বিষয়বস্তুতে চলুন

পল্লী-সমাজ/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

১২

 ছেলেবেলায় একদিন রমেশ রমাকে ভালবাসিয়াছিল। নিতান্ত ছেলেমানুষি ভালবাসা, তাহাতে সন্দেহ নাই; কিন্তু সে যে কত গভীর, তাহা তারকেশ্বরে সে প্রথম অনুভব করিতে পারিয়াছিল। এবং আরও কত গভীর, সেইদিন সব চেয়ে বেশী টের পাইয়াছিল, যে দিন সন্ধ্যার অন্ধকারে রমার সমস্ত সম্বন্ধ সে একেবারে ভূমিসাৎ করিয়া দিয়া চলিয়া আসিয়াছিল। তৎপরে সেই নিদারুণ রাত্রির ঘটনার পর হইতে রমার দিক্‌টাই একেবারে রমেশের কাছে মহামরুর ন্যায় শূন্য ধূ ধূ করিতেছিল। কিন্তু, সে যে তাহার সমস্ত কাজ-কর্ম্ম, শোয়া-বসা, এমন কি চিন্তা, অধ্যয়ন পর্য্যন্ত এমন বিস্বাদ করিয়া দিবে, তাহা রমেশ কল্পনাও করে নাই। তাহাতে গৃহ-বিচ্ছেদ এবং সর্ব্বব্যাপী অনাত্মীয়তায় প্রাণ যখন তাহার এক মূহুর্ত্তও আর গ্রামের মধ্যে তিষ্ঠিতে চাহিতেছিল না, তখন নিম্নলিখিত ঘটনায় সে আর একবার সোজা হইয়া বসিল।

 খালের ওপারে পিরপুর গ্রামেই তাহাদেরই জমিদারী। এখানে মুসলমানের সংখ্যাই অধিক। একদিন তাহারা দল বাঁধিয়া, রমেশের কাছে উপস্থিত হইল; এই বলিয়া নালিশ জানাইল যে, যদিচ তাহারা তাঁহাদেরই প্রজা, অথচ তাহাদের ছেলেপিলেকে মুসলমান বলিয়া গ্রামের স্কুলে ভর্ত্তি হইতে দেওয়া হয় না। কয়েকবার চেষ্টা করিয়া তাহারা বিফলমনোরথ হইয়াছে, মাষ্টার মহাশয়রা কোন মতেই তাহাদের ছেলেদের গ্রহণ করেন না। রমেশ বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হইয়া কহিল,—“এমন অন্যায় অত্যাচার ত কখনও শুনি নাই? তোমাদের ছেলেদের আজই লইয়া আইস; আমি নিজে দাঁড়াইয়া থাকিয়া ভর্ত্তি করিয়া দিব।” তাহারা কহিল,—“যদিচ, তাহারা প্রজা বটে, কিন্তু, খাজনা দিয়াই জমি ভোগ করে। সে জন্য হিঁদুর মত জমিদারকে তাহারা ভয় করে না; কিন্তু, এ ক্ষেত্রে বিবাদ করিয়াও লাভ নাই। কারণ ইহাতে বিবাদই হইবে, যথার্থ উপকার কিছুই হইবে না। বরঞ্চ, তাহারা নিজেদের মধ্যে একটা ছোট রকমের ইস্কুল করিতে ইচ্ছা করে, এবং ছোটবাবু একটু সাহায্য করিলেই হয়। কলহ বিবাদে রমেশ নিজেও ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল, সুতরাং ইহাকে আর বাড়াইয়া না তুলিয়া, ইহাদের পরামর্শ সুযুক্তি বিবেচনা করিয়া, সায় দিল এবং তখন হইতে এই নতুন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিতেই ব্যাপৃত হইল। ইহাদের সম্পর্কে আসিয়া রমেশ শুধু যে নিজেকে সুস্থ বোধ করিল, তাহা নহে, এই একটা বৎসর ধরিয়া তাহার যত বলক্ষয় হইয়াছিল, তাহা ধীরে ধীরে যেন ভরিয়া আসিতে লাগিল। রমেশ দেখিল, কুঁয়াপুরের হিন্দু প্রতিবেশীর মত ইহারা প্রতিকথায় বিবাদ করে না; করিলেও তাহারা প্রতিহাত এক নম্বর রুজু করিয়া দিবার জন্য সদরে ছুটিয়া যায় না। বরঞ্চ মুরুব্বিদের বিচারফলই, সন্তষ্ট অসন্তষ্ট যে ভাবেই হোক্‌, গ্রহণ করিতে চেষ্টা করে। বিশেষতঃ বিপদের দিনে পরস্পরের সাহায্যার্থে এরূপ সর্ব্বান্তঃকরণে অগ্রহর হইয়া আসিতে, রমেশ ভদ্র, অভদ্র, কোন হিন্দু গ্রামবাসীকেই দেখে নাই।

