পল্লী-সমাজ/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
এই কুঁয়াপুরের বিষয়টা অর্জ্জিত হইবার একটু ইতিহাস আছে, তাহা এইখানে বলা আবশ্যক। প্রায় শতবর্ষ পূর্ব্বে মহাকুলীন বলরাম মুখুয্যে, তাঁহার পিতা বলরাম ঘোষালকে সঙ্গে করিয়া, বিক্রমপুর হইতে এদেশে আসেন। মুখুয্যে শুধু কুলীন ছিলেন না, বুদ্ধিমান্ও ছিলেন। বিবাহ করিয়া বর্দ্ধমান রাজসরকারে চাক্রি করিয়া, এবং আরও কি কি করিয়া, এই বিষয়টুকু হস্তগত করেন। ঘোষালও এই দিকেই বিবাহ করেন। কিন্তু পিতৃঋণ শোধ করা ভিন্ন আর তাঁহার কোন ক্ষমতাই ছিল না; তাই, দুঃখে কষ্টেই তাঁহার দিন কাটিতেছিল। এই বিবাহ উপলক্ষ্যেই নাকি দুই মিতায় মনোমালিন্য ঘটে। পরিশেষে তাহা এমন বিবাদে পরিণত হয় যে, এক গ্রামে বাস করিয়াও বিশ বৎসরের মধ্যে কেহ কাহারও মুখদর্শন করেন নাই। বলরাম মুখুয্যে যে দিন মারা গেলেন, সে দিনেও ঘোষাল তাঁহার বাটীতে পা দিলেন না। কিন্তু তাঁহার মরণের পরদিন অতি আশ্চর্য্য কথা শুনা গেল। তিনি নিজেই সমস্ত বিষয় চুল-চিরিয়া অর্ধেক ভাগ করিয়া নিজের পুত্র ও পিতার পুত্রগণকে দিয়া গিয়াছেন। সেই অবধি এই কুঁয়াপুরের বিষয় মুখুয্যে ও ঘোষালবংশ ভোগদখল করিয়া আসিতেছে। ইঁহারা নিজেরাও জমিদার বলিয়া অভিমান করিতেন, গ্রামের লোকও অস্বীকার করিত না। যখনকার কথা বলিতেছি, তখন ঘোষালবংশও ভাগ হইয়াছিল। সেই বংশের ছোট-তরফের তারিণী ঘোষাল মকদ্দমা-উপলক্ষ্যে জেলায় গিয়া দিন ছয়েক পূর্ব্বে হঠাৎ যে দিন, আদালতের ছোটবড় পাঁচসাতটা মুলতুবি মকদ্দমায় শেষফলের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করিয়া, কোথাকার কোন্ অজানা আদালতের মহামান্য শমন মাথায় করিয়া নিঃশব্দে প্রস্থান করিলেন, তখন তাঁহাদের কুঁয়াপুর গ্রামের ভিতরে ও বাহিরে একটা হুলস্থূল পড়িয়া গেল। বড়-তরফের কর্ত্তা বেণী ঘোষাল খুড়ার মৃত্যুতে গোপনে আরামের নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাড়ী ফিরিয়া আসিলেন, এবং আরও গোপনে দল পাকাইতে লাগিলেন, কি করিয়া খুড়ার আগামী শ্রাদ্ধের দিনটা পণ্ড করিয়া দিবেন। দশ বৎসর খুড়া-ভাইপোয় মুখ দেখাদেখি ছিল না। বহু বৎসর পূর্ব্বে তারিণীর গৃহ শূন্য হইয়াছিল। সেই অবধি পুত্র রমেশকে তাহার মামার বাড়ী পাঠাইয়া দিয়া তারিণী বাটীর ভিতরে দাসদাসী এবং বাহিরে মকদ্দমা লইয়াই কাল কাটাইতেছিলেন। রমেশ রুড়কি-কলেজে এই দুঃসংবাদ পাইয়া পিতার শেষ-কর্ত্তব্য সম্পন্ন করিতে সুদীর্ঘকাল পরে কাল’ অপরাহ্নে তাহার শূন্যগৃহে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল।
