পাতা:আত্মশক্তি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬৪
আত্মশক্তি।

মহত্ত্ব একজাতীয় নহে—গ্রীস্ বিদ্যা ও বিজ্ঞানে বড়, রোম কর্ম্মে ও বিধিতে বড়। রোম তাহার বিজয়পতাকা লইয়া যখন গ্রীসের সংস্রবে আসিল, তখন বাহুবলে ও কর্ম্মবিধিতে জয়ী হইয়াও বিদ্যাবুদ্ধিতে গ্রীসের কাছে হার মানিল, গ্রীসের কলা-বিদ্যা ও সাহিত্যবিজ্ঞানের অনুকরণে প্রবৃত্ত হইল, কিন্তু তবু সে রোমই রহিল, গ্রীস্ হইল না— সে আত্মপ্রকৃতিতেই সফল হইল, অনুকৃতিতে নহে—সে লোকসংস্থানকার্য্যে জগতের আদর্শ হইল, সাহিত্যবিজ্ঞান-কলাবিদ্যায় হইল না।

 ইহা হইতে বুঝিতে হইবে, উৎকর্ষের একমাত্র আকার ও একমাত্র উপায় জগতে নাই। আজ য়ুরোপীয় প্রতাপের যে আদর্শ আমাদের চক্ষের সমক্ষে অভ্রভেদী হইয়া উঠিয়াছে, উন্নতি তাহা ছাড়াও সম্পূর্ণ অন্যআকারের হইতে পারে—আমাদের ভারতীয় উৎকর্ষের যে আদর্শ আমরা দেখিয়াছি, তাহার মধ্যে প্রাণসঞ্চার, বলসঞ্চার করিলে জগতের মধ্যে আমাদিগকে লজ্জিত থাকিতে হইবে না। একদিন ভারতবর্ষ জ্ঞানের দ্বারা, ধর্ম্মের দ্বারা চীন-জাপান, ব্রহ্মদেশ-শ্যামদেশ, তিব্বত-মঙ্গোলিয়া,—এসিয়া মহাদেশের অধিকাংশই জয় করিয়াছিল; আজ য়ুরোপ অস্ত্রের দ্বারা, বাণিজ্য দ্বারা পৃথিবী জয় করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে—আমরা ইস্কুলে পড়িয়া এই আধুনিক য়ুরোপের প্রণালীকেই যেন একমাত্র গৌরবের কারণ বলিয়া মনে না করি।

 কিন্তু ইংরেজের বাহুবল নহে, ইংরেজের ইস্কুল ঘরে-বাহিরে, দেহে-মনে, আচারে-বিচারে সর্ব্বত্র আমাদিগকে আক্রমণ করিয়াছে। আমাদিগকে যে সকল বিজাতীয় সংস্কারের দ্বারা আচ্ছন্ন করিতেছে, তাহাতে অন্তত কিছুকালের জন্যও আমাদের আত্মপরিচরের পথ লোপ করিতেছে। সে আত্মপরিচয় ব্যতীত আমাদের কখনই আত্মোন্নতি হইতে পারে না।