বিষয়বস্তুতে চলুন

পল্লী-সমাজ/অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে
১৮

 কারাপ্রাচীরের বাহিরেই যে তাহার সমস্ত দুঃখ ভগবান্‌ এমন করিয়া সার্থক করিয়া দিবার আয়োজন করিয়া রাখিয়াছিলেন, ইহা বোধ করি রমেশের উন্মত্ত-বিকারেও আশা করা তাহার পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। ছয়মাস সশ্রম অবরোধের পর মুক্তিলাভ করিয়া সে জেলের বাহিরে পা দিয়াই দেখিল, অচিন্তনীয় ব্যাপার! স্বয়ং বেণী ঘোষাল মাথায় চাদর জড়াইয়া সর্ব্বাগ্রে দণ্ডায়মান! তাঁহার পশ্চাতে উভয় বিদ্যালয়ের মাষ্টার, পণ্ডিত ও ছাত্রের দল, কয়েকজন হিন্দু-মুসলমান প্রজা। বেণী সজোরে আলিঙ্গন করিয়া কাঁদ কাঁদ গলায় কহিল,—“রমেশ, ভাই রে, নাড়ীর টান যে এমন টান এবার তা’ টের পেয়েছি। যদু মুখুয্যের মেয়ে যে আচায্যি হারামজাদাকে হাত ক’রে, এমন শত্রুতা ক’র্‌বে, লজ্জা সরমের মাথা

খেয়ে নিজে এসে মিথ্যে-সাক্ষী দিয়ে এত দুঃখ দেবে, সে কথা জেনেও যে আমি তখন জান্‌তে চাইনি, ভগবান্‌ তার শাস্তি আমাকে ভালমতেই দিয়েছেন। জেলের মধ্যে তুই বরং ছিলি ভাল রমেশ, বাইরে এই ছ’টা মাস আমি যে তুষের আগুনে জ্বলে-পুড়ে গেছি!” রমেশ কি করিবে, কি বলিবে, ভাবিয়া না পাইয়া হতবুদ্ধি হইয়া চাহিয়া রহিল। হেডমাষ্টার পাড়ুইমশাই একেবারে ভূলুণ্ঠিত হইয়া রমেশের পায়ের ধূলা মাথায় লইলেন। তাহার পিছনের দলটি তখন অগ্রসর হইয়া কেহ আশীর্ব্বাদ, কেহ সেলাম, কেহ প্রণাম করিবার ঘটায় সমস্ত পথটা যেন চষিয়া ফেলিতে লাগিল। বেণীর কান্না আর মানা মানিল না। অশ্রুগদ্‌গদকণ্ঠে কহিল,—“দাদার ওপর অভিমান রাখিস্‌নে, ভাই বাড়ী চল্‌। মা কেঁদে কেঁদে দু’চক্ষু অন্ধ কর্‌বার যোগাড় করেচেন!” ঘোড়ার গাড়ী দাঁড়াইয়াছিল; রমেশ বিনাবাক্যব্যয়ে তাহাতে চড়িয়া বসিল। বেণী সম্মুখের আসনে স্থানগ্রহণ করিয়া মাথার চাদর খুলিয়া ফেলিল। ঘা শুকাইয়া গেলেও আঘাতের চিহ্ন জাজ্বল্যমান। রমেশ আশ্চর্য্য হইয়া কহিল,—“ও কি বড়দা’?” বেণী একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া ডান হাত উলটাইয়া কহিল,—“কাকে আর দোষ দেব ভাই, এ আমার নিজেরই কর্ম্মফল—আমারই পাপের শাস্তি! কিন্তু, সে আর শুনে কি হবে?” বলিয়া মুখের উপর গভীর বেদনার আভাস ফুটাইয়া চুপ করিয়া রহিল। তাহার নিজের মুখের এই সরল স্বীকারোক্তিতে রমেশের চিত্ত আর্দ্র হইয়া গেল। সে মনে করিল, কিছু একটা হইয়াছেই। তাই, সে কথা শুনিবার জন্য আর পীড়াপীড়ি করিল না। কিন্তু, বেণী