পাতা:আত্মশক্তি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬০
আত্মশক্তি।

 বস্তুত ভিন্ন পথ দিয়া ভিন্ন জাতি ভিন্ন শ্রেণীর উৎকর্ষ লাভ করে—এবং সমগ্র মানুষের সর্ব্বাঙ্গীণ উন্নতিলাভের এই একমাত্র উপায়। য়ুরোপ কতকগুলি প্রাকৃতিক সুবিধাবশত যে বিশেষ প্রকারের উন্নতির অধিকারী হইয়াছে, আমরা যদি ঠিক সেই প্রকার উন্নতির জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠি, তবে নিজেকে ব্যর্থ ও বিশ্বমানবকে বঞ্চিত করিব। কারণ, আমাদের দেশের বিশেষ প্রকৃতি অনুসারে আমরা মনুষ্যত্বের যে উৎকর্ষ লাভ করিতে পারি, পরের বৃথা অনুকরণচেষ্টায় তাহাকে নষ্ট করিলে এমন একটা জিনিষকে নষ্ট করা হয়, যাহা মানুষ অন্য কোনো স্থান হইতে পাইতে পারে না। সুতরাং বিশ্বমানব সেই অংশে দরিদ্র হয়। চাষের জমিকে খনির মত ব্যবহার করিলে ও খনিজের জমিকে কৃষিক্ষেত্রের কাজে লাগাইলে মানবসভ্যতাকে ফাঁকি দেওয়া হয়।

 যে কারণেই হউক্, য়ুরোপের সঙ্গে ভারতবর্ষের কতকগুলি গুরুতর প্রভেদ আছে। উৎকট অনুকরণের দ্বারা সেই প্রভেদকে দূর করিয়া দেওয়া যে কেবল অসম্ভব, তাহা নহে, দিলে তাহাতে বিশ্বমানবের ক্ষতি হইবে।

 আমরা যখন বিদেশের ইতিহাস পড়ি বা বিদেশের প্রতাপকে প্রত্যক্ষচক্ষে দেখি, তখন নিজেদের প্রতি ধিক্কার জন্মে—তখন বিদেশীর সঙ্গে আমাদের যে যে বিষয়ে পার্থক্য দেখিতে পাই, সমস্তই আমাদের অনর্থের হেতু বলিয়া মনে হয়। কোনো অধ্যাপকের অর্ব্বাচীন বালকপুত্র যখন সার্কাস্ দেখিতে যায়, তাহার মনে হইতে পারে যে, এম্‌নি করিয়া ঘোড়ার পিঠের উপরে দাঁড়াইয়া লাফালাফি করিতে যদি শিখি এবং দর্শকদলের বাহাবা পাই, তবেই জীবন সার্থক হয়। তাহার পিতার শান্তিময় কাজ তাহার কাছে অত্যন্ত নির্জ্জীব ও নিরর্থক বলিয়া মনে হয়।

 বিশেষ স্থলে পিতাকে ধিক্কার দিবার কারণ থাকিতেও পারে।