পাতা:আত্মপরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দেবতার প্রত্যক্ষ দান, সে আমি আকাশে বাতাসে, বনের ছায়ায়, গঙ্গার কলস্রোতে পেয়েছি। আজ এসেছি জনসভায় কবিত্ব নিয়ে নয়, কর্মের ভার নিয়ে― এর যোগ্য দান আজ আমি মানুষের কাছে দাবি করতে পারি। যেদিন সেই ছাতের উপর খোলা আকাশের নীচে মনের স্বপ্নকে ছন্দের গাঁথনিতে একলা বসে রূপ দিয়েছি, সেদিন ছিলেম সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিখেলার সহযোগী। তিনি আমার মনের আনন্দ জুগিয়েছিলেন। আজ আমি কর্মীরূপে কর্ম ফেঁদে বসেছি। এ কর্ম মানুষের কর্ম, মানুষকে তাই সহযোগিতার জন্যে ডাক দেব। আজ আমাকে আপনারা যে সম্মান দিতে এসেছেন সে যদি সেই সহযোগিতার আহ্বানে সাড়া হয় তবে জানব কর্মের ক্ষেত্রে সার্থক হয়েছি। তা যদি না হয়, এর সঙ্গে যদি সহযোগিতা না থাকে তবে এই সম্মানের ভার দুর্বিষহ। বহুদূর থেকে নারদের পুষ্পমাল্য ইন্দুমতীকে সাংঘাতিক আঘাত করেছিল― বস্তুত সে মালারই ভার নয়, সে দূরত্বের ভার। দূরে থেকে যে সম্মান, সে সম্মানের ভার বহন করে সংসারে মুক্তচিত্তে বিচরণ করতে ক’জন পারে? মানুষ সকলের চেয়ে সুখে থাকে যখন সে আপনাকে ভোলে; যখন খ্যাতির ধাক্কায় ধাক্কায় তার নিজের দিকে তার নিজেকে কেবলই জাগিয়ে রাখে, তখন আত্মার যে নিভৃতে তার গভীরতম কৃতার্থতা সেখানে যাবার পথ অবরুদ্ধ হয়।

 বালককালে বাঁশির উপরে দখল ছিল না; বাজিয়েছিলেম যেমন-তেমন করে, পথে লোক জড়ো হয় নি। তার পরে যৌবনে বাঁশিতে সুর লাগল বলে যখন নিজের মনে সন্দেহ রইল না, তখন সকলকে নিঃসংকোচে বলেছি ‘তোমরা শোনো।’ তেমনি কর্মের আরম্ভে একদিন কর্মকে সম্পূর্ণ চিনি নি। কোন্ রূপের আদর্শে তার প্রতিষ্ঠা হবে সেদিন জানতেম না— সেদিন পথের লোকে উপেক্ষা করে চলে গেছে, আমিও বাইরের লোককে ডাক দিই নি। শেষে কর্ম যখন আপন প্রাণশক্তিতে মূর্তিপরিগ্রহ করলে

১১৮