পাতা:আনন্দমঠ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩০
আনন্দমঠ

  ব্রহ্মচারী বলিলেন, “শবে মার সকল সন্তান মাকে না বলিয়া ডাকিবে, সেই দিন উনি প্রসন্ন হইবেন।

 মহেন্দ্র সহসা জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার স্ত্রী কন্যা কোথায়?”

 ব্রহ্ম। চল—দেখিবে চল।

 মহে। তাহাদের একবারমাত্র আমি দেখিয়া বিদায় দিব।

 ব্রহ্ম। কেন বিদায় দিবে।

 ম। আমি এই মহামন্ত্র গ্রহণ করিব।

 ব্রহ্ম। কোথায় বিদায় দিবে?

 মহেন্দ্র কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিলেন, “আমার গৃহে কেহ নাই, আমার আর সুনিও নাই। এ মহামারীর সময় আর কোথায় বা স্থান পাইব?”

 ব্রহ্ম। যে পথে এখানে আসিলে, সেই পথে মন্দিরের বাহিরে যাও। মন্দির-দ্বারে তোমার স্ত্রী কন্যাকে দেখিতে পাইবে। কল্যাণী এ পর্যন্ত অভুক্ত। যেখানে তাহারা বসিয়া আছে, সেইখানে ভক্ষ্য সামগ্রী পাইবে। তাহাকে ভোজন করাইয়া তোমার যাহা অভিরুচি, তাহা করিও, এক্ষণে আমাদিগের আর কাহারও সাক্ষাৎ পাইবে না। তোমার মন যদি এইরূপ থাকে, তবে উপযুক্ত সময়ে, তোমাকে দেখা দিব।

 তখন অকস্মাৎ কোন পথে ব্রহ্মচারী অন্তর্হিত হইলেন। মহেন্দ্র পূর্বপ্রদৃষ্ট পথে নির্গমনপূর্বক দেখিলেন, নাটমন্দিরে কল্যাণী কন্যা লইয়া বসিয়া আছে।

 এদিকে সত্যানন্দ অন্য সুরঙ্গ দিয়া অবতরণপূর্বক এক নিভৃত ভূগর্ভক্ষায় নামিলেন। সেখানে জীবানন্দ ও ভবানন্দ বসিয়া টাকা গণিয়া থরে থরে সাজাইতেছে। সেই ঘরে স্থূপে স্কুপে স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, হীরক, প্রবাল, মুক্তা সজ্জিত রহিয়াছে। গত রাত্রে লুঠের টাকা, ইহারা সাজাইয়া রাখিতেছে। সত্যানন্দ সেই কমধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিলেন, “জীবানল। মহেন্দ্র আসিবে। আসিলে সন্তানের বিশেষ উপকার আছে। কেন না, তাহা হইলে উহার পুরুষানুক্রমে সঞ্চিত অর্থশি মার সেবায় অর্পিত হইবে। কিন্তু যত দিন সে কায়মনোবাক্যে মাতৃভক্ত না হয়, তত দিন তাহাকে গ্রহণ করিও না। তোমাদিগের হাতের কাজ সমাপ্ত হইলে তোমরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে উহার অনুসরণ করিও, সময় দেখিলে উহাকে বিষ্ণুমণ্ডপে উপস্থিত করিও। আর সময়ে হউক, অসময়ে হউক, উহাদিগের প্রাণ রক্ষা করিও। কেন না, যেমন দুষ্টের শাসন সন্তানের ধর্ম্ম, শিষ্টের অক্ষাও সেইরূপ ধর্ম্ম।”