বিষয়বস্তুতে চলুন

পল্লী-সমাজ/সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে
১৭

 বিশ্বেশ্বরী ঘরে ঢুকিয়া অশ্রুভরা রোদনের কণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন,—“আজ কেমন আছিস্‌ মা রমা?” রমা তাঁহার মুখের পানে চাহিয়া একটুখানি হাসিয়া বলিল,—“আজ ভাল আছি জ্যাঠাইমা।” বিশ্বেশ্বরী তার শিয়রে আসিয়া বসিলেন এবং মাথায় মুখে হাত বুলাইতে লাগিলেন। আজ তিনমাসকাল রমা শয্যাগত। বুক জুড়িয়া কাসি এবং ম্যালেরিয়া বিষে সর্ব্বাঙ্গ সমাচ্ছন্ন। গ্রামের প্রাচীন কবিরাজ প্রাণপণে ইহার বৃথা চিকিৎসা করিয়া মরিতেছে। সে বুড়া ত জানে না, কিসের অবিশ্রাম আক্রমণে তাহার সমস্ত স্নায়ুশিরা অহর্নিশি পুড়িয়া খাক্‌ হইয়া যাইতেছে। শুধু বিশ্বেশ্বরীর মনের মধ্যে একটা সংশয়ের ছায়া ধীরে ধীরে গাঢ় হইয়া উঠিতেছিল। রমাকে তিনি কন্যার মতই স্নেহ করিতেন, সেখানে কোন ফাঁকি ছিল না; তাই সেই অত্যন্ত স্নেহই রমার সম্বন্ধে তাঁহার সত্য-দৃষ্টিকে অসামান্যরূপে তীক্ষ্ণ করিয়া দিতেছিল। অপরে যখন ভুল বুঝিয়া, ভুল আশা করিয়া, ভুল ব্যবস্থা করিতে লাগিল, তাঁহার তখন বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল। তিনি দেখিতেছিলেন, রমার চোখ দুটি গভীর কোটরপ্রবিষ্ট, কিন্তু দৃষ্টি অতিশয় তীব্র। যেন বহু দূরের কিছু একটা অত্যন্ত কাছে করিয়া দেখিবার একাগ্র বাসনায় এরূপ অসাধারণ তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিয়াছে। বিশ্বেশ্বরী ধীরে ধীরে ডাকিলেন,—“রমা?”

 “কেন জ্যাঠাইমা?”

 “আমি ত তোর মায়ের মত রমা—” রমা বাধা দিয়া বলিল,—“মত কেন জ্যাঠাইমা, তুমিই ত আমার মা।” বিশ্বেশ্বরী হেঁট হইয়া রমার ললাট চুম্বন করিয়া বলিলেন,—“তবে সত্যি ক’রে বল্‌ দেখি মা, তোর কি হয়েছে?”

 “অসুখ করেচে জ্যাঠাইমা!” বিশ্বেশ্বরী লক্ষ্য করিলেন, তাহার এমন পাণ্ডুর মুখখানি যেন পলকের জন্য রাঙা হইয়া উঠিল। তখন গভীর স্নেহে তাহার রুক্ষ চুলগুলি একবার নাড়িয়া দিয়া কহিলেন,—“সে ত এই দুটো চামড়ার চোখেই দেখ্‌তে পাই মা! যা’ এতে ধরা যায় না, তেমন যদি কিছু থাকে, এ সময় মায়ের কাছে লুকোস্‌নে রমা! লুকোলে ত অসুখ সার্‌বে না মা?” জানালার বাহিরে প্রভাত-রৌদ্র তখনও প্রখর হইয়া উঠে নাই এবং মৃদুমন্দ বাতাসে শীতের আভাস দিতে ছিল। সেই দিকে চাহিয়া রমা চুপ করিয়া রহিল। খানিকপরে কহিল,—“বড়-দা’ কেমন আছেন, জ্যাঠাইমা?” বিশ্বেশ্বরী বলিলেন,—“ভাল আছে। মাথায় ঘা’ সার্‌তে এখনও বিলম্ব হবে বটে, কিন্তু ৫।