পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
প্রথম পরিচ্ছেদ

 এই স্থলে গত ষাট বৎসরে বাঙ্গালা দেশে যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটিয়াছে, তাহার কিছু পরিচয় দেওয়া বাঞ্ছনীয়। এই ষাট বৎসরের স্মৃতি আমার মনে জ্বলন্ত আছে।

 আমার পিতার বার্ষিক ছয় হাজার টাকা আয়ের ভূ-সম্পত্তি ছিল। কিন্তু তাহার পূর্বে দুই পুরুষে আমাদের পরিবার যে সম্পত্তি ভোগ করিয়াছেন, এই আয় তাহার তুলনায় সামান্য, কেননা আমার প্রপিতামহ ও পিতামহ উভয়েই বড় চাকুরী করিতেন। আমার পিতা যে অতিরিক্ত সম্পত্তি লাভ করেন, তাহার দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায় যে, তাঁহার বিবাহের সময় আমার পিতামহ আমার মাতাকে প্রায় দশ হাজার টাকার অলঙ্কার যৌতুক দিয়াছিলেন। আমার পিতার যে সব রূপার বাসন ছিল, তাহার মূল্যও কয়েক হাজার টাকা। আমার মনে পড়ে, আমার বাল্যকালে কয়েকজন বিশিষ্ট অতিথিকে একই সময় রূপার থালা, বাটি ইত্যাদিতে খাদ্য পরিবেষণ করা হইয়াছিল। আমার মাতা মোগল বাদশাহের আমলের সোণার মোহর সগর্বে আমাকে দেখাইতেন। আমার মাতার সম্মতিক্রমে তাঁহার অলঙ্কারের কিয়দংশ বিক্রয় করিয়া অন্য লাভবান কারবারে লাগানো হয়। বস্তুতঃ, তাঁহার নামে একটি জমিদারীও ক্রয় করা হয়। আমার পিতা অর্থনীতির মূল সূত্রের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তিনি বলিতেন যে, অলঙ্কারে টাকা আবদ্ধ রাখা নির্বুদ্ধিতার পরিচয়; কেননা, তাহাতে কোন লাভ হয় না; তাঁহার হাতে যথেষ্ট নগদ অর্থ ও ছিল, সতরাং তিনি লগ্নী কারবার করেন এবং কয়েক বৎসর পর্যন্ত তাহাতে বেশ লাভ হইয়াছিল। ঐ সময়ে অল্প আয়ের লোকদের পক্ষে টাকা খাটাইবার কোন নিরাপদ উপায় ছিল না এবং চোর ডাকাতদের হাত হইতে চিরজীবনের সঞ্চিত অর্থ কিরূপে রক্ষা করা যায়, তাহা লোকের পক্ষে একটা বিষম উদ্বেগের বিষয় ছিল। এই কারণেই লোকে সঞ্চিত অর্থ ও অলঙ্কার মাটীর নীচে পুঁতিয়া রাখিত।

 সুতরাং যখন আমার পিতা নিজে একটি লোন আফিসের কারবার খুলিলেন, তখন গ্রামবাসীরা নিজেদের সঞ্চিত অর্থ উহাতে স্থায়ী সুদে সাগ্রহে জমা দিতে লাগিল। আমার পিতার সততার খ্যাতি ছিল। এইজন্যও লোকে বিনা দ্বিধায় তাঁহার লোন আফিসে টাকা রাখিতে লাগিল। এইরূপে আমার পিতার হাতে নগদ টাকা আসিয়া পড়িল। বহু বৎসর পরে এই ব্যবসায়ের জন্য আমার পিতা ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছিলেন। আমার পিতার মোট বার্ষিক আয় প্রায় দশ হাজার টাকা ছিল। এখনকার দিনে এই আয় সামান্য বোধ হইতে পারে, কিন্তু সেকালে ঐ আয়েই তিনি রাজার হালে বাস করিতেন। ইহার আরও কয়েকটি কারণ ছিল।

 আমাদের পৈতৃক ভদ্রাসনকে কেন্দ্র করিয়া যদি চার মাইল ব্যাস লইয়া একটি বৃত্ত অঙ্কিত করা যায়, তবে আমাদের অধিকাংশ ভূসম্পত্তি উহারই মধ্যে পড়ে। ইহা হইতেই সহজে বুঝা যাইবে, আমার পিতা অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরাজ স্কোয়ারদের মত বেশ সচ্ছলতা ও জাঁকজমকের সঙ্গে বাস করিতে পারিতেন; কারণ এই যে, তিনি তাঁহার নিজের প্রজাদের মধ্যেই রাজত্ব করিতেন। আমাদের সদর দরজায় মোটা বাঁশের যষ্টিধারী ছয়জন পাইক বরকন্দাজ থাকিত। আমার পিতা তাঁহার কাছারী বাড়ীতে সকাল ৮টা হইতে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত বসিতেন, ঐ কাছারী যেন গম্‌গম করিত। তাঁহার এক পার্শ্বে মুন্সী অন্য পার্শ্বে খাজাঞ্জী বসিত এবং নায়েব গোমস্তারা প্রজা ও খাতকদের নিকট হইতে খাজনা লইত বা লগ্নী কারবারের টাকা আদায় করিত।

 কাছারীতে রীতিমত মামলা মোকদ্দমার বিচারও হইত। এই বিচারপ্রণালী একটু রুক্ষ হইলেও, উভয় পক্ষের নিকট মোটামুটি সন্তোষজনক হইত। কেননা, বাদী বিবাদীদের