পাতা:আধুনিক সাহিত্য-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৬
আধুনিক সাহিত্য

পথ জানে নাই। কৌতুহল এবং অনভিজ্ঞতায় সে একবার ঈষৎ অগ্রসর হয়, আবার জড়সড় অঞ্চলটির অন্তরালে আপনার নিভৃত কোমল কুলায়ের মধ্যে ফিরিয়া আশ্রয় গ্রহণ করে।

 এখন প্রেমে বেদনা অপেক্ষা বিলাস বেশি। ইহাতে গভীরতার অটল স্থৈর্য নাই, কেবল নবানুরাগের উদভ্রান্ত লীলাচাঞ্চল্য। বিদ্যাপতির এই পদগুলি পড়িতে পড়িতে একটি সমীচঞ্চল সমুদ্রের উপরিভাগ চক্ষে পড়ে। ঢেউ খেলিতেছে, ফেন উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতেছে, মেঘের ছায়া পড়িতেছে, সূর্যের আলোক শত শত অংশে তিস্ফুরিত হইয়া চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত হইতেছে; তরঙ্গে তরঙ্গে স্পর্শ এবং পলায়ন, কলরব, কলহাস্য, করতালি, কেবল নৃত্য এবং গীত, আভাস এবং আন্দোলন, আলোক এবং বর্ণবৈচিত্র্য। এই নবীন চঞ্চল প্রেমহিল্লোলের উপর সৌন্দর্য যে কত ছন্দে কত ভঙ্গিতে বিচ্ছুরিত হইয়া উঠে বিদ্যাপতির গানে তাহাই প্রকাশ পাইয়াছে। কিন্তু সমুদ্রের অন্তর্দেশে যে গভীরতা, নিস্তব্ধতা, যে বিশ্ববিস্মৃত ধ্যানলীনতা আছে তাহা বিদ্যাপতির গীতিতরঙ্গের মধ্যে পাওয়া যায় না।

 কদাচ কখনো দেখা হয়, যমুনার জলে অথবা স্নান করিয়া ফিরিবার সময়। কিন্তু ভালো করিয়া দেখা হয় না। একে অল্পক্ষণের দেখা, তাহাতে অধৈর্যচঞ্চল দোদুল্যমান হৃদয়ে সৌন্দর্যের যে প্রতিবিম্ব পড়ে তাহা ভাঙিয়া ভাঙিয়া যায়। মনকে শান্ত করিয়া ধৈর্য ধরিয়া দেখিবার অবসর পাওয়া যায় না। যেটুকু দেখা গেল সে কেবল—

‘আধ আঁচর খসি  আধ বদনে হসি
আধ হি নয়ানতরঙ্গ।’

কিন্তু ‘ভালো করি পেখন না ভেল’।

 তাহার পর কত আসা-যাওয়া, কত বলা-কওয়া, কত ছলে কত ভাবপ্রকাশ, কত ভয় কত ভাবনা—অবশেষে একদিন মধুর বসন্তে