৬ দিনের মধ্যে হাঁসপাতাল থেকে বাড়ী আস্‌তে পার্‌বে।” রমার মুখে বেদনার চিহ্ন অনুভব করিয়া বলিলেন,—“দুঃখ কোরো না মা, এই তার প্রয়োজন ছিল। এতে তার ভালই হবে।” বলিয়া তিনি রমার মুখে বিস্ময়ের আভাস অনুভব করিয়া কহিলেন,—“ভাবচ, মা’ হ’য়ে সন্তানের এত বড় দুর্ঘটনায় এমন কথা কি করে বল্‌চি? কিন্তু, তোমাকে সত্যি বল্‌চি মা, এতে আমি ব্যথা বেশি পেয়েচি, কি আনন্দ বেশি পেয়েচি, তা’ আমি বলতে পারিনে। কেন না, আমি জানি, যারা অধর্ম্মকে ভয় করে না, লজ্জার ভয় যাদের নেই, প্রাণের ভয়টা যদি না তাদের তেম্‌নি বেশি থাকে, তা হ’লে সংসার ছার-খার হয়ে যায়! তাই কেবলই মনে হয় রমা, এই কলুর ছেলে, বেণীর যে মঙ্গল ক’রে দিয়ে গেল, পৃথিবীতে কোন আত্মীয়-বন্ধুই ওর সে ভাল কর্‌তে পার্‌ত না। কয়লাকে ধুয়ে তার রঙ্‌ বদ্‌লানো যায় না, মা, তাকে আগুনে পোড়াতে হয়।” রমা জিজ্ঞাসা করিল,—“বাড়ীতে তখন কি কেউ ছিল না?” বিশ্বেশ্বরী কহিলেন,—“থাক্‌বে না কেন, সবাই ছিল। কিন্তু, সে ত খামকা মেরে বসেনি, নিজে জেলে যাবে ব’লে ঠিক ক'রে, তবে, তেল বেচ্‌তে এসেছিল। তার নিজের রাগ একটুও ছিল না, মা, তাই তার বাঁকের এক ঘায়েই বেণী যখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল, তখন চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে রইল,—আর আঘাত কর্‌লে না। তা’ ছাড়া সে ব’লে গেছে, এর পরেও বেণী সাবধান না হ’লে, সে নিজে আর কখনো ফিরুক, না ফিরুক, এই মারই তার শেষ মার নয়।” রমা আস্তে আস্তে বলিল,—“তার মানে আরও লোক পিছনে আছে। কিন্তু, আমাদের দেশে ছোটলোকের এত সাহস ত কোন দিন ছিল না জ্যাঠাইমা, কোথা থেকে এ তারা পেলে?” বিশ্বেশ্বরী মৃদু হাসিয়া কহিলেন,—“সে কি তুই নিজে জানিস্‌ নে, মা, কে দেশের এই ছোটলোকদের বুক এমন ক’রে ভরে দিয়ে গেছে? আগুন জ্বলে উঠে শুধু শুধু নেবে না রমা! তাকে জোর ক’রে নেবালেও সে আশেপাশের জিনিষ তাতিয়ে দিয়ে যায়। সে আমার ফিরে এসে দীর্ঘজীবী হয়ে যেখানে খুসি সেখানে থাক; বেণীর কথা মনে ক’রে আমি কোন দিন দীর্ঘশ্বাস ফেলব না।” কিন্তু, বলা সত্ত্বেও বিশ্বেশ্বরী যে জোর করিয়াই একটা নিঃশ্বাস চাপিয়া ফেলিলেন, রমা তাহা টের পাইল। তাই তাঁহার হাতখানি বুকের উপর টানিয়া লইয়া স্থির হইয়া রহিল। একটুখানি সামলাইয়া লইয়া বিশ্বেশ্বরী পুনশ্চ কহিলেন,—“রমা, এক সন্তান যে কি, সে শুধু মায়েই জানে। বেণীকে যখন তারা অচৈতন্য অবস্থায় ধরাধরি ক’রে পাল্কিতে তুলে হাঁসপাতালে নিয়ে গেল, তখন যে আমার কি হয়েছিল, সে তোমাকে আমি বোঝাতে পার্‌ব না। কিন্তু, তবুও আমি কারুকে একটা অভিসম্পাত বা কোন লোককে আমি দোষ দিতে পর্য্যন্ত পারিনি। এ কথা ত ভুল্‌তে পারিনি, মা, যে এক সন্তান ব’লে ধর্ম্মের শাসন ত মায়ের মুখ চেয়ে চুপ ক’রে থাকবে না।” রমা একটুখানি ভাবিয়া কহিল,—“তোমার সঙ্গে তর্ক কর্‌চিনে