পাতা:আত্মকথা - সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গুরুমহাশয় বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোর মা লেখাপড়া জানে ?” উত্তর, “হা, আমার মা বেশ পড়তে পারে ।” তাহার পর গুরুমহাশয় সন্ধান লাইলেন যে আমার মা একাকিনী বাড়িতে থাকেন, বাবা বিদেশে । একদিন গুরুমহাশয় আমার লিখিবার তালপাতে কি লিখিয়া আমাকে দিলেন, বলিলেন, “তোর মাকে দিস, আর কেউ যেন দেখে না ।’ আমি ভাবিলাম, সকল বালকের মধ্যে আমি ভাগ্যবান, গুরুমহাশয় আমার মাকে পত্র লিখিয়াছেন । আমি বাড়িতে আসিয়া এক গাল হাসিয়া মাকে বলিলাম, ‘ওরে মা, গুরুমহাশয় তোকে কি লিখেছে দেখ, ।” মা তালপাতাটি আমার হাত হইতে লইয়া একটু পড়িয়াই গম্ভীর মূর্তি ধারণ করিলেন, পাতাটি ছিাড়িয়া টুকরা টুকরা করিয়া ফেলিয়া দিলেন। আমি তাহা আনিয়াছিলাম বলিয়া আমাকে মারিলেন, এবং তৎপর দিন হইতে আমার পাঠশালে যাওয়া বন্ধ করিলেন । সেই আমার পাঠশালে যাওয়া শেষ । তৎপরে তিনি আমাকে গ্রামের নবপ্রতিষ্ঠিত হার্ডিঞ্জ মডেল স্কুলে ভর্তি করিয়া দিলেন। আর একটি ঘটনা অন্যরূপ। সে ঘটনাটি সে সময়ে আমার মনে দৃঢ় রূপে মুদ্রিত হওয়াতে স্মরণ আছে। একবার আমার মাতুলালয়ে কয়েকজন নবাগত অতিথি আহারে বসিয়াছেন। আমার মায়ের জ্ঞাতি সম্বন্ধে খুড়তুতো ভাই অভয়চরণ চক্রবর্তী সেই সঙ্গে বসিয়াছেন । এই অভয়ামামা কলিকাতার সেণ্ট জেভিয়ার্স কলেজে কি বিশপস কলেজে সংস্কৃত পণ্ডিত ছিলেন। তিনি গ্রামে একজন পদস্থ ব্যক্তি । কিন্তু আমার মা ও পাড়ার অপরাপর প্রাচীন আত্মীয়া মহিলারা অভয়ামামাকে বালককাল হইতে ‘ঘোনো’। ‘ঘোনো’ বলিয়া ডাকিতেন। তঁহার ‘অভয়’ নাম দিদিদের বা খুড়ী-জেঠীদের মুখে। কখনই শোনা যাইত না । সকলেই ‘ঘেনো’। ‘ঘেনো” বলিয়া ডাকিতেন । উক্ত দিবস আহারের সময় আমার মা পরিবেশন করিতেছিলেন । তিনি মাছ পরিবেশন করিবার সময় অভয়ামামাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঘোনো, তোকে একটা মাছের মুড়ে দেব?” কারণ অভয়ামামা আহারের বিষয়ে খুতখুতে লোক ছিলেন, মা তাহা জানিতেন । এত লোকের সমক্ষে "ঘেনে বলিয়া ডাকাতে অভয়ামামা রোষকষায়িতলোচনে একবার আমার মায়ের মুখের দিকে চাহিলেন, এবং অবজ্ঞাসূচক দুই-একটি বাক্য প্রয়োগ করিলেন । আমার মা তখন কিছু বলিলেন না । তৎপরে আচমনান্তে অভয়ামামা যেই ঘরের মধ্যে পান খাইতে আসিয়াছেন, অমনি মা কুপিতা সিংহীর ন্যায়, পদাহিত্য ফিশিনীর ন্যায়, গজিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “লেখাপড়া শিখে তোর এই বিস্তে হয়েছে ? আমি তোকে ‘ঘোনো” বলেছি, তাই ভালো দেখায়, না। ‘অভয়বাবু বললে ভালো দেখায় ? তোর বন্ধুরা কি জানে না। আমি তোর দিদি ? তুষ্ট বাইরে অভয়বাবু হতে পারিস, আমাদের কাছে তো সেই ঘোনোই আছিল। Swo