 একে ত জাতিভেদের উপর রমেশের কোনদিনই আস্থা ছিল না, তাহাতে এই দুই গ্রামের অবস্থা পাশাপাশি তুলনা করিয়া তাহার অশ্রদ্ধা শতগুণে বাড়িয়া গেল। সে স্থির করিল, হিন্দুদিগের মধ্যে ধর্ম্ম ও সামাজিক অসমতাই এই হিংসাদ্বেষের কারণ। অথচ, মুসলমানমাত্রই ধর্ম্মসম্বন্ধে পরস্পর সমান, তাই একতার বন্ধন ইহাদের মত হিন্দুদের নাই এবং হইতেও পারে না। আর জাতিভেদ নিবারণ করিবার কোন উপায় যখন নাই, এমন কি, ইহার প্রসঙ্গ উত্থাপন করাও যখন পল্লীগ্রামে একরূপ অসম্ভব, তখন কলহবিবাদের লাঘব করিয়া সখ্য ও প্রীতি সংস্থাপনে প্রয়াস করাই পণ্ডশ্রম। সুতরাং এই কয়টা বৎসর ধরিয়া সে নিজের গ্রামের জন্য যে বৃথা চেষ্টা করিয়া মরিয়াছিল, সে জন্য তাহার অত্যন্ত অনুশোচনা বোধ হইতে লাগিল। তাহার নিশ্চয় প্রতীতি হইল, ইহারা এম্‌নি খাওয়া-খায়ি করিয়াই চিরদিন কাটাইয়াছে, এবং, এমনি করিয়াই চিরদিন কাটাইতে বাধ্য। ইহাদের ভালো কোন দিন কোনমতেই হইতে পারে না! কিন্তু, কথাটা পাকা করিয়া লওয়া ত চাই। নানা কারণে অনেক দিন হইতে তাহার জ্যাঠাইমার সঙ্গে দেখা হয় নাই। সেই মারামারির পর হইতে কতকটা ইচ্ছা করিয়াই সে সেদিকে যায় নাই। আজ ভোরে উঠিয়া সে একেবারে তাঁর ঘরের দোরগোড়ায় আসিয়া দাঁড়াইল। জ্যাঠাইমার বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার উপর তাহার এমনি বিশ্বাস ছিল যে, সে কথা তিনি নিজেও জানিতেন না। রমেশ একটুখানি আশ্চর্য্য হইয়াই দেখিল, জ্যাঠাইমা এত প্রত্যূষেই স্নান করিয়া প্রস্তুত হইয়া সেই অস্পষ্ট আলোকে ঘরের মেঝের বসিয়া, চোখে চস্‌মা আঁটিয়া, একখানি বই পড়িতেছেন। তিনিও বিস্মিত কম হইলেন না। বইখানি বন্ধ করিয়া তাঁহাকে আদর করিয়া ঘরে ডাকিয়া বসাইলেন এবং মুখ পানে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,—“এত সকালেই যে রে?” রমেশ কহিল,—“অনেক দিন তোমাকে দেখ্‌তে পাইনি জ্যাঠাইমা। আমি পিরপুরে একটা ইস্কুল কর্‌চি।” বিশ্বেশ্বরী বলিলেন,—“শুনেচি। কিন্তু, আমাদের ইস্কুলে আর পড়াতে যাস্‌নে কেন বল্‌ত?” রমেশ কহিল,—“সেই কথাই বল্‌তে এসেচি জ্যাঠাইমা! এদের মঙ্গলের চেষ্টা করা শুধু পণ্ডশ্রম। যারা কেউ কারো ভাল দেখ্‌তে পারে না, অভিমান অহঙ্কার যাদের এত বেশী, তাদের মধ্যে খেটে মরায় লাভ কিছুই নেই, শুধু, মাঝ্‌থেকে নিজেরই শত্রু বেড়ে ওঠে। বরং, যাদের মঙ্গলের চেষ্টায় সত্যকার মঙ্গল হবে, আমি সেখানেই পরিশ্রম করব!” জ্যাঠাইমা কহিলেন—“একথা ত নতুন নয় রমেশ! পৃথিবীতে ভাল করবার ভার যে কেউ নিজের ওপর নিয়েচে, চিরদিনই তাঁর শত্রু সংখ্যা বেড়ে উঠেচে। সেই ভয়ে যারা পেছিয়ে দাঁড়ায়, তুইও তাহাদের দলে গিয়ে যদি মিশিস্‌, তা হ’লে ত চল্‌বে না বাবা! এ গুরুভার ভগবান্‌ তোকেই বইতে দিয়েচেন, তোকেই ব’য়ে বেড়াতে হবে। কিন্তু, হাঁরে, রমেশ, তুই নাকি ওদের হাতে জল খাস?” রমেশ হাসিয়া কহিল,—“এই দ্যাখ জ্যাঠাইমা, এর মধ্যেই তোমার কাণে উঠেচে। এখনো খাইনি বটে, কিন্তু, খেতে ত আমি কোন দোষ দেখিনে। আমি তোমাদের জাতিভেদ মানিনে।” জ্যাঠাইমা আশ্চর্য্য হইয়া প্রশ্ন করিলেন,—“মানিস্‌নে কিরে? এ কি মিছে কথা, না, জাতিভেদ নেই যে, তুই মান্‌বিনে?” রমেশ কহিল,—“ঠিক ওই কথাটাই জিজ্ঞাসা কর্‌তে আজ তোমার কাছে এসেছিলাম জ্যাঠাইমা! জাতিভেদ আছে, তা’ মানি, কিন্তু, একে ভাল ব’লে মানিনে?”

