পাতা:আধুনিক সাহিত্য-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মন্দ্র
১২৯

নৃত্য করিতেছে, কেহ স্থির হইয়া নাই; ভাবের অভাবনীয় আবর্তনে তাহার ছন্দ ঝংকৃত হইয়া উঠিতেছে এবং তাহার অলংকারগুলি হইতে আলোক ঠিকরিয়া পড়িতেছে।

 কিন্তু নর্তনশীল নটীর সঙ্গে তুলনা করিলে মন্দ্রকাব্যের কবিতাগুলির ঠিক বর্ণনা হয় না। কারণ, ইহার কবিতাগুলির মধ্যে পৌরুষ আছে। ইহার হাস্য বিষাদ বিদ্রুপ বিস্ময় সমস্তই পুরুষের, তাহাতে চেষ্টাহীন সৌন্দর্যের সঙ্গে একটা স্বাভাবিক সবলতা আছে। তাহাতে হাবভাব ও সাজসজ্জার প্রতি কোনো নজর নাই। বরং উপমা দিতে হইলে শ্রাবণের পূর্ণিমারাত্রির কথা পাড়া যাইতে পারে। আলোক এবং অন্ধকার, গতি এবং স্তব্ধতা, মাধুর্য ও বিরাটভাব আকাশ জুড়িয়া অনায়াসে মিলিত হইয়াছে। আবার মাঝে মাঝে এক-এক পশলা বৃষ্টিও বাতাসকে আর্দ্র করিয়া ঝরঝর শব্দে ঝরিয়া পড়ে। মেঘেরও বিচিত্র ভঙ্গি—তাহা কখনো চাঁদকে অর্ধেক ঢাকিতেছে, কখনো পুরা ঢাকিতেছে, কখনো বা হঠাৎ একেবারে মুক্ত করিয়া দিতেছে, কখনো বা ঘোরঘটায় বিদ্যুতে স্ফুরিত ও গর্জনে স্তনিত হইয়া উঠিতেছে।

 দ্বিজেন্দ্রলালবাবু বাংলাভাষার একটা নূতন শক্তি আবিষ্কার করিয়াছেন। প্রতিভাসম্পন্ন লেখকের সেই কাজ। ভাষাবিশেষের মধ্যে যে কতটা ক্ষমতা আছে তাহা তাঁহারাই দেখাইয়া দেন; পূর্বে যাহার অস্তিত্ব কেহ সন্দেহ করে নাই তাহাই তাহারা প্রমাণ করিয়া দেন; দ্বিজেন্দ্রলালবাবু বাংলা কাব্যভাষায় একটি বিশেষ শক্তি দেখাইয়া দিলেন। তাহা ইহার গতিশক্তি। ইহা যে কেমন দ্রুতবেগে, কেমন অনায়াসে তরল হইতে গম্ভীর ভাষায়, ভাব হইতে ভাবান্তরে চলিতে পারে—ইহার গতি যে কেবলমাত্র মৃদুমন্থর আবেশভারাক্রান্ত নহে—তাহা কবি দেখাইয়াছেন।