কর্ম্মবাড়ী। মধ্যে শুধু দুটো দিন বাকী। বৃহস্পতিবারে রমেশের পিতৃশ্রাদ্ধ। দুই একজন করিয়া ভিন্ন গ্রামের মরুব্বিরা উপস্থিত হইতেছেন। কিন্তু নিজেদের কুঁয়াপুরের কেন যে কেহ আসে না, রমেশ তাহা বুঝিয়াছিল,—হয় ত, শেষ পর্য্যন্ত কেহ আসিবেই না, তাহাও জানিত। শুধু ভৈরব আচার্য্য ও তাহার বাড়ীর লোকেরা আসিয়া কাজকর্ম্মে যোগ দিয়াছিল। স্বগ্রামস্থ ব্রাহ্মণদিগের পদধূলির আশা না থাকিলেও, উদ্যোগ-আয়োজন রমেশ বড়লোকের মতই করিতেছিল। আজ অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত রমেশ বাড়ীর ভিতরে কাজকর্ম্মে ব্যস্ত ছিল। কি জন্যে বাহিরে আসিতেই দেখিল, ইতিমধ্যে জন-দুই প্রাচীন ভদ্রলোক আসিয়া, বৈঠকখানার বিছানায় সমাগত হইয়া ধূমপান করিতেছেন। সম্মুখে আসিয়া সবিনয়ে কিছু বলিবার পূর্ব্বেই, পিছনে শব্দ শুনিয়া ফিরিয়া দেখিল, এক অতি বৃদ্ধ ৫।৬টি ছেলেমেয়ে লইয়া কাসিতে কাসিতে বাড়ী ঢুকিলেন। তাঁহার কাঁধের উপর মলিন উত্তরীয়, নাকের উপর একযোড়া ভাঁটার মত মস্ত চস্মা,—পিছনে দড়ি দিয়া বাঁধা শাদা চুল, শাদা গোঁফ—তামাকের ধুঁয়ায় তাম্রবর্ণ। অগ্রসর হইয়া আসিয়া তিনি সেই ভীষণ চস্মার ভিতর দিয়া রমেশের মুখের দিকে মুহূর্ত্তকাল চাহিয়া বিনা বাক্যব্যয়ে কাঁদিয়া ফেলিলেন। রমেশ চিনিল না ইনি কে, কিন্তু যেই হোন্, ব্যস্ত হইয়া কাছে আসিয়া তাঁহার হাত ধরিতেই, তিনি ভাঙা-গলায় বলিয়া উঠিলেন,—“না বাবা রমেশ, তারিণী যে এমন ক’রে ফাঁকি দিয়ে পালাবে, তা স্বপ্নেও জানিনে, কিন্তু আমারও এমন চাটুয্যে–বংশে জন্ম নয় যে, কারু ভয়ে মুখ দিয়ে মিথ্যা কথা বেরুবে। আসবাব সময় তোমার বেণী ঘোষালের মুখের সাম্নে ব’লে এলুম, আমাদের রমেশ যেমন শ্রাদ্ধের আয়োজন কর্চে, এমন করা চুলোয় যাক্, এ অঞ্চলে কেউ চোখেও দেখেনি।” একটু থামিয়া বলিলেন, “আমার নামে অনেক শালা অনেক রকম ক’রে তোমার কাছে লাগিয়ে যাবে বাবা’, কিন্তু এটা নিশ্চয় জেনো, এই ধর্ম্মদাস শুধু ধর্ম্মেরই দাস,আর কারো নয়।” এই বলিয়া বৃদ্ধ সত্য-ভাষণের সমস্ত পৌরুষ আত্মসাৎ করিয়া লইয়া, গোবিন্দ গাঙ্গুলীর হাত হইতে হুঁকাটা ছিনিয়া লইয়া তাহাতে এক টান্ দিয়াই প্রবলবেগে কাসিয়া ফেলিলেন।
