পল্লী-সমাজ/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
এমনি একটা আশঙ্কা যে রমেশের মাথায় একেবারেই আসে নাই, তাহা নহে। তথাপি, পরদিন সন্ধ্যার সময়ে গোপাল সরকার সদর হইতে ফিরিয়া আসিয়া যখন সত্য সত্যই জানাইল যে, ভৈরব আচার্য্য তাহাদের মাথার উপরেই কাঁঠাল ভাঙিয়া ভক্ষণ করিয়াছে, অর্থাৎ সে মকদ্দমায় হাজির হয় নাই, এবং তাহা এক-তরফা হইয়া ডিস্মিস হইয়া গিয়া তাহাদের প্রদত্ত জমা টাকাটা বেণী প্রভৃতির হস্তগত হইয়াছে, তখন, একমুহূর্ত্তেই রমেশের ক্রোধের শিখা বিদ্যুদ্বেগে তাহার পদতল হইতে ব্রহ্মরন্ধ্র পর্য্যন্ত জ্বলিয়া উঠিল। সে দিন ইহাদের জাল ও জুয়াচুরি দমন করিতে যে মিথ্যাঋণ সে ভৈরবের হইয়া জমা দিয়াছিল, মহাপাপিষ্ঠ ভৈরব তাহার দ্বারাই নিজের মাথা বাঁচাইয়া লইয়া পুনরায় বেণীর সহিতই সখ্য স্থাপন করিয়াছে। তাহার এই কৃতঘ্নতা কল্যকার অপমানকেও বহু ঊর্দ্ধে ছাপাইয়া আজ রমেশের মাথার ভিতরে প্রজ্বলিত হইতে লাগিল। রমেশ যেমন ছিল, তেম্নি খাড়া উঠিয়া বাহির হইয়া গেল। আত্মসংবরণের কথাটা তাহার মনেও হইল না। প্রভুর রক্তচক্ষু দেখিয়া ভীত হইয়া, গোপাল জিজ্ঞাসা করিল,—“বাবু কি কোথাও যাচ্চেন?” “আস্চি” বলিয়া রমেশ দ্রুতপদে চলিয়া গেল। ভৈরবের বহির্বাটীতে ঢুকিয়া দেখিল, কেহ নাই। ভিতরে প্রবেশ করিল। তখন আচার্য্য-গৃহিণী সন্ধ্যাদীপ-হাতে প্রাঙ্গণের তুলসীমঞ্চ-মূলে আসিতেছিলেন; অকস্মাৎ রমেশকে সুমুখে দেখিয়া একেবারে জড়সড় হইয়া গেলেন। যে কখনও আসে না, সে যে আজ কেন আসিয়াছে, তাহা মনে করিতেই ভয়ে তাঁহার হৃৎপিণ্ড কণ্ঠের কাছে ঠেলিয়া আসিল! রমেশ তাঁহাকেই প্রশ্ন করিল,—“আচায্যি মশাই কৈ?” গৃহিণী অব্যক্তস্বরে যাহা বলিলেন, তাহা শোনা গেল না বটে, কিন্তু বুঝা গেল, তিনি ঘরে নাই। রমেশের গায়ে একটা জামা অবধি ছিল না। সন্ধ্যার অস্পষ্ট আলোকে তাহার মুখও ভাল দেখা যাইতেছিল না। এমন সময়ে ভৈরবের বড় মেয়ে লক্ষ্মী ছেলে-কোলে গৃহের বাহির হইয়াই এই অপরিচিত লোকটাকে দেখিয়া মাকে জিজ্ঞাসা করিল,—“কে মা?” তাহার জননী পরিচয় দিতে পারিলেন না, রমেশও কথা কহিল না। লক্ষ্মী ভয় পাইয়া চেঁচাইয়া ডাকিল,—“বাবা, কে একটা লোক উঠনে এসে দাঁড়িয়েচে, কথা কয় না।”
