পাখীর কথা/তৃতীয় ভাগ/ঋতুসংহার (২)

উইকিসংকলন থেকে

ঋতুসংহার

(২)

 কাদম্বরাজহংসের নিকট হইতে বিদায় লইয়াছি। এইবার কারণ্ডব-সমস্যা ধৈর্য্যশীল পাঠকবর্গের সম্মুখে উপস্থিত করিব।কারণ্ডব সমস্যাটি একেবারে জাতিবিচার লইয়া। প্রশ্ন এই যে, ইহাকে প্রকৃতির বিরাট সভায় কোন্ পঙ্ক্তিতে বসাইব;—হাঁস, সারস, পানকৌড়ী, না জলপিপি?

 কারণ্ডবকে হংসশ্রেণীভুক্ত করা যাইতে পারে কি না, তাহা সুধীগণ বিচার করিয়া দেখুন। দুঃখের বিষয়, সংস্কৃত অভিধানগুলি এ বিষয়ে আমাদিগকে বড় বেশী সাহায্য করিতে পারে না। ‘‘কারণ্ডবকাদম্বক্রকরাদ্যাঃ পক্ষিজাতয়ো জ্ঞেয়াঃ” এইমাত্র হলায়ুধে পাওয়া যায়। এখানে কেবল এইটুকু বলা হইল যে, কাদম্ব ও কারণ্ডব পক্ষিজাতিবিশেষ;—কোন্ জাতি, কি বর্ণ, তাহা কিছুই বুঝা গেল না। অমরকোষেও সাধারণ পক্ষিজাতির মধ্যে কয়েকটি পাখীর নাম করা হইয়াছে। কারণ্ডব তাহাদিগের অন্যতম। এখানেও তাহার জ্ঞাতি, গোত্র ও বর্ণের পরিচয় পাইলাম না। তবে টীকাকার এসম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, তাহা পরে আলোচনা করিতেছি। অভিধানরত্নমালার পাশ্চাত্য টীকাকার Aufrecht সুধু টিপ্পনী করিলেন,—‘a sort of duck’ অর্থাৎ হংসবিশেষ। উইল্‌সন্[১], মনিয়ার উইলিয়ম্‌স্[২], ও অধ্যাপক কোলব্রুক্[৩] প্রত্যেকেই নিজ নিজ পুস্তকে ঐ কথাই লিখিয়া গিয়াছেন—‘a sort of duck’। বৈজ্ঞানিক হিসাবে এই উক্তির সাহায্যে আমরা একপদও অগ্রসর হইতে পারিলাম না। এতগুলি অভিধান দেখিয়া আমাদের স্বতঃই একটা প্রবৃত্তি জন্মে যে, কারণ্ডব হংসবিশেষ; তাহাতে সন্দেহের কারণ থাকা উচিত নহে। প্রায়ই ’ত তাহাকে কাদম্বের সঙ্গে সংস্কৃত-সাহিত্যে প্রকৃতিবর্ণনার মধ্যে একত্র দেখা যায়; অভিধানগুলিতেও তাহার ছাপ পড়িয়াছে। তর্কের খাতিরে যদি মানিয়া লওয়া যায় যে, কারণ্ডব হংসবিশেষ, তাহা হইলে সেই হংসের প্রকারভেদ করিবার চেষ্টা করিয়া দেখিলে ক্ষতি কি? সুশ্রুতসংহিতার টীকাকার ডল্লনাচার্য্য মিশ্র কারণ্ডবের দুই প্রকার বর্ণনা দিয়াছেন,—কারণ্ডবঃ শুক্লহংসভেদোঽল্পঃ অর্থাৎ কারণ্ডব শুক্লহংস হইতে ঈষৎ ভিন্ন। এস্থলে অনুমান করিয়া লওয়া যাইতে পারে যে, এই ভেদটুকু কেবলমাত্র দেহের বর্ণসম্বন্ধে; শুক্লহংস নয়, অল্প ভেদ আছে। তবে কি Grey Goose পর্য্যায়ে ফেলা যাইতে পারে? অথবা ইহাকে কি শুক্লহংসভেদোঽল্প anser indicus শ্রেণীর মধ্যে দাঁড় করাইব? ইহারা উভয়েই সাদা রংএর কাছাকাছি যায়;—grey goose বা anser cinereus প্রায় ধূসরত্বে উপনীত হইয়াছে, আর anser indicusএর পতত্র ও মাথার দিক্‌টা খুব সাদা, বাকি দেহের বর্ণে কিছু লাল্‌চে ও কাল রংয়ের ভাব দেখা যায়। এইরূপ বর্ণনা করিয়া আচার্য্য ডল্লনমিশ্র ক্ষান্ত হন নাই। তিনি এই বিবরণটি কোথা হইতে উদ্ধৃত করিয়াছেন জানি না, কিন্তু লিখিতেছেন—উক্তঞ্চ “কারণ্ডবঃ কাকবক্ত্রো দীর্ঘাঙ্ঘ্রিঃ কৃষ্ণবর্ণভাক্” ইতি; অর্থাৎ ইহার কাকের ন্যায় মুখ, পা দীর্ঘ, বর্ণ কালো। অমরকোষের টীকাকার মহেশ্বরও লিখিয়াছেন—অয়ং কাকতুণ্ডো দীর্ঘপাদঃ কৃষ্ণবর্ণঃ। এখন প্রশ্ন এই যে, এই কাকের মত মুখ, লম্বা লম্বা পা ও কালো রং হংসজাতীয় কোনও পাথীর মধ্যে দেখা যায় কি? Anseres পরিবারভুক্ত কোনও হংসের পা ও ঠোঁট উক্ত বর্ণনার সহিত মিলিতে পারে না। তবে কি হংস অর্থে সাসকেও বুঝিব। ‘চক্রাঙ্গঃ সারসো হংসঃ’ এই সংজ্ঞা শব্দার্ণব গ্রন্থে পাওয়া যায়। এই সারস বা Gruidae পরিবারের মধ্যে এক শ্রেণীর পাখী দেখিতে পাওয়া যায়, যাহা কতকটা কাকতুণ্ড, দীর্ঘাঙ্ঘ্রি ও কৃষ্ণবর্ণভাক্। ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ইহার সাধারণ নাম করকড়। এই করকড়ের সহিত ডল্লনমিশ্রের “করহরের” কোনও সম্পর্ক আছে কি? তিনি বলিতেছেন—“অন্যে করহরমাহুঃ”। চরকসংহিতার টীকাকার গঙ্গাধর কবিরাজের মতে কারণ্ডব আর কিছু নয়, পানকৌড়ী। পক্ষিতত্ত্বহিসাবে পানকৌড়ী Phalacrocorax javanicus নামে বিশেষজ্ঞের নিকট পরিচিত। ইহার রং কালো বটে, কিন্তু আর কিছুই উপরে উদ্ধৃত বর্ণনার সহিত মিলে না। ইহা কাকতুণ্ডও নয়, দীর্ঘপদও নয়। “বৈদ্যকশব্দসিন্ধু” গ্রন্থে[৪] কারণ্ডব অর্থে জলপিপি বলা হইয়াছে। এইবার কিছু মুষ্কিলে পড়া গেল। এই জলপিপি বা Metopidius indicusএর রং কালো, কাকের মত তুণ্ড, দীর্ঘ অঙ্ঘ্রি; কিন্তু ইহা হংসও নয়, সারসও নয় অথচ ইহা জলাশয়ে পদ্মপত্রের[৫] উপর দিয়া দ্রুত পদক্ষেপে চলিয়া যায়। তবে ইহাকে ভারতবর্ষের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলে কুত্রাপি দেখা যায় কি? হিউম বলিতেছেন[৬]