 “কেন?”

 রমেশ হঠাৎ উত্তেজিত হইয়া কহিল,—“কেন, সে কি তোমাকে বল্‌তে হবে? এর থেকেই যত মনমালিন্য, যত বাদাবাদি, এ কি তোমার জানা নেই? সমাজে যাকে ছোটজাত ক’রে রাখা হয়েচে, সে যে বড়কে হিংসা কর্‌বে, এই ছোট হয়ে থাকার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ক’রে এর থেকে মুক্ত হ’তে চাইবে, সে ত খুব স্বাভাবিক। হিন্দুরা সংগ্রহ করতে চায় না, জানে না—জানে শুধু অপচয় কর্‌তে। নিজেকে এবং নিজের জাতকে রক্ষা কর্‌বার এবং বাড়িয়ে তোল্‌বার যে একটা সংসারিক নিয়ম আছে, আমরা তাকে স্বীকার করি না বলেই প্রতিদিন ক্ষয় পেয়ে যাচ্চি। এই যে মানুষ-গণনা করার একটা নিয়ম আছে, তার ফলাফলটা যদি পড়ে দেখ্‌তে জ্যাঠাইমা, তা হ’লে ভয় পেয়ে যেতে। মানুষকে ছোট ক’রে অপমান কর্‌বার ফল হাতে হাতে টের পেতে! দেখ্‌তে পেতে, কেমন ক’রে হিন্দুরা প্রতিদিন কমে আস্‌চে, এবং মুসলমানেরা সংখ্যায় বেড়ে উঠ্‌চে। তবুত হিন্দুর হুঁস হয় না!” বিশ্বেশ্বরী হাসিয়া বলিলেন,—“তোর এত কথা শুনে এখনো ত আমার হুঁস হ’চ্চে না রমেশ! যারা তোদের মানুষ গুণে বেড়ায়, তারা যদি গুণে বল্‌তে পারে, এতগুলো ছোটজাত শুদ্ধমাত্র ছোট থাক্‌বার ভয়েই জাত দিয়েচে, তা হ’লে হয়ত আমার হুঁস হ’তেও পারে। হিন্দু যে কমে আস্‌চে, সে কথা মানি;—কিন্তু, তাঁর অন্য কারণ আছে। সেটাও সমাজের ত্রুটি নিশ্চয়; কিন্তু, ছোটজাতের জাত দেওয়াদেওয়ি তার কারণ নয়। শুধু ছোট ব’লে কোন হিন্দুই কোন দিন জাত দেয় না।”