জ্যাঠাইমা; কিন্তু, এই যদি হয়, তবে, রমেশ-দা’ কোন্‌ পাপে এ দুঃখভোগ কর্‌চেন? আমরা যা’ ক’রে তাঁকে জেলে পূরে দিয়ে এসেচি, সে ত কারো কাছেই চাপা নেই।” জ্যাঠাইমা বলিলেন,—“না মা, তা’ নেই। নেই বলেই বেণী আজ হাঁসপাতালে। আর তোমার—” বলিয়া তিনি সহসা থামিয়া গেলেন। যে কথা তাঁহার জিহ্বাগ্রে আসিয়া পড়িল, তাহা জোর করিয়া ভিতরে ঠেলিয়া দিয়া কহিলেন,—“কি জানিস্‌ মা, কোন কাজই কোন দিন শুধু শুধু শূন্যে মিলিয়ে যায় না। তার শক্তি কোথাও-না-কোথাও গিয়ে কাজ করেই। কিন্তু, কি কোরে করে, তা’ সকল সময়ে ধরা পড়ে না বলেই আজ পর্য্যন্ত এ সমস্যার মীমাংসা হ’তে পার্‌লে না, কেন একজনের পাপে আর একজন প্রায়শ্চিত্ত করে। কিন্তু, কর্‌তে যে হয় রমা, তাতে ত লেশমাত্র সন্দেহ নাই।” রমা নিজের ব্যবহার স্মরণ করিয়া নীরবে নিঃশ্বাস ফেলিল। বিশ্বেশ্বরী বলিতে লাগিলেন,—“এর থেকে আমারও চোখ ফুটেচে রমা, ভাল কর্‌ব বল্‌লেই ভাল করা যায় না। গোড়ার অনেকগুলো ছোটবড় সিঁড়ি উত্তীর্ণ হবার ধৈর্য্য থাকা চাই। একদিন রমেশ হতাশ হয়ে আমাকে বল্‌তে এসেছিল, ‘জ্যাঠাইমা, আমার কাজ নেই এদের ভাল ক’রে, আমি যেখান থেকে চলে এসেছি, সেইখানেই চ’লে যাই।’ তখন আমি বাধা দিয়ে বলেছিলাম, ‘না রমেশ, কাজ যদি সুরু করেচিস্‌ বাবা, তবে ছেড়ে দিয়ে পালাস্‌নে।’ আমার কথা সে ত কখনো ঠেল্‌তে পারে না; তাই, যে দিন তার জেলের হুকুম শুন্‌তে পেলাম, সে দিন মনে হ’ল, ঠিক যেন আমিই তাকে ধরে-বেঁধে এই শাস্তি দিলাম। কিন্তু, তার পর বেণীকে যেদিন হাঁসপাতালে নিয়ে গেল, সে দিন প্রথম টের পেলাম,—না, না, তারও জেল খাট্‌বার প্রয়োজন ছিল। তা’ ছাড়া ত জানিনি মা, বাইরে থেকে ছুটে এসে ভাল কর্‌তে যাওয়ার বিড়ম্বনা এত,—সে কাজ এমন কঠিন! আগে যে মিল্‌তে হয়, সকলের সঙ্গে ভালতে-মন্দতে এক না হ’তে পার্‌লে যে কিছুতেই ভাল করা যায় না—সে কথা ত মনেও ভাবিনি। প্রথম থেকেই সে তার শিক্ষা, সংস্কার, মস্ত জোর, মস্ত প্রাণ নিয়ে এতই উঁচুতে এসে দাঁড়াল যে, শেষ পর্য্যন্ত কেউ তার নাগালই পেলে না। কিন্তু সে ত আমার চোখে পড়ল না মা, আমি তাকে যেতেও দিলাম না, রাখ্‌তেও পারলাম না।” রমা কি একটা বলিতে গিয়া চাপিয়া গেল। বিশ্বেশ্বরী তাহা অনুমান করিয়া কহিলেন,—“না রমা, অনুতাপ আমি সে জন্যে করিনে। কিন্তু, তুইও শুনে রাগ করিস্‌নে মা,—এইবার তাকে তোরা নাবিয়ে এনে সকলের সঙ্গে যে মিলিয়ে দিলি, তাতে তোদের অধর্ম্ম যতই বড় হোক্‌, সে কিন্তু ফিরে এসে এবার যে ঠিক সত্যটির দেখা পাবে, এ কথা আমি বড় গলা করেই ব’লে যাচ্চি।” রমা কথাটা বুঝিতে না পারিয়া কহিল,—“কিন্তু, এতে তিনি কেন নেবে যাবেন জ্যাঠাইমা? আমাদের অন্যায় অধর্ম্মের ফলে