ধর্ম্মদাস নিতান্ত অত্যুক্তি করে নাই। উদ্যোগ-আয়োজন যেরূপ হইতেছিল, এদিকে সেরূপ কেহ করে নাই। কলিকাতা হইতে ময়রা আসিয়াছিল, তাহারা প্রাঙ্গণের একধারে ভিয়ান চড়াইয়াছিল। সেদিকে পাড়ার কতকগুলা ছেলেমেয়ে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। কাঙ্গালীদের বস্ত্র দেওয়া হইবে। চণ্ডীমণ্ডপের ও-ধারের বারান্দায় অনুগত ভৈরব আচার্য্য থান ফাড়িয়া পাট করিয়া, গাদা করিতেছিল—সে দিকেও জনকয়েক লোক থাবা পাতিয়া বসিয়া এই অপব্যয়ের পরিমাণ হিসাব করিয়া, মনে মনে রমেশের নির্ব্বুদ্ধিতার জন্য তাহাকে গালি পাড়িতেছিল। গরীব-দুঃখী সংবাদ পাইয়া অনেক দূরের পথ হইতেও আসিয়া জুটিতেছিল। লোকজন, প্রজাপাঠক বাড়ী পরিপূর্ণ করিয়া, কেহ কলহ করিতেছিল, কেহ বা মিছামিছি শুধু কোলাহল করিতেছিল। চারিদিকে চাহিয়া ব্যয়বাহুল্য দেখিয়া, ধর্ম্মদাসের কাসি আরও বাড়িয়া গেল।
প্রত্যুত্তরে রমেশ সঙ্কুচিত হইয়া ‘না না’ বলিয়া আরও কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু ধর্ম্মদাস হাত নাড়িয়া থামাইয়া দিয়া ঘড় ঘড় করিয়া কত কি বলিয়া ফেলিলেন; কিন্তু কাসির ধমকে তাহার একটি বর্ণও বুঝা গেল না।
গোবিন্দ গাঙ্গুলী সর্ব্বাগ্রে আসিয়াছিলেন। সুতরাং ধর্ম্মদাস যাহা বলিয়াছিল, তাহা বলিবার সুবিধা তাঁহারই সর্ব্বাপেক্ষা অধিক থাকিয়াও নষ্ট হইয়াছে ভাবিয়া তাঁহার মনে মনে ভারি একটা ক্ষোভ জন্মিতেছিল। তিনি এ সুযোগ আর নষ্ট হইতে দিলেন না। ধর্ম্মদাসকে উদ্দেশ করিয়া তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন,—“কা’ল সকালে, বুঝ্লে ধর্ম্মদাসদা, এখানে আস্ব ব’লে বেরিয়েও আসা হ’ল না—বেণীর ডাকাডা—‘গোবিন্দ খুড়ো, তামাক খেয়ে যাও।’ একবার ভাবলুম, কাজ নেই—তার পরে মনে হ’ল, ভাবখানা বেণীর দেখেই যাই না। বেণী কি বল্লে, জান বাবা রমেশ! বলে, খুড়ো, বলি তোমরা ত রমেশের মুরুব্বি হয়ে দাঁড়িয়েচ’, কিন্তু জিজ্ঞেস করি, লোকজন খাবে-টাবে ত?