 রমেশ সন্দিগ্ধকণ্ঠে কহিল,—“কিন্তু, পণ্ডিতেরা তাহা ত অনুমান করেন জ্যাঠাইমা!” জ্যাঠাইমা বলিলেন,—“অনুমানের বিরুদ্ধে ত তর্ক চলে না বাবা! কেউ যদি এমন খবর দিতে পারেন, অমুক গাঁয়ের এতগুলো ছোটজাত এই জন্যেই এ বৎসর জাত দিয়েচে, তা হ’লেও না হয় পণ্ডিতদের কথায় কাণ দিতে পারি। কিন্তু, আমি নিশ্চয় জানি, এ সংবাদ কেউ দিতে পার্‌বে না।° রমেশ তথাপি তর্ক করিয়া কহিল—“কিন্তু, যারা ছোটজাত, তারা যে অন্যায় বড়জাতকে হিংসা ক’রে চল্‌বে, এতো আমার কাছে ঠিক কথা ব’লেই মনে হয় জ্যাঠাইমা!” রমেশের তীব্র উত্তেজিত কথায় বিশ্বেশ্বরী আবার হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন,—“ঠিক কথা নয়, বাবা, একটুও ঠিক কথা নয়। এ তোদের সহর নয়। পাড়াগাঁয়ে জাত ছোট কি বড়, সে জন্যে কারো এতটুকুও মাথাব্যথা নেই। ছোট ভাই যখন ছোট ব’লে বড়ভাইকে হিংসে করে না, দুএক বছর পরে জন্মাবার জন্যে যেমন তাঁর মনে এতটুকুও ক্ষোভ নেই, পাড়াগাঁয়েও ঠিক তেমনি। এখানে কায়েত, বামুন হয়নি ব’লে একটুও দুঃখ করে না, কৈবর্ত্তও কায়েতের সমান হবার জন্যে একটুও চেষ্টা করে না। বড় ভাইকে একটা প্রণাম করতে ছোটভায়ের যেমন লজ্জায় মাথা কাটা যায় না, তেমনি কায়েতেও, বামুনের একটুখানি পায়ের ধুলো নিতে এতটুকু কুণ্ঠিত হয় না। সে নয় বাবা, জাতিভেদ-টেদ হিংসেদ্বেষের হেতুই নয়। অন্ততঃ বাঙালীর যা’ মেরুদণ্ড—সেই পল্লীগ্রামে নয়।” রমেশ মনে মনে আশ্চর্য্য হইয়া কহিল,—“তবে কেন এমন হয় জ্যাঠাইমা? ওগাঁয়ে ত এত ঘর মুসলমান আছে, তাদের মধ্যে ত এমন বিবাদ নেই। একজন আর একজনকে বিপদের দিনে এমন ক’রে ত চেপে ধরে না। সেদিন অর্থাভাবে দ্বারিক ঠাকুরের প্রায়শ্চিত্ত হয়নি ব’লে, কেউ তার মৃতদেহটাকে ছুঁতে পর্য্যন্ত চায়নি, সে ত তুমি জান।” বিশ্বেশ্বরী কহিলেন,—“জানি বাবা, সব জানি। কিন্তু, জাতিভেদ তার কারণ নয়। কারণ এই যে, মুসলমানদের মধ্যে এখনো সত্যকার একটা ধর্ম্ম আছে, কিন্তু, আমাদের মধ্যে তা’ নেই। যাকে যথার্থ ধর্ম্ম বলে, পল্লীগ্রাম থেকে সে একেবারে লোপ পেয়েচে। আছে শুধু কতকগুলো আচার-বিচারের কুসংস্কার, আর তার থেকে নিরর্থক দলাদলি।” রমেশ হতাশভাবে একটা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল,—“এর কি প্রতীকারের কোন উপায় নেই জ্যাঠাইমা?” বিশ্বেশ্বরী বলিলেন,—“আছে বই কি বাবা। প্রতীকার আছে শুধু জ্ঞানে। যে পথে তুই পা দিয়েছিস, শুধু সেই পথে। তাই ত তোকে কেবলি বলি তুই তোর এই জন্মভূমিকে কিছুতে ছেড়ে যাসনে।” প্রত্যুত্তরে রমেশ কি একটা বলিতে যাইতেছিল, বিশ্বেশ্বরী বাধা দিয়া বলিলেন,—“তুই বলবি, মুসলমানদের মধ্যেও ও অজ্ঞান অত্যন্ত বেশি। কিন্তু, তাদের সজীব ধর্ম্মই তাদের সব দিকে শুধ্‌রে রেছেচে। একটা কথা বলি রমেশ, পীরগাঁয়ে খবর নিলে শুন্‌তে পাবি, জাফর ব’লে একটা বড়লোককে তারা সবাই ‘একঘরে’ ক’রে রেখেছে, সে, তাঁর বিধবা সৎমাকে খেতে দেয় না ব’লে। কিন্তু, আমাদের এই গোবিন্দ গাঙুলী সে দিন তাঁর বিধবা বড়ভাজকে নিজের হাতে মেরে আধমরা ক’রে দিলে, কিন্তু, সমাজ থেকে তাঁর শাস্তি হওয়া চুলোয় যাক্‌, সে নিজেই একটা সমাজের মাথা হ’য়ে ব’সে আছে। এ সব অপরাধ আমাদের মধ্যে শুধু ব্যক্তিগত পাপপুণ্য; এর সাজা ভগবান্‌ ইচ্ছা হয় দেবেন, না হয় না দেবেন, কিন্তু, পল্লী-সমাজ তাতে ভ্রূক্ষেপ করে না।”

