পাতা:অলৌকিক নয় লৌকিক (প্রথম খণ্ড) - প্রবীর ঘোষ.pdf/৩০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৩০৭
অলৌকিক নয় লৌকিক (প্রথম খণ্ড)
৩০৭

ভাববাদ বনাম যুক্তিবাদ বা বস্তুবাদ ৩০৭ নির্ভর করে অনুমান। যেমন ধোঁয়া দেখলে আগুনের অনুমান, গর্ভ দেখে অতীত মৈথুনের অনুমান ইত্যাদি। অপ্রত্যক্ষ বিষয়ে অনুমান কখনই হতে পারে না। ভাববাদীদের চোখে প্রত্যক্ষ ও প্রত্যক্ষ-অনুগামী জ্ঞানের গুরুত্ব ছিল সামান্য অথবা অবান্তর। তারা অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন, ঋষি’ নামধারী ধর্মগুরুদের মুখের কথাকে, | ধর্মগুরুদের অন্ধবিশ্বাসকে—যার ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছিল আধ্যাত্মবিদ্যা। আজও যাঁরা বলেন, “বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্ম এবং অধ্যাত্মবাদের কোন দ্বন্দ্ব নেই, বরং অধ্যাত্মতত্ত্বই ‘পরম বিজ্ঞান’, তঁারা এটা ভুলে যান—প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞান ছাড়া প্রকৃত বিজ্ঞানের প্রথম ধাপটিতে পা রাখাই সম্ভব নয়। লােকায়ত দর্শন প্রত্যক্ষ ও প্রত্যক্ষ-অনুগামী জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে দ্বিধাহীন ভাষায় ঘােষণা করেছিলেন—চৈতন্য দেহেরই গুণ বা দেহেরই ধর্ম। দেহ ধ্বংস হওয়ার পর চৈতনাস্বরূপ আত্মার অস্তিত্ব অজ্ঞান ও ধূর্তদের কল্পনা মাত্র। লােকায়ত দর্শনের এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে শঙ্কারাচার্য যে যুক্তি রেখেছিলেন তা হলাে—লােকায়ত দর্শনের মতে দেহের মূল উপাদান জল, মাটি, আগুন, বায়ু ইত্যাদি ভূত-পদার্থ। এই প্রতিটিভূত-পদার্থই জড় বা অচেতন পদার্থ। তাহলে এই অচেতন পদার্থে গড়া মানুষের মধ্যে চেতনা আসছে কোথা থেকে? আসছে নিশ্চয়ই এই সব অচেতন পদার্থের বাইরে থেকেই। অতএব স্বীকার করে নেওয়া উচিত—চৈতন্য বা আত্মা দেহের অতিরিক্ত একটা কিছু। আত্মা বিষয়ে অন্যান্য বহু ভাববাদী দার্শনিকেরা যে-সব তর্কের ঝড় তুলেছেন, তাঁদের অনেকের বক্তবােই শঙ্কারাচার্যের এই যুক্তির সুর লক্ষ্য করা যায়। তাঁরাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন—জড় বা অচেতন পদার্থের গড়া দেহ তাে সরল যুক্তিতে অচেতনই হবার কথা। তবে মানুষের চৈতন্য আসছে কোথা থেকে? | লােকায়ত দর্শন এই যুক্তির বিরুদ্ধে পালটা যুক্তিও হাজির করেছেন—মদ তৈরির উপকরণগুলােতে আলাদা করে বা মিলিত অবস্থায় কোন মদশক্তি নেই। কিন্তু সেই উপকরণগুলােকেই এক ধরনের বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মিলন ঘটানাের পর সম্পূর্ণ নতুন এক গুণ পাওয়া যাচ্ছে, যাকে বলছি মদ। আত্মা বা চৈতন্যও একই জাতীয় ঘটনা। | লােকায়তিকদের চৈতন্যের সঙ্গে মদশক্তির তুলনা নিয়ে কোন বিপক্ষ দার্শনিকই কূটতর্ক গড়ে তােলার চেষ্টা করেননি। তবে, তারা দৃষ্টান্ত হিসেবে এনেছেন মৃতদেহের তুলনা। চৈতন্য যদি দেহেরই লক্ষণ বা ধর্ম হয়, তবে মৃতদেহেও তাে চৈতন্য থাকার কথা, থাকে না কেন? মৃতদেহও দেহ। লােকায়ত দর্শনের আত্মা বা অচৈতন্যতত্তের বিরুদ্ধে ভাববাদীদের এটাই সবচেয়ে জোরালতম যুক্তি।