পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩০
আত্মচরিত

শ্রেষ্ঠ জীব মনে করে এবং গ্রাম্য বালকদের কথাবার্তা, ভাবভঙ্গী, আচার ব্যবহার লইয়া তাহারা নানারূপ শ্লেষ বিদ্রুপ বর্ষণ করে। তাহারা গ্রামের লোকদের প্রতি সহানুভূতিও বোধ করে না। জনৈক ইংরাজ কবি তাঁহার সময়ে গ্রাম্য জীবনের প্রতি সহুরে লোকদের এইরূপ অবজ্ঞার ভাব লক্ষ্য করিয়া, ক্ষুব্ধচিত্তে লিখিয়াছিলেন—

Let not Ambition mock their useful toil,
Their homely joys, and destiny obscure;
Nor Grandeur hear with a disdainful smile
The short and simple annals of the poor.

 বর্তমানে, যাহারা চিরজীবন সহরে বাস করিয়া আসিয়াছে, তাহাদের মুখে “গ্রামে ফিরিয়া যাও” এই ধূয়া শুনিতে পাই। কিন্তু তাহাদের মুখে এসব তোতাপাখীর বুলি, কেননা তাহাদিগকে যদি ২৪ ঘণ্টার জন্যও সরল অনাড়ম্বর গ্রাম্যজীবন যাপন করিতে হয়, তবে তাহারা দিশাহারা হইয়া পড়ে। কৃষক ও জনসাধারণের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সংসর্গের জন্যই আমি ১৯২১ ও ১৯২২ সালে দুর্ভিক্ষ ও বন্যাপীড়িতদিগের সেবায় আত্মনিয়োগ করিতে পারিয়াছিলাম।[১]

 আমি বৎসরে দুইবার গ্রামে যাইতাম—শীতে ও গ্রীষ্মের অবকাশে। ইহার ফলে আমার মন সহরের অনিষ্টকর প্রভাব হইতে অনেকটা মুক্ত হইত। আমার এই বৃদ্ধবয়সেও, শৈশবস্মৃতি জড়িত গ্রামে গেলে আমি যেমন সুখী হই এমন আর কিছুতেই হই না।

 আমার পিতার বৈঠকখানায় যাঁহারা আসিতেন, তাঁহাদের সঙ্গ আমি স্বভাবতঃ এড়াইয়া চলিতাম। কিন্তু সরল গ্রাম্যলোকদের সঙ্গে আমি খুব প্রাণ খুলিয়া মিশিতাম। আমি অনেক সময়ে তাহাদের পর্ণকুটীরে যাইতাম, সেকালে গ্রামে মুদীর দোকান খুব কমই ছিল; সাগু, এরারুট, মিছরী প্রভৃতি রোগীর প্রয়োজনীয় পথ্য গ্রামে অর্থব্যয় করিয়াও পাওয়া যাইত না। আমি রুগ্ন গ্রামবাসীদের মধ্যে এই সকল জিনিষ বিতরণ করিতে ভালবাসিতাম। মাতার ভাণ্ডার হইতেই আমি এই সব দ্রব্য গ্রহণ করিতাম, এবং আমার মাতাও সানন্দে এবিষয়ে আমাকে সাহায্য করিতেন।

 ১৮৭৬ সালের জানুয়ারী মাসের প্রথমভাগে আমি কলিকাতায় ফিরিলাম। অ্যালবার্ট স্কুলের কর্তৃপক্ষের নিকট, যতদূর পর্যন্ত আমি পড়িয়াছি, তাহার জন্য সার্টিফিকেট চাহিলাম। উদ্দেশ্য হেয়ার স্কুলে অনরূপ শ্রেণীতে ভর্তি হইব। কিন্তু কালীপ্রসন্ন ভট্টাচার্য[২] প্রমুখ আমার শিক্ষকেরা সকলে মিলিয়া আমাকে এই কার্য হইতে নিবৃত্ত করিতে চেষ্টা করিলেন। কৃষ্ণবিহারী সেন মহাশয়েরও শীঘ্রই জয়পুর হইতে ফিরিবার কথা ছিল। সুতরাং আমি মত পরিবর্তন করিলাম। আমার জীবনে এই আর একটী শুভ ঘটনা। হেয়ার স্কুলে শিক্ষকদের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ অনেকটা কৃত্রিম ছিল। ক্লাসের


  1. তথাকথিত অবনত সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে অনেকে জেলা সম্মিলনীর জন্য সামান্য চাঁদা দিয়া থাকে। ইহারা প্রায়ই অভিযোগ করে যে, “বাবুরা কেবল টাকার দরকার পড়িলে আমাদের কাছে আসেন কিন্তু তাঁহারা আমাদের স্বার্থ দেখেন না বা আমাদের সঙ্গে সমানভাবে মিশেন না।” দুর্ভোগ্যক্রমে তাহাদের এই অভিযোগ সত্য। জাতিগত শ্রেষ্ঠতা হইতে যে অহঙ্কারপূর্ণ দূরত্বের ভাব জন্মে তাহাই শিক্ষিত ভদ্রলোক ও জনসাধারণের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করিয়াছে। এই বিষয়ে চীনাছাত্রদের আচরণ আমাদের অনুকরণীয়।
  2. সংস্কৃতের অধ্যাপক, অল্পদিন পূর্বে ইঁহার মৃত্যু হইয়াছে।