বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:অলৌকিক নয় লৌকিক (প্রথম খণ্ড) - প্রবীর ঘোষ.pdf/২৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
ভাববাদ বনাম যুক্তিবাদ বা বস্তুবাদ
২৮৫

হেতুবাদান্ প্রবদিতা বক্তা সংসৎসু হেতুমৎ।
আক্রোষ্টা চ অভিবক্তা চ ব্রহ্মবাক্যেষু চ দ্বিজান্॥
নাস্তিকঃ সর্বশঙ্কী চ মূর্খঃ পণ্ডিতমানিকঃ।
তস্য ইয়ং ফলনিবৃত্তিঃ শৃগালত্বং মম দ্বিজ॥

(শান্তিপর্ব ১৮০/৪৭-৪৯)

 অর্থাৎ, আমি ছিলাম বেদ-সমালোচক যুক্তিবাদী পণ্ডিত। নিরর্থক তর্কবিদ্যায় ছিলাম অনুরক্ত। বিচারসভায় ছিলাম যুক্তিবাদের প্রবক্তা। যুক্তির সাহায্যে দ্বিজদের ব্রহ্মবিদ্যার বিরুদ্ধে আক্রোশ মেটাতাম। ছিলাম জিজ্ঞাসু মনের নাস্তিক, অর্থাৎ কি পণ্ডিত্যাভিমানী মূর্খ। হে ব্রাহ্মণ, তারই ফলস্বরূপ আমার এই শিয়ালজন্ম।

মুক্তমণের বিরোধী তর্কবিদ্যা কেন ভাববাদী দর্শনের গৌরব

 অনেকের মতেই এই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, ভাববাদ যদি যুক্তিবাদের অর্থাৎ জিজ্ঞাসু মনের বিরোধীই হবে, তবে কেন তর্কবিদ্যা অর্থাৎ ন্যায়দর্শন ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে প্রধান গৌরব বলে স্বীকৃতি পেল? দেশের শাসকশ্রেণী বা আইনকর্তারা যদি যুক্তি-তর্কের এত তীব্র বিরোধীরই হবেন তবে তর্কবিদ্যা এতদূর এগোলে কি করে?

 বিষয়টা পরিষ্কার না করলে বিভ্রান্তি থাকাই স্বাভাবিক। ভাববাদীরা যুক্তি-তর্কের লড়াইকে পরিষ্কার দুটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। (১) বেদ ও ধর্মশাস্ত্রের অভ্রান্ততায় পরিপূর্ণ বিশ্বাস রেখেও যেখানে যুক্তি-তর্কের কূট কচকচালি চালিয়ে যাওয়া যায়। (২) যুক্তি-তর্ক যেখানে প্রমাণ ছাড়া কোনও কিছুকেই অভ্রান্ত বলে মানতে নারাজ—এমনকি তা বেদ এবং ধর্মশাস্ত্র হলেও।

 ধর্মশাস্ত্রকার তর্কশাস্ত্রকে প্রশংসা করেছেন। তবে সে তর্ককে এগোতে হবে অবশ্যই বেদের অভ্রান্ততাকে মেনে নিয়ে। বেদের প্রামাণ্যকে শিরোধার্য করে নানা জটিল প্রশ্ন তুলে তর্ক চালিয়ে গেলে সাধারণের মধ্যে বেদভক্তি ও ধর্মবিশ্বাস আরও প্রবল হবে—মনু যারা বেদের অভ্রান্ততাকে অস্বীকার করে, প্রমাণ ছাড়া কিছু জানতে নারাজ—তাদের সমাজ থেকে বহিষ্কার করবে।

 ভারতবর্ষে ভাববাদী দর্শনের প্রথম সুস্পষ্ট স্বাক্ষর দেখতে পাই আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ‘উপনিষদ্’ সাহিত্যে।

 চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন বা বস্তুবাদী দর্শনের সূচনা কবে হয়েছিল সঠিক বলা সম্ভব নয়। আনুমানিক অষ্টম শতকে রচিত বৌদ্ধ দার্শনিক কমল শীলের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘পঞ্জিকা’তে বস্তুবাদী চার্বাক দর্শনের উল্লেখ রয়েছে দেখতে পাই।

 কমল শীলের গুরু শান্ত রক্ষিত নিজের মতে সমর্থনে ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ নামে একটি দর্শনগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচনায় দেখতে পাই বস্তুবাদী দর্শনটিকে তিনি ‘চার্বাক’ না বলে ‘লোকায়ত’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।

 শান্ত রক্ষিত থেকে শঙ্করাচার্য পর্যন্ত বেশ কয়েকজন বিখ্যাত ভাববাদী