“কে রে?” বলিয়া সাড়া দিয়া তাহার পিতা ঘরের বাহিরে আসিয়াই একেবারে কাঠ হইয়া গেল। সন্ধ্যার ম্লান-ছায়াতেও সেই দীর্ঘ, ঋজু-দেহ চিনিতে তাহার বাকী রহিল না। রমেশ কঠোরস্বরে ডাকিল,—“নেমে আসুন।” বলিয়া তৎক্ষণাৎ নিজেই উঠিয়া গিয়া বজ্রমুষ্টিতে ভৈরবের একটা হাত ধরিয়া ফেলিল। কহিল,—“কেন এমন কাজ কর্লেন?” ভৈরব কাঁদিয়া উঠিল, “মেরে ফেল্লে রে লক্ষ্মী, বেণী বাবুকে খবর দে।” সঙ্গে সঙ্গে বাড়ীশুদ্ধ ছেলে-মেয়ে চেঁচাইয়া কাঁদিয়া উঠিল এবং চোখের পলকে সন্ধ্যার নীরবতা বিদীর্ণ করিয়া বহুকণ্ঠের গগনভেদী কান্নার রোলে সমস্ত পাড়া ত্রস্ত হইয়া উঠিল। রমেশ তাহাকে একটা প্রচণ্ড ঝাঁকানি দিয়া কহিল,—“চুপ। বলুন, কেন এ কাজ ক’র্লেন?” ভৈরব উত্তর দেবার চেষ্টামাত্র না করিয়া, একভাবে চীৎকার করিয়া গলা ফাটাইতে লাগিল, এবং নিজেকে মুক্ত করিবার জন্য টানাহেঁচড়া করিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে পাড়ার মেয়ে-পুরুষে প্রাঙ্গণ পরিপূর্ণ হইয়া গেল; এবং, তামাসা দেখিতে আরও লোক ভিড় করিয়া ভিতরে ঢুকিতে ঠেলা-ঠেলি করিতে লাগিল। কিন্তু, ক্রোধান্ধ রমেশ সেদিকে লক্ষ্যই করিল না। শতচক্ষুর কৌতূহলী দৃষ্টির সম্মুখে দাঁড়াইয়া সে উন্মত্তের মত ভৈরবকে ধরিয়া একভাবে নাড়া দিতে লাগিল। একে রমেশের গায়ের জোর অতিরঞ্জিত হইয়া প্রবাদের মত দাঁড়াইয়াছিল; তাহাতে তাহার চোখের পানে চাহিয়া এই একবাড়ী লোকের মধ্যে এমন সাহস কাহারও হইল না যে, হতভাগ্য ভৈরবকে ছাড়াইয়া দেয়। গোবিন্দ বাড়ী ঢুকিয়াই ভিড়ের মধ্যে মিশিয়া গেলেন। বেণী উঁকি মারিয়াই সরিতেছিলেন, ভৈরব দেখিতে পাইয়া কাঁদিয়া উঠিল—“বড়বাবু—” বড়বাবু কিন্তু কর্ণপাত করিলেন না, চোখের নিমিষে কোথায় মিলাইয়া গেলেন। সহসা জনতার মধ্যে একটুখানি পথের মত হইল এবং পরক্ষণেই রমা দ্রুতপদে আসিয়া রমেশের হাত চাপিয়া ধরিল। কহিল,—“হয়েছে—এবার ছেড়ে দাও।” রমেশ তাহার প্রতি অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া কহিল,—“কেন?” রমা দাঁতে দাঁত চাপিয়া অস্ফুট-ক্রুদ্ধ-কণ্ঠে বলিল,—“এত লোকের মাঝ্খানে তোমার লজ্জা করে না, কিন্তু, আমি যে লজ্জায় ম’রে যাই!” রমেশ প্রাঙ্গণপূর্ণ লোকের পানে চাহিয়া, তৎক্ষণাৎ ভৈরবের হাত ছাড়িয়া দিল। রমা তেম্নি মৃদুস্বরে কহিল,—“বাড়ী যাও।” রমেশ দ্বিরুক্তি না করিয়া বাহির হইয়া গেল। হঠাৎ এ যেন একটা ভোজবাজি হইয়া গেল! কিন্তু, সে চলিয়া গেলে, রমার প্রতি তাহার এই নিরতিশয় বাধ্যতায় সবাই যেন কি একরকম মুখ-চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিল। এবং এমন জিনিসটা এত আড়ম্বরে আরম্ভ হইয়া এভাবে শেষ হইয়া যাওয়াটা কাহারই যেন মনঃপূত হইল না।