আমি বা ছাড়ি কেন? তুমি বড়লোক আছ না আছ, আমার রমেশও কারো চেয়ে খাটো নয়—তোমার ঘরে ত এক মুঠো চিঁড়ের পিত্যেশ কারু নেই।—বললুম, বেণীবাবু, এই ত পথ, একবার কাঙ্গালী বিদেয়টা দাঁড়িয়ে দেখো।’ কালকের ছেলে রমেশ, কিন্তু বুকের পাটা ত বলি একে! এতটা বয়েস হ’ল, এমন আয়োজন কখনও চোখে দেখিনি। কিন্তু, তাও বলি ধর্ম্মদাস দা, আমাদের সাধ্যই বা কি! যাঁর কাজ তিনি উপর থেকে করাচ্চেন। তারিণী-দা শাপভ্রষ্ট দিক্পাল ছিলেন বৈ ত নয়!” ধর্ম্মদাসের কিছুতেই কাসি থামে না, সে কাসিতেই লাগিল, আর তাহার মুখের সাম্নে গাঙ্গুলী মশাই বেশ বেশ কথাগুলি অপরিপক্ক তরুণ জমিদারটিকে বলিয়া যাইতে লাগিলেন দেখিয়া, ধর্ম্মদাস আরও ভাল কিছু বলিবার চেষ্টায় যেন আকুলি-বিকুলি করিতে লাগিল।
গাঙ্গুলী বলিতে লাগিল, “তুমি ত আমার পর নও বাবা,—নিতান্ত আপনার। তোমার মা যে আমার একেবারে সাক্ষাৎ পিসতুত বোনের মামাত ভগিনী। রাধানগরের বাঁড়ুয্যে-বাড়ী—সে সব তারিণী দা’ জান্তেন। তাই যে কোন কাজকর্ম্মে—মামলা-মোকদ্দমা কর্তে, সাক্ষী দিতে—ডাক্ গোবিন্দকে!” ধর্ম্মদাস প্রাণপণবলে কাসি থামাইয়া খিঁচাইয়া উঠিলেন; “কেন, বাজে বকিস্ গোবিন্দ? খক্—খক্—খক্—আমি আজকের নয়—না জানি কি? সে বছর সাক্ষী দেবার কথায় বল্লি, ‘আমার জুতো নেই, খালি-পায়ে যাই কি ক’রে? খক্—খক্—তারিণী অম্নি আড়াই-টাকা দিয়ে একজোড়া জুতো কিনে দিল। তুই সেই পায়ে দিয়ে বেণীর হয়ে সাক্ষী দিয়ে এলি! খক্-খক্-খক্-খ—” গোবিন্দ চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া কহিল, “এলুম?”
“এলিনে?”
“দূর মিথ্যাবাদী!”
“মিথ্যাবাদী তোর বাবা!”
গোবিন্দ তাহার ভাঙা-ছাতি হাতে করিয়া লাফাইয়া উঠিল—“তবে রে শালা!”—ধর্ম্মদাস তাহার বাঁশের লাঠি উঁচাইয়া ধরিয়া হুঙ্কার দিয়াই প্রচণ্ডভাবে কাসিয়া ফেলিল। রমেশ শশব্যস্তে উভয়ের মাঝ্খানে আসিয়া পড়িয়া স্তম্ভিত হইয়া গেল। ধর্ম্মদাস লাঠি নামাইয়া কাসিতে কাসিতে বসিয়া পড়িয়া বলিল, “ও-শালার সম্পর্কে আমি বড়-ভাই হই কি না, তাই শালার আক্কেল দেখ—"
“ওঃ, শালা আমার বড় ভাই!” বলিয়া গোবিন্দ গাঙ্গুলীও ছাতি গুটাইয়া বসিয়া পড়িল।
সহরের ময়রারা ভিয়ান ছাড়িয়া চাহিয়া রহিল। চতুর্দ্দিকে যাহারা কাজকর্ম্মে নিযুক্ত ছিল, চেঁচামিচি শুনিয়া তাহারা তামাসা দেখিবার জন্য সুমুখে ছুটিয়া আসিল; ছেলেমেয়েরা খেলা ফেলিয়া হাঁ করিয়া মজা দেখিতে লাগিল; এবং এই সমস্ত লোকের দৃষ্টির সম্মুখে রমেশ লজ্জায়, বিস্ময়ে, হতবুদ্ধির মত স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার মুখ দিয়া একটাও কথা বাহিল হইল না। কি এ? উভয়েই