 “As a matter of fact it is almost absolutely confined to the moister portions of the country, and is very rarely, if ever, seen in the drier portions of the North West Provinces, in the Punjab, Rajputana and Sindh.”

 বাঙ্গালীর পরিচিত জলপিপি পাখী কি সংস্কৃত-সাহিত্যের কারণ্ডবের সহিত অভিন্ন? কিন্তু উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের কাদম্বরাজহংসের সহিত কোনও ঋতুতে ইহাকে দেখা যায় কি না সে সম্বন্ধে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে। অথচ আমাদের সংস্কৃত কাব্য-সাহিত্যে শরৎবর্ণনায় কারণ্ডবকে কাদম্ব-রাজহংস-সারসের সহিত অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত দেখা যায়।

 এই সারস পাখীটিকে সাধারণতঃ আমাদিগের কাব্যসাহিত্যমধ্যে হংসজাতীয় জলচর ও স্থলচর বিহঙ্গগণের সহচররূপে পাইয়া থাকি। অন্যত্র আমরা ইহার কতকটা বৈজ্ঞানিক পরিচয় দিবার চেষ্টা করিয়াছি। আমাদের পাঠকপাঠিকাগণের নিকটে ইহার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু নূতন তথ্য এখানে আর উপস্থিত করিতেছি না; তবে তাঁহাদিগকে স্মরণ করাইয়া দিতে চাই যে, পদ্মসমাকুল সরোবরের সহিত ইহার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখিয়া অভিধানকারগণ ইহাকে পুষ্করাহ্বয় বা পুষ্করাহ্ব আখ্যা প্রদান করিয়াছেন। ঋতুসংহারের কবি ইহার নিমিত্ত যে background রচনা করিয়াছেন, তাহা একটি তটিনী;—তাহার সলিল সরোরুহরজের দ্বারা অরুণীকৃত হইয়াছে। এই তটিনীতে সারসকে দেখা গেল বটে, কিন্তু তাহার কণ্ঠস্বর শুনাইবার জন্য মহাকবিকে প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে নূতন যবনিকার উত্তোলন করিতে হইল;—ইহার স্বভাবসুলভ সুদূরপ্রসারী তীব্র কণ্ঠস্বর সীমান্তরকে প্রতিনিনাদিত করিয়াসারস তুলিতেছে। এই যাযাবর পাখীটি সমস্ত শরৎ ঋতু ভারতবর্ষে অতিবাহিত করে, এই জন্য শরৎ ঋতুর বর্ণনায় মহাকবি ইহাকে উপেক্ষা করিতে পারেন নাই।

 কিন্তু এই শরৎ ঋতুতে বক ও ময়ূরের স্বভাবে পরিবর্ত্তন দেখা গেল। সূক্ষ্মদর্শী নিপুণ কবির দৃষ্টিকে তাহা এড়াইতে পারে নাই।

ধূনন্তি পক্ষপবনৈর্ন নভো বলাকাঃ
পশ্যন্তি নোম্নতমুখা গগনং ময়ূরাঃ।

বলাকাগণ পক্ষপবনের দ্বারা নভোমণ্ডল কম্পিত করে না; ময়ূরগণ উন্নতমুখ হইয়া গগনকে নিরীক্ষণ করে না।

 শিখিগণ এখন আর নৃত্য করে না,—“নৃত্যপ্রয়োগরহিতাশ্ছিখিনঃ।”

 বর্ষাপগমে ইহাদের স্বভাবের পরিবর্ত্তন হইয়াছে বটে কিন্তু ইহারা যাযাবর নহে; সমস্ত বৎসর ইহাদিগকে দেখিতে পাওয়া যায়। সঙ্গিহীন অবস্থায় বকজাতীয় পাখীগুলি নানা স্থানে বিচরণ করিতে থাকে; বর্ষাকালে তাহারা কেমন শ্রেণীবদ্ধ হইয়া আকাশমার্গে উড্ডীয়মান হয়, মেঘদূতের কবি তাহা দেখাইয়াছেন। শরৎকালে আর তাহারা ঝাঁকে ঝাঁকে পক্ষবিস্তার করিয়া উড়িতে চায় না। হেমন্তে ও শিশিরে বকপরিবারস্থ ক্রৌঞ্চের কণ্ঠস্বর সীমান্তরকে ধ্বনিত করিয়া তুলে। সাধারণ বকের বৈজ্ঞানিক পরিচয় অন্যত্র দিয়াছি, কিন্তু এই ক্রৌঞ্চটি বিহঙ্গতত্ত্বজ্ঞের নিকটে ardeola grayi বা Pond heron নামে পরিজ্ঞাত। বাঙ্গালায় ইহা কোঁচবক বলিয়া খ্যাত। সুশ্রূত-সংহিতারক্রৌঞ্চ টীকাকার ডল্লনাচার্য্য মিশ্র ক্রৌঞ্চ অর্থে লিখিতেছেন—ক্রৌঞ্চির কোঁচবক ইতি লোকে। হেমন্তে শস্যবহুল প্রান্তরে ইহার মধুর নাদ শ্রুত হইয়া থাকে—

