পলাশির যুদ্ধ/প্রথম সর্গ

উইকিসংকলন থেকে

পলাশির যুদ্ধ।

প্রথম সর্গ।

মুরসিদাবাদ—জগৎশেঠের মন্ত্রভবন।


দ্বিতীয়-প্রহর নিশি, নীরব অবনী;
নিবিড়-জলদাবৃত গগন-মণ্ডল;
বিদারি আকাশতl,—যেন দুষ্ট ফণী—
খেলিতেছে থেকে থেকে বিজণি চঞ্চল।
দেখিতে বঙ্গের দশা সুর-বালাগণ,
গগন-গবাক্ষ যেন চকিতে খুলিয়া,
অমনি সিরাজ-ভয়ে করিতে বন্ধন
চমকিছে রূপজ্যোতিঃ নয়ন ধাঁধিইয়া।

মুহূর্ত্তেক হাসাইয়া গগন-প্রাঙ্গণ,
সভয়ে চপলা মেঘে পশিছে তখন।


যবনের অত্যাচার করি দরশন,
বিমল হৃদয় পাছে হয় কলুষিত,
ভয়েতে নক্ষত্র-মালা লুকায়ে বদন,
নীরবে ভাবিছে মেঘে হয়ে আচ্ছাদিত।
প্রজার রোদন, রাজ-আমোদের ধ্বনি,
করিয়াছে যাইনির বধির শ্রবণ;
গগন পরশে পাছে ভাসায়ে ধরণী,
এই ভয়ে ঘনঘটা গর্জ্জে ঘন ঘন।
গম্ভীর ঘর্ঘর শব্দে কাঁপিছে অবনী,
দ্বিগুণ ভীষণতরী হতেছে মামিনী।


নীরদ নির্ম্মিত-নীল-চন্দ্রাতপতলে
দাড়াইয়া তরুরাজি, স্থির, অবিচল,—
প্রস্তরে নির্ম্মিত যেন। জাহ্নবীর জলে;
একটি হিল্লোল নাহি করে টলমল।
না বহে সময়-শ্রোত, জাহ্নবীর জল;
প্রকৃতি অচলভাবে আছে দাঁড়াইয়া;

অম্পন্দ অন্তরে যেন স্তব্ধ ধরাতল
শুনিছে, কি মেঘমন্দ্রে ঘন গরজিয়া
বিজ্ঞাপিছে বিধাতার ক্রোধ ভয়ঙ্কর,
কাঁপাইয়া অত্যাচারী পাপীর অন্তর।


ভয়ানক অন্ধকারে ব্যাপ্ত দিগন্তর,
তিমিরে অনন্যকায় শূন্য ধরাতল।
বিনাশিয়া একেবারে বিশ্বচরাচর,
অবিষাদে অন্ধকার বিরাজে কেবল।
কত বিভীষিকা মূর্ত্তি হয় দরশন;—
সমাধি করিয়া যেন বদন ব্যাদান
নির্গত করেছে শব বিকট-দশন,
বারেক খুলিলে নেত্র ভয়ে কাঁপে প্রাণ।
ধরা যেন বোধ হয় প্রকাও শ্মশান,
নাচিছে ডাকিনী করে উলঙ্গ-কৃপাণ।


ধরিয়া বঙ্গের গলা কাল নিশীথিনী,
নীরবে নবাব-ভয়ে করিছে রোদন;
নীরবে কাঁদিছে আহা! বঙ্গবিষাদিনী,
নীহার-নয়নজলে তিতিছে বসন।

নীরব ঝিল্লির রব; স্তব্ধ সমীরণ;
মাতৃবুকে শিশুগণ, দম্পতী শয্যায়,
পতি প্রাণভয়ে, সতী সতীত্বকারণ,
ভাবিছে অনন্যমনে কি হবে উপায়।
বিরামদায়িনী নিদ্রা ছাড়ি বঙ্গালয়
কোথায় গিয়াছে, ডরি নবাব নিদয়।


যেই মুরসিদাবাদ সমস্ত শর্ব্বরী
শোভিত আলোকে, যথা শারদ গগন
খচিত নক্ষত্র-হারে; রজনী সুন্দরী
হাসিত কুসুমদামে রঞ্জিয়া নয়ন;
উথলিত অনিবার আমোদ লহরী;
ভাসিত নগরবাসী, অমক সমান,
শান্তির সাগরে সুখে; সে মহানগরী,
ভাবনা-সাগরে কেন আজি ভাসমান?
যাহার সঙ্গীত স্বরে জাহ্নবী-জীবন
নাচিত উল্লাসে, আজি সে কেন এমন?


পাঠক!
চঞ্চল চপলালোকে চল এক বার,
যাই সুরপুরী-সম শেঠের ভবনে,

ভারতে বিখ্যাত যেন কুবের-ভাণ্ডার;
অচলা কমলা যথা হীরক-আসনে।
যথায় সঙ্গীত-শ্রোত বহে অনিবার
কামিনী-কোমলকণ্ঠে, জিনিয়া সুস্বরে
কোকিল-কাকলী, কিম্বা সুতার সেতার,
বরষি অমৃতধারা শ্রবণ-বিবরে।
অন্ধকারে সাবধানে শঙ্কিত অন্তরে,
চল যাই কি আমোদ দেখি সেই ঘরে।


একি!!
নীরব সেতার, বীণা, মধুর বাশরী!
পাখোয়াজ, মেঘনাদে গর্জ্জে না গভীর!
নৈশ-নীরদের মালা আবাহন করি,
কেহ নাহি গায় মেঘমল্লার গম্ভীর!
নিস্কোষিত-অসি করে দৌবারিকদল,
অন্ধকারে দ্বারে দ্বারে করিছে ভ্রমণ;
একটি কপাট কোথা নাহি অনর্গল,
একটি প্রদীপ কোথা জলে না এখন।
তিমিরে অদৃষ্ঠ গৃহ, প্রাচীর, প্রাঙ্গণ;
বোধ হয় ঠিক্‌ যেন বিরল বিজন।


কেবল কতটী রশ্মি গবাক্ষ বিদারি,
একটী মন্দির হ’তে হইয়া নির্গত,
তমোরাশি মাঝে ক্ষীণ আলোক বিস্তারি
শোভিছে, আকাশ-চু্যত নক্ষত্রের মত।
যেই ক্ষুদ্র পথে রশ্মি হয়েছে নিঃসৃত,
কল্পনে! সে পথে পশি নিভৃত আলমে,
কহ, সর্ব্বপুরী যবে তিমিরে আবৃত,
এই কক্ষে আলো কেন জলে এ সময়ে?
গভীর নিশীথে কিগো বসি কোন জন,
অভীষ্টিত মহামন্ত্র করিছে সাধন?