লোকজন চলিয়া গেল। গোবিন্দ গাঙুলি আত্মপ্রকাশ করিয়া একটা আঙুল তুলিয়া, মুখখানা অতিরিক্ত গম্ভীর করিয়া কহিল,—“বাড়ী চড়াও হয়ে যে আধমরা ক’রে দিয়ে গেল, এর কি করবে, সেই পরামর্শ কর।” ভৈরব দুই হাঁটু বুকের কাছে জড় করিয়া বসিয়া হাঁপাইতেছিল, নিরুপায়ভাবে বেণীর মুখপানে চাহিল। রমা তখনও যায় নাই। বেণীর অভিপ্রায় অনুমান করিয়া তাড়াতাড়ি কহিল,—“কিন্তু, এ পক্ষের দোষও ত কম নেই বড়দা’? তা ছাড়া, হয়েচেই বা কি, যে, এই নিয়ে হৈচৈ কর্তে হবে!” বেণী ভয়ানক আশ্চর্য্য হইয়া কহিল,—“বল কি রমা?” ভৈরবের বড়মেয়ে তখনও একটা খুঁটি আশ্রয় করিয়া দাঁড়াইয়া কাঁদিতেছিল। সে দলিতা ফণিনীর মত একেবারে গর্র্জ্জাইয়া উঠিল, “তুমি ত ওর হয়ে বল্বেই রমাদিদি! তোমার বাপকে কেউ ঘরে ঢুকে মেরে গেলে কি কর্তে বল ত?” তাহার গর্জ্জনে রমা প্রথমটা চম্কিয়া গেল। সে যে পিতার মুক্তির জন্য কৃতজ্ঞ নয়—তা’ না হয় নাই হইল; কিন্তু, তাহার তীব্রতার ভিতর হইতে এমন একটা কটু শ্লেষের ঝাঁঝ আসিয়া রমার গায়ে লাগিল যে, সে পরমুহূর্ত্তেই জ্বলিয়া উঠিল। কিন্তু, আত্মসংবরণ করিয়া কহিল,—“আমার বাপ ও তোমার বাপে অনেক তফাত লক্ষ্মী, তুমি সে তুলনা কোরো না; কিন্তু, আমি কারও হয়েই কোনও কথা বলিনি, ভালর জন্যেই বলেছিলাম।” লক্ষ্মী পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, ঝগড়ায় অপটু নহে। সে তাড়িয়া আসিয়া বলিল,—“বটে! ওর হয়ে কোঁদল কর্তে তোমার লজ্জা করে না? বড়লোকের মেয়ে ব’লে কেউ ভয়ে কথা কয় না—নইলে কে না শুনেচে? তুমি ব’লে তাই মুখ দেখাও, আর কেউ হ’লে গলায় দড়ি দিত!” বেণী লক্ষ্মীকে একটা তাড়া দিয়া বলিল,—“তুই থাম্ না লক্ষ্মী! কাজ কি ওসব কথায়?” লক্ষ্মী কহিল,—“কাজ নেই কেন? যার জন্যে বাবাকে এত দুঃখ পেতে হ’ল, তার হয়েই উনি কোঁদল করবেন? বাবা যদি আজ মারা যেতেন!” রমা নিমেষের জন্য স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিল মাত্র। বেণীর কৃত্রিম-ক্রোধের স্বর তাহাকে আবার প্রজ্বলিত করিয়া দিল। সে লক্ষ্মীর প্রতি চাহিয়া কহিল,—“লক্ষ্মী, ওঁর মত লোকের হাতে মর্তে পাওয়াও ভাগ্যের কথা; আজ মারা পড়লে তোমার বাবা স্বর্গে যেতে পার্ত।” লক্ষ্মীও জ্বলিয়া উঠিল,—“ওঃ, তাইতেই বুঝি তুমি মরেচ, রমাদিদি?” রমা আর জবাব দিল না। তাহার দিক্ হইতে মুখ ফিরাইয়া লইয়া বেণীর প্রতি চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল,—“কিন্তু কথাটা কি, তুমিই বল ত বড়দা’?” বলিয়া সে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল। তাহার দৃষ্টি যেন অন্ধকার ভেদ করিয়া বেণীর বুকের ভিতর পর্য্যন্ত দেখিতে লাগিল। বেণী ক্ষুব্ধভাবে বলিলেন,—“কি ক’রে জান্ব বোন! লোকে কত কথা বলে—তাতে কান দিলে ত চলে না।” “লোকে কি বলে?”
