পাতা:আরণ্যক - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

করিল। পরে কাটা সুপারি হাতে রাখিয়া দুই হাত একত্র করিয়া আমার সামনে মেলিয়া ধরিয়া সসম্ভ্রমে বলিল- সুপারি লিজিয়ে হুজুর।

 সুপারি ও-ভাবে খাওয়া অভ্যাস না-থাকিলেও ভদ্রতার খাতিরে লইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম- কোথা হতে আসা হচ্ছে, কি কাজ?

 তাহার উত্তরে লোকটি বলিল, তাহার নাম নন্দলাল ওঝা, মৈথিল ব্রাহ্মণ। জঙ্গলের উত্তর-পূর্ব কোণে কাছারি হইতে প্রায় এগার মাইল দূরে সুংঠিয়া-দিয়ারাতে তাহার বাড়ি। বাড়িতে চাষবাস আছে, কিছু সুদের কারবারও আছে-সে আসিয়াছে তার বাড়িতে আগামী পূর্ণিমার দিন আমায় নিমন্ত্রণ করিতে-আমি কি তাহার বাড়িতে দয়া করিয়া পদধূলি দিতে রাজি আছি? এ সৌভাগ্য কি তাহার হইবে?

 এগার মাইল দূরে এই রৌদ্রে নিমন্ত্রণ খাইতে যাইবার লোভ আমার ছিল না- কিন্তু নন্দলাল ওঝা নিতান্ত পীড়াপীড়ি করাতে অগত্যা রাজি হইলাম- তা ছাড়া এদেশের গৃহস্থসংসার সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিবার লোভও সংবরণ করিতে পারিলাম না। পূর্ণিমার দিন দুপুরের পরে দীর্ঘ কাশের জঙ্গলের মধ্যে দিয়া কাহাদের একটি হাতি আসিতেছে দেখা গেল। হাতি কাছারিতে আসিলে মাহুতের মুখে শুনিলাম হাতিটি নন্দলাল ওঝার নিজের- আমাকে লইয়া যাইতে পাঠাইয়া দিয়াছে। হাতি পাঠাইবার আবশ্যক ছিল না- কারণ আমার নিজের ঘোড়ায় অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে পৌঁছিতে পারিতাম।

 যাহাই হউক, হাতিতে চড়িয়াই নন্দলালের বাড়িতে রওনা হইলাম। সবুজ বনশীর্ষ আমার পায়ের তলায়, আকাশ যেন আমার মাথায় ঠেকিয়াছে- দূর, দূর-দিগন্তের নীল শৈলমালার রেখা বনভূমিতে ঘিরিয়া যেন মায়ালোক রচনা করিয়াছে- আমি সে-মায়ালোকের অধিবাসী- বহু দূর স্বর্গের দেবতা। কত মেঘের তলায় তলায় পৃথিবীর কত শ্যামল বনভূমির উপরকার নীল বায়ুমণ্ডল ভেদ করিয়া যেন আমার অদৃশ্য যাতায়াত।