 এই নূতন তথ্য শুনিয়া একদিকে রমেশ যেমন অবাক্‌ হইয়া গেল, অন্যদিকে তাঁহার মন ইহাকেই স্থির-সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে দ্বিধা করিতে লাগিল। বিশ্বেশ্বরী তাহা যেন বুঝিয়াই বলিলেন,—“ফলটাকেই উপায় ব’লে ভুল করিস্‌নে বাবা! যে জন্যে তোর মন থেকে সংশয় ঘুচ্‌তে চাইচে না,—সেই জাতের ছোটবড় নিয়ে মারামারি করাটা উন্নতির একটা লক্ষণ,——কারণ নয় রমেশ। সেটা সকলের আগে না হ’লেই নয়, মনে ক’রে যদি তাকে নিয়েই নাড়াচাড়া কর্‌তে যাস্‌, এদিক্‌-ওদিক্‌ দু’দিক্‌ নষ্ট হয়ে যাবে। কথাটা সত্যি কি না, যাচাই কর্‌তে চাস্‌, রমেশ, সহরের কাছাকাছি দু’চারখানা গ্রাম ঘুরে এসে, তাদের সঙ্গে তোর এই কুঁয়াপুরকে মিলিয়ে দেখিস্‌। আপনি টের পাবি।” কলিকাতার অতি নিকটবর্ত্তী একখানা গ্রামের সহিত রমেশের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। তাহারই মোটামুটি চেহারাটা সে মনে মনে দেখিয়া লইবার চেষ্টা করিতেই, অকস্মাৎ তাঁহার চোখের উপর হইতে যেন একটা কালো পর্দ্দা উঠিয়া গেল; এবং গভীর সম্ভ্রম ও বিস্ময়ে চুপ করিয়া সে বিশ্বেশ্বরীর মুখের পানে চাহিয়া রহিল। তিনি কিন্তু, সেদিকে কিছুমাত্র লক্ষ্য না করিয়া নিজের পূর্ব্বানুবৃত্তিস্বরূপে ধীরে ধীরে বলিতে লাগিলেন,—“তাই ত তোকে বার বার বলি, বাবা, তুই যেন তোর জন্মভূমি ত্যাগ ক’রে যাস্‌নে। তোর মত বাইরে থেকে যারা বড় হ’তে পেরেচে, তারা যদি তোর মতোই গ্রামে ফিরে আস্‌ত, সমস্ত সম্বন্ধ বিছিন্ন ক’রে চ’লে না যেত, পল্লীগ্রামের এমন দুরবস্থা হ’তে পার্‌ত না। তারা কখনই গোবিন্দ গাঙুলীকে মাথায় তুলে নিয়ে তোকে দূরে সরিয়ে দিতে পার্‌ত না।” রমেশের রমার কথা মনে পড়িল। তাই আবার অভিমানের সুরে কহিল,—“দূরে স’রে যেতে আমারও আর দুঃখ নেই জ্যাঠাইমা।” বিশ্বেশ্বরী এই সুরটা লক্ষ্য করিলেন, কিন্তু, হেতু বুঝিলেন না। কহিলেন,—“না রমেশ, সে কিছুতেই হ’তে পার্‌বে না! যদি এসেচিস্‌, যদি কাজ সুরু করেচিস, মাঝ্‌পথে ছেড়ে দিলে তোর জন্মভূমি তোকে ক্ষমা কর্‌বে না।” “কেন জ্যাঠাইমা, জন্মভূমি শুধু ত আমার একার নয়?” জ্যাঠাইমা উদ্দীপ্ত হইয়া বলিলেন,—“তোর একার বই কি বাবা, শুধু তোরই মা। দেখ্‌তে পাস্‌নে, মা মুখ ফুটে সন্তানের কাছে কোনদিনই কিছু দাবি করেন না। তাই এত লোক থাক্‌তে কারো কানেই তাঁর কান্না গিয়ে পৌঁছতে পারে নি, কিন্তু তুই, আস্‌বামাত্রই শুন্‌তে পেয়েছিলি।” রমেশ আর তর্ক করিল না। কিছুক্ষণ স্থিরভাবে বসিয়া থাকিয়া, নিঃশব্দে প্রগাঢ় শ্রদ্ধাভরে, বিশ্বেশ্বরীর পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।