বেণী পরম-তাচ্ছল্যভাবে কহিলেন,—“বললেই বা রমা, লোকের কথাতে ত আর গায়ে ফোস্কা পড়ে না। বলুক না।” তাহার এই কপট সহানুভূতি রমা টের পাইল। এক মুহূর্ত্ত চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল,—“তোমার গাঁয়ে হয় ত কিছুতেই ফোস্কা পড়ে না। কিন্তু, সকলের গাঁয়ে ত গণ্ডারের চাম্ড়া নেই! কিন্তু, লোককে একথা বলাচ্চে কে? তুমি?”
“আমি?”
রমা প্রাণপণ-শক্তিতে ভিতরের দুর্নিবার ক্রোধ সংবরণ করিয়া রাখিতেছিল—এখনও তাহার কণ্ঠস্বরে তাহা প্রকাশ পাইল না। বলিল,—“তুমি ছাড়া আর কেউ নয়। পৃথিবীতে কোন দুষ্কর্মই ত তোমার বাকি নেই—চুরি, জুয়াচুরি, জাল, ঘরে আগুন-দেওয়া, সবই হয়ে গেছে, এটাই বাঁ বাকি থাকে কেন?” বেণী হতবুদ্ধি হইয়া হঠাৎ কাথা কহিতেই পারিল না। রমা কহিল,—“মেয়েমানুষের এর বড়ো সর্ব্বনাশ যে আর নেই, সে বোঝবার তোমার সাধ্য নেই! কিন্তু, জিজ্ঞাসা করি, এ কলঙ্ক রটিয়ে তোমার লাভ কি?” বেণী ভীত হইয়া বলিল,—“আমার লাভ কি হবে! লোকে যদি তোমাকে রমেশের বাড়ী থেকে ভোরবেলা বা’র হতে দেখে—আমি কর্ব কি?” রমা সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া, বলিতে লাগিল,—“এত লোকের সাম্নে আমি আর বলতে চাইনে। কিন্তু, তুমি মনে কোরো না বড়দা’, তোমার মনের ভাব আমি টের পাইনি! কিন্তু, এ নিশ্চয় জেনো, আমি মর্বার আগে তোমাকেও জ্যান্ত রেখে যাবো না।” আচার্য্য-গৃহিণী এতক্ষণ নিঃশব্দে নিকটে কোথাও দাঁড়াইয়াছিলেন; সরিয়া আসিয়া রমার একটা বাহু ধরিয়া ঘোমটার ভিতর হইতে মৃদুস্বরে বলিলেন,—“পাগল হয়েচ, মা, এখানে তোমাকে না জানে কে?” নিজের কন্যার উদ্দেশে বলিলেন, ““লক্ষ্মি, মেয়েমানুষ হয়ে মেয়েমানুষের নামে এ অপবাদ দিস্নে রে, ধর্ম্ম সইবেন না। আজ ইনি তোদের যে উপকার করেচেন, তোরা মানুষের মেয়ে হ’লে তা’ টের পেতিস্।” বলিয়া টানিয়া রমাকে ঘরে লইয়া গেলেন। আচার্য্য-গৃহিণীর স্বামীর উদ্দেশে এই কঠোর শ্লেষ, এবং নিরপেক্ষ সত্যবাদিতায় উপস্থিত সকলেই যেন কুণ্ঠিত হইয়া সরিয়া পড়িল।