প্রাচীন, ভদ্রলোক—ব্রাহ্মণ-সন্তান! এত সামান্য কারণে এমন ইতরের মত গালিগালাজ করিতে পারে? বারান্দায় বসিয়া ভৈরব কাপড়ের থাক্ দিতে দিতে সমস্তই দেখিতেছিল, শুনিতেছিল। এখন আসিয়া রমেশকে উদ্দেশ করিয়া কহিল, “প্রায় শ’-চারেক কাপড় ত হ’ল, আরও চাই কি?” রমেশের মুখ দিয়া হঠাৎ কথাই বাহির হইল না। ভৈরব রমেশের অভিভূতভাব লক্ষ্য করিয়া হাসিল। মৃদু অনুযোগের স্বরে কহিল, “ছিঃ গাঙ্গুলী মশাই! বাবু একেবারে অবাক্ হয়ে গেছেন। আপনি কিছু মনে কর্বেন না বাবু, এমন ঢের হয়। বৃহৎ কাজকর্ম্মের বাড়ীতে কত ঠেঙা-ঠেঙি রক্তারক্তি পর্য্যন্ত হ’য়ে যায়—আবার যে-কে সেই হয়। নিন্ উঠুন, চাটুয্যে মশাই,—দেখুন দেখি, আরও থান ফাড়্ব কি না?” ধর্ম্মদাস জবাব দিবার পূর্ব্বেই গোবিন্দ গাঙ্গুলী সোৎসাহে শিরশ্চালনপূর্ব্বক খাড়া হইয়া বলিলেন, “হয়ই ত! হয়ই ত! ঢের হয়! নইলে বিরদ কর্ম্ম বলেচে কেন? শাস্তরে আছে, লক্ষ কথা না হলে বিয়েই হয় না যে! সে বছর তোমার মনে আছে ভৈরব, যদু মুখুয্যে মশায়ের কন্যা রমার গাছ পিতিষ্ঠের দিনে সিধে নিয়ে রাঘব ভট্চায্যিতে, হারাণ চাটুয্যেতে মাথা-ফাটাফাটি হ’য়ে গেল! কিন্তু আমি বলি ভৈরব ভায়া, বাবাজীর এ কাজটা ভাল হচ্চে না। ছোটলোকদের কাপড় দেওয়া, আর ভস্মে ঘি ঢালা এক কথা। তার চেয়ে বামুনদের একজোড়া, আর ছেলেদের একখানা ক’রে দিলেই নাম হ’ত। আমি বলি বাবাজী সেই যুক্তিই করুন, কি বল ধর্ম্মদাসদা?” ধর্ম্মদাস ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন, “গোবিন্দ মন্দ কথা বলেনি, বাবাজী! ও ব্যাটাদের হাজার দিলেও নাম হবার জো নেই। নইলে আর ওদের ছোটলোক বলেছে কেন? বুঝলে না বাবা রমেশ?” এখন পর্য্যন্ত রমেশ নিঃশব্দে ছিল। এই বস্ত্র-বিতরণের আলোচনায় সে একেবারে যেন মর্ম্মাহত হইয়া পড়িল। ইহার সুযুক্তি-কুযুক্তি সম্বন্ধে নহে; এখন এইটাই তাহার সর্ব্বাপেক্ষা অধিক বাজিল যে, ইহারা যাহাদিগকে ছোটলোক বলিয়া ডাকে, তাহাদেরই সহস্র চক্ষুর সম্মুখে এইমাত্র যে এত বড় একটা লজ্জাকর কাণ্ড করিয়া বসিল, সে জন্য ইহাদের কাহারও মনে এতটুকু ক্ষোভ বা লজ্জার কণামাত্রও নাই। ভৈরব মুখপানে চাহিয়া আছে দেখিয়া, রমেশ সংক্ষেপে কহিল, “আরও দু’শ কাপড় ঠিক ক’রে রাখুন।” “তা নইলে কি হয়? ভৈরব ভায়া, চল, আমিও যাই—তুমি একা আর কত পার্বে বল?” বলিয়া কাহারও সম্মতির অপেক্ষা না করিয়া গোবিন্দ উঠিয়া বস্ত্ররাশির নিকট গিয়া বসিল। রমেশ বাটীর ভিতর যাইবার উপক্রম করিতেই ধর্ম্মদাস তাহাকে একপাশে ডাকিয়া লইয়া চুপিচুপি অনেক কথা কহিল। রমেশ প্রত্যুত্তরে মাথা নাড়িয়া সম্মতি-জ্ঞাপন করিয়া ভিতরে চলিয়া গেল। কাপড় গুছাইতে