যে জন্য এই ভূমিকাটি করিল, তাহা ফাঁসিয়া যাইতেছে দেখিয়া সে নিজেই মনে মনে ছট্‌ফট্‌ করিতে লাগিল। মিনিট দুই নিঃশব্দে কাটার পরে, সে আবার একটা নিঃশ্বাসের দ্বারা রমেশের মনোযোগ আকর্ষণ করিয়া ধীরে ধীরে কহিল,—“আমার এই একটা জন্মগত দোষ যে, কিছুতেই মনে এক, মুখে আর কর্‌তে পারিনে। মনের ভাব আর পাঁচজনের মত ঢেকে রাখ্‌তে পারিনি বলে কত শাস্তিই যে, ভোগ কর্‌তে হয়, কিন্তু, তবু ত আমার চৈতন্য হল না!” রমেশ চুপ করিয়া শুনিতেছে দেখিয়া, বেণী কণ্ঠস্বর আরও মৃদু ও গম্ভীর করিয়া কহিতে লাগিল,—“আমার দোষের মধ্যে সে দিন মনের কষ্ট আর চাপ্‌তে না পেরে কাঁদ্‌তে কাঁদ্‌তে বলে ফেলেছিলাম, রমা, আমরা তোর এমন কি অপরাধ করেছিলাম যে, এই সর্ব্বনাশ আমাদের কর্‌লি! জেল হয়েছে শুন্‌লে যে মা একেবারে প্রাণ-বিসর্জ্জন কর্‌বেন! আমরা ভায়ে ভায়ে বিষয় নিয়ে ঝগড়া করি—যা’ করি, কিন্তু, তবু ত সে আমার ভাই! তুই একটি আঘাতে আমার ভাইকে মার্‌লি, মাকে মার্‌লি! কিন্তু, নির্দ্দোষীর ভগবান্‌ আছেন।” বলিয়া সে গাড়ীর বাহিরে আকাশের পানে চাহিয়া আর একবার যেন নালিশ জানাইল। রমেশ যদিও এ অভিযোগে যোগ দিল না, কিন্তু মন দিয়া শুনিতে লাগিল। বেণী একটু থামিয়া কহিল, —“রমেশ, রমার সে উগ্রমূর্ত্তি মনে হ’লে এখনো হৃৎকম্প হয়, দাঁতে দাঁত ঘ’ষে বল্‌লে, ‘রমেশের বাপ আমার বাবাকে জেলে দিতে যায় নি? পার্‌লে ছেড়ে দিত বুঝি?” মেয়েমানুষের এত দর্প আর সহ্য হল না রমেশ। আমিও রেগে ব’লে ফেললাম, “আচ্ছা ফিরে আসুক সে, তার পরে এর বিচার হবে!” এতক্ষণ পর্য্যন্ত রমেশ বেণীর কথাগুলা মনের মধ্যে ঠিকমত গ্রহণ করিতে পারিতেছিল না। কবে তাহার পিতা রমার পিতাকে জেলে দিবার আয়োজন করিয়াছিলেন, তাহা সে জানে না, কিন্ত ঠিক এই কথাটিই সে দেশে পা-দিয়াই রমার মাসীর মুখে শুনিয়াছিল, তাহা তাহার মনে পড়িল। তখন পরের ঘটনা শুনিবার জন্য সে উৎকর্ণ হইয়া উঠিল। বেণী তাহা লক্ষ্য করিয়া কহিল,—“খুন করা তার অভ্যাস আছে ত! আকবর লেঠেলকে পাঠিয়েছিল, মনে নেই? কিন্তু, তোমার কাছে ত চালাকি খাটেনি,—বরঞ্চ তুমিই উলটে শিখিয়ে দিয়েছিলে। কিন্তু, আমাকে দেখ্‌চ ত? এই ক্ষীণজীবী—” বলিয়া বেণী একটুখানি চিন্তা করিয়া লইয়া, তুষ্টু কলুর ছেলের কল্পিত বিবরণ নিজের অন্ধকার অন্তরের ভিতর হইতে বাহির করিয়া, আপনার ভাষা দিয়া একটু একটু গ্রথিত করিয়া বিবৃত করিল। রমেশ রুদ্ধনিশ্বাসে কহিল,—“তার পর?” বেণী মলিনমুখে একটুখানি হাসিয়া কহিল,—“তার পরে কি আর মনে আছে