পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
আত্মচরিত

ইংরাজী সাহিত্যেও তাঁহার বেশ দখল ছিল এবং আমার বাল্যকালে তাঁহার মুখ হইতেই আমি প্রথম ‘ইয়ং’এর ‘Night Thoughts’ এবং বেকনের ‘Novum Organum প্রভৃতি গ্রন্থের নাম শুনি। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ডাঃ রাজেন্দ্রলাল মিত্র সম্পাদিত ‘বিবিধার্থসংগ্রহ,’ ‘হিন্দু পত্রিকা,’ ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ এবং তাহার পূর্ববর্তী ‘অমৃত-প্রবাহিনী’ ও ‘সোমপ্রকাশের’ তিনি নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন। কেরী কৃত হোলী বাইবেলের অনুবাদ, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’ ও ‘রাজাবলী,’ লসনের ‘পশ্বাবলী’ (জীবজন্তুর কথা) এবং কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘এন্‌সাইক্লোপিডিয়া বেঙ্গলেনসিস’[১] তাঁহার লাইব্রেরীতে ছিল। সমসাময়িক যুগের তুলনায় আমার প্রপিতামহও বেশ শিক্ষিত লোক ছিলেন মনে হয়। ইহার একটি প্রমাণ, তিনি ‘সমাচার দর্পণের’ নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন। ‘সমাচার দর্পণ’ প্রথম বাঙ্গলা সংবাদপত্র, ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর হইতে মিশনারীগণ কর্তৃক প্রকাশিত হয়। আমার বাল্যকালে আমাদের লাইব্রেরীতে এই সংবাদপত্রের ফাইল আমি দেখিয়াছি। বিলাতে ঔপন্যাসিক ফিল্ডিং এর সময়ে গ্রামের ভদ্রলোকেরা যে ভাবে জীবন যাপন করিতেন, আমার পিতাও কতকটা সেইভাবে জীবন আরম্ভ করেন। স্কোয়ার অলওয়ার্দির সঙ্গে তাঁহার চরিত্রের সাদৃশ্য ছিল। তাঁহার অবস্থা সচ্ছল ছিল, সুতরাং নিজের রুচি অনুসারে চলিতে পারিতেন। কলিকাতার সঙ্গেই তাঁহার বেশী যোগ ছিল এবং তিনি ঐ সহরের শিক্ষিত ও সভ্য সমাজের সঙ্গে মিশিতেন। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, দিগম্বর মিত্র, কৃষ্ণদাস পাল, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রভৃতি তৎকালীন প্রধান প্রধান লোকদের সঙ্গে তাঁহার পরিচয় ছিল। গত শতাব্দীর মধ্যভাগে (১৮৬০ খৃষ্টাব্দের পূর্বে) আমার পিতা ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশনের সদস্য হইয়াছিলেন। তিনি সঙ্গীত ভাল বাসিতেন। এবং ওস্তাদের মত বেহালা বাজাইতে পারিতেন। সন্ধ্যাকালে তাঁহার বৈঠকখানায় সঙ্গীতের ‘জল্‌সা’ বসিত এবং পরবর্তী জীবনে স্বভাবতই তিনি সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর ও সঙ্গীতাচার্য ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীর প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিলেন। শেষোক্ত দুই জন বাঙ্গলা দেশে হিন্দু সঙ্গীতের পুনরভ্যুদয়ের জন্য অনেক কাজ করিয়াছেন। আমার পিতা পৈতৃক সম্পত্তি পরিচালনার ভার গ্রহণ করিয়া প্রথমেই ভদ্রাসন বাটীর সদর মহল ভাঙ্গিয়া নূতন করিয়া নির্মাণ করেন। স্থাপত্যশিল্পেও তাঁহার বেশ সৌন্দর্যবোধ ছিল। দিগম্বর মিত্র (পরে রাজা ও সি, এস, আই, উপাধিপ্রাপ্ত) আমাদের গ্রামের নিকটে সোলাদানা জমিদারী ক্রয় করেন। তিনি আমাদের বাড়ীতে দুই এক দিনের জন্য পিতার আতিথ্য গ্রহণ করেন। সুন্দরবনের সীমানার নিকটবর্তী একটি গ্রামে এমন বাড়ী ও সুসজ্জিত বৈঠকখানা দেখিয়া তিনি বিস্মিত ও আনন্দিত হইয়াছিলেন। কেননা, আমাদের বাড়ী ও বৈঠকখানা কলিকাতার যে কোন ধনীর বাড়ী ও বৈঠকখানার সঙ্গে তুলনীয় ছিল।

 আমি পূর্বেই বলিয়াছি, আমার পিতা ১৮৫০ খৃঃ অঃ অর্থাৎ আমার জন্মের এগার বৎসর পূর্বে নিজের জমিদারীতে স্থায়িভাবে বাস করিতে আরম্ভ করেন। তিনি “নব্য বাঙ্গলার” ভাবে অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন। সুতরাং, নিজের জেলায় শিক্ষা বিস্তারে তিনি একজন অগ্রণী ব্যক্তি ছিলেন। রাডুলিতে তিনিই বলিতে গেলে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ইহারই পার্শ্বে একটি মধ্য ইংরাজী বিদ্যালয়ও স্থাপিত হয়। ৭৫ বৎসর পূর্বে এ সব বিদ্যালয় বাংলার অধিকাংশ স্থানেই বিরল ছিল এবং গ্রামের গৌরবস্বরূপ বলিয়া গণ্য হইত। বর্তমানে এক খুলনা জেলাতেই ৪৫টা উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয় আছে, তা ছাড়া দুটি প্রথম শ্রেণীর কলেজ এবং বালিকাদের জন্য উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয়ও আছে।


  1. দ্বিভাষায় লিখিত পাঠ্যগ্রন্থ (১৮৪৩) লর্ড হার্ডিঞ্জের নামে উৎসর্গীকৃত।