পাতা:আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করিনা - প্রবীর ঘোষ.pdf/১০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

যে-প্রজন্ম ধারাবাহিকভাবে তৈরি হয়ে চলেছে, তারা প্রকৃত শিক্ষিত না হয়ে অসাম্যের এই সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার সহায়ক শক্তি হয়ে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ তাদের শিক্ষা, তাদের সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশ ভুল শিখিয়ে এসেছে ‘দেশপ্রেম' সম্পর্কে, 'বিচ্ছিন্নতাবাদ' সম্পর্কে, 'জাতীয়তাবাদ' সম্পর্কে, 'জাতীয় সংহতি' সম্পর্কে, 'মৌলবাদ' সম্পর্কে, 'ধর্মনিরপেক্ষতা' সম্পর্কে, 'গণতন্ত্র' সম্পর্কে, 'মানুষের উপর পরিবেশের প্রভাব' সম্পর্কে (এই বিষয়ে বিস্তৃত জানতে পড়ুন ‘সংস্কৃতি: সংঘর্ষ ও নির্মাণ)।

 টেলিভিশন, রেডিও, সিনেমা, থিয়েটার,গান, নাচ, বৃহৎ পত্র-পত্রিকাগোষ্ঠী ও প্রকাশকরা বিশাল ভাবে আমাদের চিন্তা ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আমরা টেলিভিশনে কতটা মারদাঙ্গা দেখব, কতটা যৌনতা, কতটা ভক্তিরসে আপ্লুত হবো, ধর্মগুরুদের বাণীর দ্বারা কতটা আচ্ছন্ন হবো, কতটা ভাগ্য-নির্ভর হবো, কতটা ঈশ্বর বিশ্বাসী হব, কতটা ভূতে, “আদর্শ-নারীর গুণ–পতিসেবা, পতির পরিবারের সেবা, লজ্জা”—এই ধরনের নীতিবোধ কতটা আমাদের মাথায় ঠাসবো—এ সবই ঠিক করে দিচ্ছে বিভিন্ন ধনকুবের গোষ্ঠি ও রাষ্ট্রশক্তি। আমরা কী ধরনের গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস কবিতা পড়ব—তা ব্যাপকভাবে নির্ধারিত করে দিচ্ছে বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠী ও প্রকাশকরা। প্রচারমাধ্যমগুলোর সংবাদ সরবরাহের ‘নিরপেক্ষ' মোড়কের আড়ালে থাকে একটি একপেশে মূল্যবোধ ও মতাদর্শগত কর্তৃত্বকে সাধারণ মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেবার দৃঢ় প্রচেষ্টা। এই একপেশে মূল্যবোধ কাদের স্বার্থরক্ষায় সহায়ক হবে? অর্থাৎ, কোন শ্রেণীর স্বার্থরক্ষায় সহায়ক হবে? অবশ্যই প্রচারমাধ্যমের মালিক যে শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেন, সেই শ্রেণীর। কারণ প্রচারমাধ্যমগুলোর নীতি মালিকের শ্রেণী চরিত্রের উপর নির্ভর করে।

 প্রচারমাধ্যমগুলোর সাহায্যে ধনকুবেরগোষ্ঠী আমাদের মনে জাগিয়ে তোলে নতুন নতুন উৎপাদিত ভোগ্যবস্তুর প্রতি ক্ষুধা। আমরা কোন ধরনের সিনেমা দেখব, ‘অপরাধ' কতটা বীরত্বের সূচক হিসেবে আমাদের চেতনায় ধরা পড়বে, ধর্ষণে কতটা খুঁজে পাব উত্তেজনার মজা, অশ্লীল নাচে কতটা খুঁজে পাবে আধুনিকতার মুক্ত হাওয়া, দেশপ্রেম সম্পর্কে কতটা ভুল ধারণা গেলানো হবে - সে সবই ঠিক করে কোটিপতি চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সেনসর ক্ষমতার অধিকারী সরকার। এমনই সমাজ সাংস্কৃতিক প্রভাবের ফলশ্রুতি হিসেবেই দলে দলে উঠে আসছে কিশোর অপরাধী, ঠাণ্ডামাথার কিশোর খুনি, ঠাণ্ডামাথার কিশোর ধর্ষক।

 শুভবাবু, এতক্ষণের দেওয়া যুক্তিগুলোর মধ্য দিয়ে নিশ্চয়ই আপনার পূর্ব-মতকে পাল্টাতে সমর্থ হয়েছিল। আপনি যদি সুপরিকল্পিতভাবে ঈশ্বর বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট ব্যক্তি না হন, যুক্তির প্রতি যদি ভালোবাসা থাকে, সুন্দর সমাজ গড়ে ওঠার প্রতি যদি আন্তরিক সহানুভূতি থাকে, তবে নিশ্চয়ই আপনি পাল্টাবেন।

১০৫