পাতা:আধুনিক সাহিত্য-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৪৯

উইকিসংকলন থেকে
পরিভ্রমণে চলুন অনুসন্ধানে চলুন
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সাকার ও নিরাকার

দ্বার বন্ধ করিয়া আকাশ দেখার সাধ মিটাইতে পারি না। আমি যতদূর পর্যন্ত দেখিতে পাই তাহা না দেখিয়া আমার তৃপ্তি হয় না।

 এই-যে প্রয়াস বস্তুত ইহাই উপাসনা। আমার শেষ পর্যন্ত গিয়াও যখন তাহার শেষ পাই না—আমার মন যখন একাকী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে যাত্রা করিয়া বাহির হয়, যখন অগণ্য গ্রহ চন্দ্র তারকা অনন্ত জটিল জ্যোতিররণ্য-মধ্যে সে হারাইয়া যায় এবং প্রভাতকরপ্লাবিত নীলাকাশের মহোচ্চ দেশে বিলীনপ্রায় বিহঙ্গমের মতো উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে গাহিয়া উঠে, ‘তুমি ভুমা, আমি তোমার শেষ পাইলাম না’, তখন তাহাতেই সে কৃতার্থ হয়। সেই অন্ত না পাইয়াই তাহার সুখ। ভূমৈব সুখং, নাল্পে সুখমস্তি।

 টলেমির জগৎতন্ত্র আমাদের ধারণাযোগ্য। পৃথিবীকে মধ্যে রাখিয়া বদ্ধ কঠিন আকাশে জ্যোতিষ্কগণ সংকীর্ণ নিয়মে ঘুরিতেছে, ইহা ঠিক মনুষ্যমনের আয়ত্তগম্য। কিন্তু অধুনা জ্যোতির্বিদ্যার বন্ধনমুক্তি হইয়াছে, সে সীমাবদ্ধ ধারণার বাহিরে অনন্ত রহস্যের মধ্যে গিয়া পড়িয়াছে বলিয়া তাহার গৌরব বাড়িয়াছে। জগৎটা যে পৃথিবীর প্রাঙ্গণমাত্র নহে, পৃথিবী যে বিশ্বজগতে ধূলিকণার অধম, এই সংবাদেই আমাদের কল্পনা প্রসারিত হইয়া যায়।

 আমাদের উপাস্য দেবতাকেও যখন কেবলমাত্র মনুষ্যের গৃহপ্রাঙ্গণের মধ্যে বদ্ধ করিয়া না দেখি, তাহাকে আমাদের ধারণার অতীত বলিয়া জানি, যখন ঋষিদের মুখে শুনি—

যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ
আনন্দং ব্রহ্মণণা বিদ্বান্ ন বিভেতি কুতশ্চন

অর্থাৎ, মনের সহিত বাক্য যাহাকে না পাইয়া ফিরিয়া আসে সেই আনন্দকে, সেই ব্রহ্মকে, যিনি জানেন তিনি কাহা হইতেও ভয় পান না—তখনই আমাদের বদ্ধ হৃদয় মুক্তির আশ্বাস লাভ করিতে থাকে।