১০


কি আশ্চর্য্য!
বঙ্গের অদৃষ্ট ন্যস্ত যাহাদের করে,
উজ্জ্বল বঙ্গের মুখ যাদের গৌরবে,
তাঁরা কেন আজি এত বিষন্ন অস্তরে,
নিশীথে নিভৃত স্থানে বসিয়া নীরবে?
সহস্রে বেষ্টিত হয়ে স্বর্ণ সিংহাসনে
বসেন সতত যারা তারা কেন, হায়!
নির্জ্জনে, মলিন মুখে, বিষাদিত মনে,
বসিয়া গম্ভীর ভাবে মজিয়া চিন্তায়?

প্রাচীরে চিত্রিত পটে নৃমুণ্ডমালিনী,
লোল-জিহ্বা অট্টহাসি ভৈরব-ভামিনী।

১১


রাখিয়া দক্ষিণ করে দক্ষিণ কপোল,
বসি অবনত মুখে বীর পঞ্চজন;
বহে কি না বহে শ্বাস, চিন্তায় বিহ্বল,
কুটিল ভাবনাবেশে কুঞ্চিত নয়ন।
অনিমেষ-নেত্রে, কষ্টে, যেন একমনে
পড়িছে বঙ্গের ভাগ্য অঙ্কিত পাষাণে
বিধির অস্পষ্টাক্ষরে; কিম্বা চিত সনে
প্রাণ যেন আরোহিয়া কল্পনা-বিমানে,
সময়ের যবনিকা করি উদঘাটন,
বঙ্গ ভবিষ্যৎ-সিন্ধু করে সস্তরণ।

১২


একটা রমণীমূর্ত্তি বসিয়া নীরবে,
গৌরাঙ্গিণী, লম্ব-গ্রীবা, আকর্ণ-নয়ন,
(শুক-তারা শোভে যেন আকাশের পটে।)
শোভিছে উজলি জ্ঞান-গর্ব্বিত বদন।
আবার পলকে সেই নয়নযুগল,
স্নেহের সলিলে হয় কোমলতাময়;

এই বর্ষিতেছে ক্রোধ-গরিমা-গরল,
অমনি দয়াতে পুনঃ দ্রবীভূত হয়।
বিশ্বব্যাপী সেই দয়া, জাহ্নবী যেমন,
সমস্ত বঙ্গেতে করে সুধা ববিষণ।

১৩


সুস্নিগ্ধ নয়নে ঐ গম্ভীর বদনে,
করতলে বামগণ্ড করিয়া স্থাপন,
ভাবিছে, জানকী যেন অশোক কাননে
আপন উদ্ধার-চিন্তা, বিষাদিত মন।
আবার এ দিকে দেখ, স্বতন্ত্র আসনে
নীববে বসিয়া এক তেজস্বী যবন,
দুরূহ ভাবনা যেন ভাবিতেছে মনে,
শ্বেত শ্মশ্রু-রাশি তাব চুম্বিছে চরণ।
ক্ষণে চাহে শূন্য পানে, ক্ষণে ধরাতল,
সুদীর্ঘ নিশ্বাসে শ্মশ্রু কবে দলমল।

১৪


দেশদেশান্তর হ’তে ইহারা সকল,
সমবেত কেন এই নিভৃত মন্দিবে?
বঙ্গের যে ক’টী তারা নির্ম্মল, উজ্জল,
কি ভাবনা-মেঘে সব ঢেকেছে অচিরে?

সৈরিন্ধ্রীস্বরূপা বঙ্গে, পাপ-কামনায়
করেছে কি অপমান কীচক-যবন?
কেমনে উচিত দণ্ড দিবেন তাহায়,
তাই কি মন্ত্রণা করে ভ্রাতা পঞ্চজন?
অথবা রাজ্যের তরে বিষাদিত মনে,
ভাবিছে কি কৃষ্ণা সহ বসি তপোবনে

১৫


কোন্‌ ব্রতে ব্রতী আজি কে বলিবে হায়?
কি বর মাগিছে সবে শ্যামার চরণে,
সামান্য লোকের মন বলা নাহি যায়,
রাজাদের কি কামনা বলিব কেমনে?
ওই দেখ—
সুদীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ি তুলিয়া বদন,
কষ্টের স্বপন যেন, হলো অপসৃত,
সঙ্গীদের মুখপানে করি নিরীক্ষণ,
কহিতে লাগিল মন্ত্রী নিজ মনোনীত।
পর্ব্বতনির্ঝর হ’তে অবরুদ্ধ নীর,
বহ্নিতে লাগিল যেন, গরজি গম্ভীর।

১৬


“মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র!
অনেক চিন্তার পর করিলাম স্থির,

আমা হ’তে এই কর্ম্ম হবে না সাধন।
আজন্ম যাহার অন্নে বর্দ্ধিত শরীর,
কৃতঘ্নতা-অসি—ধর্ম্মে দিয়া বিসর্জ্জন—
কেমনে ধরিব আহা! বিপক্ষে তাহার?
যেই তরুছায়াতলে জুড়াই জীবন,
কেমনে সে তরুমূল কাটিব আবার?
অথবা নিষ্ঠুর মনে, ভূজঙ্গ যেমন,
কোন্‌ প্রাণে, যে গাভীর করি স্তনপান,
দুগ্ধ বিনিময়ে তাবে করি বিষ দান?

১৭


“কৃতঘ্নতা মহাপাপ! বল না আমায়
যেই করে করে মুখে আহার প্রদান,
কোন্‌ জনে সেই কব কাটিবারে চায়?
কৃতঘ্নহৃদয় আহা নরক সমান!
সমান্য যে উপকারী, তার অপকার
করিলে, পাপেতে আত্মা হয় কলুষিত;
একে রাজদ্রোহী, তাহে মন্ত্রী হয়ে তার,
কেমনে কুমন্ত্রে তার করি বিপরীত?
একে রাজ বিদ্রোহিতা! তাহে অনিশ্চিত
এই পাপ পরিণাম—হিত, বিপরীত!