যত বড় যাতনাই তাঁকে ভোগ ক’র্‌তে হোক, আমাদের দুষ্কৃতি আমাদেরই নরকের অন্ধকূপে ঠেলে দেবে, তাঁকে স্পর্শ ক’র্‌বে কেন?” বিশ্বেশ্বরী ম্লানভাবে একটুখানি হাসিয়া বলিলেন,—“কর্‌বে বই কি মা; নইলে পাপ আর এত ভয়ঙ্কর কেন? উপকারের প্রত্যুপকার কেউ যদি নাই করে, এমন কি, উল্‌টে অপকারই করে, তাতেই বা কি এসে যায় মা, যদি না তাঁর কৃতজ্ঞতায় দাতাকে নাবিয়ে আনে! তুই ব’ল্‌চিস মা, কিন্তু, তোদের কুঁয়াপুর রমেশকে কি আর তেম্‌নিটি পাবে? সে ফিরে এলে তোরা স্পষ্ট দেখ্‌তে পাবি, সে, যে হাত দিয়ে দান ক’রে বেড়াতো, ভৈরব তার সেই ডানহাতটাই মুচড়ে ভেঙ্গে দিয়েচে।” তার পরে একটুখানি থামিয়া নিজেই বলিলেন,—“কিন্তু, কে জানে! হয় ত ভালই হয়েচে। তার বলিষ্ঠ সমগ্র হাতের অপর্য্যাপ্ত দান গ্রহণ করবার শক্তি যখন গ্রামের লোকের ছিল না, তখন এই ভাঙা হাতটাই বোধ করি এবার তাদের সত্যকার কাজে লাগবে।” বলিয়া তিনি গভীর একটা নিঃশ্বাস মোচন করিলেন। তাঁহার হাতখানি রমা কিছুক্ষণ নীরবে নাড়াচাড়া করিয়া ধীরে ধীরে বড় করুণকণ্ঠে কহিল,—“আচ্ছা জ্যাঠাইমা, মিথ্যে-সাক্ষী দিয়ে নিরপরাধীকে দণ্ডভোগ করানোর শাস্তি কি?” বিশ্বেশ্বরী জানালার বাহিরে চাহিয়া রমার বিপর্য্যস্ত রুক্ষ চুলের রাশির মধ্যে অঙ্গুলি-চালনা করিতে হঠাত দেখিলেন, তাহার নির্মীলিত দুই চোখের প্রান্ত বাহিয়া অশ্রু গড়াইয়া পড়িতেছে। সস্নেহে মুছাইয়া দিয়া কহিলেন,—“কিন্তু তোমার ত হাত ছিল না মা। মেয়েমানুষের এত বড় কলঙ্কের ভয় দেখিয়ে যে কাপুরষেরা তোমার ওপর এই অত্যাচার ক’রেচে, এর সমস্ত গুরুদণ্ডই তাদের। তোমাকে ত এর একটি কিছুই বইতে হবে না মা।” বলিয়া তিনি আবার তাহার চক্ষু মুছাইয়া দিলেন। তাঁহার এইটুকুমাত্র আশ্বাসই রমার রুদ্ধ-অশ্রু এইবার প্রস্রবণের ন্যায় ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে সে কহিল,—“কিন্তু, তাঁরা যে তাঁর শত্রু। তাঁরা বলেন, ‘শত্রুকে যেমন করেই হৌক্‌, নিপাত কর্‌তে দোষ নেই।’ কিন্তু আমার ত সে কৈফিয়ত নেই জ্যাঠাইমা।”

 “তোমারই বা কেন নেই মা?” প্রশ্ন করিয়া তিনি দৃষ্টি আনত করিতেই অকস্মাৎ তাঁহার চোখের উপর যেন বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। যে সংশয় মুখ ঢাকিয়া এতদিন তাঁহার মনের মধ্যে অকারণে আনাগোনা করিয়া বেড়াইত, সে যেন তাহার মুখোস ফেলিয়া দিয়া একেবারে সোজা হইয়া দাঁড়াইল। আজ তাহাকে চিনিতে পারিয়া ক্ষণকালের জন্য বিশ্বেশ্বরী বেদনায়, বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। রমার হৃদয়ের ব্যথা আর তাঁহার অগোচর রহিল না। রমা চোখ বুজিয়া ছিল, বিশ্বেশ্বরীর মুখের ভাব দেখিতে পাইল না। ডাকিল,—“জ্যাঠাইমা?”

