দূরে একটা মহা বন, সেখানে বসন্ত-বাউরি ‘বউ-কথা-কও’ ব’লে থেকে থেকে ডাক দেয়; কাছে পাহাড়তলির আবাদের পশ্চিমে, ঢালু মাঠের ধারে, পুরোনো গোলাবাড়ির গায়ে মাচার উপর কুঞ্জলতার বেড়া-দেওয়া কোঠাঘর; সেখানে একটা ঘড়ি বাজবার আগে পাপিয়ার মতো ‘পিয়া পিউ’ শব্দ করে। যার বাড়ি তার পাখির বাতিক; পোষা পাখি, বুনো পাখি, এই গোলাবাড়ির আর কোঠাবাড়ির ফাঁকে ফাঁকে কত যে আছে ঠিক নেই, কেউ দরজা-ভাঙা খাঁচায়, কেউ ছেড়া ঝুড়িতে, চালের খড়ে, দেয়ালের ফাটলে বাসা বেঁধে সুখে আছে। ও-পাড়ার ডালকুত্তো তন্মা মাঝে মাঝে মুরগির ছানা চুরি করতে এদিকে আসে, কিন্তু পাখিদের বন্ধু পাহাড়ী কুত্তানি জিম্মার সামনে এগোয়, তার এমন সাহস নেই। বাড়ি যার, সে যখন বাইরে গেল, পাহারা দিতে রইল জিন্মা, আর রইল মোরগ-ফুল-মাথায়-গোঁজা কুঁকড়ো— সে এমন কুঁকড়ো যে সবার আগে চোখ খোলে, সবার শেষে ঘুমে ঢোলে।
এই কুঁকড়োর চার রঙের চার বউ। সাদি, মেমসাহেবের মতো গোলাপী ফিতে মাথায় বেঁধে সাদা ঘাগর প’রে ঘুর-যুর করছেন; কালি, চোখে কাজল আর নীলাম্বরী শাড়ি-পরা মাথায় সোনালী মোড়া বেনে খোঁপা, যেন কালতে ঠাকরুন; সুরকি, তিনি ঠোঁটে আলতা দিয়ে, গোলাপী শাড়ি প’রে যেন কনে বউটি; আর খাকি, তিনি ধূপছায়া রঙের সায়া জড়িয়ে বসে রয়েছেন, যেন একটি আয়া।
বেলা পড়ে আসছে, গোলাবাড়ির উঠোনে বিকেলের রোদ এসেছে। সফেদি, সিয়াঈ, সুরকি, খাকি, গুলবাহারি সব মুরগি মিলে জটলা করছে। বাচ্ছারা এক দিকে একটা কেঁচো। নিয়ে টানাটানি মারামারি চেঁচামেচি বাধিয়ে দিয়েছে; ঘরের মধ্যে ঘড়ি সাড়া দিলে “পিয়া পিউ।” সফেদি বলে উঠল, “ওই পাপিয়া ডাকল।” খাকি তাড়াতাড়ি ছুটে এসে বললে, “পাপিয়া লো কোন্ পাপিয়া? বনের না ঘরের? ঘড়ির ভিতরে যার বাসা, সে কি ডাক দিলে।” সফেদি তখন ধান খুঁটে খুঁটে গালে দিচ্ছিল; এবার খুব দূর থেকে শব্দ এল, “পিউ পিউ।” সফেদি বললে, “এ যেন বনেরই বোধ হচ্ছে। শুনছিস, কত দূর থেকে ডাক দিয়ে গেল।” ঘড়ির মধ্যে থেকে যে ‘পিয়া’ ব’লে থেকে থেকে দিনে রাতে অনেকবার ডাক দেয়