১৮

“সিংহাসন-চ্যুত করি অভাগা নবাবে,
কোন্‌ অভিসন্ধি বল হইবে সাধন?
লইবে যে রাজদও আপন প্রভাবে,
যমদণ্ড করিলে কে করিবে বারণ?
নাদেরসাহার মত যদি কোন জন,
দিল্লী বিনাশিয়া আসে বঙ্গে বীরভরে,
কেমনে রাখিবে ধন, বাঁচাবে জীবন,
কে বল বাঁধিয়া বুক দাঁড়াবে সমরে?
হরিয়া সর্ব্বস্ব যদি প্রদানে কেবল
বিনিময়ে ভিক্ষাপাত্র, দাসত্ব-শৃঙ্খল?

১৯


“সহজে দুর্ব্বল মোরা চির-পরাধীন।
পঞ্চ শত বৎসরের দাসত্ব জীবন
করিয়ার্ছে বঙ্গদেশ শৌর্য-বীর্য্য হীন,
রক্ষিতে আপন দেশ অশক্ত এখন।
শাসিতে বাঙ্গালা-রাজ্য আপনার বলে
পার যদি, নবাবেরে করিতে দমন,
সাজহ সমরসাজে;—কি কাজ কৌশলে?
নতুবা অধীন থাক এখন যেমন।

রাজপদে, মন্ত্রিপদে, আছি বিরাজিত,
অদৃষ্টকে ধন্যবাদ দাও সমুচিত।

২০


“সিরাজ দুর্দ্দান্ত অতি, নিষ্ঠুর পামর,
মানি আমি। কিন্তু বল বনের শার্দ্দুল
পোষে নাকি? পোষে নাকি কালবিষধর
বুদ্ধির কৌশলে?—তবে কেন হেন ভুল?
ধর্ম্মনীতি, রাজনীতি পাপ-পুণ্যভয়,
সবে মিলি কর যদি হৃদয়ে সঞ্চার,
এই যে অনমনীয় দুষ্প্রবৃত্তিচয়,
হইবে কোমল যেন কুসুমের হার।
শীতল সৌরভরূপে শান্তির বিধান
হইবে সমস্ত বঙ্গে, স্বর্গের সমান।

২১


“নাহি কাজ অতএব পাপ-মন্ত্রণায়;
কি কাজ পাপেতে আত্মা করি কলুষিত!
মজিয়া মোহের ছলে, মাতি দুরাশায়,
কি জানি ঘটাব পাছে হিতে বিপরীত!”
এইরূপে ভবিষ্যত কহি মন্ত্রিবর
নীরবিল। মুহূর্ত্তেক নীরব সকল।

নিরাশ ভাবিয়া মনে যবন পামর,
প্রত্যেকের মুখপানে দেখিছে কেবল।
অমনি জগৎশেঠ তুলিয়া বদন,
বলিতে লাগিল দর্পে সজীব বচন।

২২


“মন্ত্রিবর!
সাধু কি বাঙ্গালী মোরা চির-পরাধীন?
সাধে কি বিদেশী আসি দলি পদভরে
কেড়ে লয় সিংহাসন? করে প্রতিদিন
অপমান শত শত চক্ষের উপরে?
স্বর্গ মর্ত্ত্য করে যদি স্থান-বিনিময়,
তথাপি বাঙ্গালী নাহি হবে এক-মত;
প্রতিজ্ঞায় কল্পতরু, সাহসে দুর্জয়!
কার্য্যকালে খোজে সবে নিজ নিজ পথ।
যে দিন মামুদ ঘোরি আসে সিন্ধুপার,
সেই দিন হ’তে দেখ দৃষ্টান্ত অপার।

২৩


“কুি আশ্চর্য্য! মন্ত্রীর যে এই অভিপ্রায়
হবে আজি, এই ভাব হবে অকস্মাৎ!!
একটী কণ্টক কভু ফুটেনি যে পায়,
সে কেন না হাসিবেক দেখি শেলাঘাত?

বিদরে হৃদয় যার সে করে রোদন।
যেখানে অস্ত্রের লেখা ব্যথাও তথায়।
ফলতঃ মন্ত্রীর এই বঙ্গ-সিংহাসন,
এই সব মন্ত্রণায় তাঁহার কি দায়?
যাহার হৃদয়ে শেল, সে জানে কেমন,
পরের কেবলমাত্র লৌকিক রোদন।

২৪


“কি বলিব মন্ত্রিবর! বিদরে হৃদয়
বলিতে সে সব কথা। তপ্তলোষ্ট্র-সম
ধমনীতে রক্ত-স্রোত প্রবাহিত হয়।
প্রতি কেশরন্ধ্রে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ-নির্গম
হয় বিদ্যুতের বেগে। কি বলিব আর,
বেগমের বেশে পাপী পশি অন্তঃপুরে,
নিরমল কুল মম—প্রতিভা যাহার
মধ্যাহ্ন-ভাস্কর-সম, ভূভারত যুড়ে
প্রজ্বলিত,—সেই কুলে দুষ্ট দুরাচার
করিয়াছে কলঙ্কের কালিমা-সঞ্চার।

২৫


“শেঠের বংশের হায়! ঐশ্বর্য্যের কথা
সমস্ত ভারতে রাষ্ট্র প্রবাদের মত।

জগৎশেঠের নাম বঙ্গে যথা তথা
লক্ষমুদ্রা-সমকক্ষ। জাহ্নবীর মত
শত মুখে বাণিজ্যের স্রোতে অনিবার
ঢালিছে সম্পদ-রাশি সমুদ্র-ভাণ্ডারে।
আপনি নবাব যিনি, (অন্য কোন্‌ ছার!)
ঋণপাশে বাঁধা সদা যাহার দুয়ারে।
কিন্তু অপমানে হায়! ফেটে যায় বুক,
সে জগৎশেঠ আজ অবনত-মুখ।

