পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১২
আত্মচরিত

প্রথা ছিল। বাঁকুড়া জেলায় পূর্বে পানীয় জল এবং সেচনকার্যের জন্য বড় বড় জলাধার খনন করা হইত। এখন সে গুলির কিরূপ দুর্দশা হইয়াছে, তাহা আমি পরে দেখাইব। নিম্নবঙ্গেও যে ঐরূপ সুব্যবস্থা ছিল তাহার কথাই আমি এখন বলিব। প্রাতঃস্মরণীয় রাণী ভবানী তাঁহার বিস্তৃত জমিদারীতে অসংখ্য পুষ্করিণী খনন করান। ১৬শ ও ১৭শ শতাব্দীতে যে সমস্ত হিন্দু সামন্তরাজগণ মোগল প্রতাপ উপেক্ষা করিয়া বাঙ্গলা দেশে প্রাধান্য স্থাপন করেন, তাঁহারা বহু সুবৃহৎ (কতকগুলি বড় বড় হ্রদের মত) পুষ্করিণী খনন করান। ঐ গুলি এখনও আমাদের মনে প্রশংসার ভাব জাগ্রত করে। নিম্নবঙ্গে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে প্রথম উপনিবেশ স্থাপনকারী মুসলমান পীর ও গাজীগণ এ বিষয়ে পশ্চাৎপদ ছিলেন না। প্রধানতঃ, এই কারণেই হিন্দুদের মনে তাঁহাদের স্মৃতি অক্ষয় হইয়া আছে। তাহারা কেবল যে ঐ সব পীর ও গাজীর দরগায় ‘সিন্নি’ দেয়, তাহা নহে, তাহাদের নামে বার্ষিক মেলাও বসায়।

 রাজা সীতারাম রায়ের পুষ্করিণী সম্বন্ধে ওয়েষ্টল্যাণ্ড বলেন,—“১৭০ বৎসর পরেও উহাই জেলার মধ্যে সর্ববৃহৎ জলাধার। ইহার আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৪৫০ গজ হইতে ৫০০ গজ এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৫০ গজ হইতে ২০০ গজ। ইহাতে কোন সময়েই ১৮ ফিট হইতে ২০ ফিটের কম গভীর জল থাকে না। সীতারামের ইহাই সর্বপ্রধান কীর্তি এবং তিনি একমাত্র ইহার সঙ্গেই নিজের নাম—“রাম” যোগ করিয়াছিলেন।”—ওয়েষ্টল্যাণ্ড, “যশোহর”, ২৯ পঃ।[১]

 প্রাচীন জমিদারদের প্রাসাদোপম বড় বড় বাড়ী নির্মাণ করিতে নিপুণ রাজমিস্ত্রী ও স্থপতিদের অন্নসংস্থান হইত, স্থাপত্যশিল্পেরও উন্নতি হইত। কিন্তু বড় বড় অভিজাত বংশের লোপ এবং প্রধানতঃ তাহাদের বংশধরদের গ্রাম ত্যাগের ফলে ঐ সমস্ত শিল্পীরা লুপ্তপ্রায় হইয়াছে। অধিকাংশ প্রাচীন জমিদারদের সভায় সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ থাকিতেন, ইঁহারাও লোপ পাইতেছেন। পরাতন পুষ্করিণীগুলি প্রায় ভরাট হইয়া গিয়াছে এবং ঐ স্থান ধান্যক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছে। বৎসরের মধ্যে ৬ মাস হইতে ৮ মাস পর্যন্ত গ্রামে জলাভাবে অতি সাধারণ এবং কর্দমপূর্ণ ডোবার দ্বারা যে পানীয় জল সরবরাহ হয়, তাহা “গলিত জঞ্জাল” অপেক্ষা কোন অংশে ভাল নহে। এই সব স্থানে প্রতি বৎসর কলেরা ম্যালেরিয়াতে বহুলোকের মৃত্যু হয়। ঘন জঙ্গল ও ঝোপ ঝাড়ের দ্বারা রুদ্ধ-আলোক


  1. বেভারেজ তাঁহার “বাখরগঞ্জ” গ্রন্থে এইরূপ বড় বড় পুষ্করিণীর বিবরণ দিয়াছেন:—“এই পুষ্করিণী খনন করিতে নয় লক্ষ টাকা ব্যয় হইয়াছিল। এই পুষ্করিণীতে এখন জল নাই। কিন্তু কমলার মহৎকার্য ব্যর্থ হয় নাই। এই পুষ্করিণীর শুষ্ক তলদেশে এখন প্রচুর ধান হয় এবং ইহার চারিদিকের বাঁধের উপর তেঁতুল ও অন্যান্য ফলবৃক্ষপূর্ণ, বাঁশঝাড় ঘেরা ৪০। ৪৫টি কৃষকের গৃহ দেখা যায়। চারিদিকের জলাজমি হইতে ঊর্ধ্বে অবস্থিত এই সব বাড়ী দেখিতে মনোহর। একজন বিলুপ্ত স্মৃতি বাঙ্গালী রাজকুমারীর মহৎ অন্তকরণের দানেই আজ তাহাদের এই সুখ-ঐশ্বর্য!” কর্ণাট অঞ্চলে জমিদারদের খনিত পুষ্করিণী সমূহের উল্লেখ করিয়া বার্কও উচ্চ প্রশংসা করিয়াছেন। —“বাখরগঞ্জ”, ৭৫—৭৬ পৃঃ।