এই ঘটনার কার্য্য-কারণ যত বড় এবং যাই হোক, নিজের কদাকার অসংযমে রমেশের শিক্ষিত, ভদ্র অন্তঃকরণ সম্পূর্ণ দুইটা দিন এম্নি সঙ্কুচিত হইয়া রহিল যে, সে বাটীর বাহির হইতেই পারিল না। তথাপি এত লোকের মধ্য হইতে রমা যে স্বেচ্ছায় তাহার লজ্জার অংশ লইতে আসিয়াছিল, এই চিন্তাটা তাহার সমস্ত লজ্জার কালোমেঘের গায়ে দিগন্তলুপ্ত, অতি ঈষৎ বিদ্যুৎ-স্ফূরণের মত ক্ষণেক্ষণে যেন সৌন্দর্য্য ও মাধুর্য্যের দীপ্তরেখা আঁকিয়া দিতেছিল। তাই তাহার গ্লানির মধ্যেও পরিতৃপ্তির পীড়া ছিল। এই দুঃখ ও সুখের বেদনা লইয়া, সে যখন আরও কিছুদিন তাহার নির্জ্জন-গৃহের মধ্যে অজ্ঞাতবাসের সঙ্কল্প করিতেছিল, তখন তাহাকেই উপলক্ষ্য করিয়া বাহিরে যে আর একজনের মাথার উপর নিরবিচ্ছিন্ন লজ্জা ও অপমানের পাহাড় ভাঙিয়া পড়িতেছিল, তাহা সে স্বপ্নেও ভাবে নাই।
কিন্তু লুকাইয়া থাকিবার সুযোগ তাহার ঘটিল না। আজ বৈকালে পীরপুরের মুসলমান প্রজারা তাহাদের পঞ্চায়েত বৈঠকে উপস্থিত হইবার জন্য তাহাকে ডাকিতে আসিল। এ বৈঠকের আয়োজন রমেশ নিজেই কিছুদিন পূর্ব্বে করিয়া আসিয়াছিল। সেইমত, তাহারা আজ একত্র হইয়া ছোট বাবুর জন্যই অপেক্ষা করিয়া বসিয়া আছে বলিয়া যখন সংবাদ দিয়া গেল, তখন তাহাকে যাইবার জন্য উঠিতেই হইল। কেন, তাহা বলিতেছি।
রমেশ সন্ধান লইয়া জানিয়াছিল, প্রত্যেক গ্রামেই কৃষকদিগের মধ্যে দরিদ্রের সংখ্যা অত্যন্ত অধিক; অনেকেরই এক ফোঁটা জমি-জায়গা নাই; পরের জমিতে খাজনা দিয়া বাস করে, এবং পরের জমিতে ‘জন’ খাটিয়া উদরান্নের সংস্থান করে। দু’দিন কাজ না পাইলে, কিংবা অসুখ-বিসুখে কাজ করিতে না পারিলেই, সপরিবারে উপবাস করে। খোঁজ করিয়া আরও অবগত হইয়াছিল যে, ইহাদের অনেকেরই একদিন সঙ্গতি ছিল, শুধু ঋণের দায়েই সমস্ত গিয়াছে। ঋণের ব্যবস্থাও সোজা নয়। মহাজনেরা জমি বাঁধা রাখিয়া ঋণ দেয়, কিন্তু প্রায়ই সুদ গ্রহণ করে না; ফসলের অংশ দাবী করে। সুদ কষিলে এই অংশের মূল্য সময়ে সময়ের আসলের অনতিদূরে গিয়া পৌঁছে। সুতরাং একবার যে কোন কৃষক সামাজিক ক্রিয়াকর্ম্মের দায়েই হৌক, বা অনাবৃষ্টির অতিবৃষ্টির জন্যই হৌক্, ঋণ করিতে বাধ্য হয়, সে আর সামলাইয়া উঠিতে পারে না। প্রতি বৎসরেই তাঁহাকে সেই মহাজনের দ্বারে গিয়া হাত পাতিতে হয়! এ বিষয়ে হিন্দু-মুসলমানের একই অবস্থা। কারণ, মহাজনেরা প্রায় হিন্দু। রমেশ সহরে থাকিতে এ সম্বন্ধে বই পড়িয়া যাহা জানিয়াছিল, গ্রামে আসিয়া তাহাই চোখে দেখিয়া, প্রথমটা একেবারে অভিভূত হইয়া পড়িল। তাহার অনেক টাকা ব্যাঙ্কে পড়িয়াছিল। এই টাকা এবং আরও