ইহা আত্ম-নাশের প্রবর্ত্তক নহে। দুঃখের স্বরূপ-নির্ণয় ও তাহার অত্যন্ত-নাশে কল্যানের প্রতিষ্ঠা,—ইহাই প্রাচ্য দুঃখবাদের প্রতিপাদ্য।
সর্ব্বজয়ী দুঃখ ও তাহার সর্ব্বব্যাপী প্রভাব কবির চিত্তও অধিকার করিবে, ইহা অবশ্য বিচিত্র নহে। প্রাচী ও প্রতীচীর অনেক কবি দুঃখের গান গায়িয়াছেন; কিন্তু উভয় দেশের দুঃখবাদের প্রকৃতি সম্পূর্ণ বিভিন্ন। প্রাতীচ্য কবির দুঃখবাদের কবিতায় প্রতীচ্য প্রকৃতির বিকাশ ঘটিয়াছে। প্রাচীন প্রাচ্য কবিদের দুঃখবাদে ভারতীয় ভাবের অভিব্যক্তি হইয়াছে। ইহাই স্বাভাবিক। কিন্তু নব-ভারতে ইহার ব্যতিক্রম ঘটিয়াছে। তাহার কারণও অজ্ঞেয় নহে, সুস্পষ্ট। নব-ভারতের সমুদ্র-বেলায় নানা দেশের ভাব ভাসিয়া আসিতেছে। যে দেশের সহিত নব-ভারতের ঘনিষ্ঠ যোগ ঘটিয়াছে, সে দেশের বহু ভাবে আমরা অভিভূত হইয়াছি। সাহিত্যেও সে প্রভাবের আধিপত্য ঘটিয়াছে। আমাদের সোনার বাঙ্গালায় সেই সম্বন্ধ প্রথম বদ্ধমূল হইয়াছিল। সেই যোগের যুগে বাঙ্গালী প্রতীচ্য ভাবের প্রথম পরিচয় লাভ করে। সে পরিচয় ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে পরিণত হইয়াছে। প্রাচীন ভারতের ও প্রাচীন বাঙ্গালার ভাব-সম্পদের উত্তরাধিকারী হইয়াও বাঙ্গালী সাগর-পারের প্রভাবে অভিভূত হইয়াছিল। বাঙ্গালার কোমল মৃত্তিকায় আগন্তুকের পদাঙ্ক বোধ করি সহজেই মুদ্রিত হইয়াছিল। দেশের পুরাতন ভাঙ্গিতে লাগিল; অনেক প্রাচীন ভাব ও আদর্শ কালস্রোতে ভাসিয়া গেল। বাঙ্গালী নবাগত বিজেতার ভাবে মুগ্ধ হইল। শ্বেতদ্বীপের দুঃখবাদের ঝঙ্কারও বাঙ্গালী কবিদের বীণায় ঝঙ্কৃত হইয়া উঠিল। ইহা অনুচিকীষা হইতে পারে, পারিপার্শ্বিক অবস্থার অবশ্যম্ভাবী, অনতিক্রমণীয় প্রভাবের স্বাভাবিক ফলও হইতে পারে। কারণ যাহাই হউক, বাঙ্গালীর আদর্শগ্রহণপটু স্বচ্ছ মনে এই বিদেশী দুঃখবাদ প্রতিবিম্বিত হইয়াছিল, এবং এখনও হইতেছে, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই।
অক্ষয়কুমারও সাহিত্য-সাধনার প্রথম সোপানে এই ভাবে অভিভূত হইয়াছিলেন। তাঁহার কবিতাতেও দুঃখবাদের প্রগাঢ় ছায়া আছে। কবির প্রথম রচনা 'প্রদীপে'র নীচেও সে অন্ধকার বিদ্যমান; কিন্তু আমার মনে হয়,— বড়ালের দুঃখবাদে একটু বিশেষত্ব আছে। বড়ালের বিষাদ-গাথা— নিরাশার গান হিন্দুর দুঃখবাদ। প্রতীচ্য দুঃখবাদের যাহা আদি, মধ্য ও অন্ত, তাহাতেই বড়ালের দুঃখের গানের আরম্ভ। প্রতীচ্য দুঃখবাদের প্রভাবে তাহার উদ্ভব বটে, কিন্তু হিন্দুর দুঃখবাদে তাহার পুষ্টি ও পরিণতি। দুঃখবাদে তাহাদের সূচনা, সুখবাদে তাহাদের সমাপ্তি। বড়াল কবি দুঃখের গান গায়িয়াছেন,—কিন্তু সেই দুঃখের হলাহলে সুখের সুধা ঢালিয়া দিয়াছেন। তিনি দুঃখে— অমঙ্গলে বিহ্বল ও আত্মবিস্মৃত হন নাই, মঙ্গলের আবাহন করিয়াছেন। বড়ালের কাব্যে