২৬


“কিন্তু এ প্রতিজ্ঞা মম,—সমস্ত পৃথিবী
সিবাজদ্দৌলার যদি হয় অনুকুল,
অথবা (মানুষ ছার, তুচ্ছ ক্ষীণজীবী!)
করেন অভয়দান যদি দেবকুল,
তথাপি—তথাপি এই কলঙ্কের কালী
সিরাজদ্দৌলার রক্তে ধুইব নিশ্চয়।
যা থাকে কপালে, আর যা করেন কালী,
কঠিন পাষাণে দেখ বেঁধেছি হৃদয়।
সম্ভব, হইবে লুপ্ত শারদ চন্দ্রিমা,
অসম্ভব, হ’বে লুপ্ত শেঠের গরিমা।

২৭


“যেই প্রতিহিংসা-অগ্নি—ভীম দাবানল—
জ্বলিছে হৃদয়ে মম, প্রতিজ্ঞা আমার
সিরাজদ্দৌলার তপ্ত শোণিত তরল
নিবাইবে সে অনল। কি বলিব আর,
সাধিতে প্রতিজ্ঞা যদি হয় প্রয়োজন,
উপাড়িব এক নভো-নক্ষত্রমণ্ডল,
সুমেরু সিন্ধুর জলে দিব বিসর্জ্জন,
লইব ইন্দ্রের বজ্র পাতি বক্ষঃস্থল।
যদি পাপিষ্ঠের থাকে সহস্র পরাণ,
সহস্র হলেও তবু নাহি পরিত্রাণ।

২৮


“বঙ্গমাতা-উদ্ধারের পস্থা সুবিস্তার,
রয়েছে সম্মুখে ছায়াপথের মতন;
হও অগ্রসর, নহে করি পরিহার,
জঘন্য দাসত্ব-পথে কর বিচরণ।
আমি এ কলঙ্ক ডালি লইয়া মাথায়,
দেখাব না মুখ পুনঃ স্বজাতি-সমাজে;
সঁপেছি জীবন মম এই প্রতিজ্ঞায়,
কথায় যা বলিলাম দেখাইব কাজে।

প্রতিহিংসা-প্রতিহিংসা—প্রতিহিংসা সার,
প্রতিহিংসা বিনে মম কিছু নাই আর!”

২৯


নীরবিলা শেঠ-শ্রেষ্ঠ। অরুণ-লোচনে
হতেছিল যেন অগ্নি-স্ফুলিঙ্গ নির্গত।
অধর রক্তাক্তপ্রায় দশন-দংশনে;
মুষ্টিবদ্ধ কুরদ্বয়। “স্বপনের মত”—
বলিলেন রাজা রাজবল্লভ তখন,
“বোধ হয় পাপিষ্ঠের অত্যাচার মত;
নর-প্রকৃতিতে নাহি সস্তুবে কখন।
মনুষ্য-হৃদয় নহে পাপাসক্ত এত।
এই অল্প দিনে, দেহ হয় রোমাঞ্চিত,
কি পাপে না বঙ্গভূমি হ’লো কলুষিত।

৩০


“ক্রমে পাপলিপ্সা-স্রোত হ’তেছে বিস্তার।
এই দুর্নিবার নদী, কে বলিতে পারে,
কোথা হবে পরিণত? কিছুদিন আর,
সতীত্ব-রতন এই বঙ্গের ভাণ্ডারে
থাকিবে না,—থাকিবে ন কুলশীলমান
বঙ্গবাসীদের হায়! এখনো সবার

অনিশ্চিত ভয়ে, ত্রাসে, কণ্ঠাগত প্রাণ।
সীমা হ’তে সীমান্তরে এই বাঙ্গালার,
উঠিতেছে হাহাকার, ভাবে প্রজাগণ
কেমনে রাখিবে ধন, রাখিবে জীবন।

৩১


“যে যন্ত্রণা দুরাচার দিতেছে আমায়
জানেন সকলে, আমি কি বলিব আর?
যে অবধি সিংহাসনে বসিয়াছে, হায়!
সে অবধি বিষদৃষ্টি উপরে আমার।
প্রিয় পুত্র কৃষ্ণদাস সহ পরিবার
হইয়াছে দেশান্তর; ইংরেজ বণিক
আশ্রয় না দিত যদি, কি দশা আমার
হ’তো এত দিনে! মম প্রাণের অধিক
পত্নীপুত্র-বিরহেতে হয়েছি এখন,
নিদাঘে পল্লব-শূন্য তরুর মতন।

৪২


“কলিকাতা-জয়কালে—কাঁপে কলেবর
অন্ধকূপ-অত্যাচার করিলে স্মরণ;
কেশরাশি কণ্টকিত হয় শিরোপর,
শঙ্কিত শজারুপৃষ্ঠ-কণ্টক যেমন!—

কলিকাতা-জয়-কালে, যদিও পামর
পেয়ে গ্রাসে ছাড়িয়াছে পুত্র কৃষ্ণদাস,
যে দিন হইবে পাপী নির্ভয় অন্তর,
সে দিন আমার হ’বে সবংশে বিনাশ।
বিপদে বেষ্টিত ব’লে মনে বড় ভয়,
আপাততঃ তাই প্রাণ রেখেছে নির্দ্দয়।

৩৩


“এই ত কলির সন্ধ্যা; প্রগাঢ় তিমিরে
এখনো বঙ্গের মুখ হয়নি আবৃত।
এখনো রয়েছে আলো আশার মন্দিরে,
নয়ন না পালটিতে হবে অন্তর্হিত।
এই রজনীতে যথা ঘন জলধরে
অবিচ্ছিন্ন ব্যাপিয়াছে গগনমণ্ডল,
এইরূপে চিন্তা-মেঘ, ভীম বেশ ধ’রে,
ঢাকিবে সমস্ত রাজ্য। দৌরাত্ম্য কেবল
গভীর জলদনাদে করিবে গর্জ্ঞন;—
কার সাধ্য সেই ঝড় করিবে বারণ?

