পাত্র তাপসীর জন্যে ধর্ণা দেবে। সেই গর্ব্বের স্বপ্নে মেয়ের মন থেকে সে বিয়ের স্মৃতি মুছে ফেলবার প্রয়াসের অন্ত ছিল না তাঁর।
কিন্তু হায়, এ নিদারুণ সত্যকে যদি এতো সহজেই মুছে ফেলা যেতো! তাকে নিয়ে চিত্রলেখার আতিশয্যে কখনো সে করেছে বিদ্রোহ—কখনো নিরূপায় হয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। নিজের অসামান্য রূপ-গুণ-যৌবনকে নিষ্ঠুরভাবে বঞ্চিত করে, উন্মুখ হৃদয়ের কণ্ঠরোধ করে বার বার সে প্রত্যাখ্যান করেছে প্রলোভনকে, বার বার প্রত্যাখ্যান করেছে চিত্রলেখার নির্ব্বাচিত সুপাত্রদের।
তবু মাঝে মাঝে নিষ্ঠুর প্রশ্ন তাকে জর্জ্জরিত করেছে—কেন, কেন সে চিরকাল এমনি বঞ্চিত হয়ে থাকবে? পাপের ভয়ে, না তার সেই খেলাঘরের বরের আশায়? কোথায় সেদিনকার সেই অপরিণত বয়স্ক বালক—তার স্বামী! কোনোদিন কি আর সে ফিরে আসবে তাপসীর কাছে স্বামীত্বের দাবী নিয়ে? না তাপসীই চিরকাল তাকে খুঁজে বেড়াবে? আশাহীন আনন্দহীন, প্রেমস্পর্শহীন নিরর্থক জীবনটা কিসের আশায় সে নির্জ্জন ঘরে ধূপের মতো জ্বালিয়ে নিঃশেষ করতে থাকবে?... কে জানে—এতোদিন ধ’রে যে বাধাকে দুর্লঙ্ঘ্য মনে করে পলে পলে নিজেকে ক্ষয় করে আসছে, আসলে, সেটা একটা বিরাট ফাঁকি কি না!
ট্রেন ছুটে চলেছে হু হু করে।... প্রতি মুহূর্ত্তে কিরীটির আর তার মাঝে ব্যবধান যতো বাড়ছে তার হৃদয়তন্ত্রীগুলোতে ততো প্রবল টান পড়ছে যেন। আর সকলের মতো কিরীটিকে সে ফেরাতে পারলো কই। কেন তার সামনে নিজেকে এতো অসহায় মনে হয়—তার আকর্ষণে সব ধৈর্য্য, সব সংকল্প ভেসে যেতে চায়! তবু কিরীটি এসে দাঁড়িয়েছে নীরব প্রার্থীর মতো—সসম্ভ্রমে। যদি সে দস্যুর মতো লুঠ করতে চাইতো? পারতো কি তাপসী তার খুঁটি আঁকড়ে থাকতে?
আকর্ষণ আর বিকর্ষণের একি নিষ্করুণ দোটানার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে সে! কে দেবে তাকে আজ পথের নির্দ্দেশ?
সে যুগের সীতা একদিন এই রকম এক অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণা হয়ে নারীর কপালে দিয়েছিলেন জয়-তিলক। আর আজ সে কি দেবে—কলঙ্ক? বৃদ্ধা বসুন্ধরা বুঝি আজ বধিরা—নইলে এতো বড়ো সঙ্কটের দিনে সেদিনের মতোই তাপসীকে কোল দিতেন।