কিছু টাকা সংগ্রহ করিয়া, এই সকল দুর্ভাগাদিগকে মহাজনের কবল হইতে উদ্ধার করিবার জন্য সে কোমর বাঁধিয়া লাগিল। কিন্তু দুই একটা কাজ করিয়াই ধাক্কা খাইয়া দেখিল যে, এই সকল দরিদ্রদিগকে সে যতটা অসহায় এবং কৃপাপাত্র বলিয়া ভাবিয়াছিল, অনেক সময়েই তাহা ঠিক নয়। ইহারা দরিদ্র নিরুপায় এবং অল্পবুদ্ধিজীবী বটে, কিন্তু, বজ্জাতি বুদ্ধিতে ইহারা কম নহে। ধার করিয়া শোধ না দিবার প্রবৃত্তি ইহাদের যথেষ্ট প্রবল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরলও নয়, সাধুও নয়। মিথ্যা বলিতে ইহারা আধোবদন হয় না এবং ফাঁকি দিতে জানে। প্রতিবেশীর স্ত্রী কন্যা সম্বন্ধে সৌন্দর্য্যচর্চ্চার সখও মন্দ নাই। পুরুষের বিবাহ হওয়া কঠিন ব্যাপার; অথচ নানা বয়সের বিধবায় প্রতি গৃহস্থ ভারাক্রান্ত। তাই, নৈতিক স্বাস্থ্যও অতিশয় দুস্থ। সমাজ ইহাদিগের আছে,—তাহার শাসনও কম নয়; কিন্তু পুলিশের সহিত চোরের যে সম্বন্ধ, সমাজের সহিত ইহারা ঠিক সেই সম্বন্ধ পাতাইয়া রাখিয়াছে। অথচ সর্ব্বসমেত ইহারা এমন পীড়িত, এত দুর্ব্বল, এমন নিঃস্ব যে, রাগ করিয়া বসিয়া থাকাও অসম্ভব। বিদ্রোহী বিপথগামী সন্তানের প্রতি পিতার মনোভাব যা হয়, রমেশের অন্তরটা ঠিক তেমনি করিতেছিল বলিয়াই আজিকার সন্ধ্যায় সে পীরপুরের নূতন ইস্কুলঘরে পঞ্চায়েত আহ্বান করিয়াছিল। কিছুক্ষণ হইল, সন্ধ্যার ঝাপসা-ঘোর কাটিয়া গিয়া দশমীর জ্যোৎস্নায় জানালার বাহিরে মুক্ত-প্রান্তরের এদিক্ ওদিক্ ভরিয়া গিয়াছিল। সেই দিকে চাহিয়া রমেশ যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়াও যাই-যাই করিয়া বিলম্ব করিতেছিল। এমন সময়ে রমা আসিয়া তাহার দোরগোড়ায় দাঁড়াইল। সে স্থানটায় আলো ছিল না, রমেশ বাটীর দাসী মনে করিয়া কহিল,—“কি চাও?” “আপনি কি বাইরে যাচ্চেন?” রমেশ চমকিয়া উঠিল—“এ কি রমা? এমন সময় যে!” যেহেতু তাহাকে সন্ধ্যার আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইয়াছিল, তাহা বলা বাহুল্য; কিন্তু যে জন্য সে আসিয়াছিল, সে অনেক কথা। অথচ, কি করিয়া যে আরম্ভ করিবে, ভাবিয়া না পাইয়া রমা স্থির হইয়া রহিল। রমেশও কথা কহিতে পারিল না। খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া, রমা প্রশ্ন করিল,—“আপনার শরীর এখন কেমন আছে?”