 ভক্তি, করুণা ও কর্ত্তব্যের একান্ত-নিষ্ঠায় হৃদয় পরিপূর্ণ করিয়া লইয়া রমেশ বাড়ী ফিরিয়া আসিল। তখন সবেমাত্র সূর্য্যোদয় হইয়াছে। তাহার ঘরের পূর্ব্বদিকে মুক্ত জানালার সম্মুখে দাঁড়াইয়া সে স্তব্ধ আকাশের পানে চাহিয়াছিল, সহসা শিশুকণ্ঠের আহ্বানে সে চমকিয়া মুখ ফিরাইতে দেখিল, রমার ছোটভাই যতীন দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া লজ্জায় আরক্তভাবে ডাকিতেছে,—“ছোড়দা’!—” রমেশ কাছে গিয়া হাত ধরিয়া তাহাকে ভিতরে আনিয়া জিজ্ঞাসা করিল,—“কাকে ডাক্‌চ যতীন্‌?” “আপনাকে।”

 “আমাকে? আমাকে ছোড়দা’ বল্‌তে তোমাকে কে ব’লে দিলে?”

 “দিদি।”

 “দিদি? তিনি কি কিছু বল্‌তে তোমাকে পাঠিয়েছেন?” যতীন মাথা নাড়িয়া কহিল,—“কিছু না। দিদি বল্‌লেন, ‘আমাকে সঙ্গে ক’রে তোর ছোড়দা’র বাড়ীতে নিয়ে চল্‌’—ঐ যে ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন”—বলিয়া সে দরজার দিকে চাহিল। রমেশ বিস্মিত ও ব্যস্ত হইয়া আসিয়া দেখিল, রমা একটা থামের আড়ালে দাঁড়াইয়া আছে। সরিয়া আসিয়া সবিনয়ে কহিল, —“আজ আমার এ কি সৌভাগ্য! কিন্তু আমাকে ডেকে না পাঠিয়ে, নিজে কষ্ট করে এলে কেন? এস, ঘরে এস।” রমা একবার ইতস্ততঃ করিল, তারপর যতীনের হাত ধরিয়া রমেশের অনুসরণ করিয়া তাহার ঘরের চৌকাঠের কাছে আসিয়া বসিয়া পড়িল। কহিল,—“আজ একটা জিনিষ ভিক্ষে চাইতে আপনার বাড়ীতেই এসেচি,—বলুন, দেবেন?” বলিয়া সে রমেশের মুখের পানে স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। সেই চাহনিতে রমেশের পরিপূর্ণ হৃদয়ের সপ্তস্বরা অকস্মাৎ যেন উন্মাদ-শব্দে বাজিয়া উঠিয়া একেবারে ভাঙ্গিয়া ঝরিয়া পড়িল। কিছুক্ষণ পূর্ব্বেই তাহার মনের মধ্যে যে সকল সঙ্কল্প, আশা ও আকাঙ্ক্ষা অপরূপ দীপ্তিতে নাচিয়া ফিরিতেছিল, সমস্তই একেবারে নিবিয়া অন্ধকার হইয়া গেল। তথাপি প্রশ্ন করিল,—“কি চাই বল?” তাহার অস্বাভাবিক শুষ্কতা রমার দৃষ্টি এড়াইল না। সে তেমনি মুখের প্রতি চোখ রাখিয়া কহিল,—“আগে কথা দিন।” রমেশ ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া, মাথা নাড়িয়া কহিল,—“তা’ পারিনে। তোমাকে কিছুমাত্র প্রশ্ন না কোরেই আমার কথা দেবার শক্তি তুমি নিজের হাতেই যে ভেঙে দিয়েছ রমা!”

