বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:অক্ষয়কুমার বড়াল গ্রন্থাবলী.djvu/২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৷৵৹
অক্ষয়কুমার বড়াল-গ্রন্থাবলী

তাহা রূপে, বর্ণে, গন্ধে সুসম্পূর্ণ হইয়া সার্থকতা লাভ করে। কবিতার যে উপাদানে এই গূঢ় শক্তি প্রচ্ছন্ন থাকে, তাহাই ব্যঞ্জনা। কবিতা সুন্দর, ব্যঞ্জনা সুন্দরতম। 'প্রদীপে'র অধিকাংশ কবিতা ব্যঞ্জনা সমৃদ্ধ।

 'প্রদীপ' কবির প্রথম রচনা। প্রথম বয়সের চিন্তায় 'আপনা'র প্রাধান্যই অধিক থাকে; 'অহম্'ই তাহাতে অধিকমাত্রায় ফুটিয়া উঠে। নবজাগরূক কবি চিত্তবৃত্তির আকস্মিক উচ্ছাসে আত্মহারা হইয়া আপনার সুখের গান, দুঃখের গান গায়িয়া যান; কিন্তু বিশ্বের সুখ-দুঃখের সহিত যাহার সম্বন্ধ অল্প, তাহা কখনও সার্ব্বভৌমিক-সার্ব্বজনীন হইতে পারে না। সে সঙ্কীর্ণ সুখ-দুঃখের গান নিতান্তই ব্যক্তিগত হইয়া পড়ে। সে দিন এক জন নিপুণ সমালোচক- স্বয়ং সুকবি— বলিয়াছেন, বড়াল জাত-কবি। সে কথা সত্য। তিনি জাত-কবি, এবং এই কারণেই প্রথম যৌবনেও সেই জাত-কবির স্বধর্ম্ম 'সহজ-বুদ্ধি'টুকুর আলোয় আপনার হৃদয়-বেলাভূমির উপলরাশি হইতে চিন্তা-মণিগুলি বাছিয়া লইয়াছিলেন। এই জন্য তাঁহার প্রথম রচনাবলীতেও 'ন্যাকামী' নাই বলিলেও চলে। কবি উত্তরকালে 'প্রদীপে'র অল্পবিস্তর সংস্কার করিয়াছেন। তাহাতে 'প্রদীপ' মালিণ্যশূন্য— পরিচ্ছন্ন হইয়াছে।

 কবি 'কবিতা'য় নিজেই বলিয়াছেন,— তিনি প্রথমে কবিতার 'উজ্জ্বল বিভায় মুগ্ধ হইয়া, দিগ্বিদিক হারাইয়া' 'প্রদীপ' লইয়া সাহিত্যের দরবারে প্রবেশ করিয়াছিলেন। বাঙ্গালীর সৌভাগ্যক্রমে তিনি লালসার শিখা— আলোয় আলোয় মুগ্ধ হন নাই। এই 'প্রদীপ'ই তাহার প্রমাণ। 'প্রদীপে' রক্তমাংসের গন্ধ আদৌ নাই, এমন বলিতে পারি না, কিন্তু তাহা অত্যন্ত অল্প। যাহাও আছে, তাহাও লালসার— কামের ন্যক্কারজনক দুর্গন্ধে বীভৎস হইবার অবকাশ পায় নাই। কাঁচা বয়সের প্রবৃত্তির তাড়নায়, মানব-মনের স্বাভাবিক মোহপ্রবণতার প্রেরণায় বড়াল কবির কিশোরী কল্পনা ক্কচিৎ লালসার রাগে রঞ্জিত হইয়াছে; কিন্তু কবি যেন স্বাভাবিক শক্তিবলে সে মোহ অতিক্রম করিয়াছেন। লালসায় যে কবিতার সূচনা, সৌন্দর্য্যের— বহিঃপ্রকৃতি বা অন্তঃপ্রকৃতির উদ্বোধনে তাহার উপসংহার হইয়াছে। মনে হয়, যেন আসারবঞ্চিত শুষ্কপ্রায় জলাশয়ের দুর্গন্ধ পঙ্কবিস্তারে প্রফুল্ল শতদল ঢল-ঢল করিতেছে। এই শুচিতাই 'প্রদীপে'র আদিরসাত্মক কবিতাগুলির বিশেষত্ব। 'ভবনেত্র-জন্মা বহ্নি' মদনকে 'ভস্মাবশেষ' করিয়াছিল। বড়ালের কিশোরী প্রতিভার শুচি-স্মিত জ্যোৎস্নায় লালসার মোহিনী মায়া দগ্ধ হইয়াছে। প্রথম বয়সের কবিতায় এমন সংযম প্রায় দেখা যায় না। উত্তরকালে কবি স্বীয় রচনায় যে সুরুচি ও সুনীতির পরিচয় দিয়াছেন, এই 'প্রদীপে'ই তাহার প্রথম সূচনা। বৃক্ষের জীবন ও ধর্ম্ম বীজেই নিহিত থাকে; অল্প পরিসরে তাহার ক্রম-বিকাশ-পদ্ধতির অনুসরণ অসম্ভব।