প্রভূতশালিপ্রসবৈশ্চিতানি
মৃগাঙ্গনাযূথবিভূষিতানি।
মনোহরক্রৌঞ্চনিনাদিতানি
সীমান্তরাণ্যুৎসুকয়ন্তি চেতঃ॥

শিশিরে প্রভূত শালিধান্যের মধ্য হইতে ইহার কণ্ঠস্বর ক্বচিৎ নির্গত হইয়া যেন শীতঋতুর আগমনবার্ত্তা প্রচার করিতেছে। তাই ঋতুসংহারের

কঙ্ক, ক্রৌঞ্চ, বলাকা
 
[পৃঃ ১৭৮

U. RAY & SONS, CALCUTTA.

পঞ্চম সর্গের প্রথম শ্লোকেই নবাগত শিশিরের পরিচয় দিতে গিয়া সুপক্ক শালিধান্যের মধ্যে প্রচ্ছন্ন পাখীটির কণ্ঠস্বরকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করিয়া কবি লিখিতেছেন—

প্ররূঢ়শাল্যংশুচয়ৈর্মনোহরং
ক্বচিৎস্থিত-ক্রৌঞ্চনিনাদরাজিতম্।
প্রকামকামং প্রমদাজনপ্রিয়ং
বরোরু কালং শিশিরাহ্বয়ং শৃণু॥

এই ক্রৌঞ্চ সাধারণ heron জাতীয় পাখী অপেক্ষা ক্ষুদ্রতর, তাই সে অত সহজে সুপক্ক ধানের ক্ষেতের মধ্যে আত্মগোপন করিতে পারে। ব্লান্‌ফোর্ডের পুস্তকে[৭] ইহার সম্বন্ধে এই প্রকার লেখা আছে—

 “The Pond Herons, or as they are often called by British ornithologists, Squacco Herons, are smaller than the true Herons and Egrets, and are somewhat intermediate in plumage between Egrets and Herons. *   *   *   *   *   often found about paddy fields, ditches, village tanks, and similar places, not easily seen when sitting.”

উপরে উদ্ধৃত “ক্বচিৎস্থিত” শব্দটির প্রতি সহৃদয় পাঠক পাঠিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে চাই। কবি যেন স্পষ্টই বলিতেছেন যে শীতকালে ক্রৌঞ্চজাতীয় বকেরা দল না বাঁধিয়া বিক্ষিপ্তভাবে মাঠে ঘাটে বিচরণ করে। এই যে বকজাতীয় পাখী বিশেষ বিশেষ ঋতুতে একা থাকিতে ভালবাসে, পাশ্চাত্য পক্ষিতত্ত্বজ্ঞেরা ইহা লক্ষ্য করিয়া ইহাদিগকে unsociable সংজ্ঞা দিয়াছেন। বর্ষাকালে ইহারা দল বাঁধিয়া একত্র একস্থানে নীড় রচনা করে একথা মেঘদূত প্রসঙ্গে বলিয়াছি। একজন ইংরাজ লিখিতেছেন[৮],—

 “The heron is gregarious during the breeding season.”

 আর একজন লিখিয়াছেন[৯]

 “In the breeding season they congregate, and make their nests very near each other.”

 বর্ষাঋতুই ইহাদের গর্ভাধানকাল। অন্য ঋতুতেও ইহাদিগকে মাঝে মাঝে ছোট খাটো দল বাঁধিয়া আকাশপথে উড়িয়া যাইতে দেখা যায় না, এমন নহে,—তাই হেমন্ত বর্ণনার শেষ শ্লোকে হিমঋতুর প্রভূত শালিধান্যের মধ্যে ক্রৌঞ্চমালার সুস্পষ্ট উল্লেখ দেখিতে পাই।

বহুগুণরমণীয়ো যোষিতাং চিত্তহারী
পরিণতবহুশালিব্যাকুলগ্রামসীমা।
সততমতিমনোজ্ঞঃ ক্রৌঞ্চমালাপরীতঃ
প্রদিশতু হিমযুক্তঃ কালঃ এষঃ সুখং বঃ॥