 রমা আশ্চর্য্য হইয়া কহিল, “আমি?” রমেশ বলিল, “তুমি ছাড়া এ শক্তি আর কারু ছিল না। রমা, আজ তোমাকে একটা সত্যকথা বল্‌ব! ইচ্ছে হয় বিশ্বাস কোরো, না হয় কোরো না। কিন্তু, জিনিসটা যদি না একেবারে ম’রে নিঃশেষ হয়ে যেত, হয় ত কোনদিনই এ কথা তোমাকে শোনাতে পার্‌তাম না!” বলিয়া একটুখানি চুপ করিয়া, পুনরায় কহিল,—“আজ না কি আর কোনপক্ষেরই লেশমাত্র ক্ষতিবৃদ্ধির সম্ভাবনা নাই, তাই আজ জানাচ্চি, তোমাকে অদেয় আমার সেদিন পর্য্যন্ত কিছুই ছিল না। কিন্তু কেন জান?” রমা মাথা নাড়িয়া জানাইল,—‘না।’ কিন্তু, সমস্ত অন্তঃকরণটা তাহার কেমন একটা লজ্জাকর আশঙ্কায় কণ্টকিত হইয়া উঠিল। রমেশ কহিল,—“কিন্তু, শুনে রাগ কোরো না, কিছুমাত্র লজ্জাও পেয়ো না। মনে কোরো, এ কোন্‌ পুরাকালের একটা গল্প শুন্‌চ মাত্র।” রমা মনে মনে প্রাণপণে বাধা দিবার ইচ্ছা করিল, কিন্তু মাথা তাহার এমনি ঝুঁকিয়া পড়িল যে, কিছুতেই সোজা করিয়া তুলিতে পারিল না। রমেশ তেমনি শান্ত, মৃদু ও নির্লিপ্তকণ্ঠে বলিয়া উঠিল,—“তোমাকে ভালবাস্‌তাম রমা! আজ আমার মনে হয়, তেমন ভালবাসা বোধ করি, কেউ কখনো বাসেনি; ছেলেবেলায় মা’র মুখে শুন্‌তাম, আমাদের বিয়ে হ’বে। তার পরে, যে দিন সমস্ত আশা ভেঙ্গে গেল, সে দিন আমি কেঁদে ফেলেছিলাম, আজও আমার তা’ মনে পড়ে।” কথাগুলা জ্বলন্ত সীসার মত রমার দুই কানের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দগ্ধ করিয়া ফেলিতে লাগিল; এবং একান্ত অপরিচিত অনুভূতির অসহ্য, তীব্র বেদনায় তাহার বুকের একপ্রান্ত হইতে অপরপ্রান্ত পর্য্যন্ত কাটিয়া কুচি-কুচি করিয়া দিতে লাগিল। কিন্তু, নিষেধ করিবার কোন উপায় খুঁজিয়া না পাইয়া নিতান্ত নিরুপায় পাথরের মূর্ত্তির মত স্তব্ধ হইয়া বসিয়া, রমা রমেশের বিষাক্ত-মধুর কথাগুলো একটির পর একটি ক্রমান্বয়ে শুনিয়া যাইতে লাগিল। রমেশ কহিতে লাগিল,—“তুমি ভাব্‌চ, তোমাকে এ সব কাহিনী শোনানো অন্যায়! আমার মনেও সেই সন্দেহ ছিল ব’লেই সে দিন তারকেশ্বরে যখন একটি দিনের যত্নে আমার সমস্ত জীবনের ধারা বদ্‌লে দিয়ে গেলে, তখনও চুপ ক’রে ছিলাম। কিন্তু, সে চুপ ক’রে থাকাটা আমার পক্ষে সহজ ছিল না।” রমা কিছুতেই আর সহ্য করিতে পারিল না। কহিল,—“তবে,—আজকেই বা বাড়ীতে পেয়ে আমাকে অপমান কর্‌চেন কেন?” রমেশ কহিল,—“অপমান! কিছু না। এর মধ্যে মান-অপমানের কোন কথাই নেই। এ যাদের কথা হ’চ্চে, সে রমাও কোন দিন তুমি ছিলে না, সে রমেশও আমি আর নেই। যাই হোক, শোন! সেদিন আমার, কেন জানিনে, অসংশয়ে বিশ্বাস হয়েছিল তুমি যা’ ইচ্ছে বল, যা’ খুসি কর, কিন্তু, আমার অমঙ্গল তুমি কিছুতেই সইতে পার্‌বে না। বোধ করি ভেবেছিলাম, সেই যে ছেলেবেলায় একদিন আমাকে ভালবাস্‌তে আজও তা’ একেবারে ভুল্‌তে পারনি। তাই ভেবেছিলাম, কোন কথা তোমাকে না জানিয়ে, তোমার ছাওয়ায় বসে আমার সমস্ত জীবনের কাজগুলো ধীরে ধীরে ক’রে যাব। তার পরে সে রাত্রে আক্‌বরের নিজের মুখে যখন শুনতে পেলাম, তুমি নিজে—ও কি? বাইরে এত গোলমাল কিসের?”