 জ্যাঠাইমা চকিত হইয়া তাহার মাথাটা একটুখানি নাড়িয়া দিয়া সাড়া দিলেন। রমা কহিল,—“একটা কথা আজ তোমার কাছে স্বীকার কর্‌ব জ্যাঠাইমা। পীরপুরের জাফর আলীর বাড়ীতে সন্ধ্যার পর গ্রামের ছেলেরা জড় হয়ে রমেশদা’র কথা মতো সৎ আলোচনাই কর্‌ত, বদমাইসের দল ব’লে তাদের পুলিশে ধরিয়ে দেবার একটা মৎলব চল্‌ছিল—আমি লোক পাঠিয়ে তাদের সাবধান করে দিয়েচি। কারণ, পুলিশ ত এই চায়। একবার তাদের হাতে পেলে ত আর রক্ষা রাখত না!” শুনিয়া বিশ্বেশ্বরী শিহরিয়া উঠিলেন। “বলিস্‌ কি রে? নিজের গ্রামের মধ্যে পুলিশের এই উৎপাত বেণী মিছে করে ডেকে আন্‌তে চেয়েছিল?” রমা কহিল,—“আমার মনে হয় বড়দা’র এই শাস্তি তারই ফল। আমাকে মাপ কর্‌তে পার্‌বে জ্যাঠাইমা?” বিশ্বেশ্বরী হেঁট হইয়া নীরবে রমার ললাট চুম্বন করিলেন। বলিলেন—“তার মা হয়ে এ যদি না আমি মাপ কর্‌তে পারি, কে পার্‌বে রমা? আমি আশীর্ব্বাদ করি, এর পুরস্কার ভগবান্‌ তোমাকে যেন দেন।” রমা হাত দিয়া চোখ মুছিয়া ফেলিয়া কহিল,—“আমার এই একটা সান্ত্বনা জ্যাঠাইমা, তিনি ফিরে এসে দেখ্‌বেন, তাঁর সুখের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে আছে। যা’ তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর সেই দেশের চাষাভুষারা এবার ঘুম-ভেঙ্গে উঠে বসেচে। তাঁকে চিনেছে, তাঁকে ভালবেসেছে। এই ভালবাসার আনন্দে তিনি আমার অপরাধ কি ভুল্‌তে পার্‌বেন না জ্যাঠাইমা?” বিশ্বেশ্বরী কথা কহিতে পারিলেন না। শুধু তাঁহার চোখ হইতে এক ফোঁটা অশ্রু গড়াইয়া রমার কপালের উপর পড়িল। তারপর বহুক্ষণ পর্য্যন্ত উভয়েই স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। রমা ডাকিল,—“জ্যাঠাইমা?” বিশ্বেশ্বরী বলিলেন,—“কেন মা?” রমা কহিল,—“শুধু একটা যায়গায় আমরা দূরে যেতে পারিনি। তোমাকে আমরা দুজনেই ভালবেসেছিলাম।” বিশ্বেশ্বরী আবার নত হইয়া তাহার ললাট চুম্বন করিলেন। রমা কহিল,—“সেই জোরে আমি একটা দাবী তোমার কাছে রেখে যাব। আমি যখন আর থাক্‌ব না, তখনও আমাকে যদি তিনি ক্ষমা কর্‌তে না পারেন, শুধু এই কথাটি আমার হ’য়ে তাঁকে বোলো জ্যাঠাইমা, যত মন্দ ব’লে আমাকে তিনি জান্‌তেন, তত মন্দ আমি ছিলাম না। আর যত দুঃখ তাঁকে দিয়েচি, তার অনেক বেশী দুঃখ যে আমিও পেয়েচি,—তোমার মুখের এই কথাটি হয় ত তিনি অবিশ্বাস কর্‌বেন না।” বিশ্বেশ্বরী উপুড় হইয়া পড়িয়া, বুক দিয়া রমাকে চাপিয়া ধরিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন। বলিলেন, “চল্‌ মা, আমরা কোন তীর্থে গিয়ে থাকি। যেখানে বেণী নেই, রমেশ নেই—যেখানে চোখ তুল্‌লেই ভগবানের মন্দিরের চূড়া চোখে পড়ে—সেইখানে যাই। আমি সব বুঝ্‌তে পেরেচি রমা। যদি যাবার দিনই তোর এগিয়ে এসে থাকে, মা, তবে এ বিষ বুকে পূরে জ্বলে পুড়ে সেখানে গেলে ত চল্‌বে না। আমরা বামুনের মেয়ে, সেখানে যাবার দিনটিতে আমাদের তার মতই গিয়ে উপস্থিত হ’তে হবে।” রমা অনেকক্ষণ চুপ করিয়া পড়িয়া থাকিয়া, একটা উচ্ছ্বসিত দীর্ঘশ্বাস আয়ত্ত করিতে করিতে শুধু কহিল,—“আমিও তেমনি ক’রেই যেতে চাই জ্যাঠাইমা।”