 এখন এই ক্রৌঞ্চ পাখীটীর সম্বন্ধে আরও দুই একটী কথা বলা আবশ্যক। মনিয়ার উইলিয়মস্, ম্যাক্‌ডোনেল, কোলব্রুক প্রমুখ বিদেশীয় অভিধানকারগণ ক্রৌঞ্চকে Ardea বা heron পর্য্যায়ভুক্ত না করিয়া তাহাকে Curlewর সহিত সগোত্র করিয়াছেন। এই শেষোক্ত পাখীটির কণ্ঠস্বর অত্যন্ত করুণ; ইহাকে ভারতবর্ষে সাধারণতঃ শীতকালে দেখিতে পাওয়া যায়। নদীর জল যেখানে সমুদ্রের সহিত মিশিতেছে, সেখানে ইহাদিগকে অপেক্ষাকৃত অধিক সংখ্যায় বিচরণ করিতে ও দিগন্তপ্রসারিত নদীসৈকতে কীটাদি খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টায় ব্যাপৃত থাকিতে দেখা যায়[১০]। শস্যবহুল ক্ষেত্রে বা শষ্পাচ্ছাদিত প্রান্তরে ইহাদের বিলাপধ্বনি শ্রুত হয় না। এস্থলে প্রধানতঃ পাখীর জাতিতত্ত্বনির্ণয় করিবার জন্য কয়েকটী বিষয় লক্ষ্য করিতে হইবে। প্রথমতঃ Curlew আগন্তুক মাত্র; দ্বিতীয়তঃ সে শীতকালে এদেশে আসে ও শীতবসানের সঙ্গে সঙ্গে এদেশ হইতে চলিয়া যায়। কোথায় চলিয়া যায়, সে অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবার আবশ্যকতা এখন নাই। তৃতীয়তঃ, যতদিন তাহাকে দেখা যায়, সমুদ্রতীরে অথবা বড় বড় নদীর সৈকতে, ক্বচিৎ বড় বড় জলাভূমিতে তাহাকে বিচরণ করিতে দেখিতে পাই। বাঙ্গালাদেশে সে ত rara avis। ধানক্ষেতের সঙ্গে অথবা তৃণাচ্ছাদিত প্রান্তরের সঙ্গে যে তাহার কোন সম্পর্ক আছে তাহা মনে হয় না। চতুর্থতঃ, সে কৃমিকীটশম্বুকভুক্; কখনও শস্য অথবা কিসলয় আহার্য্যরূপে ব্যবহার করে না। পঞ্চমতঃ, তাহার কণ্ঠস্বর এত সকরুণ যে, নদীসৈকতে তাহা বিলাপধ্বনির মত মনে হয়।

 এইবার কবি-বর্ণিত ক্রৌঞ্চের সহিত এই পাখীটির চরিত্রগত সাম্য আছে কি না, তাহা একবার যাচাই করিয়া লইতে হইবে। ঋতুসংহারের কবি যতবার ক্রৌঞ্চের উল্লেখ করিয়াছেন, ততবারই শালিধান্যবহুল সীমান্তরের সহিত ইহার সম্বন্ধ স্থাপন করিতে ভুলেন নাই। বাস্তবিক যদি সমুদ্রসৈকতে বিচরণ করাই ইহার স্বভাব হয়, তাহা হইলে কেমন করিয়া ইহাকে শস্যবহুল সীমান্তরে দেখা যাইতে পারে? শিশিরের নবীন আগন্তুক Curlew দল বাঁধিয়া ঝাঁকে ঝাঁকে যখন বড় বড় নদীসৈকতগুলি অধিকার করে, তখন তাহাকে “ক্বচিৎস্থিত” আখ্যা কিছুতেই দেওয়া যায় না; অথচ আমাদের পরিচিত ক্রৌঞ্চ প্ররূঢ়শালিধান্যের মধ্যে ক্বচিৎস্থিত; তাহার নিনাদে আমরা বুঝিতে পারি যে সে সেখানে আছে। এই “নিনাদ” কথাটি কখনই করুণ বিলাপধ্বনির অর্থে ব্যবহৃত হয় নাই। আমরা দেখিতেছি যে, ক্রৌঞ্চনিনাদ সমস্ত সীমান্তরকে ধ্বনিত করিয়া তুলিতেছে। কাতরতার লেশমাত্র কোথাও ইহার সহিত জড়িত হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না। শীতের প্রারম্ভে যে পাখী এদেশে দলে দলে আসে, এবং যাহাকে বিশেষ বিশেষ স্থানে ঝাঁকে ঝাঁকে বিচরণ করিতে দেখা যায়, কেমন করিয়া তাহাকে হেমন্তের অবসানে শিশিরের প্রারম্ভে কেবল তাহার কণ্ঠধ্বনির পরিচয়ে নিশ্চয়ই সে কোথাও আছে স্থির করিয়া, তাহাকে ক্বচিৎ-স্থিত বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে? তর্কের খাতিরে না হয় মানিয়া লইলাম যে, মোটামুটী হেমন্তকে winter এর মধ্যে পরিগণিত করা যাইতে পারে; তাহা হইলে কবিবর্ণিত হেমন্তে ক্রৌঞ্চমালার সহিত ব্লানফোর্ডের Flocks are not uncommon এই উক্তি মিলাইয়া দিতে পারা যায়; আবার শিশির-বর্ণনায় “ক্বচিৎ-স্থিত” ক্রৌঞ্চের সহিত ব্লানফোর্ডে-বর্ণিত একাকি-বিচরণশীল Curlew পাখীর মিল হইতে পারে; কিন্তু কোনও পাশ্চাত্য পক্ষিতত্ত্ববিৎ ধানের ক্ষেতে সীমান্তরে নদীহীনস্থানে Curlew পাখীকে অবস্থান করিতে দেখিয়াছেন কি? এবং যে কণ্ঠনিনাদ সীমান্তরকে ধ্বনিত করিয়া তুলিতেছে, তাহাকে কখন কি plaintive শব্দে অভিহিত করা যাইতে পারে?

 আবার সংস্কৃত অভিধানের শরণ লওয়া যাউক। ক্রৌঞ্চ যে বক জাতির অন্তর্গত, তাহা অমরকোষে স্পষ্টরূপে নির্দ্দিষ্ট না থাকিলেও, যাদবের বৈজয়ন্তী অভিধানে ইহার সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে,—

বকো বকোটঃ কহ্বোঽথ বলাকা বিসকণ্ঠিকা।
বকজাতির্দর্বিতুণ্ডো দর্বিঃ ক্রৌঞ্চশ্চ দর্বিদা॥

Gustav Oppert এই ক্রৌঞ্চের টীকা করিয়াছেন “Kind of crane”। সাধারণতঃ heron বা বককে বিলাতে গ্রাম্য ভাষায় crane বলা হয়,—মেঘদূত-প্রসঙ্গে এসম্বন্ধে পূর্ব্বেই আলোচনা করিয়াছি।

 বাচস্পত্য অভিধানে আছে “ক্রৌঞ্চঃ—(কোঁচবক) বকভেদে”। শব্দার্থচিন্তামণিতে[১১] ক্রৌঞ্চ অর্থে লেখা আছে—“কোঁচবক ইতি গৌড়ভাষাপ্রসিদ্ধে পক্ষিণি”।