 “বাবু—” গোপাল সরকারের ত্রস্ত-ব্যাকুল কণ্ঠস্বরে রমেশ ঘরের বাহিরে আসিতেই সে কহিল,—“বাবু, পুলিশের লোক ভজুয়াকে গ্রেপ্তার করেচে।”

 “কেন?”

 গোপালের ভয়ে ঠোঁট কাঁপিতেছিল; সে কোনমতে কহিল,—“পরশু রাত্তিরে রাধানগরের ডাকাতিতে সে নাকি ছিল।” রমেশ ঘরের দিকে চাহিয়া কহিল,—“আর এক মুহূর্ত্ত থেকো না রমা, খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে যাও। পুলিশ খানাতল্লাসি কর্‌তে ছাড়্‌বে না।” রমা নীলবর্ণ মুখে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল,—“তোমার কোন ভয় নেই ত?” রমেশ কহিল,—“বলতে পারিনে। কত দূর কি দাঁড়িয়েচে, সে ত এখনো জানিনে।” একবার রমার ওষ্ঠাধর কাঁপিয়া উঠিল, একবার তাহার মনে পড়িল, পুলিশে সে দিন তাহার নিজের অভিযোগ করা, তার পরই সে হঠাৎ কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল,—“আমি যাব না।” রমেশ বিস্ময়ে মুহূর্ত্তকাল অবাক্‌ থাকিয়া বলিল,—“ছি—এখানে থাক্‌তেই নেই রমা-শীগ্‌গীর বেরিয়ে যাও।”—বলিয়া আর কোন কথা না শুনিয়া, যতীনের হাত ধরিয়া, জোর করিয়া টানিয়া, এই দুটি ভাইবোন্‌কে খিড়কির পথে বাহির করিয়া দিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল।