠ প্রভৃতি নানা পালা গাহিবার পরে, একটি নূতন পালা গাওয়া হইবে। দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও ঠাকুর-পরিবারের অপরাপর প্রায় সমস্ত ব্যক্তিই প্রত্যহ আসরে উপস্থিত থাকিতেন। অপরদিকে সেই পরিবারের মহিলারাও গান শুনিতে আসিতেন। রবীন্দ্রনাথই শিবুকে আনাইয়াছিলেন। মাথুর গাইয়া শিবু শ্রোতৃবর্গকে অশ্রুর বন্যায় ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছিল। বৃদ্ধ দ্বিজেন্দ্রনাথই শ্রোতাদের মধ্যে বেশী কাঁদিতেন। ছেলেদের গৃহ-শিক্ষক জার্ম্মান্ Lawrence সাহেব কথাগুলি না বুঝিয়াও শিবুকৃত এই অপূর্ব্ব উদ্মাদনার প্রভাব দেখিয়া বিস্মিত হইতেন, তিনি চুপ করিয়া আসরের একটি কোণে বসিয়া থাকিতেন। একদিন রবীন্দ্রনাথ প্রাতে শিবুকে বলিলেন, “কীর্ত্তন তো বেশ গাহিতেছ, আজ সন্ধ্যায় কি গাহিবে?” শিবু বলিল, “খণ্ডিতা”। রবীন্দ্রনাথ চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিলেন, “শিবু এইবার দেখ্‌ছি মজালে! আমাদের বাড়ীর মহিলাদের সম্মুখে তুমি “খণ্ডিতা” গাইবে? এইবার তোমার অর্জ্জিত যশ পণ্ড হবে। ব্রাহ্ম মেয়েদের রুচি তুমি জান না—ইহাদের কাছে তুমি খণ্ডিতার পালা গাইবে কোন্ সাহসে?” শিবু জোড়হাতে করিয়া বলিল, “হুজুর, আমরা যে-জিনিষটা যে-ভাবে দেখি, আপনারা সে-ভাবে দেখেন না। আমাদের কাছে রাধাকৃষ্ণের লীলা পবিত্র, ইহাতে পাপ আসবে কিরূপে? আপনি আসরে এসে দেখবেন, কোন অসঙ্গত ভাব বা ভাষা আমার মুখ হতে বাহির হবে না।”

 সন্ধ্যায় আমরা আসরে আসিয়া বসিলাম। গৌরচন্দ্রিকা গাওয়ার পরে শিবু যে গানটি প্রথম গাহিল, তাহা আমার মনে নাই, কিন্তু তাহার মর্ম্ম এই—“ভগবান পাপী-তাপী কাহাকেও ছাড়িতে পারেন না, তিনি সকল দুয়ারেই প্রেমভিক্ষা করিয়া বেড়ান, পাপী তাঁহাকে কষ্ট দেয়, তাঁহাকে ক্ষত-বিক্ষত করে। প্রেমিক তাঁহার এই আচরণে ব্যথিত হন।” এই গানটি অতি করুণ ও গদ্‌গদ কণ্ঠে সে গাহিয়া আসরে এমন একটি নির্ম্মল হাওয়ার সৃষ্টি করিল, যাহার পরে চন্দ্রাবতীকৃত অত্যাচারের কথা শ্রোতারা ভাবের সেই উচ্চগ্রাম হইতে শুনিল, কোন অশিষ্টভাব মনে হওয়া তো দূরের কথা—ভক্তির বন্যায় আসর ভাসিয়া গেল। শ্রোতারা নির্ব্বিকারচিত্তে শুনিতে লাগিল—“আহা বঁধু শুকায়েছে মুখ। কে ‍সাজাল হেন সাজে হেরি বাসি দুখ।”

 বস্তুতঃ বাঙালার নিম্নশ্রেণীর মধ্যে কত যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষা—ভক্তি ও প্রেমের গভীর জ্ঞান লুক্কায়িত আছে, তাহা কেমন করিয়া বুঝাইব? তাহাদের অসাধারণ ভক্তি-গঙ্গা-স্রোতে শ্লীল-অশ্লীল বহুমূল্য পণ্য-বোঝাই ডিঙ্গি ও গলিত শব একটানে ভাসিয়া যায়—প্রেমের সাগর-সঙ্গমে। সেই গঙ্গার পাবনী স্পর্শে পবিত্র ও অপবিত্রের মধ্যে ব্যবচ্ছেদ রেখা মুছিয়া যায়—সকলই দেবতার আশীর্ব্বাদ বহন করে।

 গোপীদের এই উপলক্ষে পরিহাস-সূচক অনেক পদ চণ্ডীদাস লিখিয়াছেন:—

‘‘নয়নের কাজর,   বয়ানে লেগেছে,
   কালোর উপরে কালো।
প্রভাতে উঠিয়া,   ও মুখ দেখিলু,
   দিন যাবে আজি ভালো।
অধরের তাম্বুল,   নয়নে লেগেছে,
   ঘুমে ঢুলু চুলু আঁখি;
আমা পানে চাও,   ফিরিয়া দাঁড়াও,
   নয়ন ভরিয়া দেখি।
চাঁচর কেশের   চিকুর বেণী
   সে কেন বুকের মাঝে।
সিন্দুরের দাগ,   আছে সর্ব্ব গায়
   মোরা হৈলে মরি লাজে।’’ ইত্যাদি—

মান কীর্ত্তনীয়ারা আসরে গায় না—কারণ ইহার প্রতিটি ছত্রে যে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত আছে, তাহা শীলতার হানিকর। কিন্তু যাঁহারা ভাগবানের চরণে সমর্পিতপ্রাণ রসিক ভক্ত, তাঁহারা গোপীদের মনোবেদনাপূর্ণ শ্লেষের ভাষার মধ্যে করুণাময়ের প্রতি ব্যথিত চিত্তের অশ্রুভারাক্রান্ত নিবেদনের ভাব উপলব্ধি করিয়া থাকেন।

 সেকালের রুচি আর একালের রুচির লক্ষ্য পৃথক। এখনকার লোকেরা জগতের অদ্বৈতরূপ দেখিতে পান না। ভাল-মন্দ, পবিত্র-অপবিত্র, ভষ্ম-চন্দন প্রভৃতি সমস্ত ব্যাপিয়া যাঁহার সত্বা, তাঁহাকে তাঁহারা পোষাকী করিয়া মন্দির মধ্যে—জগৎ হইতে স্বতন্ত্র স্থানে তুলিয়া রাখিতে চান; প্রাচীনেরা তাঁহাদের সমস্ত ক্রিয়া কর্ম্ম, লীলা খেলারও মধ্যে তাঁহাকে না পাইলে তৃপ্ত হইতেন না। যাঁহাকে তাঁহারা পূজার ঘরে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন, তাঁহাকে তাঁহারা খেলার ঘরে আনিতেও দ্বিধা বোধ করিতেন না। সমস্ত দেহ ও সর্ব্বেন্দ্রিয় এবং মন দ্বারা তাঁহাকে সেবা করা—এই ছিল তাঁহাদের ভাবধারা। ভক্তি-ভস্ম গায় মাখিয়া তাঁহারা প্রেম-মধুচক্রে প্রবেশ করিতেন, তখন তাঁহারা ইন্দ্রিয়-মক্ষিকার দংশনের অতীত হইয়া থাকিতেন। কোন একটি ভাল কীর্ত্তনের আসরে ভক্তের কণ্ঠে কীর্ত্তন শুনিলে, আমি যাহা বুঝাইতে এত কথা বলিলাম, তাহা পাঠক অনায়াসে বুঝিতে পারিবেন। আমি সেই ভক্তির কণা কোথায় পাইব, যাহার বন্যাস্রোতে মহাপ্রভু এদেশের নিম্নশ্রেণীকে মাতাইয়াছিলেন! পণ্ডিতেরা সেই ভক্তির অমৃতভাণ্ড ফেলিয়া দিয়াছেন, নিম্নশ্রেণীর লোকেরা এখনও সেই প্রসাদ কুড়াইয়া রাখিয়া দিয়াছে।

 এদেশের কীর্ত্তনের একটা বিশেষ মূল্য আছে। গণিকারাও কীর্ত্তন গাহিয়া থাকে। তাহাদিগকে ব্রহ্মসংগীত, রামপ্রসাদ ও দাশরথীর গান, বাউল সংগীত, টপ্পা, খেয়াল, গোপাল উড়ের গান, নিধুবাবুর গান প্রভৃতি যাহা কিছু গাহিতে বলা যায়, তাহাই গাহিবে। কীর্ত্তন গাহিতে হইলে বলিবে, “স্নান করিয়া কাপড় ছাড়িয়া আসি”; শুদ্ধা, স্নাতা না হইয়া তাহারা কীর্ত্তন গায় না। কীর্ত্তন সম্বন্ধে এদেশের জন-সাধারণের কিরূপ উচ্চ ধারণা, তাহা ইহা হইতে বুঝা যায়।

 কৃষ্ণ গোপীদের শ্লেষের উত্তরে অনেক উপদেশ দিয়াছেন, গোপীরা বলিতেছে—

“ভাল ভাল ভাল, কালিয়া নাগর, শুনালে ধরম কথা,
সরলা-বালিকা ছলিলে যখন, ধরম আছিল কোথা?
চলিবার তরে কর উপদেশ পাথর চাপিয়া পিঠে,
বুকেতে মারিয়া ছুরির ঘা, তাহাতে নুনের ছিটে।”

—সেই ভবঘুরে কৃষ্ণের জগতে কোথায় গতিবিধি নাই? ধর্ম্মযাজকের ভজন-মন্দির ও মাতালের আড্ডা—সর্ব্বত্র তাঁহার অবাধ গতি। এজন্য গোপী বলিতেছে—

‘‘সোনা, রূপা, কাঁসা চোর কি বাছে,
চোরের কখন কি নিবৃত্তি আছে?’’

 আধুনিক শিক্ষিত সম্প্রদায় এই সকল গানের মূল্য ধর্ম্মের দিক্ দিয়া স্বীকার করিবেন কিনা সন্দেহ। কিন্তু বঙ্গদেশে প্রেমের পথে সাধকের অভাব নাই। পল্লীর কুটিরে এখনও বৃদ্ধ বৈষ্ণব একতারা লইয়া এই ধরণের গান গাহিয়া কাঁদিয়া বিভোর হন। সোণার পুতুল রাই-এর কষ্টে তাঁহার প্রাণ বিগলিত হয়। গৌরাঙ্গকে কৃষ্ণ একবার দেখা দিয়া পুনরায় অদৃশ্য হইয়া যত কাঁদাইয়াছেন—সেই কথা তাহার মনে পড়ে। সে ইন্দ্রিয়াতীত রাজ্যের বিশুদ্ধ লীলার স্বাদ আমরা কোথায় পাইব?—যাহা খড়-কুটোকে সিঁড়িরূপে ব্যবহার করিয়া ভক্তির রাজ্যে পৌছাইয়া দেয়!

 আর একবার গোপী কৃষ্ণকে পরিহাস করিয়াছিল, তাহা বড় কষ্টে। ডাক্তার আসিয়া মুমূর্ষ রোগীকে দেখিয়া যেরূপ মনের অবিশ্বাস ঢাকিয়া একটু হাসে, এই পরিহাস-রস সেই হাসির পর্য্যায়ে। চন্দ্রা কৃষ্ণকে আনিতে মথুরায় গিয়াছে। কৃষ্ণ বৃন্দাবনের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন। দূতী তখন যে-সকল ব্যঙ্গোক্তি করিয়াছিল, তাহা মর্ম্ম-বেদনায় ভরপুর, হাসির ছদ্মবেশে মর্ম্মান্ত দুঃখের অশ্রু। রাধার কথা বলিতে যাইয়া গোপী বলিতেছে—