ভাই! কে, কিসে ক’রে যে আমাকে হাঁসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, সেখানে কি হ’ল, কে দেখ্‌লে কিছুই জানিনে। দশদিন পরে জ্ঞান হ’য়ে দেখ্‌লাম, হাঁসপাতালে প’ড়ে আছি। এ যাত্রা যে রক্ষে পেয়েচি সে কেবল মায়ের পুণ্যে—এমন মা কি আর আছে রমেশ! রমেশ একটি কথাও কহিতে পারিল না, কাঠের মূর্ত্তির মত শক্ত হইয়া বসিয়া রহিল। শুধু কেবল তাহার দুই হাতের দশ অঙ্গুলি জড় হইয়া বজ্রকঠিন মুঠায় পরিণত হইল। তাহার মাথায় ক্রোধ ও ঘৃণার যে ভীষণ বহ্নি জ্বলিতে লাগিল, তাহার পরিমাণ করিবারও তাহার সাধ্য রহিল না। বেণী যে কত মন্দ, তাহা সে জানিত। তাহার অসাধ্য যে কিছুই নাই, ইহাও তাহার অপরিজ্ঞাত ছিল না। কিন্তু, সংসারে কোনো মানুষই যে এত অসত্য এমন অসঙ্কোচে, এরূপ অনর্গল উচ্চারণ করিয়া যাইতে পারে, তাহা কল্পনা করিবার মত অভিজ্ঞতা তাহার ছিল না। তাই, সে রমার সমস্ত অপরাধই সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিল।

 সে দেশে ফিরিয়া আসায় গ্রামময় যেন একটা উৎসব বাধিয়া গেল। প্রতিদিন সকালে, দুপুরে এবং রাত্রি পর্য্যন্ত এত জনসমাগম, এত কথা, এত আত্মীয়তার ছড়াছড়ি পড়িয়া গেল যে, কারাবাসের যেটুকু গ্লানি তাহার মনের মধ্যে অবশিষ্ট ছিল দেখিতে দেখিতে তাহা উড়িয়া গেল। তাহার অবর্ত্তমানে গ্রামের মধ্যে যে খুব বড় একটা সামাজিক স্রোত ফিরিয়া গিয়াছে, তাহাতে কোন সংশয় নাই; কিন্তু এই কয়টা মাসের মধ্যেই এত বড় পরিবর্ত্তন কেমন করিয়া সম্ভব হইল, ভাবিতে গিয়া তাহার চোখে পড়িল, বেণীর প্রতিকূলতায় যে শক্তি পদে পদে প্রতিহত হইয়া কাজ করিতে পারিতেছিল না, অথচ সঞ্চিত হইতেছিল, তাহাই এখন তাহারি অনুকূলতায় দ্বিগুণ বেগে প্রবাহিত হইয়াছে। বেণীকে সে আজ আরও একটু ভাল করিয়া চিনিল। এই লোকটাকে এরূপ অনিষ্টকারী জানিয়াও সমস্ত গ্রামের লোক যে, তাহার কতদূর বাধ্য, তাহা আজ যেমন সে দেখিতে পাইল, এমন কোন দিন নয়। ইহারই বিরোধ হইতে পরিত্রাণ পাইয়া রমেশ মনে মনে হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। শুধু তাই নয়। রমেশের উপর অন্যায় অত্যাচারের জন্য গ্রামের সকলেই মর্ম্মাহত, সেকথা একে-একে সবাই তাহাকে জানাইয়া গিয়াছে। ইহাদের সমবেত-সহানুভূতি লাভ করিয়া, এবং বেণীকে স্বপক্ষে পাইয়া, আনন্দ, উৎসাহে হৃদয় তাহার বিস্ফারিত হইয়া উঠিল। ছয়মাস পূর্ব্বে যে সকল কাজ আরম্ভ করিয়াই তাহাকে ত্যাগ করিয়া যাইতে হইয়াছিল, আবার পূরাদ্যমে তাহাতে লাগিয়া পড়িবে সঙ্কল্প