“ভাল নয়। আবার রোজ রাত্রেই জ্বর হচ্চে।”
“তা’হলে কিছুদিন বাইরে ঘুরে এলে ত ভাল হয়।” রমেশ হাসিয়া কহিল,—“ভাল ত হয় জানি, কিন্তু, যাই কি ক’রে?” তাহার হাসি দেখিয়া রমা বিরক্ত হইল। কহিল,—“আপনি বল্বেন, আপনার অনেক কাজ; কিন্তু এমন কাজ কি আছে, যা নিজের শরীরের চেয়েও বড়?” রমেশ পূর্ব্বের মতই হাসিয়া জবাব দিল,—“নিজের দেহটা যে ছোট জিনিস, তা’ আমি বলিনে। কিন্তু, এমন কাজ মানুষের আছে, যা’ এই দেহটার চেয়ে অনেক বড়,—কিন্তু, সে ত তুমি বুঝবে না রমা!” রমা মাথা নাড়িয়া কহিল,—“আমি বুঝতেও চাইনে। কিন্তু আপনাকে আর কোথাও যেতেই হবে। সরকার মশায়কে ব’লে দিয়ে যান, আমি তাঁর কাজকর্ম্ম দেখ্ব!” রমেশ বিস্মিত হইয়া কহিল,—“তুমি আমার কাজকর্ম্ম দেখ্বে? কিন্তু—”
“কিন্তু কি?”
“কিন্তু কি জানো রমা, আমি তোমাকে বিশ্বাস কর্তে পার্ব কি?” রমা অসঙ্কোচে তৎক্ষণাৎ কহিল,—“ইতরে পারে না, কিন্তু আপনি পার্বেন।” তাহার দৃঢ়কণ্ঠের এই অচিন্তনীয় উক্তিতে রমেশ বিস্ময়ে স্তব্ধ হইয়া গেল। কিন্তু, ক্ষণেক মৌন থাকিয়া বলিল,—“আচ্ছা, ভেবে দেখি।” রমা মাথা নাড়িয়া কহিল, “না, ভাববার সময় নেই,—আজই আপনাকে আর কোথাও যেতে হবে। না গেলে—” বলিতে বলিতেই সে স্পষ্ট অনুভব করিল, রমেশ বিচলিত হইয়া উঠিয়াছে। কারণ, অকস্মাৎ এমন করিয়া না পলাইলে বিপদ্ যে কি ঘটিতে পারে, তাহা অনুমান করা কঠিন নয়। রমেশ ঠিকই অনুমান করিল; কিন্তু, আত্ম-সংবরণ করিয়া কহিল,—“ভাল, তাই যদি যাই, তাতে তোমার লাভ কি? আমাকে বিপদে ফেল্তে তুমি নিজেও ত কম চেষ্টা কর নি যে, আজ আর একটা বিপদে সতর্ক ক’র্তে এসেচ! সে-সব কাণ্ড এত পুরাণো হয়নি যে, তোমার মনে নেই। বরং, খুলে বল, আমি গেলে তোমার নিজের কি সুবিধে হয়, আমি চ’লে যেতে হয় ত রাজী হতেও পারি।” বলিয়া সে যে—উত্তরের প্রত্যাশায় রমার অস্পষ্ট মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল, তাহা পাইল না। কত বড় অভিমান যে রমার বুক জুড়িয়া উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল, তাহাও জানা গেল না, রমেশের নিষ্ঠুর বিদ্রূপের আঘাতে মুখ যে তাহার কিরূপ বিবর্ণ হইয়া রহিল, তাহাও অন্ধকারে লক্ষ্য-গোচর হইল না। কিছুক্ষণ স্থির হইয়া রমা আপনাকে সামলাইয়া লইল। পরে কহিল,—“আচ্ছা, খুলেই বলচি। আপনি গেলে আমার লাভ কিছুই নেই, কিন্তু না গেলে অনেক ক্ষতি। আমাকে সাক্ষী দিতে হবে।” রমেশ শুষ্ক হইয়া কহিল,—“এই? কিন্তু সাক্ষী না দিলে?” রমা আবার একটুখানি থামিয়া কহিল,—“না দিলে? না