‘‘যে গেছে—তার সবই গেছে, কুল গেছে—মান গেছে,
রূপ গেছে, লাবণ্য গেছে, প্রাণ যেতে বসেছে।
তায় তোমায় কি ব’য়ে গেছে, আরও বিষয় বেড়েছে।
পাঁচ পদে যে ব্যাপার করে, এক পদে যদি সে হারে,
হানি কি সে জানতে পারে?’’
‘‘দেখে আমার ব্রজের কথা মনে পড়েছে আজ,
সে কথা শুনাই তোমা বল রস রাজ!”
“ছিল ধেনু গোপের পাড়া—
এথা কত হাতী-ঘোড়া;
সেখানে পরিতে ধড়া,
এথা কত জামা জোড়া,
রাই-পদে লুটান-মাথায় পাগড়ী পড়েছে তেড়া।
ছিলে নন্দের ধেনুর রাখাল,
তারপরে রাই রাজার কোটাল,
একা এসে হয়েছে ভূপাল।”

 এই সকল তীব্র-মর্ম্মবেদনার শ্লেষ। কিন্তু চন্দ্রা শেষে কৃষ্ণ-পরিত্যক্ত বৃন্দাবনের যে চিত্র উদ্ঘাটিত করিল, তাহা মর্ম্মান্তিক—

‘‘তুয়া সে রহলি মধুপুর,
ব্রজকুল আকুল—কলরব দুকুল—
কানু কানু করি ঝুর

যশোবতী নন্দ, অন্ধ সম বৈধত,
সখাগন, ধেনুগণ, সহসা উঠই না পার।
বেনুরব বিসরণ—বিসরণ নগর বাজার।
কুসুম তেজিয়া অলি, ক্ষিতিতলে লুঠই,
তরুগণ মলিন সমান।
সারী-শুক-পিক, ময়ুরী না নাচত,
কোকিলা না করতহি গান।
বিরহিণী-বিরহ কি কহব মাধব,
দশদিশ বিরহ হতাশ!
শীতল যমুনা জল, অনল সমান ভেল,
কহতহি গোবিন্দ দাস।”

 রাধা-কৃষ্ণ লীলার অঙ্কে অঙ্কে চৈতন্য জীবনের ঘটনা। বৈষ্ণবদের কাব্য-কথা বুঝিতে হইলে, চৈতন্যের জীবন-চরিত দিয়া বুঝিতে হইবে—তাহা ছাড়া উপায়ান্তর নাই। কৃষ্ণ-পরিত্যক্ত বৃন্দাবন-চিত্রের সঙ্গে আর একটি চিত্র মিলাইয়া দেখুন—তাহা চৈতন্য-পরিত্যক্ত নবদ্বীপ। চৈতন্য তাঁহার প্রিয় পরিকর জগদানন্দকে পুরী হইতে শচী দেবীকে দেখিতে নদীয়ায় পাঠাইয়াছেন–

‘‘নীলাচল হৈতে,   শচীরে দেখিতে,
  আইসে জগদানন্দ।
রহি কত দূরে,   দেখে নদীয়ারে,
  গোকুল পুরের ছান্দ।
লতা-তরু যত,   দেখে শত শত,
  অকালে খসিছে পাতা।
রবির কিরণ   না হয় স্ফূরণ,
  মেঘগণ দেখে রাতা।

শাখে বসি পাখা,   মুদি দুটি আঁখি,
  ফল জল তেয়াগিয়া।
ধেনু বুথে বুথে,   দাঁড়াইয়া পথে,
  কার মুখে নাহি রা।
নগরে নাগরী,   কাঁদরে গুমরি,
  থাকয়ে বিরলে বসি।
না মেলে পসার   না করে আহার
  কারো মুখে নাহি হাসি।’’
‘‘শুনি শচী আই,   সচকিতে চাই,
  কহিলেন পণ্ডিতেরে।
কহে তাঁর ঠাঁই   আমার নিমাই।
  আসিয়াছে কত দূরে।’’

 চন্দ্রার কথার উত্তরে কৃষ্ণের প্রত্যুত্তের একবার যাত্রায় শুনিয়াছিলাম। সে গানটি মনে ‍নাই, কিন্তু তাহার ভাব এখনও ভুলিতে পারি নাই। তাহা বঙ্গের পরিত্যক্ত পল্লীর কথা পুনঃ পুনঃ মনে করাইয়া দিয়াছিল। প্রথম ছত্রটি মনে আছে; কৃষ্ণ বলিতেছেন—তুমি আমাকে যেতে বল্‌ছ, কিন্তু আমি—“আর কি ব্রজ তেমন পাব?”—আর কি রাখালেরা আমায় তেমনই করিয়া তাহাদের একজন ভাবিতে পারিবে? মথুরা-মধ্যে আসিয়া একটা ব্যবধানের সৃষ্টি করিয়াছে—তাহা উত্তীর্ণ হইয়া আর কি ব্রজবাসীরা আমার সঙ্গে তেমনই ভাবে মেলা-মেশা করিতে পারিবে? আর কি গোচারণের মাঠগুলি তেমনই আছে? সখারা কি উচ্ছিষ্ট ফল হাতে লইয়া ছুটিয়া আসিয়া তেমনই করিয়া আমার মুখে দিতে পারিবে? আর কি মা যশোদা হাতে ননী লইয়া আমার জন্য তেমনই পাগলিনীর মত পথে দাঁড়াইয়া গোঠের দিকে চাহিয়া থাকিবেন? যে-ব্রজের রাখালকে দিয়া তোমরা ‍দাসখৎ লিখাইয়া লইয়াছিলে, তাকে কি তোমরা তেমনই প্রেমের ভিখারী মনে করিয়া কটুক্তি করিতে পারিবে?

‘‘আমি আর কি ব্রজ তেমন পাব?’’

 এই গানে ব্রজের সুরটি নাই। নিত্য-বৃন্দাবনের লীলা অফুরন্ত; মথুরা তাহা নষ্ট করিতে পারে নাই, বরং ঐশ্বর্য্য-ধাঁধা ঘুচাইয়া ব্রজের গভীর প্রেমকে আরও বড় করিয়া দেখাইয়াছে। নিত্য বৃন্দাবনের সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর রসের উৎস কি কখনও ফুরাইবার ও শুকাইবার? পূর্ব্বোক্ত গানটি একান্ত আধুনিক—উহা আমাদের বর্ত্তমান কালের গৃহছাড়া হতভাগ্যদের জন্ম-পল্লীর কথা মনে জাগাইয়া দিয়া মর্ম্ম স্পর্শ করে।

 রাধাকৃষ্ণ-লীলার অধ্যায়ে অধ্যায়ে এইভাবে হাস্য-রসের চাটনির পর্য্যন্ত অধিবেশন হইয়াছে। দানলীলা, নৌ-বিলাস ও মানভঞ্জনের পালায় এই রস একান্ত বাস্তব জগতের সামগ্রী হইয়া দাঁড়াইয়াছে। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, অত্যন্ত প্রগাঢ় ভাবের ক্ষেত্রে ইহাদের জন্ম, সুতরাং তরল হাস্য ও চাপল্যের মধ্যে সময়ে সময়ে উচ্চাঙ্গের ভাবধারার সন্ধান ইহাতে দুর্ল্লভ হয় না—যেরূপ রূপার খনিতে কখনও কখনও সোণা পাওয়া অসম্ভব নহে। রাধার মান ভাঙ্গাইবার জন্য কৃষ্ণ কখনও নাপিত-বধূ, কখনও দোয়াসিনী (যোগিনী), কখনও বনিকিনী, কখনও বা গায়িকার ছদ্মবেশে আসিয়াছেন, সেই সেই দৃশ্যে পাঠক অনেক আমোদ-প্রমোদর কথা পাইবেন। গোবিন্দ দাসের একটি পদ এখানে উদ্ধৃত করিতেছি:—

‘‘গোরথ জাগাই শিঙা ধ্বনি শুনইতে
      জটিলা ভিক্ আনি দেল।
মৌনী যোগেশ্বর মাথা হিলাইত,
      বুঝল ভিক নাহি নেল।

জটিলা কহত তব কাহা তঁহু মাগত,
      যোগী কহ ত বুঝই।
তেরি বধূ হাত ভিক্ হাম লওব,
      তুরিতহি দেহ পঠাই।
পতিবরতা ভিক্ লেই যব যোগী বরত
      না হোয় নাশ,
তাকর বচন শুনইতে তনু পুলকিত
      ধাই কহে বধূ পাশ।
দ্বারে যোগীবর পরম মনোহর,
      জ্ঞানী বুঝিনু অনুমানে।
বহত যতন করি, রতন ধারি ভরি,
      ভিক্ দিহ তছু ঠামে।
শুনি ধনী রাই, ‘আই’ করি উঠল,
      যোগী নিয়ড়ে নাহি যাব।
জটিলা কহত যোগী নহি আনমত,
      দরশনে হয়ব লাভ।
গোধূম চূর্ণ পূর্ণ থারি পর কনক
      কোটরি ভরি ঘিউ।
করজোড়ে রাই, লেহ করি ফুকরই
      হেরি ঘর্‌ ঘর্‌ জীউ।
যোগী কহত হাম, ভিক্ নাহি লওব,
      তুয়া বচন এক চাই।
নন্দ-নন্দন ’পর যো অভিমানসি,
      মাপ করহ ঘরে যাই।
শুনি ধনী রাই চীরে মুখ কাঁপল,
      ভেকধারী নটরাজ।
গোবিন্দ দাস কহ নটবর শেখর
      সাধি চলল নিজ কাজ।”

 এখন যেমন “জয় চৈতন্য নিত্যানন্দ” বলিয়া ভিক্ষা চাওয়া হয়, পূর্ব্বে “গোরক্ষ জাগ” শিঙ্গায় বাজাইয়া নাথ-যোগীরা তেমনই ভিক্ষা চাহিতেন। প্রাতে এই ‘জাগ’ শব্দ উচ্চারণ করিয়া নিদ্রাভঙ্গ করিবার একটা রীতি প্রচলিত ছিল, পক্ষীগুলিকেও এই বুলি আবৃত্তি করিবার জন্য শিক্ষা দেওয়া হইত (“রাই জাগ রাই জাগ শুক-শারী বোলে”—চণ্ডীদাস)। জটিলা ভিক্ষা দিতে গেলে মৌনী যোগীবর মাথা নাড়িয়া বলিলেন, তিনি ভিক্ষা লইবেন না; তাহার কারণ এই, তিনি পতিব্রতার (এখানে অর্থ সধবার) হাতে ভিক্ষা লইবেন, বিধবার হাতে ভিক্ষা লইলে তাঁহার যোগীর ব্রত নাশ হইবে, তোমার বধূকে পাঠাইয়া দেও। এই কথায় জটিলা হৃষ্টা হইল (সাধুকে খুব সদাচারী মনে করিয়া)। পরপুরুষের কাছে ভিক্ষা লইয়া যাইতে হইবে শুনিয়া রাধিকা “আই” করিয়া বলিলেন, ‘ছিঃ, আমি ওর কাছে যাব না।’ জটিলা বলিল—আমি বুঝিয়াছি, যোগী জ্ঞানী ব্যক্তি, তুমি অন্য মত করিও না (দ্বিধাযুক্ত হইও না); ‘ঘর্ ঘর্ জীউ’ অর্থে ভিক্ষা দিতে যাইয়া তাঁহার জীউ (প্রাণ) স্পন্দিত হইতে লাগিল। “শুনি ধনি রাই—নটরাজ”,— রাধিকা এ-কথা শুনিয়া চোখ মিলিয়া চাহিতেই বুঝিলেন, ইনি ভেকধারী (ছদ্মবেশী) কৃষ্ণ, তখন স্বীয় আঁচলে মুখের হাসি ঢাকিলেন। “সাধি চলল নিজ কাজ”—নিজের কাজ সিদ্ধি হইয়াছে অর্থাৎ মানভঞ্জন হইয়াছে বুঝিয়া চলিয়া গেলেন।

 মাঝে মাঝে এই সকল আমোদ-প্রমোদের কথা আমদানী করিয়া লেখকেরা কৃষ্ণ-প্রেমের মধ্যে গূঢ় নাট্যরসের অবতারণা করিয়াছেন।

 ইহা ছাড়া নানা কাব্য-কথায় অলঙ্কৃত হইয়া এই সাহিত্য চিত্তাকর্ষক হইয়াছে। বিদ্যাপতির “নয়ন যে জনু খির ভৃঙ্গ আকার, মধু মাতল কিয়ে উড়ই না পার” (রাধার চক্ষু স্থির ভ্রমরের ন্যায়, যেন মধুভাণ্ডে পড়িয়া ভ্রমরটি আটকাইয়া গিয়াছে—উড়িতে পারিতেছে না)—ভাবাবিষ্ট চক্ষুর কি সুন্দর বর্ণনা! এই কবির “চঞ্চল লোচনে বঙ্ক নেহারণী, অঞ্জন শোভন তায়; জনু ইন্দীবরে পবন ঠেলল অলি-ভরে উলটায়” (কজ্জ্বলযুক্ত চক্ষুর অপাঙ্গ দৃষ্টি—চক্ষের তারা এক কোণে সরিয়া পড়েছে। যেমন ভ্রমর-পদ-পীড়িত নীলোৎপলকে পবনে ঠেলিয়া ফেলিতেছে)। চণ্ডীদাসের“চলে নীল শাড়ী, নিঙাড়ি নিঙাড়ি—পরাণ সহিত মোর”, রায় শেখরের—“তুঙ্গমণি-মন্দিরে বিজলী ঘন সঞ্চরে, মেঘরুচি বসন পরিধানা” প্রভৃতি শত শত পদে অপূর্ব্ব কবিত্ব ফুটিয়াছে। আবার কোন কোন পদে কবিত্বের সঙ্গে অধ্যাত্ম-মহিমা প্রকাশ পাইয়াছে, যেন বনের ফুল দেবতার নৈবেদ্যে স্থান পাইয়াছে। জ্ঞানদাসের—

“রূপ লাগি আখি ঝুরে, গুণে মন ভোর,
প্রতি অঙ্গ লাগিকাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর,
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কাঁদে,
পরাণ পীরিতি লাগি স্থির নাহি বাঁধে।”

কে যেন জোড় ভাঙ্গিয়া বেজোড় করিয়া দিয়াছে, গল্পকথিত গ্রীক দেবতার ন্যায় কে যেন অখণ্ডকে দ্বিখণ্ডিত করিয়া ফেলিয়াছে, সেই দুই খণ্ড পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লাগিবার জন্য বিরহে হাহাকার করিতেছে। জীব যাঁহার অংশ—তাঁহার বিরহে মন ব্যাথাতুর হইয়া আছে। যেরূপ সারাদিন সূর্য্যের মত রশ্মী পৃথিবীতে আসিয়া ছুটাছুটি করে, কিন্তু সন্ধ্যায় সূর্য্যের সঙ্গে মিলিত না হইয়া পৃথিবীর মাটিতে পড়িয়া থাকে না—সেইরূপ জীব তাঁহাকে ছাড়া যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ দশ ইন্দ্রিয় দিয়া হাতড়াইয়া তাহাকে খুঁজিয়া বেড়ায়। শেষে “পরাণ পীরিতি লাগি স্থির নাহি বাঁধে”—তাঁহার প্রেম ছাড়া প্রাণ অস্থির হইয়া উঠে। এইরূপ আর একটি গান আছে, তাহা লোচন দাসের। বঙ্কিমচন্দ্র কমলাকান্তের দপ্তরে তাহার একটা ব্যাখ্যা দিয়াছেন, উহা তাঁহার মত মনস্বী ও সাহিত্য-রস-বোদ্ধার যোগ্য, কিন্তু তাহা ঠিক বৈষ্ণবের মত নহে—

‘‘এস এস বঁধু এস,   আধ আঁচরে ব’স,
  আজি নয়ন ভরিয়া তোমা দেখি।

আমার অনেক দিবসে,   মনের মানসে
  তোমা ধেনে মিলাইল বিধি।
মণি নও মাণিক নও যে   হার করি গলায় পরি,
  ফুল নও যে কেশের করি বেশ।
আমায় নারী না করিত বিধি   তোমা হেন গুণনিধি
  লইয়া ফিরিতাম দেশ দেশ।
তোমায় যখন পড়ে মনে,   আমি চাই বৃন্দাবন পানে,
  এলাইলে কেশ ‍নাহি বাঁধি।
রন্ধন-শালাতে যাই,   তুয়া বঁধু গুণ গাই,
  ধোঁয়ার ছলনা করি কাঁদি।”

 রামানন্দ রায়ের সুবিখ্যাত পদ “সো নহ রমণ, হাম নহ রমণী”টির যে লক্ষ্য—এই গানটি তাঁহারই বিবৃতি। নারী ও পুরুষের যৌন-সম্পর্ক ছাপাইয়া উঠিয়াছে, এই গীতিটি তাহার কামগন্ধহীন প্রেম-গৌরবে। এই যৌন-ভাবই আমার সঙ্গে তোমার মিলনের বাধা। তুমি পুরুষ, আমি নারী,—খুব কাছাকাছি-রূপে মিশিতে পারি না। যদি তাহা না হইয়া তুমি ফুল হইতে, তবে তোমায় মাথায় পরিতাম, মণি-মাণিক্য হইলে গলায় হার করিয়া পরিতাম—লোকনিন্দা আমাগিদকে ছুঁইতে পারিত না। অন্ততঃ আমি রমণী না হইয়া যদি পুরুষ হইতাম, তবে একদণ্ডও তোমাকে সঙ্গছাড়া করিতাম না, “লইয়া ফিরিতাম দেশ দেশ” কেহ নিন্দা করিতে পারিত না।

 এই প্রেমে যৌনভাব আদৌ নাই—কেবল সঙ্গ-সুখের কামনা, বরং বাহিরের স্ত্রী-পুরুষ-রূপভেদ মিলনের বিঘ্ন ঘটাইতেছে! ইহারা এই দেশের লোক—যেখানে স্ত্রী নাই, পুরুষ নাই, আছে শুধু বিশুদ্ধ, লালসালেশহীন প্রেম এবং চিরমিলনের আকাঙ্ক্ষা; দেহটা একটা বাধা মাত্র।

 ইহাই চৈতন্যের অচিন্ত্য ভেদাভেদ। কতকদিন পর্য্যন্ত তিনি পুরুষ আমি নারী—তাঁহার সঙ্গে ভেদ জ্ঞান; কিন্তু পরে সম্পূর্ণ মিলনেচ্ছু প্রাণ নিজের সত্ত্বা লোপ করিয়া তাঁহার সঙ্গে মিশিয়া যাইতে চায়,—তখন “অনুখন মাধব মাধব সোঙরিতে সুন্দরী ভেল মাধাই” (বি-প) কিম্বা “মধুরিপুরহং ইতি ভবেন—শীলা” (জ)। এই গানটিতে সেই অভেদ অবস্থার প্রাক্-সূচনা। “আমার ‍নারী না করিত বিধি” কথায় বুঝা যাইতেছে, নারী তাহার নারীত্বের সমস্ত দাবী ছাড়িয়া দিয়া পুরুষকে চাহিতেছেন! এই কবিতা ভোগের কবিতা নহে, তবে যদি ইহাকে ভোগই বলিতে হয়—তবে বলিব “দেব-ভোগ”।

 বৈষ্ণবেরা প্রেমের জগতে মৃত্যু স্বীকার করেন না। অনেক পদেই দেখা যায়, দশম দশায় রাধা কৃষ্ণের সঙ্গসুখ কামনা করিতেছেন। আসন্ন মৃত্যু, তখনও সখীদিগকে বলিতেছেন, মরিলে আমাকে তমাল ডালে বাঁধিয়া রাখিও (তমালের বর্ণ কৃষ্ণের বর্ণের মত), শ্যামলতা দিয়া বাঁধিও (নামের মিল-হেতু), “আমি হরি-লালসে পরাণ তেজব, তায়ে পাওব আন জনমে”—এইরূপ নানা পদেই দেখা যায়, মৃত্যুর পরও তাহার প্রাণ কৃষ্ণসঙ্গের ইচ্ছা ত্যাগ করিতেছে না; মৃত্যুর পর “আমার এ মৃতদেহ তার চরণেতে দিও ডালি”—এই প্রেম পরমানন্দময়, রাধার মৃত্যুও তাঁহাকে আনন্দপথের যাত্রীস্বরূপ চিত্রিত করিতেছে। আর একটি মাথুরের পদে রাধা বলিতেছেন, “আমার গলায় হার নিকুঞ্জে রহিল, তিনি ফিরিয়া আসিলে যেন একবার ইহা নিজের গলায় পরেন। বড় সাধ করিয়া নিজের হাতে মালতী ফুলের চারা পুঁতিয়াছিলাম, কিন্তু যখন ফুল ফুটিবার সময় হইবে—তখন আর আমি থাকিব না; তোমরা আমার হইয়া মালতী ফুলের মালা গাঁথিয়া তাঁহার গলায় পরাইয়া দিও।” কৃষ্ণকে সেবা করিবার ইচ্ছা ও সঙ্গলিপ্সা মৃত্যু-পথযাত্রীর অন্তিম-দশাকেও আনন্দের পুষ্পে পুষ্পাকীর্ণ করিতেছে। এই সকল পদে রাধা মৃতা ও মৃতপ্রায় নহেন,—অমৃতের অধিকারিণী।

 পূর্ব্বোক্ত পদটি নিম্নে দেওয়া যাইতেছে—

“কহিও কানুরে সই,   কহিও কানুরে,
  পিয়া যেন একবার আইসে ব্রজপুরে।
নিকুঞ্জে রহিল এই   হিয়ার হেম-ছায়,
  পিয়া যেন গলায় পরয়ে একবার।
রোপিনু মল্লিকা,   নিজ করে,
  গাঁথিয়া ফুলের মালা পরাইও তারে।
তরু-ডালে রইল  মোর সাধের শারী-শুকে,
  মোর কথা পিয়া যেন শোনে তাদের মুখে।
এই বনে রহিলি   তোরা যতেক সজনী,
  আমার দুখের দুখী জীবন-সঙ্গিনী।
শ্রীদাম, সুদাম   আদি যত তার সখা,
  তা সবার সাখে তাঁর হবে পুনঃ দেখা।
দুখিনী আছয়ে   তার মাতা যশোমতী
  উঠিতে বসিতে তার নাহিক শকতি।
পিয়া যেন তারে   আসি দেয় দরশন,
  কহিও কানুর পায় এই নিবেদন।
শুনিয়া ব্যাকুল দুতী   চলে মধুপুরে,
  কি কহিবে শেখর বচন নাহি স্ফুরে।”

আর একটি পদে আছে—

‘‘যাঁহা পহুঁ অরুণ চরণে চলি যাত।
তাঁহা তাঁহা ধরণী হইয়ে মঝু গাত।
যো সরোবরে পহুঁ নিতি নিতি গাহ,
হাম ভরি সলিল হইয়ে তছু মাহ।

যো দরপণে পহুঁ নিজ মুখ চাহ,
হাম অঙ্গ জ্যোতি হইএ তছু মাহ।
যে বীজনে পহ বাঁজই গাত,
মঝু অঙ্গ তাহে হইএ মৃদু বাত।
যাঁহা পহুঁ ভরমহি জলধর শ্যাম।
মঝু অঙ্গ গগন হইএ তছু ‍ঠাম।” (গো)

 কানুর সঙ্গে মিলিত হইবার আশা মরণান্তেও তিনি ছাড়েন নাই। মরণের পরেও এই দেহ দিয়াই তাঁহার সেবা করিবেন—ইহাই তাঁহার কামনা। তাঁহার অরুণ পদ যে-পথে হাটিয়া যাইবে, আমার অঙ্গ যেন সেই পথের মাটী হইয়া থাকে। যে-সরোবরে তিনি নিতি নিতি স্নান করেন, আমি যেন তাহার সলিল হইয়া তদঙ্গ স্পর্শ লাভ করি। যে ব্যজনী তাঁহার অঙ্গে বাতাস দেয়, আমি যেন সেই ব্যজনী-সঞ্চালিত মৃদু বায়ু হইয়া তাহার সেবা করি। যে-মুকুরে তিনি তাঁহার মুখ দেখেন, আমি যেন সেই মুকুরের দীপ্তি হইয়া থাকি। যেখানে যেখানে তাঁহার মূর্ত্তি শ্যামল মেঘের মত উদিত হইবে, আমার অঙ্গ যেন সেখানে সেখানে সেই মেঘাবলম্বী আকাশে পরিণত হয়।

 অর্থাৎ আমার দেহের পঞ্চ উপাদান—ক্ষিত্যপতেজমরুদ্ব্যোমে—যেন মৃত্যুর পরেও সেবকের মত তাঁহাকে ভজনা করে!

 এই বৈষ্ণব গানটির অনুকরণে পরবর্ত্তী কালে শাক্ত কবি দাশরথি একটি গান রচনা করিয়াছিলেন, দুই-এর কতকটা এক ভাব, এক সুর।

  ‘‘দুর্গে কর এ দীনের উপায়,
  যেন পায়ে স্থান পায়।
আমার এ দেহ পঞ্চত্ব কালে, তব প্রিয় পঞ্চ স্থলে
  আমার পঞ্চভূত যেন মিশায়।
শ্রীমন্দিরে অন্তর-আকাশ যেন মিশায়, এ মৃত্তিকা যায় যেন তব মৃত্তিকায়,

  মা মোর পবন তব চামর ব্যজনে যেন যায়,
  হোমাগ্নিতে মম অগ্নি যেন মিশায়।
আমার জল যেন যায় পদ্মজলে, যেন তবে যায় বিমলে,
  দাশরথীর জীবন-মরণ দায়।”

 এই গানটিতে বৈষ্ণব আত্ম-সমর্পণের ভাব থাকিলেও, অত্যন্ত দুঃখ, নিবৃত্তি বা মুক্তির ভাব কিছু আছে। বৈষ্ণবেরা আনন্দময়ের খেলার খেঁড়ু হইয়া থাকিতে চান, তাঁহারা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হইতে চান না। কিন্তু দাশরথী জীবন-মরণ—এই দুই হইতেই মুক্তি চাহিতেছেন। বৈষ্ণব যে আনন্দময় পুরুষবরের আনন্দের স্বাদ পাইয়াছেন, সেই পুরুষের সঙ্গ তিনি চিরন্তন কালের জন্য কামনা করেন। শাক্ত কিন্তু—‘যথা জলের বিম্ব জলে বিলয়’ সেই ভাবে আপনাকে ফুরাইয়া ফেলিয়া নিষ্কৃতি প্রার্থনা করেন—এই প্রভেদ।

 গোবিন্দ দাসের আর একটি পদে সেই সুন্দর পুরুষবরের যে রূপ-বর্ণনা আছে, উহার প্রত্যেকটি অক্ষর হইতে কবিত্বের জ্যোতিঃ ফুটিতেছে। যে পদ দিয়া তিনি যান, তাঁহার চরণস্পর্শে সেইস্থলে স্থলপদ্ম ফুটিয়া উঠে। (যাঁহা যাঁহা অরুণ চরণ চলই, তাঁহা তাঁহা খল-কমল খলই)। যেখানে তাঁহার ভ্রভঙ্গিতে চঞ্চল কটাক্ষ খেলিয়া যায়,–“তাঁহা তাঁহা উছলই কালিন্দহিল্লোল”। যেখানে তিনি প্রসন্ন দৃষ্টিতে চান—সেখানে যেন নীলোৎপল ফুটিয়া ওঠে। যেখানে তাঁহার মধুর হাস্য বিকশিকত হয় তাঁহা—“তাঁহা কুন্দকুমুদপরকাশ”।

 বৈষ্ণব কবির মত ভগবানের অপূর্ব্ব রূপ আর কাহার চক্ষে এরূপ ভাবে ধরা পড়িয়াছে! আমরা রাধার পাদ-পদ্মের কথা একবার উল্লেখ করিয়াছি, এই বিষয়ের কবিতাগুলি ভক্তি ও প্রেমে ভরপুর।

 বংশীবদন লিখিয়াছেন—“না যাইও না যাইনা রাই বৈস তরুমূলে, অসিতে পেয়েছ ব্যথা চরণ-কমলে” সেই চরণ-কমলে একটা কুশাঙ্কুর ফুটিলে তাহা কৃষ্ণের প্রাণে শেলের মত বিঁধে।

‘‘সিনান দুপুর সময়ে জানি
তপত পথেতে ঢালে সে পানি’’

 দ্বিপ্রহরে যমুনার সিকতাময় পুলিন রোদে তাতিয়া উঠে, রাধা কি করিয়া সেই উত্তপ্ত বালুকার পথে হাটিয়া স্নান করিতে আসিবেন! এজন্য কৃষ্ণ পূর্ব্ব হইতেই কলসী কলসী জল ঢালিয়া সেই পথ শীতল করিয়া রাখেন। রাধার প্রসাদী তাম্বুল পাইবার আশায় তিনি পথে হাত পাতিয়া থাকেন,

‘‘লাজে হাম যদি মন্দিরে যাই,
পদচিহ্ন তলে লুটে কানাই।
প্রতি পদচিহ্ন চুম্বয়ে কান,
তা দেখি আকুল ব্যাকুল পরাণ।’’

এই পথে কৃষ্ণের অশিষ্টতা দেখিয়া যদি রাধা লজ্জা পাইয়া গৃহে প্রবেশ করেন, তবে কৃষ্ণ সেই পদ-চিহ্নের উপর লুটাইয়া পড়েন এবং প্রতিটি পদ চিহ্ন চুম্বন করেন। ইহা দেখিয়া আমার প্রাণ আকুলি ব্যাকুলি করিতে থাকে।

‘‘সো যদি সিনাই আগিলা ঘাটে, পিছলি ঘাটে সে নায়।
মোর অঙ্গের জল পরশ লাগিয়া যাহ পসারিয়া রয়,
বসনে বসন লাগিবে লাগিয়া, একই রজক দেয়,
আমার নামের একটি আখর পাইলে হরিষে লেয়।
ছায়ায় ছায়ায় লাগিবে লাগিয়া ফিরই কতই পাকে,
আমার অঙ্গের বাতাস যে-দিকে সে-দিন সে-মুখে থাকে।
মনের কাকুতি বেকত করিতে কত না সন্ধান জানে,
পায়ের সেবক রায়-শেখর কিছু কহে অনুমানে।’’

 সম্মুখের ঘাটে রাধা স্নান করিলে, অপর দিকের ঘাটে কৃষ্ণের স্নান করিয়া দুই হাত বাড়াইয়া রাধার স্পর্শ-করা জলের জন্য প্রতীক্ষা করা, তাঁহার ছায়ার সঙ্গে নিজের ছায়া মিলাইবার জন্য ঘোরা-ফেরা, তাঁহার অঙ্গের স্পর্শে যে-কাপড়খানি পবিত্র হইয়া আছে, সেই বস্ত্রের সঙ্গে নিজের পরিধেয়ের একটু ছোঁয়াছুয়ি হওয়ার অপূর্ব্ব সুখের জন্য এক-রজকের নিকট কাপড় দেওয়া, কোন খানে রাধার নামের একটি অক্ষর পাইলে দুর্ল্লভ সামগ্রীর ন্যায় সেটিকে গ্রহণ করা, যে-দিন রাধার অঙ্গস্পৃষ্ট হাওয়া যে-দিকে বহিয়া যায়, সে-দিন সেই বাতাসের স্পর্শ-সুখের জন্য সারাদিন সেই-দিকে থাকা, ইত্যাদি প্রচেষ্টা পূর্ব্বরাগের প্রমত্ত অবস্থাসূচক, রায়শেখর বলিতেছেন—দেখা সাক্ষাৎ নাই, কথা-বার্ত্তার সুযোগ নাই, তথাপি কত প্রকারে যে কৃষ্ণ তাঁহার মনের আগ্রহ ব্যক্ত করেন, কবি তাহার কয়েকটি মাত্র অবস্থার কথা বলিলেন।

 প্রেম এখানে শুধু কবিত্বের উৎস নহে, উহা দিনরাত্রের অপস্যা।

 কৃষ্ণের মথুরা যাওয়ার ফলে রাধা ও সখিগণ মূর্চ্ছাপর। রাধার জীবন-সংশয়—এই কথা শুনিয়া চন্দ্রাবলী রাধার কুঞ্জে আসিলেন, আজ আর হিংসা নাই, ঈর্ষা নাই, ‘সম দুখের দুখিনী’ সকলে। আজ প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিন ফুরাইয়াছে। চন্দ্রা এতদিন ঈর্ষায় রাধার মুখ দেখেন নাই, আজ রাধার রূপ দেখিয়া আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া গেলেন, কিন্তু রাধার এই রূপ বাহিরের রূপ নহে—যে রূপে তিনি কৃষ্ণকে এতটা মুগ্ধ করিয়াছিলেন যে চন্দ্রাবলীর পার্শ্বে থাকিয়াও তিনি ‘রাধা!’ বলিয়া কাঁদিয়া উঠিতেন—ইহা সেই রূপ। যেখানে যেখানে রাধা তাঁহার কৃষ্ণপ্রেমের লীলা দেখাইয়াছেন, সেই সেই খানে চন্দ্রা তাঁহার রূপ আবিষ্কার করিয়াছেন, অন্যত্র নহে—

‘‘সে ধনী আছিল শ্যামেব হিয়ার হার—
বঁধূর হিয়ার হার আছ ধূলায় পড়ি গো—
মরি মরি হরি-বিরহে আজ কি দশা তাঁহার’’

 এখানে কৃষ্ণ তাঁহাকে নিজের গলার হারের ন্যায় মূল্যবান মনে করিতেন, এইজন্যই চন্দ্রাবলীর কাছে রাধার রূপের মূল্য ও তাঁহার জন্য এত আক্ষেপ।

‘‘হায় গো অতুল রাতুল কিবা চরণ দুখানি,
আলতা পরাত বঁধু, কতই বাখানি।
এ কোমল চরণে যখন চলিত হাটিয়া গো—
বঁধুর অনুরাগে গো,
হেন বাঞ্ছা হ’ত যে পাতিরে দেই হিয়ে।’’

 আল্‌তা পরাইবার সময় কৃষ্ণ সেই পদযুগ্মের রূপের কতই না ব্যাখ্যা করিতেন, এইজন্য সেই “অতুল রাতুল চরণ দুখানি” চন্দ্রার কাছে এত সুন্দর এবং যখন এই দুইটি চরণ-কমলে পথে হাটিয়া শ্যাম-দর্শনের জন্য রাধা যাইতেন, তখন চন্দ্রা সেই পথে বুক পাতিয়া রাখিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিতেন—যেন রাধার পায়ে পথের কাঁকর বা কাঁটা না বাজে।

 চন্দ্রাবলী এই যে রাধার নিরুপম রূপ আবিষ্কার করিয়াছিলেন, তাহা বাহিরের রূপ নহে, সে রূপ কৃষ্ণ-প্রেমের মধ্যে। এই রূপের গৌরব করিয়াই রাধা বলিয়াছিলেন— “আমি রূপসী তোমার রূপে” এবং চন্দ্রা বলিয়াছিলেন— “মরি, যে রাধার রূপ বাঞ্ছে শ্রীপাব্বর্তী, যাঁহার সৌভাগ্যশ্রী বাঞ্ছে অরুদ্ধতী”! চন্দ্রা রাধার রূপ দেখিতেছিলেন না, তিনি কৃষ্ণের প্রেমই দেখিতেছিলেন।