করিয়া রমেশ কিছু দিনের জন্য নিজেও এই সকল আমোদ-আহ্লাদে গা ঢালিয়া দিয়া, সর্ব্বত্র, ছোট-বড় সকল বাড়ীতে, সকলের কাছে, সকল বিষয়ের খোঁজখবর লইয়া সময় কাটাইতে লাগিল। শুধু একটা বিষয় হইতে সে সর্ব্বপ্রযত্নে নিজেকে পৃথক্‌ করিয়া রাখিতেছিল—তাহা রমার প্রসঙ্গ। সে পীড়িতা, তাহা পথেই শুনিয়াছিল; কিন্তু, সে পীড়া যে এখন কোথায় উপস্থিত হইয়াছিল,—তাহার কোন সংবাদ গ্রহণ করিতে চাহে নাই। তাহার সমস্ত সম্বন্ধ হইতে আপনাকে সে চিরদিনের মত বিচ্ছিন্ন করিয়া লইয়াছে, ইহাই তাহার ধারণা। গ্রামে আসিয়াই মুখে মুখে শুনিয়াছিল, শুধু একা রমাই যে তাহার সমস্ত দুঃখের মূল, তাহা সবাই জানে। সুতরাং এইখানে বেণী যে মিথ্যা কথা কহে নাই, তাহাতে আর তাহার সন্দেহ রহিল না। দিন পাঁচছয় পরে বেণী আসিয়া রমেশকে চাপিয়া ধরিল। পীরপুরের একটা বড় বিষয়ের অংশ-বিভাগ লইয়া বহুদিন হইতে রমার সহিত তাহার প্রচ্ছন্ন মনোবিবাদ ছিল। এই সুযোগে সেটা হস্তগত করিয়া লওয়া তাহার উদ্দেশ্য। বেণী বাহিরে যাহাই বলুক, সে মনে মনে রমাকে ভয় করিত। এখন সে শয্যাগত, মামলা-মোকদ্দমা করিতে পারিবে না; উপরন্তু তাহাদের মুসলমান প্রজারাও রমেশের কথা ঠেলিতে পারিবে না। পরে যাই হোক্‌, আপাততঃ বেদখল করিবার এমন অবসর আর মিলিবে না, বলিয়া সে একেবারে জিদ্‌ ধরিয়া বসিল। রমেশ আশ্চর্য্য হইয়া অস্বীকার করিতেই বেণী বহু প্রকারের যুক্তিপ্রয়োগ করিয়া শেষে কহিল,—“হবে না কেন? বাগে পেয়ে সে কবে তোমাকে রেয়াৎ করেচে যে, তার অসুখের কথা তুমি ভাব্‌তে যাচ্চ? তোমাকে যখন সে জেলে দিয়েছিল, তখন তোমার অসুখই বা কোন্ কম ছিল ভাই!” কথাটা সত্য। রমেশ অস্বীকার করিতে পারিল না। তবু, কেন যে তাহার মন কিছুতেই তাহার বিপক্ষতা করিতে চাহিল না, বেণীর সহস্র কটু উত্তেজনা সত্ত্বেও রমার অসহায়, পীড়িত অবস্থা মনে করিতেই তাহার সমস্ত বিরুদ্ধশক্তি সঙ্কুচিত হইয়া বিন্দুবৎ হইয়া গেল, তাহার সুস্পষ্ট হেতু সে নিজেও খুঁজিয়া পাইল না! রমেশ চুপ করিয়া রহিল। বেণী, কাজ হইতেছে জানিলে, ধৈর্য্য ধরিতে জানে। সে তখনকার মত আর পীড়াপীড়ি না করিয়া, চলিয়া গেল।