দিলে দুদিন পরে আমার মহামায়ার পূজায় কেউ আস্বে না, আমার যতীনের উপনয়নে কেউ খাবে না—আমার বার-ব্রত—” এরূপ দুর্ঘটনার সম্ভাবনামাত্রে রমা শিহরিয়া উঠিল। রমেশের আর না শুনিলেও চলিত, কিন্তু থাকিতে পারিল না। কহিল,—“তার পরে?” রমা ব্যাকুল হইয়া বলিল,—“তারও পরে? না তুমি যাও—আমি মিনতি কর্চি রমেশদা’,—আমাকে সব দিকে নষ্ট কোরো না; তুমি যাও,—যাও এ দেশ থেকে।” কিছুক্ষণ পর্য্যন্ত উভয়েই নীরব হইয়া রহিল। ইতিপূর্ব্বে যেখানে, যে কোন অবস্থায় হৌক, রমাকে দেখিলেই রমেশের বুকের রক্ত অশান্ত হইয়া উঠিত। মনে মনে শত যুক্তি প্রয়োগ করিয়া, নিজের অন্তরকে সহস্র কটূক্তি করিয়াও তাহাকে শান্ত করিতে পারিত না। হৃদয়ের এই নীরব বিরুদ্ধতায় সে দুঃখ পাইত, লজ্জা অনুভব করিত, ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিত; কিন্তু কিছুতেই তাহাকে বশে আনিতে পারিত না। বিশেষ করিয়া আজ এইমাত্র নিজের গৃহের মধ্যে সেই রমাকে অকস্মাৎ একাকিনী উপস্থিত হইতে দেখিয়া কল্যকার কথা স্মরণ করিয়াই তাহার হৃদয়-চাঞ্চল্য একেবারে উদ্দাম হইয়া উঠিয়াছিল। রমার শেষ কথায় এতদিন পরে আজ সেই হৃদয় স্থির হইল। রমার ভয়-ব্যাকুল নির্ব্বন্ধতায় অখণ্ড স্বার্থপরতার চেহারা এতই সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল যে, তাহার অন্ধ হৃদয়েরও আজ চোখ খুলিয়া গেল। রমেশ গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিল,—“আচ্ছা, তাই হবে। কিন্তু আজ আর সময় নেই। কারণ, আমার পালাবার হেতুটা যত বড়ই তোমার কাছে হোক্, আজ রাত্রিটা আমার কাছে তার চেয়েও গুরুতর। তোমার দাসীকে ডাকো, আমাকে এখনই বা’র হ’তে হবে।” রমা আস্তে আস্তে বলিল,—“আজ কি কোনমতেই যাওয়া হ’তে পারে না?” “না। তোমার দাসী গেল কোথায়?” “কেউ আমার সঙ্গে আসেনি।” রমেশ অবাক হইয়া বলিল,—“সে কি কথা! এখানে একা এলে কোন্ সাহসে? একজন দাসী পর্য্যন্ত সঙ্গে ক’রে আননি!” রমা তেম্নি মৃদু স্বরে কহিল,—“তাতেই বা কি হ’ত? সেও ত আমাকে তোমার হাত থেকে রক্ষা ক’র্তে পার্ত না!” “তা না পারুক, লোকের মিথ্যা দুর্নাম থেকে ত বাঁচাতে পারত! রাত্রি কম হয়নি রাণি!” সেই বহুদিনের বিস্মৃত নাম! সহসা কি একটা বলিবার জন্য রমার অত্যন্ত আবেগ উপস্থিত হইল, কিন্তু সে সংবরণ করিয়া ফেলিল। তাঁর পর শুধু কহিল,—“তাতেও ফল হ’ত না রমেশদা’! অন্ধকার রাত্রি নয়—আমি বেশ যেতে পারব।” বলিয়া আর কোন কথার জন্য অপেক্ষা না করিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।