 এখন ক্রৌঞ্চকে বিদায় দিয়া ময়ূরের কথা পাড়িব। একবার মহাকবির মেঘদূতখানি অবলম্বন করিয়া আমি বলিয়াছিলাম যে, তিনি সজল-নয়ন শুক্লাপাঙ্গ নীলকণ্ঠ ময়ূরকে উপেক্ষার চক্ষে দেখেন নাই। ঋতুসংহারে গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎ বর্ণনায়ময়ূর সেই ময়ূরের ছবি বিচিত্র পরিবেষ্টনীর মধ্যে নব নব ভঙ্গিমায় ফুটিয়া উঠিয়াছে। গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড সূর্য্যকিরণতপ্ত বিদহ্যমান ফণী অধোমুখে মুহুর্মুহুঃ নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে প্রায় নিশ্চল হইয়া ময়ূরের তলে শয়ান রহিয়াছে;—ক্লান্তদেহ কলাপী কলাপচক্র-মধ্যে নিবেশিতানন সর্পকে হনন করিতেছে না।—যাহাদের মধ্যে খাদ্যখাদক সম্বন্ধ তাহাদের এইরূপ অবসাদ, ক্লান্তি ও শান্তির ছবি জগতের কোনও সাহিত্যে অন্য কোনও কবি এমন করিয়া দিতে পারিয়াছেন কি না জানি না। কিন্তু এই সাপ ও ময়ূরটিকে অবলম্বন করিয়া যে প্রচণ্ড গ্রীষ্মের ছবি আমাদের মনশ্চক্ষুর সমক্ষে জাগিয়া উঠিল, তেমনটি আর কিছুতে ফুটিয়া উঠিত কি না সন্দেহ। উৎকট বস্তুতন্ত্রতার দিক্ হইতে দেখিলে হয়’ত সমালোচক বলিবেন যে, কবিবর এখানে কিছু বাড়াবাড়ি করিয়াছেন। বাস্তবিক জীবতত্ত্বহিসাবে উহাদের মধ্যে খাদ্য-খাদক সম্বন্ধ রহিয়াছে একথা অস্বীকার করিবার যো নাই। পাঠকবর্গের স্মরণ থাকিতে পারে যে, এই ময়ূরটি আমাদের পুরাতন পরিচিত বন্ধু pavo Cristatus। তাহার বিহারের কথা বলিবার কিঞ্চিৎ সুযোগ পাইয়াছিলাম; কিন্তু অহারের কথা এপর্য্যন্ত বলা হয় নাই। ভারত গভর্ণমেণ্টের কৃষি বিভাগের প্রকাশিত নিবন্ধে[১২] ভারতবর্ষীয় পক্ষীর আহার সম্বন্ধে অনেক তথ্য বিবৃত হইয়াছে। তন্মধ্যে শিখীর (pavo cristatus) আহার্য্য-প্রসঙ্গে এইরূপ লিপিবদ্ধ আছে—

 They feed on grain, buds, shoots of grass, insects, small lizards and snakes.

 উক্ত নিবন্ধে এই প্রসঙ্গে মিঃ রিড-এর উক্তি উদ্ধৃত করা হইয়াছে—

 They live for the most part on grain when procurable but do not object to insects, and—sorry I am to say it—Snakes! Years ago—my cook took a small snake, about 8 inches long, from the stomach of one I had given him to clean.

 এখন প্রখর সূর্য্যাতপে উহারা উভয়েই কোনও রূপ শারীরিক পরিশ্রম করিতে আদৌ রাজী নহে;—একটি খাদ্যাহরণচেষ্টা হইতে একেবারেই বিরত, অপরটি এতই মুহ্যমান যে পলাইবার চেষ্টা করা দূরে থাকুক, হিংস্র শত্রুর বর্হভারশীতল তলদেশকে উপাদেয় মনে করিয়া তথায় নিশ্চিন্তচিত্তে অবস্থান করিতেছে। প্রচণ্ড গ্রীষ্মের এই আলস্যমন্থর নিষ্প্রভ নির্জীবপ্রয় ময়ূরটি কিন্তু গ্রীষ্মাপগমে আসন্ন বর্ষায় তাহার সমস্ত আলস্য ও অবসাদ দূরে নিক্ষেপ করিয়া বিকীর্ণবিস্তীর্ণকলাপশোভায় আমাদিগকে মুগ্ধ করিয়া ফেলে—

সদা মনোজ্ঞং স্বনদুৎসবোৎসুকং
বিকীর্ণবিস্তীর্ণকলাপশোভিতম্।
সসম্ভ্রমালিঙ্গনচুম্বনাকুলং
প্রবৃত্তনৃত্যং কুলমদ্য বর্হিণাম্॥

এই স্ফুরিত বর্হমণ্ডলীর চিত্তহারিণী শোভায় মুগ্ধ হইয়া উৎপলভ্রমে ঝাঁকে ঝাঁকে মধুপ আসিয়া তদুপরি পতিত হইতেছে—

বিপত্রপুষ্পাং নলিনীং সমুৎসুকা
বিহায় ভৃঙ্গাঃ শ্রুতিহারিনিস্বনাঃ।
পতন্তি মূঢ়াঃ শিখিনাং প্রনৃত্যতাং
কলাপচক্রেষু নবোৎপলাশয়া॥

পর্ব্বতে পর্ব্বতে ময়ূরের নৃত্যের কথা পূর্ব্বেই বিবৃত করিয়াছি। ভূধরকে কেমন বিচিত্র সৌন্দর্য্যে ইহারা মণ্ডিত করিতে পারে, তাহার একটি চিত্র ঋতুসংহারের কবি দিয়াছেন। পর্ব্বতের গাত্র বহিয়া প্রস্রবণ ঝরিয়া পড়িতেছে, শ্বেত উৎপলের আভায় মণ্ডিত হইয়া মেঘ উপলখণ্ডগুলিকে চুম্বন করিতেছে, নৃত্যপরায়ণ শিখীদিগের আনন্দনর্ত্তনে আকুল হইয়া ভূধরগুলি প্রকৃতিকে সমুৎসুক করিয়া তুলিতেছে—

সিতোৎপলাভাম্বূদচুম্বিতোপলাঃ
সমাচিতাঃ প্রসবণৈঃ সমন্ততঃ।
প্রবৃত্তনৃত্যৈঃ শিখিভিঃ সমাকুলাঃ
সমুৎসুকত্বং জনয়ন্তি ভূধরাঃ॥

 বর্ষার এই নৃত্যপরায়ণ ময়ূর শরদাগমে আর উন্নতমুখ হইয়া গগন নিরীক্ষণ করে না,—পশ্যন্তি নোন্নতমুখা গগনং ময়ূরাঃ। মেঘদূত প্রসঙ্গে বলিয়াছি যে বর্ষাকালই ময়ূরের গর্ভাধানকাল। ঋতুসংহারে দেখিতে পাইতেছি যে, শরৎকালে মদন নৃত্যপ্রয়োগরহিত শিখীদিগকে ত্যাগ করিয়া কলকণ্ঠ হংসকে আশ্রয় করিতেছেন—

নৃত্যপ্রয়োগরহিতাঞ্ছিখিনো বিহায়।
হংসানুপৈতি মদনো মধুরপ্রগীতান্।

 আমরাও এই নৃত্যপ্রয়োগরহিত ময়ূরকে ত্যাগ করিয়া বিহগান্তরকে আশ্রয় করিব। নীহারপাতবিগমে শিশিরাবসানে যাহার কণ্ঠধ্বনি প্রিয়াবদননিহিত যুবকের চিত্ত ম্রিয়মাণকোকিল করিয়া ফেলে; গৃহকর্ম্মরতা লজ্জাবনতা কুলবধূর হৃদয় ক্ষণেকের নিমিত্ত পর্য্যাকুল করিয়া তুলে; যাহা বায়ুভরে কম্পমান কুসুমিত সহকারশাখার মধ্য দিয়া প্রসারিত হইয়া দিগ্‌বিদিকে বসন্তের আগমন বার্ত্তা ঘোষিত করে; সেই কোকিলের ছবি ঋতুসংহারের ষষ্ঠ সর্গে নিপুণভাবে চিত্রিত রহিয়াছে—

পুংস্কোকিলশ্চূতরসাসবেন
মত্তঃ প্রিয়াং চুম্বতি রাগহৃষ্টঃ।

আম্ররসাস্বাদনে মত্ত হইয়া কোকিল অনুরাগভরে প্রিয়াকে চুম্বন করিতেছে।

পুংস্কোকিলৈঃ কলবচোভিরুপাত্তহর্ষৈঃ
কূজদ্ভিরুন্মদকলানি বচাংসি ভৃঙ্গৈঃ ইত্যাদি।

কোকিল ও ভ্রমরের সানন্দ কূজনগঞ্জনে কুলবধূগণ বিচলিত হইতেছেন। কবি এই কথাই বারম্বার আমাদিগকে শুনাইতেছেন,—মধুমাসে মধুর কোকিলভৃঙ্গনাদ নরনারীর হৃদয় হরণ করিতেছে,—

মাসে মধৌ মধুরকোকিলভৃঙ্গনাদৈ-
র্নার্য্যো হরন্তি হৃদয়ং প্রসভং নরাণাম্।
*               *               *               *               
সমদমধুভরাণাং কোকিলানাং চ নাদৈঃ
কুসুমিতসহকারৈঃ কর্ণিকারৈশ্চ রম্যঃ।
ইষুভিরিব সুতীক্ষ্ণৈর্মানসং মানিনীনাং
তুদতি কুসুমমাসো মন্মথোদ্বেজনায়॥

এস্থলে একটা জিনিষ লক্ষ্য করা যাইতেছে যে, কবি পুংস্কোকিলের ডাকের কথাই বিশেষ করিয়া বলিতেছেন। এ সম্বন্ধে একটি কথা বলা আবশ্যক। ডারউইন-তত্ত্বপন্থিগণ অবশ্যই সকলকে একটা কথা মানিয়া লইতে বলেন যে, সাধারণতঃ পক্ষিজাতির মধ্যে পুরুষটাই গান করে,—স্ত্রীটা নহে। তাঁহাদের মতে বিহঙ্গজাতির যৌননির্ব্বাচন ও নৈসর্গিক নির্ব্বাচনতত্ত্বের সহিত এই সাধারণ সত্যটি ঘনিষ্ঠভাবে সম্বদ্ধ। বিহঙ্গতত্ত্বের দিক্ হইতে দেখিলে কোনও ornithologist ইহা অমূলক বলিবেন না। অতএব সে হিসাবে ঋতুসংহারের বসন্তবর্ণনায় যে পুংস্কোকিলের কণ্ঠধ্বনি শ্রুত হইবে, ইহা স্বাভাবিক ও বৈজ্ঞানিক সত্য। স্ত্রীকোকিলেরও ডাক শোনা যায়, কিন্তু যে পঞ্চম স্বর চিরদিন ভারতবর্ষের আবালবৃদ্ধবনিতাকে মুগ্ধ করিয়া আসিতেছে, তাহা নিশ্চয়ই ঐ পুংস্কোকিলেরই কণ্ঠধ্বনি। বসন্তাগমে কোকিলেরা ঘরকন্না পাতিয়া বসে না, অথচ এই সময়েই তাহাদের গর্ভাধান কাল। তাহাদের জীবনের পরভৃৎরহস্যের প্রসঙ্গ এস্থলে তুলিতেছি না;—পরভৃৎরহস্যের কতকটা বিস্তারিত আলোচনা পূর্ব্বে প্রসঙ্গান্তরে করিয়াছি। এই গর্ভাধান কালে কিন্তু কোকিলদম্পতির কলকণ্ঠ, বিশেষতঃ পুং-স্কোকিলের কণ্ঠস্বর বিদেশীয়দিগের মস্তিষ্কবিকৃতি জন্মায়; নহিলে তাহারা কোকিলকে Brain-fever Bird বলিবে কেন? ইহাদের স্বরের তারতম্য বিষয়ে জার্ডন লিখিতেছেন[১৩]

 About the breeding season the koel is very noisy * * * * the male bird has also another note * * *. When it takes flight, it has yet another somewhat melodious and rich liquid call.

 এই melodious rich liquid call না থাকিলে কি “পরভৃত”, “অন্যপুষ্ট” কোকিলকে বিতনুর বন্দী আখ্যা দেওয়া যায়? যাহার কণ্ঠস্বর মদনের বৈতালিক গীত, তাহাকে পরপুষ্ট পরভৃত বলিয়া ঘৃণা করা চলে না; তাই ঋতুসংহারের বসন্তবর্ণনায় সমস্ত ষষ্ঠ সর্গ ব্যাপিয়া সে এতখানি জায়গা জুড়িয়া বসিয়া আছে। কেমন করিয়া পরের বাসায় ডিম ফুটিয়া কোকিলের ছানা বাহির হয়, কি উপায়ে এতকাল ধরিয়া শত্রুপুরীতে তাহার জীবন রক্ষা হইয়া আসিতেছে, প্রকৃতির এই বিচিত্র লীলারহস্যের কিঞ্চিৎ বিস্তারিত আলোচনা অন্যত্র করিয়াছি। কোনও বিহঙ্গতত্ত্বজিজ্ঞাসু এই রহস্য এড়াইয়া যাইতে পারেন না। মহাকবি কালিদাসের সূক্ষ্ম দৃষ্টিও ইহার উপরে পতিত হইয়াছে। চূতরসাসবে কোকিল পরিপুষ্ট হইয়া থাকে; নানা মনোজ্ঞকুসুমদ্রুমভূষিত পর্ব্বতের সানুদেশে “অন্যপুষ্টের” হৃষ্ট কলধ্বনি শ্রুত হয়;—কোকিলের আহার ও আবাস সম্বন্ধে কবিবর এইরূপ বর্ণনা করিয়াছেন। জার্ডন বলেন—

 It frequents gardens, avenues and open jungles; and feeds almost exclusively, I believe, on fruits of various kinds.

 ফ্রান্‌ক্ ফিন্‌ও ঠিক এইরূপ মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন—

 Unlike most Cuckoos, the koel feeds on fruit entirely or almost so.

 এই ফলভুক্ পিকটির সম্বন্ধে স্বতঃই একটি প্রশ্ন মনের মধ্যে জাগিয়া উঠে;—ঋতুসংহারের কবি কেবলমাত্র বসন্ত বর্ণনায় কোকিলকে আসরে নামাইলেন কেন? অন্যান্য ঋতুতে সে কি প্রকৃতির জীবননাট্যে যবনিকার অন্তরালে আত্মগোপন করিয়া থাকে? তবে কি সে যাযাবর? Messenger of springএর মত মধুমাসের আগমন-বার্ত্তা ঘোষণা করিবার জন্য সহসা ফাগুন চৈতে সে তাহার পঞ্চম স্বরে দিগঙ্গনাগণকে চঞ্চল করিয়া তুলে? ইহার উত্তরে বিহঙ্গতত্ত্ববিৎ বলিবেন যে, ভারতবর্ষের কোকিল যাযাবর নহে; অর্থাৎ ঋতুবিশেষে সে অন্য কোনও পাখীর ন্যায় দেশ ছাড়িয়া চলিয়া যায় না। তবে সে ভারতবর্ষের মধ্যেই গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে দিকে দিকে স্বেচ্ছায় উড়িয়া বেড়ায়; বৎসরের মধ্যে অধিকাংশ সময় বৃক্ষপত্রান্তরালে অথবা ঝোপের মধ্যে লুক্কায়িত থাকিতে ভালবাসে; আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তাহার মৌনব্রত প্রায় ভঙ্গ হয় না। এই মৌনী পিক কিন্তু বসন্তাগমে মুখর হইয়া উঠে এবং যতই দিন যায় ততই তাহার কাকলী ভারতবর্ষের কুঞ্জে কুঞ্জে বনবীথিকায় পথিককে উন্মনা করিয়া দেয়। ম্যাকিণ্টসের পুস্তকে[১৪] দেখিতে পাই—

 Indian koel is found in the plains where its clear melodious voice is heard in hot balmy days in early spring.

 নবীন বসন্তে পিকবধূর গর্ভাধান কাল; তখন পিকদম্পতির কলকূজনের বিরাম থাকে না। কোকিলকূজিত কুঞ্জকুটীরের চারিদিকে কোমল মলয়সমীর বহিতে থাকে। জার্ডন বলিতেছেন—

 About the breeding Season the koel is very noisy, and may be then heard at all times, even during the night, frequently uttering its wellknown cry.

 এখন অবশ্যই বুঝিতে পারা যাইবে যে, যদিও কোকিল, হংসের মত, যাযাবর নহে, তবুও সে এমন ভাবে কিছুকালের জন্য প্রকৃতির চিত্রপট হইতে আপনাকে লুপ্ত করিয়া ফেলে যে, কবি কিম্বা অকবি, কেহই তাহার সন্ধান পান না। তাই ঋতুসংহারে গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত শিশির—বর্ণনার মধ্যে এই Eudynamis honorata বা কোকিলকে খুঁজিয়া পাওয়া গেলনা।

 এইখানে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় পিককে বিদায় করা যাক্।—“তুমি বসন্তের কোকিল, শীতবর্ষার কেহ নও।” যে বর্ষায় ময়ূরের আনন্দনৃত্য ও বলাকার উড্ডীনগতি পথিকের চিত্তহরণ করে, সেই বর্ষার আর একটি পাখীর তৃষাকুলধ্বনি অনবরত তাহার শ্রবণমূলে আঘাত করে। মেঘদূতপ্রসঙ্গে তাহার কথা ভাল করিয়া আলোচনা করিবার সুযোেগ পাইয়াছিলাম। সেই চাতকপাখীরচাতক মেঘের সহিত এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দাঁড়াইয়া গিয়াছে যে, ঋতুসংহারের বর্ষাবর্ণনায় মহাকবি তাহাকে কিছুতেই বর্জ্জন করিতে পারিলেন না,—

তৃষাকুলৈশ্চাতকপক্ষিণাং কুলৈঃ
প্রযাচিতাস্তোয়ভরাবলম্বিনঃ।
প্রযান্তি মন্দং বহুধারবর্ষিণো
বলাহকাঃ শ্রোত্রমনোহরস্বনাঃ॥

বহুধারবর্ষী মেঘ শ্রবণমধুর শব্দ করিয়া ধীরে ধীরে গমন করিতেছে। পিপাসাকুল চাতক তোয়ভারাবলম্বী মেঘের নিকট বারিবিন্দু যাচ্ঞা করিতেছে। এই চাতক ও আমাদের ‘ফটিকজল’ পাখী এক কি না, সে সম্বন্ধে মেঘদূতপ্রসঙ্গে যাহা বলিয়াছি তদতিরিক্ত আপাততঃ আমার কিছু বলিবার নাই।

 এইখানে এই প্রবন্ধের উপসংহার করিয়া আমি বলিতেছিলাম আমার কথাটি ফুরালো। কিন্তু কিংশুক পুষ্পের আড়াল হইতে বসন্তঋতুতে ছদ্মবেশে শুকপাখীকে দেখিতে পাইতেছি;—একেবারে তাহার কথা কিছুই না বলিয়া কেমন করিয়া ঋতুসংহারের পাখীর কথা শেষ করা যায়। কবি প্রশ্ন করিতেছেন—কিং কিংশুকৈঃ শুকমুখচ্ছবিভির্ন ভিন্নং, অর্থাৎ টিয়া পাখীর মুখের ছবির মত পলাশকুসুম কিশুক (নারীগতচিত্ত যুবকের মনকে) বিদীর্ণ করিতে সমর্থ হইতেছে না? এখানে সৌন্দর্য্যের কবি কালিদাসের চক্ষে পাখীর রূপের সঙ্গে ফুলের কান্তির বিচিত্র সম্মিলন হইল বটে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক তত্ত্বজিজ্ঞাসুর সমক্ষে ornithology সঙ্গে Botany আসিয়া মিশিল। এই ফুলের ও পাখীর কথা, উদ্ভিদ্‌বিদ্যার ও বিহঙ্গতত্ত্বের অপরূপ সংঘর্ষ, ইহা যে কেবল কবির মস্তিষ্কপ্রসূত তাহা নহে। প্রকৃতির চিত্রপটে ফুল ও পাখী যে সৌন্দর্য্যের রেখা টানিয়া যায়, রূপে ও রসে, গন্ধে ও স্পর্শে যে মাধুর্য্য বিকীর্ণ করে, তাহা কবির রসসাহিত্যের অত্যাবশ্যক উপাদান বটে; কিন্তু Botanist ও ornithologist পাশাপাশি বসিয়া বৈজ্ঞানিক চসমা চোখে আঁটিয়া পাখীর ও ফুলের লীলা দেখিয়া শেষ করিতে পারেন না। এ প্রসঙ্গে আমি পরাগকেশর ও গর্ভকেশর এবং চঞ্চুপুটসাহায্যে উভয়ের মধ্যে বিহঙ্গের দৌত্যের কাহিনী বিবৃত করিতে চাহি না। পক্ষিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ্‌তত্ত্ব এই উভয় তত্ত্বের দিক্ হইতে economic ornithologyর অবতাৱণা করিতেছি না; কিন্তু এ অবস্থায় ঐ টিয়াপাখীর মুখোসপরা কিংশুককে লইয়া কি করিব? শুধু মোটামুটি অবৈজ্ঞানিক ভাবে বোধ হয় এখানে উভয়ের বর্ণসাদৃশ্য দেখাইয়া দেওয়া ছাড়া আর কিছু বলা চলে না। পলাশফুলের রং লাল; আর, বর্ণপরিচয় প্রথমভাগের ছড়ার ভাষায় বলিলেই বোধ হয় যথেষ্ট হইবে—টিয়াপাখীর ঠোঁটটি লাল।

  1. A Dictionary in Sanskrit and English (1874) by H. H. Wilson.
  2. Sanskrit-English Dictionary by Monier Williams.
  3. Colebrook’s Amarkosha.
  4. কবিরাজ উমেশচন্দ্র গুপ্ত কবিরত্ন কর্ত্তৃক সঙ্কলিত এবং কবিরাজ শ্রীনগেন্দ্রনাথ সেন কর্ত্তৃক সংশোধিত (১৯১৪)।
  5. “The floating lotus-leaves on which it walks.”—Cassell’s Book of Birds IV, p. 103. “This Jacana runs with wonderful facilitty over the Birds, edited by floating weeds, lotus leaves etc.”—Hume’s Nests and Eggs of Indian Birds, vol. III, p. 357.
  6. Nests and Eggs of Indian Birds by Allan O. Hume, Second Edition, Vol. III, p. 356.
  7. Fauna of British India, Birds, Vol. IV, p. 392.
  8. Charles Waterton in Natural History Essays, p. 382.
  9. Montagu’s Ornithological Dictionary, Second Edition.
  10. Curlew পাখীর সম্বন্ধে ব্লান্‌ফোর্ড লিখিয়াছেন—“In India Curlews are most abundant on the seacoast and on the banks of tidal rivers. * * * A winter visitor to India * * * Seen singly or in twos or threes, but flocks are not uncommon * * * has a peculiar, very plaintive cry.”
  11. ব্রহ্মাবধূত শ্রীসুখানন্দ নাথেন বিনির্ম্মিতঃ (Udaypur Sambat 1982) Vol. I, p. 711.
  12. “The Food of Birds in India (January 1912) by C. W. Mason and H. Maxwell Lefroy, p. 225.
  13. The Birds of India, Vol. I, p. 343.
  14. Birds of Darjeeling and India by L. J. Mackintosh.