৵৹
কাল্পনিক চরিত্র থাকিবে; কথাবার্তাগুলি প্রায়শঃ তাঁহার নিজের রচিত, কিন্তু বর্ণিত ঘটনা এবং বিষয়-পরিকল্পনা (প্লট) একেবারে নিছক সত্য, ইতিহাস হইতে তোলা।
তাঁহার এই সঙ্কীর্ণ সংজ্ঞায় ‘রাজসিংহ’ ভিন্ন ঐ অপর ছয়টি গ্রন্থ ঐতিহাসিক উপন্যাস হইতে পারে না। তবে, তিনি এগুলি লিখিলেন কেন? তাঁহার গার্হস্থ্য উপন্যাসগুলিই তো তাঁহার অতুলনীয় প্রতিভা, প্লট গাঁথিবার, চরিত্র সৃষ্টির, কথোপকথন রচিবার শক্তি প্রমাণ করিয়াছিল। সেই শ্রেণীর আরও নভেল লিখিয়া গেলে তাঁহার যশের কিছুমাত্র হ্রাস হইত না। তাঁহার মস্তিষ্ক তো জীবনের শেষ দিন পর্য্যন্ত অটুট তেজ দেখাইয়া গিয়াছিল।
এই প্রশ্নের উত্তর তাঁহার নিকট হইতেই পাইয়াছি। বঙ্কিম মর্ম্মে মর্ম্মে, শরীরের সূক্ষ্মতম স্নায়ুতে পর্য্যন্ত, স্বদেশ-প্রেমী স্বজাতি-ভক্ত। 'বঙ্গদর্শনে’র সর্ব্বপ্রথম সংখ্যায় নবীন বঙ্কিম, ‘প্রচারে’র সর্ব্বপ্রথম সংখ্যায় প্রবীণ বঙ্কিম, সেই একই কথা বলিতেছেন:— “অহঙ্কার অনেক স্থলে মনুষ্যের উপকারী।... জাতীয় গর্ব্বের কারণ লৌকিক ইতিহাসের সৃষ্টি বা উন্নতি। ইতিহাস-বিহীন জাতির দুঃখ অসীম।... বাঙ্গালীর ইতিহাস চাই। নহিলে বাঙ্গালী কখন মানুষ হইবে না। যাহার মনে থাকে যে, এ বংশ হইতে কখন মানুষের কাজ হয় নাই, তাহা হইতে কখন মানুষের কাজ হয় না।” “যে বলে যে,... বাঙ্গালী চিরকাল দুর্ব্বল, চিরকাল ভীরু, স্ত্রীস্বভাব,... তাহার কথা মিথ্যা।... বাঙ্গালী যে পূর্ব্বকালে বাহুবলশালী, তেজস্বী, বিজয়ী ছিল, তাহার অনেক ঐতিহাসিক প্রমাণ পাই। অধিক নয়, আমরা এক শত বৎসর পূর্ব্বের বাঙ্গালী পহলয়ানের, বাঙ্গালী লাঠি শড়কওয়ালার... বলবীর্য্যের কথা বিশ্বস্তসূত্রে শুনিয়াছি।”
পরদেশের নানা উৎকৃষ্ট ইতিহাস পড়িয়া যেমন তাঁহার মনের বিকাশ ও উপরতা জম্মিল, তেমনি দুঃখ হইল যে, “হায়! ভারতের অতীত কাহিনী তো এমন সুন্দর এমন বিপুল করিয়া লেখা হয় নাই; বিশেষতঃ আমাদের নিজস্ব বঙ্গজননীর ইতিহাস নাই বলিলেই হয়, আর যাহা ইতিহাস বলিয়া চলিতেছে তাহা লজ্জা ও হীনতার কারণ মাত্র।” ‘আনন্দমঠে’র ভাব অন্তঃসলিলা গঙ্গার মত ‘আনন্দমঠে’র স্রষ্টাকে আদি যৌবন হইতেই অনুপ্রাণিত করিয়াছিল, যদিও এই ভাব তাঁহার লেখনীমুখে প্রকাশ পাইতে অনেক বৎসর বিলম্ব ঘটে। তাই, তিনি প্রথম হইতেই বাঙ্গলার ইতিহাস খুঁজিতে লাগিলেন, অনেক গ্রন্থ পড়িলেন, কিন্তু ইতিহাস গড়িতে পারিলেন না, কারণ সে সময়ে উহার উপাদানগুলি হাতে পাওয়া যাইত না, তাহার মধ্যে অনেকগুলির অস্তিত্ব, এমন কি নাম পর্য্যন্ত, তখন