পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩২
আত্মচরিত

পত্র, দৈনিক পত্র প্রভৃতি রক্ষিত হইত। আমি ক্লাস বসিবার এক ঘণ্টা পূর্বে রিডিং রুমে যাইয়া ঐসব সাময়িক পত্র প্রভৃতি যতদূর পারি পড়িতাম।

 এই সময় রুশ-তুর্ক যুদ্ধ বাধিয়াছিল। ওসমান পাশা প্লেভ্‌না এবং আহম্মদ মুক্তার পাশা কার্‌স কিভাবে শত্রুহস্ত হইতে রক্ষা করিতেছিলেন জগৎবাসী, বিশেষতঃ, এসিয়াবাসীরা তাহা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করিতেছিল। দিনের পর দিন সংবাদপত্র পাঠ করিয়া আমি যুদ্ধের গতি প্রকৃতি অনুধাবন করিতাম। বলা বাহুল্য আমার সহানুভূতি সম্পর্ণরূপে তুর্কদের প্রতিই ছিল, কেননা তাহারাই একমাত্র এসিয়াবাসী জাতি—যাহারা ইউরোপের উপর তখনও প্রাধান্য বিস্তার করিয়াছিল। মনে পড়ে, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সঙ্গে যুদ্ধের নৈতিক আদর্শ লইয়া আমার তুমুল তর্কবিতর্ক হইত। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা প্ল্যাডষ্টোনের বাক্যের দ্বারা প্রভাবান্বিত হইয়াছিলেন এবং প্ল্যাডষ্টোনের অনুকরণ করিয়া বলিতেন—তুর্কীরা “অপাংক্তেয়” এবং তাহাদিগকে মালপত্র সমেত ইউরোপ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দেওয়া উচিত।

 কৃষ্ণবিহারীর শিক্ষকতায় ইংরেজী সাহিত্যের প্রতি আমার অনুরাগ বৃদ্ধি পাইল। যাহারা কতকগুলি পদের প্রতিশব্দ দিয়া এবং কতকগুলি শব্দের ব্যাখ্যা করিয়াই কর্তব্য শেষ করে, কৃষ্ণবিহারী সেই শ্রেণীর সাধারণ শিক্ষক ছিলেন না। তাঁহার শিক্ষাদানের প্রণালী সম্পর্ণ স্বতন্ত্র ছিল। তিনি যে বিষয়ে পড়াইতেন তৎসম্বন্ধে নানা নূতন তথ্য সংগ্রহ করিয়া বিষয়টি চিত্তাকর্ষক করিয়া তুলিতেন। একদিন পড়াইতে পড়াইতে তিনি বলিলেন যে বায়রণ স্কটকে Apollo's venal son এই আখ্যা দিয়াছেন। এই কথা শুনিয়া আমার কবি বায়রণ সম্বন্ধে জানিতে ইচ্ছা হইল। বায়রণ গ্রীকদিগকে তুরস্কের বন্ধনশৃঙ্খল ছিন্ন করিবার জন্য যে উদ্দীপনাময়ী বাণী শুনাইয়াছিলেন আমি ইতিপূর্বেই তাহা কণ্ঠস্থ করিয়াছিলাম। স্কটের Ivanhoe উপন্যাসে যে পরিচ্ছেদে লড়াই দ্বারা বিচার মীমাংসা করিবার বর্ণনা আছে, তাহাও আমি পড়িয়াছিলাম। আমি এখন আমাদের লাইব্রেরী হইতে বায়রণ ও স্কটের অন্যান্য কাব্য গ্রন্থাবলী খুঁজিয়া পড়িতে আরম্ভ করিলাম। বাল্যবয়সের আমার এই প্রয়াস যদিও বামন কর্তৃক দৈত্যের অস্ত্রসম্ভার হরণের মতই বোধ হইতে পারে বটে, কিন্তু আমি “English Bards and Scotch Reviewers” নামক রচনায় বায়রণ এডিনবার্গের সাহিত্য সমালোচকদের প্রতি যে তাঁর শ্লেষ বর্ষণ করিয়াছিলেন, তাহা পড়িয়া বেশ আনন্দ উপভোগ করিলাম।

 আমি আমার জীবনের এই অংশের কথা বিস্তৃতভাবেই বর্ণনা করিলাম, কেননা দুই এক বৎসরের পরেই এমন সময় উপস্থিত হইল, যখন আমাকে সাহিত্য ও বিজ্ঞান এই দুইটির মধ্যে একটিকে বাছিয়া লইতে হইল। আমি সাহিত্যের মায়া ত্যাগ করিয়া বিজ্ঞানেরই আনুগত্য স্বীকার করিলাম এবং বিজ্ঞান নিঃসংশয় একনিষ্ঠ সেবককেই চাহিল।

 আমি প্রবেশিকা পরীক্ষা দিলাম। আমার শিক্ষকদের আমার সম্বন্ধে খুব উচ্চ আশা ছিল। তাঁহারা আমার পরীক্ষার ফল দেখিয়া একটু নিরাশ হইলেন। কেননা আমার নাম বৃত্তিপ্রাপ্তদের তালিকার মধ্যে ছিল না। আমি নিজে এই বিষয় শান্তভাবেই গ্রহণ করিলাম। যাহারা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতিষ্করূপে মুহূর্তকাল উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়া পরমুহূর্তেই নিবিয়া যায়, যাহারা আজ খুবে যশের অধিকারী, কিন্তু কালই বিস্মৃতির গর্ভে বিলীন হইবে, সেরূপ ছেলেদের কথা মনে করিয়া আমি বরাবরই মনে মনে হাসি।

 বিদ্যালয়ের পরীক্ষা দ্বারা প্রকৃত মেধা বা প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় কিনা, এ বিষয় লইয়া অনেক লেখা যাইতে পারে। শিক্ষকের কার্যে আমার ৪৫ বৎসর ব্যাপী অভিজ্ঞতায়,