গুছাইতে গোবিন্দ গাঙ্গুলী আড়চোখে সমস্ত দেখিল। “কৈ গো, বাবাজী কোথায় গো?” বলিয়া একটি শীর্ণকায় মুণ্ডিতশ্মশ্রূ প্রাচীন ব্রাহ্মণ প্রবেশ করিলেন। ইহার সঙ্গেও গুটিতিনেক ছেলে-মেয়ে। মেয়েটি সকলের বড়। তাহারই পরণে শুধু একখানি অতি জীর্ণ ডুরে-কাপড়। বালক দু’টি কোমরে এক-একগাছি ঘুন্সি ব্যতীত একেবারে দিগম্বর। উপস্থিত সকলেই মুখ তুলিয়া চাহিল। গোবিন্দ অভ্যর্থনা করিল—“এস দীনুদা, বোসো। বড় ভাগ্যি আমাদের যে, আজ তোমার পায়ের ধূলো পড়্ল। ছেলেটা একা সারা হয়ে যায়, তা’ তোমরা—” ধর্ম্মদাস গোবিন্দের প্রতি কট্মট্ করিয়া চাহিল। সে ভ্রূক্ষেপমাত্র না করিয়া কহিল, “তা তোমরা ত কেউ এ দিক্ মাড়াবে না, দাদা”—বলিয়া তাঁহার হাতে হুঁকাটা তুলিয়া দিল। দীনু ভট্চায আসন গ্রহণ করিয়া দগ্ধ হুঁকাটায় নিরর্থক গোটাদুই টান দিয়া বলিলেন, “আমি ত ছিলাম না ভায়া—তোমার বৌঠাক্রুণকে আন্তে তাঁর বাপের বাড়ী গিয়েছিলুম। বাবাজী কোথায়? শুন্চি নাকি ভারি আয়োজন হচ্চে? পথে আস্তে ও-গাঁয়ের হাটে শুনে এলুম, খাইয়ে-দাইয়ে ছেলে বুড়োর হাতে ষোলখানা ক’রে লুচি আর চার-জোড়া ক’রে সন্দেশ দেওয়া হবে।” গোবিন্দ গলা খাটো করিয়া কহিল, “তা’ ছাড়া হয় ত একখানা ক’রে কাপড়ও। এই যে রমেশ বাবাজী, তাই দীনুদা’কে বল্ছিলুম বাবাজী—তোমাদের পাঁচজনের বাপ-মায়ের আশীর্ব্বাদে যোগাড়-সোগাড় একরকম করা ত যাচ্চে, কিন্তু বেণী একেবারে উঠে পড়ে লেগেচে। এই আমার কাছেই দু’বার লোক পাঠিয়েছে। তা আমার কথা না হয় ছেড়েই দিলে, রমেশের সঙ্গে আমার যেন নাড়ির টান্ রয়েচে; কিন্তু এই যে দীনু-দা, ধর্ম্মদাস-দা, এঁরাই কি, বাবা তোমাকে ফেল্তে পার্বেন? দীনু-দা ত পথ থেকে শুন্তে পেয়ে ছুটে আস্চেন। ওরে ও ষষ্ঠীচরণ, তামাক দে না রে! বাবা রমেশ, একবার এদিকে এস দেখি, একটা কথা ব’লে নিই!” নিভৃতে ডাকিয়া লইয়া গোবিন্দ ফিস্ফিস্ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ভেতরে বুঝি ধর্ম্মদাস-গিন্নী এসেছে? খবরদার, খবরদার, অমন কাজটি কোরো না বাবা! বিট্লে বামুন যতই ফোস্লাক্, ধর্ম্মদাস-গিন্নীর হাতে ভাঁড়ারের চাবিটাবি দিয়ো না বাবা, কিছুতে দিয়ো না—ঘি, ময়দা, তেল, নুন অর্দ্ধেক সরিয়ে ফেল্বে। তোমার ভাবনা কি বাবা? আমি গিয়ে তোমার মামীকে পাঠিয়ে দেব। সে এসে ভাঁড়ারের ভার নেবে, তোমার একগাছি কুটো পর্যন্ত লোকসান্ হবে না।” রমেশ ঘাড় নাড়িয়া “যে আজ্ঞে” বলিয়া মৌন হইয়া রহিল। তাহার বিস্ময়ের অবধি নাই। ধর্ম্মদাস যে তাঁহার গৃহিণীকে ভাঁড়ারের ভার লইবার জন্য পাঠাইয়া দিবার কথা এত গোপনে কহিয়াছিল, গোবিন্দ ঠিক তাহাই আন্দাজ করিল কিরূপে?
উলঙ্গ শিশু-দুটো ছুটিয়া আসিয়া দীনু-দার কাঁধের উপর ঝুলিয়া পড়িল, “বাবা, সন্দেশ খাব।” দীনু একবার রমেশের প্রতি, একবার গোবিন্দের প্রতি চাহিয়া কহিল, “সন্দেশ কোথায় পাব রে?” “কেন, ঐ যে হচ্চে” বলিয়া তাহারা ওদিকের ময়রাদের দেখাইয়া দিল।
“আঁমরাও দাঁদামশাই”—বলিয়া নাকে কাঁদিতে কাঁদিতে আরও তিন-চারিটি ছেলে—মেয়ে ছুটিয়া আসিয়া বৃদ্ধ ধর্ম্মদাসকে ঘিরিয়া ধরিল। “বেশ ত, বেশ ত” বলিয়া রমেশ ব্যস্ত হইয়া অগ্রসর হইয়া আসিল, “ও আচায্যি মশাই, বিকেলবেলায় ছেলেরা সব বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, খেয়ে ত আসেনি; ওহে ও কি নাম তোমার? নিয়ে এস ত ঐ থালাটা এদিকে।” ময়রা সন্দেশের থালা লইয়া আসিবামাত্র ছেলেরা উপুড় হইয়া পড়িল; বাঁটিয়া দিবার অবকাশ দেয় না, এমনি ব্যস্ত করিয়া তুলিল। ছেলেদের খাওয়া দেখিতে দেখিতে দীননাথের শুষ্কদৃষ্টি সজল ও তীব্র হইয়া উঠিল—“ওরে ও খেঁদি, খাচ্চিস ত, সন্দেশ হয়েচে কেমন বল্ দেখি?” “বেশ বাবা।” বলিয়া খেঁদি চিবাইতে লাগিল। দীনু মৃদু হাসিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, “হাঃ তোদের আবার পছন্দ! মিষ্টি হলেই হ’ল। হাঁ হে কারিকর, এ কড়াটা কেমন নামালে? কি বল, গোবিন্দ ভায়া, এখনো একটু রোদ আছে ব’লে মনে হচ্চে না?
ময়রা কোন দিকে না চাহিয়াই তৎক্ষণাৎ কহিল, “আজ্ঞে আছে বৈ কি! এখনো ঢের বেলা আছে, এখনো সন্ধ্যে আহ্নিকের—”
“তবে কৈ, দাও দেখি একটা গোবিন্দ ভায়াকে চেখে দেখুক, কেমন কল্কাতার কারিকর তোমরা! না, না, আমাকে আবার কেন? তবে আধখানা—আধখানার বেশী নয়। ওরে ও ষষ্ঠীচরণ, একটু জল আন্ দিকি বাবা, হাতটা ধুয়ে ফেলি—” রমেশ ডাকিয়া বলিয়া দিল, “অমনি বাড়ীর ভিতর থেকে গোটা-চারেক থালাও নিয়ে আসিস্ ষষ্ঠীচরণ।” প্রভুর আদেশমত ভিতর হইতে গোটাতিনেক রেকাবি ও জলের গেলাস আসিল এবং দেখিতে দেখিতে এই বৃহৎ থালার অর্দ্ধেক মিষ্টান্ন এই তিনটি প্রাচীন ম্যালেরিয়াক্লিষ্ট, কৃশ, সদ্ব্রাহ্মণের জলযোগে নিঃশেষিত হইয়া গেল। “হাঁ, কল্কাতার কারিকর বটে! কি বল ধর্ম্মদাসদা?” বলিয়া দীননাথ রুদ্ধনি:শ্বাস ত্যাগ করিলেন। ধর্ম্মদাস-দা’র তখনও শেষ হয় নাই, এবং যদিচ তাঁহার অব্যক্ত কণ্ঠস্বর সন্দেশের তাল ভেদ করিয়া সহজে মুখ দিয়া বাহির হইতে পারিল না, তথাপি বোঝা গেল, এ বিষয়ে তাঁহার মতভেদ নাই। “হাঁ, ওস্তাদি হাত বটে” বলিয়া গোবিন্দ সকলের শেষে হাত ধুইবার উপক্রম করিতেই ময়রা সবিনয়ে