৩৪


“এই কালে এত বিষ!-পূর্ণকলেবর
হবে যবে এ ভুজঙ্গ, না জানি তখন

হ’বে কিবা ভয়ঙ্কর তীব্র বিষধর।
নাশিবে নিশ্বাসে কত মানব-জীবন!
সকালে সকালে যদি না কর বিনাশ,
কিম্বা বিষদম্ভ নাহি হয় উৎপাটন,
কিছু পরে কার সাধ্য সহিবে নিশ্বাস,
বঙ্গসিংহাসন হ’তে ঘুচাবে বেষ্টন?
নিমীলিত নেত্রে থাকা আর শ্রেয় নয়;
সিংহাসনচ্যুত হবে কিসে দুরাশয়,

৩৫


“চিন্ত সদুপায়। মম এই অভিপ্রায়—
সহৃদয় ইংরেজের লইয়া আশ্রয়
রাজ্যভ্রষ্ট করি এই দুরন্ত যুবায়,
(কত দিনে বিধি বঙ্গে হইবে সদয়!)
সৈন্যধ্যক্ষ সাধু মিরজাফরের করে
সমর্পি এ রাজ্যভার। তা হ’লে নিশ্চয়
নিদ্রা যাবে বঙ্গবাসী নির্ভয় অন্তরে;
হইবে সমস্ত রাজ্য শাস্তি-সুধাময়!”
নীরবিলা নৃপমণি, উঠিল কাঁপিয়া
দুরু দুরু করি মিরজাফরের হিয়া।



৩৬


আরম্ভিলা কৃষ্ণচন্দ্র, ধরণী-ঈশ্বর’,
সম্বোধিয়া ধীরে রাজনগর-ঈশ্বরে
সসন্ত্রমে,—“যা কহিলা সত্য, নৃপবর!
কার সাধ্য অণুমাত্র অস্বীকার করে?
যে করে সে মূঢ়! ভেবে দেখ মনে
শার্দ্দুল-কবল-গত কিম্বা নাগপাশে
বদ্ধ যেই জন হায়! ভীষণ বেষ্টনে,
নিরাপদ, বসি যেন আপনার বাসে,
ভাবে সে যদ্যপি মনে, তবে এ সংসারে
ততোধিক মূর্খ আর বলিব কাহারে?

৩৭


“একে ত অদুরদর্শী নৃশংস যুবক,—
আজন্ম বর্দ্ধিত পাপে। হিংসা অহঙ্কার
অলঙ্কার তার। তাহে পথপ্রদর্শক
হয়েছে ইতরমনা যত কুলাঙ্গার,
নীচাশয়। ইহাদের পরামর্শে, হায়!
ফলিছে বঙ্গের ভাগ্যে যে বিষম ফল,
বলিতে বিদরে বুক; যথায় তথায়
হাহাকার-ধ্বনি রাজ্যে উঠিছে কেবল।

নাচে অত্যাচার, করে উলঙ্গ কৃপাণ;
সুন্দর বাঙ্গালা-রাজ্য হয়েছে শ্মশান।

৩৮


“সেই দিন মহারাষ্ট্র বিপ্লবে বিশেষ
এ দেশ উপর্য্যুপরি হয়েছে প্লাবিত।
যথা এই দস্যুদল করেছে প্রবেশ
ভীম রোষে, দাবানলরূপে আচম্বিত,
অগ্নিতে, অসিতে, অপরহণে সে দেশ
হইয়াছে মরুভূমি। সত্রাসে কৃষক
বিষাদে বিজন বনে করেছে প্রবেশ,
না ডরি শার্দ্দূলে, সিংহে; কুরঙ্গ-শাবক
অদূরে শুনিয়া ব্যাধ বন-নিপীড়ন,
সভয়ে যেমতি পশে নিবিড় কানন!

৩৯


“ইহাদের দুরবস্থা করিতে মোচন,
কি যত্ন না করিয়াছে স্বর্গীয় নবাব
বীরশ্রেষ্ঠ আলিবদ্ধি, সমরে শমন,
শিবিরে অপক্ষপাতী, অমায়িক ভাব!
জীবনের অবসানে, তথাপি উজ্জল
ছিল ভস্ম-আচ্ছাদিত বহ্নির মতন;

প্রভায় সমস্ত বঙ্গ ছিল সমুজ্জল।
ছিল যেই সিংহাসনে, ইন্দ্রের মতন
পরাক্রমে পরস্তপ, এতাদৃশ শুর,
এখন বসেছে এক ঘৃণিত কুক্কুর।

৪০


“বিরাজিত বঙ্গেশ্বর বিচিত্র সভায়!
কামিনী:কোমল-কোল রত্নসিংহাসন!
রাজদণ্ড সুরাপাত্র, যাহার প্রভায়
নবাব-নয়নে নিত্য ঘোরে ত্রিভুবন।
সুগোল মৃণালভূজ উত্তরীয় স্থলে
শোভিতেছে অংসোপরে; শুনিছে শ্রবণ
বামাকণ্ঠ-প্রেমালাপ মন্ত্রণার ছলে।
রমণীর সুশীতল রূপের কিরণ
আলোকিছে সভাস্থল; নৃপতি-সদন
সঙ্গীতে গাইছে অর্থী মনের বেদন।

৪১


“কিন্তু কি করিবে সখে! বিধাতা বিমুখ
অভাগিনী বঙ্গপ্রতি। বলিতে না পারি
লিখেছেন বিধি হায়! কত যে কি দুঃখ
কপালে তাহার—চির-অভাগিনী নারী!

সেনকুল-কুলাঙ্গার, গৌড়-অধিপতি,
সপ্তদশ অশ্বারোহী তুরকের ডরে,
কি কুলগ্নে কাপুরুষ বৃদ্ধ নরপতি
তেয়াগিল সিংহাসন সত্রাস অস্তবে!
সেই দিন হ’তে যেই দাসত্ব-শৃঙ্খল
প’ড়েছে বঙ্গের গলে, আর্যসুত-বল

৪২


“আর কি পরিবে তারে কবিতে খণ্ডন?
জানেন ভবিতব্যতা! কিম্বা এ শৃঙ্খল
জেতৃভেদে কতবাব হইবে নূতন
কে বলিবে। কে বলিতে পাবে রণস্থল
পাণিপথে কত বার হবে পরীক্ষিত
ভাবত-অদৃষ্ট হায! গিয়াছে পাঠান;
গতপ্রায মোগলেরা; কিন্তু শৃঙ্খলিত
আছে এক ভাবে যত ভারত সস্তান
সার্দ্ধ পঞ্চশত-বর্ষ! না জানি কখন
ভারত-দাসত্ব বিধি করিবে মোচন!

৪৩


“কিন্তু কি কবিবে, হায়! জিজ্ঞাসি আবার
কি করিবে? সেই দিন করিয়া মন্ত্রণা,

বরিলাম পূর্ণিয়ার পাপী দুরাচার,
বুঝিতে না পারি পাপ-আশার ছলনা।
কিন্তু পরিণামে হায় লভিছু কি ফল?
সুরামত্ত, কামাসক্ত, পড়িল সংগ্রামে,
যেমতি পড়িল ক্রৌঞ্চমিথুন দুর্ব্বল
ব্যাধকবি বাল্মীকির ব্যাধ-বিদ্ধবাণে।
নবাবের ঘোর কোপে পড়িয়া সকলে
না জানি পাইনু রক্ষা কোন্‌ পুণ্যফলে।

৪৪


“কিন্তু তাহা ভাবি মনে, এ শর-শয্যায়
কেমনে থাকিব বল? দিবস যামিনী
থাকি সশঙ্কিত, ধন-প্রাণ-আশঙ্কায়;
দুঃখে দিবা, অনিদ্রায় কাটি নিশীথিনী।
ভূত-ভয়ে ভীত জন ঘোর অন্ধকারে
স্বীয় পদ-শব্দে যথা হয় সত্রাসিত,
আমরা তেমন মৃদু পবনসঞ্চারে
ভাবি শমনের ডাক, হই রোমাঞ্চিত!
অগ্নিতে নির্ভয় কভু সম্ভবে কি তার,
জতুগৃহে জ্ঞাতসারে বসতি যাহার?



৪৫


“অতএব ইংরেজেরে করিয়া সহায়,
রাজ্যচ্যুত করি এই দুরন্ত পামরে—
যবন-কুলের গ্লানি!—মম অভিপ্রায়,
বসাইতে সৈন্যাধ্যক্ষে সিংহাসনোপরে।
অন্ধকূপ-অত্যাচার প্রতিবিধানিতে
এসেছে ব্রিটিশ-সিংহ—বীর-অবতার।
উদ্ধারিয়া কলিকাতা পশিল হুগ্রীতে
দ্রুত-ইরম্মদ-বেগে; সৈন্য-পারাবার
নবাবের বিনাশিয়া ভাতিল অম্বরে
শিশির ভেদিয়া সূর্য্য হুগ্রীর সমরে।

৪৬


“অসম সাহসে পশি, অভয় হৃদয়ে
বিলোড়িয়া নবাবের সৈন্যেরর সাগর,
তুলেছিল যেই ঝড়, দাঁতে তৃণ লয়ে
সভয়ে সিরাজদ্দৌলা ত্যজিল সমর।
দেখিতে দেখিতে পুনঃ ফরাশি ইংরাজ
মিলিল আহবে ঘোর; গঙ্গা-তীরে, নীরে,
জ্বলিল সমরানল ধরি ভীম সাজ;
ভরে ভীতা ভাগীরথী বহিলেক ধীরে।

নবম দিবস পরে নভঃ আলো ক'রে,
উঠিল ব্রিটিশ-ধ্বজা চন্দননগরে।

৪৭


“ফরাশির সম যোদ্ধা নাহি ভূ-ভারতে”
বঙ্গদেশে একবাক্যে বলিত সকলে।
সে ফরাশি-যশোরবি সেই দিন হ’তে
ক্লাইবের কটাক্ষেতে গেছে অস্তাচলে।
বিশেষ তাহার সনে বঙ্গ-সেনাপতি,
স্বীয় সৈন্ত যদি যুদ্ধে করেন মিলন,
—প্রভঞ্জনসহ সিন্ধু দুর্নিবার-গতি,—
পাবক-সহায় হ’বে প্রবল পবন।
মুহূর্ত্তে ক্লাইব যুদ্ধে হ’লে সম্মুখীন,
উড়াইবে তৃণবৎ যুবা অর্ব্বাচীন।”

৪৮


এ যুক্তিতে সমবেত সভ্য যত জন,
কিছু তর্ক পরে, সবে হ’লেন সন্মত।
বললেন কৃষ্ণচন্দ্র ফিরায়ে নয়ন,—
“জানিতে বাসনা করি রাণীর কি মত?”
যবনিকা-অন্তরালে চিত্রার্পিত প্রায়,
বসিয়া রমণীমূর্ত্তি; অস্পন্দ-শরীর;

নাহি বহিতেছে যেন ধমনী-শাখায়
রক্তস্রোত; শূন্য দৃষ্টি, দুনয়ন স্থির।
এইরূপে বঙ্গমাত বসি শূন্যমনে,
‘রাণীর কি মত?’—প্রশ্ন শুনিলা স্বপনে।
‘রাণীর কি মত? গুনি সুপ্তোখিত প্রায়,
বলিতে লাগিলা রাণী ভবানী তখন,—
“আমার কি মত, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়!
শুনিতে বাসনা যদি, বলিব এখন।
যেই কাল রঙ্গে সবে চিত্রিলে নবাবে,
জানি আমি এই চিত্র অতি ভয়ঙ্কর;
যতই বিকৃত কেন নিকৃষ্ট স্বভাবে
কর চিত্র, ততোধিক পাপাত্মা পামর।
রে বিধাতঃ! কোন্‌ জন্মে করেছি কি পাপ?
কোন্‌ দোষে সহে বঙ্গ এত মনস্তাপ?

৫০


“সহজে অবলা আমি দুর্ব্বল-হৃদয়,
নৃপবর! কি বলিব? কিন্তু—এ চক্রান্ত
কৃষ্ণনগরাধিপের উপযুক্ত নয়।
কেন মহারাজ এত হইলেন ভ্রান্ত?
কাপুরুষ-যোগ্য এই হীন মন্ত্রণায়

কেমনে দিলেন সায় একবাক্যে সব,
বুঝিতে না পারি আমি; না বুঝিনু, হায়!
ভবাদৃশ বীরগণ, বীরবংশোদ্ভব—
কেমনে হীন মন্ত্রে উত্তেজিত,
আমি ষে অবলা নারী, আমার ঘৃণিত।

৫১


“লক্ষ্মণস্লেনের সেই কাপুরুষতায়
সহি এত ক্লেশ। তবে জানিলে কেমনে
তোমাদের ঘৃণাম্পদ এই মন্ত্রণায়
ফলিবে কি ফল পরে? ভেবে দেখ মনে,
সেনাপতি সিংহাসনে বসিবেন যবে,
তিনি যদি এতাধিক হন অত্যাচারী,—
ইংরাজ সহায় তাঁর,—কি করিবে তবে?
এ পাণ্ডিত্য আমি নারী বুঝিতে না পারি।
বঙ্গভাগ্যে এ বীরত্বে ফলিবে তখন
দাসত্বের বিনিময়ে দাসত্বস্থাপন।

৫২


“মহারাজ! একবার মানস-নয়নে
ভারতের চারিদিকে কর দরশন!
মোগল-গৌরব-রবি, আরঙ্গ জিব সনে

অস্তমিত; নহে দুর দিল্লীর পতন।
শুনিয়াছি দাক্ষিণাত্যে ফরাশি-বিক্রম
হতবল, মহাবল ক্লাইবের করে।
বঙ্গদেশে এই দশা—ব্রিটিশ-কেতন
উড়িছে ফরাশি দুর্গে হাসিয়া অম্বরে।
ক্ষুব্ধসিংহ প্রতিদ্বন্দ্বী যুথপতি-বরে
আক্রমিবে কোন মতে, বসিয়া কিবরে

৫৩


“চিন্তে মনে মনে যথা, ক্লাইব তেমতি
আক্রমিতে বঙ্গেশ্বরে ভাবিছে সুযোগ।
তাহাতে তোমরা যদি সহ সেনাপতি
বর তাঁরে, তবে তাঁর প্রতাপ অমোঘ
হইবে অপ্রতিহত। যে ভীম অনল
জ্বলিবে সমস্ত বঙ্গে, পতঙ্গের মত
পোড়াবে নবাবে; মিরজাফরের বল
কি সাধ্য নিবাবে তারে? হবে পরিণত
দাবানলে; না পারিবে এই ভীমানল,
সমস্ত জাহ্নবীজল করিতে শীতল।

৫৪


“বঙ্গদেশ তুচ্ছকথা; সমস্ত ভারতে
ব্রিটিশের তেজোরাশি, বল, অতঃপর

কে পরিবে নিবারিতে? কে পারে জগতে
নিবারিতে সিন্ধুচ্ছ্বাস, ঝঙ্কা ভয়ঙ্কর?
আছে মহারাষ্ট্রীয়েরা, বিক্রমে যাহার
মোগল-সাম্রাজ্য কেন্দ্র পর্য্যস্ত কম্পিত,
দস্যুব্যবসায়ী তারা, হবে ছারখার
ব্রিটিশের রণদক্ষ সৈনিক সহিত
সম্মুখ সমরে। যেই শশী তারাগণে
জিনি শোভে, হততেজ ভানুর কিরণে

৫৫


“যেইরূপে যবনেরা ক্রমে হতবল
হইতেছে দিন দিন, অদৃশ্যে বসিয়া
যেরূপে বিধাতা ক্রমে ঘুরাতেছে কল
ভারত-অদৃষ্ট যন্ত্রে, দেখিয়া শুনিয়া
কার চিত্ত হয় নাই আশায় পূরিত?
দাক্ষিণাত্যে যেইরূপ মহারাষ্ট্র-পতি
হ’তেছে বিক্রমশালী, কিছু দিন আর,
মহারাষ্ট্র-পতি হ’তে ভারত ভূপতি।
অচিরে হইবে পুনঃ ভারত-উদ্ধার।
সার্দ্ধপঞ্চশত দীর্ঘ বৎসরের পরে
আসিবে ভারত নিজ সন্তানের করে।

৫৬

“বিষম বিকল্প স্থানে আছি দাঁড়াইয়।
আমরা, অদূরে রাজ-বিপ্লৱ দুর্ব্বার।
নাহি কাজ অদৃষ্টের সিন্ধু সাঁতারিয়া,
ভাসি স্রোতোধীন, দেখি বিধি বিধাতার।
কেন মিছে খাল কেটে আনিবে কুমীরে?
প্রদানিবে স্বীয় হস্তে স্বগৃহুে অনল?
বরিয়া ক্লাইবে, খড়গ নবারের শিরে
প্রহারি চক্রাস্তবলে, লভিবে কি ফল?
ঘুচিবে কি অত্যাচার, বল নৃপবর!
অধীনতা, অত্যাচার নিত্য সহচর।

৫৭


“জ্ঞানহীন নারী আমি, তবু মহারাজ!
দেখিতেছি দিব্য চক্ষে, সিরাজদ্দৌলায়
করি রাজ্যচ্যুত, শাস্ত হবে না ইংরাজ।
বরঞ্চ হুইরে মত্ত রাজ্য-পিপাসায়।
যেই শক্তি টলাইবে বঙ্গ-সিংহাসন,
থামিবে না এইখানে; হয়ে উগ্রতর,
শোণিতের স্বাদে মত্ত শার্দ্দুল যেমন,
প্রবেশিবে মহারাষ্ট্র সৈন্যের ভিতর।

হ’বে রণ ভারতের অদৃষ্টের তরে,
পরিণাম ভেবে মম শরীর শিহরে।

৫৮


“জানি আমি যবনের ইংরাজের মত
ভিন্নজাতি; তবু ভেদ আকাশ পাতাল।
যবন ভারতবর্ষে আছে অবিরত
সার্দ্ধপঞ্চশ্বত বর্ষ। এই দীর্ঘকাল
একত্রে বসতি হেতু, হয়ে বিদূরিত
জেতা জিত বিষভাব, আর্য্যসুত সনে
হইয়াছে পরিণয় প্রণয় স্থাপিত;
নাহি বৃথা দ্বন্দ্ব জাতি-ধর্ম্মের কারণে।
অশ্বথ-পাদপ-জাত উপবৃক্ষ মত,
হইয়াছে যবনেরা প্রায় পরিণত।

৫৯


“বিশেষ তাদের এই পতন-সময়;
কি পাতশাহ, কি নবাব, আমাদের করে
পুতুলের মত; খুঁজে খোঁজ নাহি হয়,
কে কোথায় ভাসিতেছে আমোদ-সাগরে।
আমাদের করে রাজ্য-শাসনের ভার।
কিবা সৈন্য, রাজকোষ, রাজমন্ত্রণায়,

