পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
আত্মচরিত

জানিতেন না। সুতরাং তাঁহারা তাঁহাদের অধীন অসাধু ভারতীয় কর্মচারীদের হাতের পুতুল হইয়া দাঁড়াইলেন। আর ঐ সমস্ত ভারতীয় কর্মচারীরা যদি এরূপ লোভনীয় অবস্থার সুযোগ না লইতেন, তাহা হইলেই বরং অস্বাভাবিক হইত। অজন্মার জন্য কোন জমিদার খাজনা দিতে পারিল না, তাহার জমিদারী “সূর্যাস্ত আইনে” এক হাতুড়ীর ঘায়েই নীলাম হইয়া যাইবে এবং এক মুহূর্তেই সে কপর্দকশূন্য পথের ভিখারী হইবে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপিতে সে কালেক্টরের নিকট দরখাস্ত করিল, তিনি তাহাকে ইচ্ছা করিলে রক্ষা করিতে পারেন। কিন্তু এই কালেক্টর আবার প্রায়ই দেওয়ান বা সেরেস্তাদারের পরামর্শেই চালিত হইতেন। সতরাং সেরেস্তাদার বা দেওয়ানকে যে পরিমাণ উৎকোচ দ্বারা প্রসন্ন করা হইত, সেই পরিমাণেই তিনি জমিদারদের পক্ষ সমর্থন করিতেন। ফৌজদারী মোকদ্দমাতেও পেস্কারের পরামর্শ বা ইঙ্গিতেই জজসাহেব অল্পবিস্তর প্রভাবান্বিত হইতেন। তখন জুরী প্রথা ছিল না, সুতরাং এই সব অধস্তন কর্মচারীদের হাতে কতদূর ক্ষমতা ছিল, তাহা সহজেই অনুমেয়। অসহায় জজেরা পেস্কারদের হাতের পতুল হইতেন, এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল নহে।

 এক শতাব্দী পর্বে আমার প্রপিতামহ মাণিকলাল রায় কৃষ্ণনগরের কালেক্টরের এবং পরে যশোহরের কালেক্টরের দেওয়ান[১] ছিলেন। এই পদে তিনি যে প্রভূত ধন সঞ্চয় করিয়াছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। আমার বাল্যকালে তাঁহার সঞ্চিত ধনের অদ্ভুত গল্প শুনিতাম। তিনি মাঝে মাঝে মাটীর হাঁড়ি ভরিয়া কোম্পানীর ‘সিক্কা টাকা’ বাড়ীতে পাঠাইতেন। বিশ্বস্ত বাহকেরা বাঁশের দুইধারে ভার ঝুলাইয়া অর্থাৎ বাঁকে করিয়া এই সমস্ত টাকা লইয়া যাইত। সেকালে নদীয়া-যশোর গ্রাণ্ডট্রাঙ্ক রোডে ডাকাতের অত্যন্ত উপদ্রব ছিল। সুতরাং ডাকাতদের সন্দেহ দূর করিবার জন্য মাটীর হাঁড়ির নীচে টাকা ভর্তি করিয়া উপরে বাতাসা দিয়া ঢাকিয়া দেওয়া হইত।

 আমার পিতামহ আনন্দলাল রায় যশোরের সেরেস্তাদার ছিলেন এবং প্রচুর ধন উপার্জন করিয়া পৈতৃক সম্পত্তি বৃদ্ধি করেন। তিনি যশোরেই অকস্মাৎ সন্ন্যাসরোগে মারা যান। আমার পিতা সংবাদ পাইয়া রাড়ুলি গ্রাম হইতে তাড়াতাড়ি যশোরে যান, কিন্তু তিনি পৌছিবার পূর্বেই পিতামহের মৃত্যু হয়, সুতরাং পিতাকে কোন কথাই বলিয়া যাইতে পারেন নাই।

 আমার প্রপিতামহ বিপুল ঐশ্বর্ষ সঞ্চয় করিয়াছিলেন। ১৮০০ খৃষ্টাব্দে তিনি যে ভূসম্পত্তি ক্রয় করেন, তাহা তাঁহার ঐশ্বর্যের কিয়দংশ মাত্র। তাঁহার অবশিষ্ট ঐশ্বর্য কিরূপে হস্তচ্যুত হইল সে সম্বন্ধে নানা কাহিনী আছে। আমি যখন শিশু, তখন আমাদের পরিবারের বৃদ্ধা আত্মীয়াদের নিকট গল্প শুনিয়াছি যে, আমার প্রপিতামহ


  1. ‘দেওয়ান’ শব্দ ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হইত। রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর, নিমক চৌকীর দেওয়ান ছিলেন। মিঃ ডিগ্‌বী রাজা রামমোহন রায়ের “কেন উপনিষৎ ও বেদান্তসারের” ইংরাজী অনুবাদের ভূমিকায় লিখিয়াছেন, “তিনি (রামমোহন) পরে যে জেলায় রাজস্ব সংগ্রহের দেওয়ান বা প্রধান দেশীর কর্মচারী নিযুক্ত হইয়াছিলেন, সেই জেলায় আমি পাঁচ বৎসর (১৮০-১৪) ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সিভিল সার্ভিসে কালেক্‌টর ছিলাম।”— মিস্ কোলেট কৃত রাজা রামমোহন রায়ের জীবনী ও পত্রাবলী, ১৯০০, ১০-১১ পূঃ।
     “সেকালে সেট্‌ল্‌মেণ্টের কাজে বিশ্বস্ত দেশীর সেরেস্তাদারদিগকেই সাধারণতঃ কালেক্‌টরেরা প্রধান এজেণ্ট নিযুক্ত করিতেন এবং কালেক্‌টরেরা এই সব সেরেস্তাদারদের পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত ধারা বহুল পরিমাণে চালিত হইতেন।” শিবনাথ শাস্ত্রী প্রণীত ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাস, ১২ পৃঃ।
     ‘মডার্ণ রিভিউ’, ১৯৯০, মে, ৫৭২ পৃঃ, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।