পাতা:অবনীন্দ্র রচনাবলী প্রথম খণ্ড.djvu/৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

এমনি আর-একটা শব্দ পাখিরা জাগার আগে থেকেই শোবার ঘরে এসে পোছত। ভোর চারটে রাত্রে, অন্ধকারে তখন চোখ ছটাে কিছুই দেখছে না অথচ শব্দ দিয়ে দেখছি— সহিস ঘোড়ার গা মলতে শুরু করেছে, শব্দগুলোকে কথায় তর্জমা করে চলত মন অন্ধকারে— গাধুনে গাধুসনে, চটপট, হঠাৎ খাটখোট চাবকান পঠাৎ পঠাৎ, গাধু গাধু খাটি খুটি চটপট ! এই রকম সহিসে ঘোড়ায়, সহিসের হাতের তেলোতে, ঘোড়ার খুরে মিলে কতকগুলো শব্দ দিয়ে ঘটনাকে পাচ্ছি। এমনি একটা গানের কথা আর স্থর দিয়ে পেয়ে যেতেম সময়ে সময়ে একজন অন্ধ ভিখারীকে । লোকটি চোখের আড়ালে, কিন্তু গানটা ধরে আসত সে নিকটে একেবারে তিনতলায় উঠে। ভিখারীর গানের একটা ছত্র মনে আছে এখনো— উমা গো, মা তুমি জগতের মা, ওমা কি জন্যে তুমি আমায় মা বলেচে ’ সন্ধেবেলায় খিড়কির দুয়োরে একটা মানুষ এসে হাক দেয়— ‘মুশকিল আসান’ ! কথাটার অর্থ উলটাে বুঝতেম— ভয়ে যেন হাত-পা কুঁকড়ে যেত ; গা ছমছম করত আর সেইসঙ্গে পাকা দাড়ি, লম্ব টুপি, বাপ্পা-বোপ্পা কাপড়-পরা ভূতুড়ে একটা চেহারা এসে সামনে দাড়াত দেখতেম। বেলা তিনটের সময় একটা শব্দ– সেটা স্বরেতে মানুষেতে একসঙ্গে মিলিয়ে আসত—চুড়ি চাই, খেলোনা চাই – এবারে কিন্তু মানুষটার চেয়ে পরিষ্কার করে দেখতে পেতেম– রঙিন কাচের ফুলদান, গোছার্বাধী চুড়ি, চীনে-মাটির কুকুর বেড়াল । বরফওয়ালার হাক, ফুলমালির হাক এমনি অনেকগুলো হাক-ডাক এখন শহর ছেড়ে পালিয়েছে এবং তার জায়গায় মোটরের ভেঁপু, ট্রাম-গাড়ির হুসহাস, টেলিফোনের ঘণ্টা এসে গেছে শহরে। কোন বয়েস থেকে দেখাশোনা আরম্ভ, কখনই বা শেষ সে-হিসেব বেঁচে থাকতে কষে দেখার মুশকিল আছে, তবে জনে জনে দেখাশোনায় প্রভেদ আছে বলতে পারি। আমাদের পুরোনো বাড়িতে পেট-ঘড়িটা বাজছে যখন শুনতে পেলেম তখন তার বাজনের হিসেবের মজাটা দেখতে পেলেম । সকালে উপরো-উপরি ছ’টা, সাতটা, সাড়ে সাতটা বাজিয়ে ঘড়িটা থামত । তার পরে আটটা ন’টা দু’ঘণ্টা ফাক। ফের উপরো-উপরি দশ আর সাড়ে দশ বাজিয়ে স্নান আহার করে যেন ঘুম দিলে ঘড়িটা দুপুরবেলায়। উঠল বিকেলে, চার ও পাঁচ বাজিয়ে। ঘড়ির এই রকম খামখেয়ালি চলার অর্থ তখন বুঝতেম না। Woo.