অনঙ্গদের বাড়ী গোয়ালপাড়ার প্রান্তে, দুখানা মেটে ঘর। খড়ের ছাউনি, একখ দোচালা রান্নাঘর। পরিকার-পরিচ্ছন্ন উঠানের ধারে ধারে পেঁপে ও মানকচু গাছ। চারা দিশি কুমড়োর লতা দেওয়া হয়েচে কঞ্চি দিয়ে, রান্নাঘরের পাশে গোটকতক বেগান গাছ ঢেঁড়সা গাছ।
অনঙ্গ এসে দেখল বাদ্যিনাথ কলু বড় একটা ভাঁড়ে প্রায় আড়াই সের খাঁটি সর্ষে-তেল এনেচে। তেল মাপা হয়ে গেলে বাদ্যিনাথ বললে-মা-ঠাকরুণ, আজ আর সর্ষে দেবে নাকি?
-উনি বাড়ী এলে পাঠিয়ে দেবো। এখন এই তেলে এক মাস চলে যাবে -আর পয়সা ছ'টা?
-কেন খোল তো নিয়েচ, আবার পয়সা কেন?
-ছটা পয়সা দিতে হবে সর্ষে ভাঙানির মজরি। খোলের আর কত দাম মা-ঠাকরুণ তাতে আমাদের পেট চলে?
-আচ্ছা উনি বাড়ী এলে পাঠিয়ে দেবো।
অনঙ্গ-বৌয়ের দুটি ছেলে। বড়টির বয়েস এগারো বছর, তার ডাকনাম পটল। ছোট আট বছরের। তাকে এখনও খোকা বলেই ডাকা হয়। পটল খুব সংসারী ছেলে-এ তরিতরকারীর ক্ষেত সে-ই করেচে বাড়ীতে। এখন সে উঠোনের একপাশে বসে বেড়া বাঁধবার জন্যে বাঁশের বাখ্যারি চাঁচছিল। ওর মা বললে-পট্লা, ওসব রাখ্ এত বেলা হোল দুধ দেয় নি কেন দেখে আয় তো?
পটল বাখ্যারি চাঁচতে চাঁচতেই বললে-আমি পারবো না।
-পারবি নে তো কে যাবে? আমি যাবো দুধ আনতে সেই কেষ্টদাসের বাড়ী?
-আহা, ভারি তো বেলা হয়েচে, এখন বেড়াটা বেঁধে নিই, একটু পরে দুধ এনে দেবো -না এখুনি যা।
-তোমার পায়ে পড়ি মা। বাবা বাড়ী এলে আর বেড়া বাঁধতে পারবো না। এই দ্যাখো ছাগল এসে আজ বেগুন গাছ খেয়ে গিয়েচে।
খোকা এসে বললো-মা, আমি দুধ আনবো? দাদা বেড়া বাঁধুক—
অনঙ্গ সে কথা গায়ে না মেখে বললে-খোকা, গাছ থেকে দুটো কাঁচা ঝাল তোল তোদের মুড়ি মেখে দি খোকা জেদের সুরে বললে-আমি দুধ আনবো না মা?
-না।
-কেন, আমি পারি নে!
-তোকে বিশ্বাস নেই।—ফেলে দিলেই গেল।
—তুমি দিয়ে দাখো। না পারি, কাল থেকে আর দিও না।
-কাল থেকে তো দেবো না, আজকের দুসের দুধ তো বালির চড়ায় গড়াগড়ি খাক তোর সর্দারি করবার দরকার কি বাপু? দুটো কাঁচা ঝাল তুলতে বললাম, তাই তোল;
এমন সময়ে পটলের বাবা গঙ্গাচরণ চক্কত্তি বাড়ী ঢুকে বললে-কোথায় গেলে-এই মাছ ধরো, দীনু তীওর দিলে, বললে সাত-আটটা মাছ পেয়েচি -এটা ব্রাহ্মণের সেবায় লাগুক বেশ বড় মাছটা-না? এই পটলা পড়া গেল, শুনো গেল, ও কি হচ্চে সকালবেলা?