অনুরোধ করিল, “যদি কষ্টই করলেন ঠাকুর মশাই, তবে মিহিদানাটাও অমনি পরখ ক’রে দিন।” “মিহিদানা? কৈ, আন দেখি বাপু?” মিহিদানা আসিল এবং এতগুলি সন্দেশের পরে এই নূতন বস্তুটির সদ্ব্যবহার দেখিয়া রমেশ নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল! দীননাথ মেয়ের প্রতি হস্ত প্রসারিত করিয়া কহিলেন, “ওরে ও খেঁদি, ধর্ দিকি মা, এই দুটো মিহিদানা।” “আমি আর খেতে পার্ব না বাবা।” “পার্বি, পার্বি।” এক ঢোক জল খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নে দিকি, মুখ মেরে গেছে বৈ ত নয়! না পারিস্, আঁচলে একটা গেরো দিয়ে রাখ্, কা’ল সকালে খাস্। হাঁ বাপু, খাওয়ালে বটে! যেন অমৃত! তা’ বেশ হয়েচে। মিষ্টি বুঝি দুরকম কর্লে বাবাজী!” রমেশকে বলিতে হইল না। ময়রা সোৎসাহে কহিল, “আজ্ঞে না, রসগোল্লা, ক্ষীরমোহন—”
“অ্যাঁ, ক্ষীরমোহন! কৈ, সে ত বা’র করলে না বাপু?” বিস্মিত রমেশের মুখের পানে চাহিয়া দীননাথ কহিল, “খেয়েছিলুম বটে, রাধানগরের বোসেদের বাড়ীতে। আজও যেন মুখে লেগে রয়েচে। বল্লে বিশ্বাস করবে না বাবাজী, ক্ষীরমোহন খেতে আমি বড্ড ভালোবাসি।” রমেশ হাসিয়া একটুখানি ঘাড় নাড়িল। কথাটা বিশ্বাস করা তাহার কাছে অত্যন্ত কঠিন বলিয়া মনে হইল না। রাখাল কি কাজে বাহিরে যাইতেছিল। রমেশ তাহাকে ডাকিয়া কহিল, “ভেতরে বোধ করি আচায্যিমশাই আছেন; যা ত রাখাল, কিছু ক্ষীরমোহন তাঁকে আন্তে ব’লে আয় দেখি।” সন্ধ্যা বোধ করি উত্তীর্ণ হইয়াছে। তথাপি ব্রাহ্মণেরা ক্ষীরমোহনের আশায় উৎসুক হইয়া বসিয়া আছেন। রাখাল ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “আজ আর ভাঁড়ারের চাবি খোলা হবে না বাবু।” রমেশ মনে মনে বিরক্ত হইল। কহিল, “বল্ গে, আমি আন্তে বল্ছি।”
গোবিন্দ গাঙ্গুলী রমেশের অসন্তোষ লক্ষ্য করিয়া চোক ঘুরাইয়া কহিল, “দখ্লে দীনু দা ভৈরবের আক্কেল? এ যে দেখি মায়ের চেয়ে মাসীর বেশী দরদ। সেইজন্যই, আমি বলি—” তিনি কি বলেন, তাহা না শুনিয়াই রাখাল বলিয়া উঠিল—“আচায্যিমশাই কি কর্বেন? ও-বাড়ী থেকে গিন্নীমা এসে ভাঁড়ার বন্ধ করেছেন যে!” ধর্ম্মদাস এবং গোবিন্দ উভয়ে চমকিয়া উঠিল—“কে, বড়-গিন্নী?” রমেশ সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল, “জ্যাঠাইমা এসেছেন?” “আজ্ঞে হাঁ, তিনি এসেই ছোট বড় দুই ভাঁড়ারই তালাবন্ধ ক’রে ফেলেচেন।” বিস্ময়ে, আনন্দে, রমেশ দ্বিতীয় কথাটি না বলিয়া দ্রুতপদে ভিতরে চলিয়া গেল।