কোথায় না হিন্দুদের আছে অধিকার?
সমরে, শিবিরে, হিন্দু প্রধান সহায়।
অচিরে যবন-রাজ্য টলিবে নিশ্চয়;
উপস্থিত ভারতেব উদ্ধার সময়।

৬০


“অন্ততরে-ইংরাজেরা নব্য পরিচিত;
ইহাদের রীতি নীতি আচার বিচার
অণুমাত্র নাহি জানি। না জানি নিশ্চিত
কোথায় বসতি, দুব সমুদ্রের পাব।
বানর-ঔরসে জন্ম রাক্ষসী-উদরে—
এই মাত্র কিম্বদন্তী; আকারে, আচারে,
ভয়ানক অসাদৃশ্য। বাণিজ্যের তরে
আসিয়া ভারতে এবে রাজ্যের বিস্তাব
করিতেছে চারি দিকে; দুর্দ্দান্ত প্রভাবে
কাঁপায়েছে বীরশ্রেষ্ঠ স্বর্গীয নবাবে।

৬১


“বুদ্ধ আলিবর্দ্দিব সে ভবিষ্যদবাণী
ভুলেছ কি মহারাজ? যদি কোন জন
ইংরাজের তেজোরাশি করিবাবে গ্লানি
যোগাত মন্ত্রণা, বৃদ্ধ বলিত তখন—

‘স্থলে জ্বলিয়াছে যেই সমর-অনল
না পারি নিবা’তে আমি; তাহাতে আবার
প্রজ্বলিত হয় যদি সমুদ্রের জল,
কে বল এ বঙ্গদেশ করিবে নিস্তার?’
এই সংস্কার তাঁর ছিল চিরদিন,
অচিরে ভারত হবে ব্রিটিশ-অধীন।

৬২


“বাণিজ্যের ব্যবসায়ে, নবাব-ছায়ায়,
এতই প্রভাব যার, ভেবে দেখ মনে,
নবাব অবর্তমানে, এই বাঙ্গালায়
কে আঁটিবে তার সনে বীর-পরাক্রমে?
মেঘাবৃত রবি যদি এত তপ্ত, হায়!
মেঘমুক্ত হবে কিবা তেজস্বী বিপুল!
স্বাধীনতা-আশালতা, মুকুলিত প্রায়
ভারত-হৃদয়ে যাহা, হইবে নির্ম্মূল
প্রভাবে তাহার; নাহি জানি অতঃপর
কি আছে ভারত-ভাগ্যে —একি ভয়ঙ্কর!”

৬৩


কড় কড় মহাশব্দে বিদারি গগন,
জিনি শত সিংহনাদ, সহস্র কামান,

অদূরে পড়িল বজ্র, ধাঁধিয়া নয়ন।
গরজিল ঘন, ধরা হ’ল কম্পমান।
সেই ভীম মন্দ্র, রাণী ভবানীর কাণে
প্রবেশিল; বলিলেন—“একি ভয়ঙ্কর!
ওই শুন, মহারাজ! বসিয়া বিমানে
কহিছেন স্বরীশ্বর দেব পুরন্দর—
“দুঃখিনী ভারত ভাগ্যে”—অভ্রান্ত ভাষায়—
“লিখেছেন বজ্রাঘাত ভবিতব্যতায়।”

৬৪


“অতএব মহারাজ! এই মন্ত্রণায়
নাহি কাজ; ষড়যন্ত্রে নাহি প্রয়োজন।
শীতলিতে নিদাঘের আতপ-জ্বালায়
অনল-শিখায় পশে কোন্‌ মূঢ় জন?
‘রাণীর কি মত?’—শুন আমার কি মত;—
ইন্দ্রিয়-লালসা-মত্ত সিরাজদ্দৌলায়
রাজ্যচ্যুত করা নহে আমার অমত,
(আহা! কিন্তু অভাগার কি হবে উপায়।)
নিশ্চয় প্রকৃত রোগ হয়েছে নির্ণয়,
কিন্তু এ ব্যবস্থা মম মনোমত নয়।

৬৫

“আমার কি মত? তবে শুন মহারাজ!
অসহ্য দাসত্ব যদি, নিস্কোষিয়া আসি,
সাজিয়া সমর-সাজে নৃপতি-সমাজ
প্রবেশ সম্মুখরণে; যেন পুর্ণ শশী,
বঙ্গ-স্বাধীনতা-ধ্বজা বঙ্গের আকাশে
শত বৎসরের ঘোর অমাবস্যা পরে
হাসুক উজলি বঙ্গ। এই অভিলাষে
কোন্‌ বঙ্গবাসি-রক্ত ধমনী-ভিতরে
নাহি হয় উষ্ণতর? আমি যে রমণী,
বহিছে বিদ্যুৎ-বেগে আমার ধমনী।

৬৬


“ইচ্ছা করে এই দণ্ডে ভীমা অসি করে,
নাচিতে চামুণ্ডারূপে সমর ভিতর।
পরদুঃখে সদা মম হৃদয় বিদরে,
সহি কিসে মাতৃদুঃখ? সত্য শেঠবর
বঙ্গমাতা উদ্ধারের পন্থা সুবিস্তার
রয়েছে সম্মুখে ছায়াপথের মতন;
হও অগ্রসর, নহে করি পরিহার,
জঘন্য দাসত্ব-পথে কর বিচরণ।

প্রগল্‌ভতা মহারাজ! ক্ষম অবলার,
ভয়ে ভীত যদি, আমি দেখাব—আবার!”

৬৭


আবার ভীষণ নাদে অশনি-পতন;
আবার জীমূতবৃন্দ গর্জ্জিল ঘর্ঘরে;
বহিল ভীষণ-বেগে ভীম প্রভঞ্জন;
দূর হ’তে হুঙ্কারিয়া মহাক্রোধ-ভরে
বারিধারা রণক্ষেত্রে করিল প্রবেশ;
উঠিল তুমুল ঝড় ঝট্‌কায় ঝট্‌কায়
কাঁপাইয়া অট্টালিকা তরু-নির্ব্বিশেষ,
রণাহত মহীরুহ উপাড়ি ধরায়;
ছুটিল বিদ্যুৎ-বেগে ঝলসি নয়ন,
আলোকিয় মুহুর্মুহুঃ প্রকৃতি ভীষণ।

প্রথম সর্গ সমাপ্ত।