 এবার আর একটা জিনিস রমেশের বড় দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল। বিশ্বেশ্বরীর কোন দিনই সংসারে যে বিশেষ আসক্তি ছিল না, তাহা সে পূর্ব্বেও জানিত, কিন্তু এবার ফিরিয়া আসিয়া সেই অনাসক্তিটা যেন বিতৃষ্ণায় পরিণত হইয়াছে বলিয়া তাহার মনে হইতেছিল। কারাগার হইতে অব্যাহতি লাভ করিয়া বেণীর সমভিব্যাহারে যে দিন সে গৃহে প্রবেশ করিয়াছিল, সে দিন বিশ্বেশ্বরী আনন্দ-প্রকাশ করিয়াছিলেন, সজল-কণ্ঠে বারংবার অসংখ্য আশীর্ব্বাদ করিয়াছিলেন, তথাপি কি-যেন-একটা তাহাতে ছিল, যাহাতে সে ব্যথাই পাইয়াছিল। আজ হঠাৎ কথায় কথায় শুনিল,—বিশ্বেশ্বরী কাশী-বাস সঙ্কল্প করিয়া যাত্রা করিতেছেন, আর ফিরিবেন না। শুনিয়া সে চমকিয়া গেল। কৈ, সে ত কিছুই জানে না! নানাকাজে পাঁচছয় দিনের মধ্যে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই; কিন্তু, যে দিন হইয়াছিল, সে দিন ত তিনি কোন কথা বলেন নাই। যদিচ সে জানিত, তিনি নিজে হইতে আপনার বা পরের কথা আলোচনা করিতে কোন দিন ভালবাসেন না, কিন্তু, আজকের সংবাদটার সহিত সে দিনের স্মৃতিটা পাশাপাশি চোখের সাম্‌নে তুলিয়া ধরিবামাত্র তাঁহার এই একান্ত বৈরাগ্যের অর্থ দেখিতে পাইল। আর তাহার লেশমাত্র সংশয় রহিল না, জ্যাঠাইমা সত্যই বিদায় লইতেছেন! এ যে কি, তাঁহার অবিদ্যমানতা যে কি অভাব, মনে করিতেই তাহার দুই চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল। আর মুহূর্ত্ত বিলম্ব না করিয়া সে এ বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। বেলা তখন ন’টা দশটা। ঘরে ঢুকিতে গিয়া দাসী জানাইল, তিনি মুখুয্যে-বাড়ী গেছেন। রমেশ আশ্চর্য্য হইয়া প্রশ্ন করিল,—“এমন অসময় যে?”

 এ দাসীটি বহুদিনের পুরাণো। সে মৃদু হাসিয়া কহিল,—“মা’র আবার সময় অসময়! তা’ ছাড়া আজ তাঁদের ছোটবাবুর পৈতে কি না।” যতীনের উপনয়ন? রমেশ আরও আশ্চর্য্য হইয়া কহিল,—“কৈ, এ কথা ত কেউ জানে না!” দাসী কহিল,—“তাঁরা কাউকে বলেননি। বল্‌লেও ত কেউ গিয়ে খাবে না—রমাদিদিকে কর্ত্তারা সব ‘একঘরে’ ক’রে রেখেছেন কি না!” রমেশের বিস্ময়ের অবধি রহিল না। সে একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া, কারণ জিজ্ঞাসা করিতেই, দাসী সলজ্জে ঘাড়টা ফিরাইয়া বলিল,—“কি জানি ছোটবাবু—রমাদিদির কি সব বিশ্রী অখ্যাতি বেরিয়েচে কি না—আমরা গরীব-দুঃখী মানুষ, সে সব জানিনে ছোটবাবু—” বলিতে বলিতে সে সরিয়া পড়িল।

 কিছুক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া রমেশ গৃহে ফিরিয়া আসিল। এ যে বেণীর ক্রুদ্ধ প্রতিশোধ, তাহা জিজ্ঞাসা না করিয়াও সে বুঝিল। কিন্তু, ক্রোধ কি জন্য, এবং কিসের প্রতিহিংসা কামনা করিয়া সে কোন্‌ বিশেষ কদর্য্য ধারায় রমার অখ্যাতিকে প্রবাহিত করিয়া দিয়াছে, এ সকল ঠিকমত অনুমান করাও তাহার দ্বারা সম্ভবপর ছিল না।